অমিত কুমার সাহু
আবর্তনের ঘূর্ণিপাকে প্রতি বছর, ক্যালেন্ডারের পাতায় কিছু কিছু দিনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম l সেরকম একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন হলো ৮ মে -- আন্তর্জাতিক রেড ক্রস দিবস l ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের ৮ মে থেকে পালিত হয়ে আসছে আন্তর্জাতিক রেড ক্রস দিবস বা বিশ্ব রেড ক্রস দিবস l
২০২৫ সালে বিশ্ব রেড ক্রস দিবসের থিম মানবিকতা বাঁচিয়ে রাখা । এই থিমের মূল বার্তা হল, মানুষের কষ্ট লাঘব করতে এবং তাদের সম্মান রক্ষা করতে যারা নিজেদের সময় ও জীবন উৎসর্গ করেন, তাদের সম্মান জানানোর পাশাপাশি তাদের জীবন রক্ষাকারী কাজের গুরুত্ব তুলে ধরা। এই স্লোগানটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, অভূতপূর্ব সঙ্কট ও ক্ষতির সময়ে মানবিক কর্মীদের দৈনন্দিন বিপদ ও তাদের কাজকে সম্মান ও সুরক্ষিত করা আমাদের সকলের দায়িত্ব।
এই প্রসঙ্গে রেড ক্রস সৃষ্টির ইতিহাসটি জানা খুবই দরকার l রেড ক্রস হলো একটি আন্তর্জাতিক সেবামূলক মানবতাবাদী অরাজনৈতিক সংস্থা l এই রেড ক্রসের প্রতিষ্ঠাতা হলেন জিন হেনরি ডুনান্ট (Jean Henri Dunant)l
১৮২৮ খ্রিস্টাব্দের ৮ মে সুইজারল্যান্ডের জেনিভা শহরে জিন হেনরি ডুনান্ট (Jean Henri Dunant) জন্মগ্রহণ করেন l পড়াশুনা শেষ করার পরে ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দে আলজেরিয়ার একটি সরকারী সাহায্যপ্রাপ্ত কোম্পানীর হিসাবরক্ষক হিসাবে নিযুক্ত হন, পরে ব্যবসায়িক পেশায় যুক্ত হন ও প্রতিষ্ঠা লাভ করেন l
🍂
ব্যবসায়িক কাজে যাওয়ার সূত্রে সালফেরিনোতে এক ভয়াবহ যুদ্ধ প্রত্যক্ষ করেন l প্রায় ১৫ ঘন্টা ধরে চলা এই যুদ্ধে চল্লিশ হাজারেরও বেশি সৈন্য আহত হয়েছিলেন l মানবতার প্রতীক জিন হেনরি ডুনান্ট আশেপাশের গ্রাম থেকে বহু স্বেচ্ছাসেবককে নিয়ে তিনদিন ধরে বিরামহীন বিনিদ্র নয়নে আহত সৈনিকদের সেবা শুশ্রূষা ও চিকিৎসা উপকরণ দিয়ে সুস্থ করে তোলেন l জেনেভাতে ফিরে গিয়ে স্মৃতিপটে গাঁথা ভয়াবহ যুদ্ধের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে লিখলেন ''A Memory of Salferino'' নামে একটি অনন্য স্মৃতিগাথা, যা বহু দেশে পরে প্রচারিত হয় l যার ফলে, সে সময় আহত সামরিক ব্যক্তিদের চিকিৎসা সহায়তা দানের ধারণা বহুদেশের শাসক ও বুদ্ধিজীবী মহলের কাছে গ্রহণযোগ্য ও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে l জেনেভার বিশিষ্ট আইনজীবী সিটি সোসাইটি অফ পাবলিক ওয়েলফেয়ার এর সভাপতি গ্যুস্তাভ মোয়ানিয়ে আহত সৈনিকদের অভিজ্ঞতা হেনরি ডুনান্টের কাছ থেকে পেয়ে খুবই উৎসাহিত হলেন l অতঃপর সেই ধারণাকে কাজে লাগিয়ে একটি অরাজনৈতিক আন্তর্জাতিক সেবামূলক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার