জ্বলদর্চি

দেবর্ষি নারদের সাক্ষাৎকার

দেব-দেবীর মাহাত্ম্য প্রচার বিষয়ে দেবর্ষি নারদের একটি সাক্ষাৎকার

 
সূ র্য কা ন্ত  মা হা তো

মধ্যযুগে দেবী মনসা, চন্ডী এবং ধর্মের দেবতাদের ব্যাপক মাহাত্ম্য প্রচারের জন্য মঙ্গল কাব্যগুলো বিরাট অবদান রেখেছিল। দেবদেবীদের মাহাত্ম্য প্রচারও হয়েছিল প্রবল। এরপর এল 2020 সালের 5ই আগস্ট। রামায়ণের সোনালী চাকচিক্য আধুনিকতার জৌলুসে যখন প্রায় একরকম ঝলসেই যাচ্ছিল, ঠিক তখনই তার  স্বকীয়  ভঙ্গিমায় আর দ্যুতিময় জৌলুসে ফের প্রত্যাবর্তন। একান্তই ক্ষুদ্র আমি। তাই এত প্রশ্নমালা এসে ভিড় করেছে যে, তার ভারে ও চাপে একরকম দমবন্ধ হয়ে আসছিল। অবশেষে এই অবরুদ্ধ প্রশ্নমালা থেকে সাময়িক নিষ্কৃতি লাভের আশায় যখন মরিয়া হয়ে উঠেছিলাম, তখনই গতরাত্রে ঘুমের মধ্যে দেবর্ষি নারদকে পেলাম। জানি উনিই আমার রক্ষাকর্তা হবেন এ বিষয়ে-------

আমি : প্রভু, আপনি ত্রিকাল দর্শন করেছেন। পর্বতসম অভিজ্ঞতার আধার আপনি। সমস্ত ঘটনা আপনার নখ দর্পণে। এ বিশ্ব ব্রহ্মান্ডকে আপনি হাতের তালুর থেকেও বেশি চেনেন। আপনি...

দেবর্ষি নারদ : চুপকর ব্যাটা। নারায়ণ! নারায়ণ! তোদের এই মর্ত্যবাসীদের ঐ একটাই দোষ। আর সেটা কি জানিস?

আমি : কী, প্রভু?

দেবর্ষি : এই তোরা কারও নিকট কোনও কিছু পাওয়ার ও জানার জন্য এতটাই অধৈর্য আর ব্যগ্র হয়ে উঠিস যে, তার জন্য তাকে বারবার  তেলমারা, তোষামোদ করা, এবং তার সম্পর্কে বাড়িয়ে বাড়িয়ে প্রশংসার এমন এমন সব ভাষণ দিস যে, আমরা বেচারা লজ্জায় একেবারে বিষম খেয়ে পড়ি।

আমি : কী করব প্রভু! বিপদের মধ্যে আছি বলেই না, আপনাদের স্মরণাপন্ন?

দেবর্ষি: বল, কী প্রশ্ন আছে তোর?

আমি: বেশি গৌরচন্দ্রিকায় যাচ্ছি না। আপনার আবার সময়েরও তো মূল্য আছে। তাই সরাসরিই বলি--- গত 5ই আগস্ট অযোধ্যায় রাম মন্দিরের ভূমিপূজন সম্পন্ন হল। ফের রাময়ণের বর্ণাঢ্য মাহাত্ম্য সম্প্রচারিত হল গোটা দেশ জুড়ে।