কথা ভাবলেন l ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দের ২৬ - ২৯ অক্টোবর সুইডেনের জেনেভাতে ১৬ টি দেশের প্রতিনিধিদের নিয়ে সহমতের ভিত্তিতে গড়ে ওঠে রেড ক্রস l ১৮৬৩ সালে অঁরি দ্যুনঁ এবং গ্যুস্তাভ মোয়ানিয়ে কর্তৃক সুইজারল্যান্ডের জেনেভাতে রেড ক্রসের প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দের ২২ অগাস্ট প্রথম জেনেভা কনভেনশনে ১২ টি দেশের প্রতিনিধিদের স্বাক্ষর সম্বলিত সনদের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক রেড ক্রসর প্রতিষ্ঠা l রেড ক্রসের ইন্টারন্যাশনাল কমিটি (আই সি আর সি) একটি মানবিক সংস্থা যা সুইজারল্যান্ডের জেনেভাতে অবস্থিত l
ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব রেড ক্রস অ্যান্ড রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটিজ (আই এফ আর সি) ১৯১৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল l
রেড ক্রসের প্রতীক হলো সাদা রঙের উপর রেড ক্রস চিহ্ন l এই প্রতীক ভুলবশত অনেকে ব্যবহার করেন, যা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ l তাই এই প্রতীক ও ফ্ল্যাগের ব্যবহার ও মর্যাদা দান করা প্রতিটি দেশের প্রতিটি নাগরিকের নৈতিক দায়িত্ব ও কর্তব্য l
বর্তমানে ১৯২ টিরও বেশি দেশে রেড ক্রশ বিদ্যমান I মানবতার সেবার জন্য প্রায় ১৪ মিলিয়ন স্বেচ্ছাসেবককে রেড ক্রস একত্রিত করেছে । এই রেড ক্রসগুলো মূলত ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অফ রেড ক্রস অ্যান্ড রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটিজ (IFRC)-এর মাধ্যমে সমন্বিত।
যুদ্ধে আহত সৈনিকদের চিকিৎসা সেবার পাশাপাশি স্বাস্থ্য সেবা প্রদান , আপদকালীন কাজে, বিপদে , দুর্ভিক্ষে , বন্যা-খরা, দাঙ্গা , দুর্ঘটনা , রক্তদান , দুঃস্থদের সহায়তা সহ বহুবিধ সমাজসেবা মূলক কাজ পরিচালনা করে আন্তর্জাতিক রেড ক্রস l
রেড ক্রস এবং রেড ক্রিসেন্ট আন্দোলনের মৌলিক ৭ টি নীতি হলো ---
১۔ মানবতা (Humanity)
২. ন্যায়পরায়ণতা (Impartiality)
৩. নিরপেক্ষতা (Neutrality )
৪. স্বাধীনতা (Independance)
৫. স্বেচ্ছায় কাজকর্ম (Voluntary Service)
৬. একতা (Unity)
৭. বিশ্বজনীনতা (Universality)।
ভারতীয় রেড ক্রস সোসাইটি (IRCS): ১৯২০ সালের মার্চ মাসে, স্যার ক্লড হিল কর্তৃক ভারতীয় আইন পরিষদে একটি বিল পেশ করা হয়েছিল, যেখানে ব্রিটিশ রেড ক্রস থেকে স্বাধীন ভারতীয় রেড ক্রস সোসাইটি গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছিল।
১৯২০ খ্রিস্টাব্দে ভারতের পার্লামেন্টে Act. XV of 1920 এ ভারতীয় রেড ক্রস সোসাইটি (IRCS) গঠনের সংস্থান করা হয় l স্যার ম্যালকলম হ্যালি (Sir Malcolm Haliey) কে চেয়ারম্যান করে ৫০ জন মনোনীত সদস্য নিয়ে ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের ৭ জুন গঠিত হয় ভারতীয় রেড ক্রস সোসাইটি l