দেবর্ষি: নারায়ণ! নারায়ণ! তোর প্রশ্নটা শুনি।

আমি: আমাদের কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর "ভাষা ও ছন্দ" কবিতায় বাল্মীকি আর আপনার মধ্যে রামায়ণ রচনা বিষয়ে যে আলোচনা তা নিয়ে বলেছেন ---
                বাল্মীকি: "জানি আমি জানি তাঁরে, শুনেছি তাঁহার কীর্তিকথা"---/কহিলা বাল্মীকি,"তবু, নাহি জানি সমগ্র বারতা,/ সকল ঘটনা তাঁর--- ইতিবৃত্ত রচিব কেমনে।/পাছে সত্যভ্রষ্ট হই, এই ভয় জাগে মোর মনে।"'
          তখন--- 'নারদ কহিলা হাসি,"সেই সত্য যে রচিবে তুমি,/ঘটে যা তা সব সত্য নহে। কবি, তব মনোভূমি/ রামের জনমস্থান, অযোধ্যার চেয়ে সত্য জেনো।"'
-----সুতরাং জন্মলগ্ন থেকেই তো আপনি এর গুরুত্ব ও মাহাত্ম্য প্রচার করে চলেছেন। ফের কেন?

দেবর্ষি: ওরে তোরা মূর্খ বলে।

আমি: মানে! কি বলছেন আপনি? জানেন, আমরাই আপনাদের মাহাত্ম্য কীর্তন করে থাকি বলে আপনাদের স্বর্গে স্থান হয়েছে। আপনাদের সেবা আর পূজার্চনাতেই আমাদের জীবনের অর্ধেকটা সময় চলে যায়। তারপরেও বলছেন আমরা মূর্খ! এটা সত্যিই নিন্দনীয় প্রভু।

দেবর্ষি: নারায়ণ! নারায়ণ! ওহে মর্ত্যবাসী মিথ্যা কথা, কটু ভাষণ, ছল চাতুরী তোদের রক্তে রক্তে শিরায় শিরায়। তাই এমন একটা ডাহা মিথ্যা কথা বলতে পারলি? একটু গভীরে গিয়ে ভেবে দ্যাখ, এসব কিছু সত্যই  আমাদের জন্য করিস, নাকি শুধুই স্বার্থপরের মতো নিজেদের জন্য করিস। আসলে তোদের জীবন যাত্রা অত্যন্ত জটিল। তোদের প্রতিটি পদক্ষেপ পড়ে অনিশ্চয়তা আর বিপদের মধ্যে। তাইতো আমাদের এত কদর। আমাদের প্রয়োজনে নয়, বরং তোদের নিজেদের স্বার্থরক্ষায় বা প্রয়োজনে আমাদের মাহাত্ম্য কথা প্রচার করিস।

 আমি: ক্ষমা করবেন প্রভু, আমিও সত্য কথা বলতে ভয় পাই না। এই মর্ত্য লোকে আপনারা থাকেন না, কেবল শাপভ্রষ্ট হলেই স্বর্গচ্যুত হয়ে এখানে শাস্তি ভোগ করতে আসেন। আর আমাদেরকে সিঁড়ি বানিয়ে ফের স্বর্গে চলে যান। দেবী মনসা তো বলেই দিয়েছেন, মানুষের পূজা ব্যতীত দেবত্ব লাভ সম্ভব নয়। মঙ্গলকাব্যের দেব দেবী ও নায়ক নায়িকার স্বর্গ যাত্রা তো এভাবেই? তার বেলা ? এখন কি বলবেন, আপনাদের স্বার্থ এতে জড়িয়ে নেই?

দেবর্ষি: না, এমন স্বার্থ দেব দেবীদের মধ্যে কোনও দিন  ছিল না। এমন ভাবনা তোদের মর্ত্যবাসীদের মনগড়া। এটা তোদের পারস্পরিক প্রভুত্ব অর্জনের একটা মিথ্যা প্রয়াস মাত্র। দেবলোক দর্শন তো তোদের কোনোও দিন হয়নি, সে তো তোদের কাছে চিন্তাতীত ব্যাপার। তোদের কাছে কল্পনার বৃন্দাবন। তাই এইসব কাহিনী তৈরি করিস। বাদ দে এসব, এখন তোর প্রশ্নটা বল।

আমি: প্রভু, দেবদেবীদের এই মাহাত্ম্য প্রচারের কৌশলটা নিয়ে আমার কিছু প্রশ্ন আছে। পূজা প্রচারের জন্য দেব দেবীরা চাঁদ সদাগর, বণিক ধনপতি, রাজা হরিশ্চন্দ্র, ব্যাধ কালকেতু বা লাউসেন কেই কেন বেছে বেছে নির্বাচন করলেন?যদি ধরেই নেওয়া যায় যে, বণিক বা ব্যবসায়ী, কিংবা রাজাদের দিয়েই তাঁরা আত্মসন্তুষ্টি লাভ করেন। তাহলে এমনটা কেন? যদি তাই হয়, তবে কালকেতু বা লাউসেনের ক্ষেত্রেই বা ব্যতিক্রম কেন?