ভারতীয় রেড ক্রস সোসাইটির হেড অফিস হলো দিল্লি, যার প্রেসিডেন্ট হলেন সম্মাননীয় রাষ্ট্রপতি l সেইরূপ ভারতের প্রায় প্রতিটি রাজ্যে রেড ক্রসের রাজ্য শাখা রয়েছে, যার প্রেসিডেন্ট হলেন রাজ্যপাল l তেমনি জেলা , মহকুমা ও ব্লক শাখাও রয়েছে l ভারতীয় রেড ক্রস সোসাইটির সারা দেশে ১২০০ টিরও বেশি শাখা রয়েছে l
ইন্টারন্যাশনাল রেড ক্রসের কাজগুলির পাশাপাশি যুদ্ধে আহত সেনা কর্মীদের সেবা ও অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মী ও পরিবারকে সহায়তা দান , ফাস্টএইড, প্রাকৃতিক বিপর্যয়, আপদকালীন সহায়তা , প্রসূতি মায়েদের ও শিশুদের সেবামূলক সহায়তা দান ,অ্যাম্বুলেন্স পরিষেবা, হাসপাতাল পরিষেবা, ব্লাড ব্যাংক, এইচআইভি/এইডস প্রোগ্রাম, প্রতিবন্ধী সেনাদের জন্য আবাসস্থল, বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, ট্রেনিং কার্যক্রম, মাতৃত্ব, শিশু ও পরিবার কল্যাণ, নার্সিং, জুনিয়র রেড ক্রস কার্যক্রম, সংক্রামক ও সংক্রামক রোগের প্রতিরোধ ইত্যাদি পরিষেবা ভারতীয় রেড ক্রসের পক্ষ থেকে দেওয়া হচ্ছে।
এছাড়া অপরাধমূলক কাজে যুক্ত বা বৈধ কাগজপত্র না থাকা আটক বিদেশী কয়েদীদের উৎকণ্ঠাপীড়িত পরিবারের কাছে সন্দেশ দেওয়ার জন্যে ফ্যামিলি নিউজ সার্ভিস (FNS) পরিষেবা দেওয়া হয়। যাতে আমি নিজেও ২০২১-২২ সাল পর্যন্ত যুক্ত থেকে মেদিনীপুর কারেকশনাল হোমে কাজ করেছি l
ইন্টারন্যাশনাল কমিটি অফ রেড ক্রস (ICRC) ১৯১৭, ১৯৪৪, ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দে তিনবার শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেছে l
১৯০১ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার জিন হেনরি ডুনান্ট (Jean Henri Dunant)এবং ফ্রেডরিক প্যাসি (Frederic Passy)-কে যৌথভাবে দেওয়া হয়েছিল। জিন হেনরি ডুনান্ট ছিলেন রেড ক্রস আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা এবং জেনেভা কনভেনশন-এর সূচনাকার।
তাই মানবতার সেবায় আত্মনিয়োগের বার্তা প্রচারে রেড ক্রস দিবস পালনের আন্তর্জাতিক গুরুত্ব অপরিসীম l
কৃতজ্ঞতা : ছবি ও কিছু তথ্য যাচাই করে নেওয়ার জন্যে গুগল ও ইন্টার নেটের কাছে কৃতজ্ঞাতা স্বীকার করছি l
লেখক পরিচিতি : লেখক একজন রেড ক্রস সোসাইটির আজীবন সদস্য l বর্তমানে মেদিনীপুর শহরের স্থায়ী বাসিন্দা , পেশায় শিক্ষক , নেশায় লেখালেখি আর সমাজসেবায় একাধিক সামাজিক ও মানবিক সংস্থার নেতৃত্বদানকারী বরিষ্ঠ সংগঠক l তাঁর লেখা জনপ্রিয় বইগুলি হলো : আমার জেলা মেদিনীপুর , MASTER OF GEOMETRY , কুইজে বিদ্যাসাগর(যুগ্ম), কুইজে নেতাজি , নেতাজি ও মেদিনীপুর (সম্পাদিত)।
0 Comments