দেবর্ষি: হা-হা-হা! তোদের রাম মন্দিরের শিলান্যাস এর ভুমিপূজনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকেই ডাকলি কেন? আরও তো অনেকে ছিল তাদের ডাকলি না কেন? কারণ স্টারডম। এ তো সহজ জিনিস। জনপ্রিয়তা আর প্রভাবই তো এর একমাত্র মাপকাঠি। বণিক চাঁদ সদাগর, ধনপতি, রাজা হরিশ্চন্দ্র এদের প্রভাব প্রতিপত্তি একবার ভেবে দ্যাখ, এই স্টারডম আছে বলেই তো, তা ছাড়া তো সব ফাঁকা, শূন্য। এটাকেই তাই হাতিয়ার করা হয়েছে। এতে আর দোষ কোথায়। এরা ছাড়া অন্য কারও সেটা থাকলে তাদের কেউ ব্যবহার করা হতো। আর যদি কালকেতু আর লাউসেনের কথা বলিস, তাহলে তোকে স্খলন আর উত্থানের তত্ত্ব জানতে হবে। দৈবের স্মরণাপন্ন তোরা কখন হয়ে পড়িস? এক, সেই অবস্থা থেকে স্খলিত, পতিত,বা বিচ্যুত হয়ে পড়ার ভয়ে, নয়তো সেই অবস্থা থেকে উত্থান বা উত্তরণের কামনায়। চাঁদ সদাগর, ধনপতি, হরিশ্চন্দ্র এদের কাহিনী ছিল স্খলন বা পতনের। অন্যদিকে কালকেতু আর লাউসেনের কাহিনী ছিল উত্থানের। 

আমি: প্রভু, এমন দেবত্বের মহিমা কি কেবল স্বর্গের দেবদেবীদেরই একমাত্র প্রাপ্য? মর্ত্যের মানুষরা কি পেতে পারে না?

মহর্ষি: কেন নয়! এই তো তোদের মাদার টেরেসা, উনিই তো দেবত্বে আরোপিত হয়েছেন। পোপ তো তাকে সেন্টহুড উপাধি দিয়ে সে স্বীকৃতি পর্যন্ত দিয়েছেন। 
                                     সব কিছুই ঠিক আছে, তবে তোদের কি দোষ জানিস, মধ্যযুগে এসব নিয়ে বিরোধিতা বা প্রশ্ন তোলার মতো তোদের কেউ ছিল না। আজ যেমন যুক্তিবাদীরা এটা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। শুধু কি তাই? রামমন্দিরের ভূমিপূজাকে কেন্দ্র করে সংবিধান সংকট নিয়ে প্রশ্ন তুলছিস, ধর্ম নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছিস, রাষ্ট্র প্রধানের উপস্থিতি নিয়ে বিতর্ক তৈরি করছিস। এত প্রশ্ন করলে মাহাত্ম্য প্রচার হয় কি করে?

আমি: কিন্তু প্রভু, প্রশ্ন তো উঠবেই। বাস্তব তো সর্বকালেই স্বীকৃত। প্রশ্ন তো কেবল অলৌকিকতাকে ঘিরেই। কি দেবতা আর কি মানুষ!

দেবর্ষি: আর একটা কথা বলি শোন, এই যে স্টারডম বা প্রভাবশালী ব্যক্তিদের দিয়ে মাহাত্ম্য প্রচার, এতে তো শুধু দেবদেবীদের মাহাত্ম্যই  প্রচারিত হয় না, সেই সঙ্গে তোদের সেই প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বেরও তো ব্যাপকভাবে  মাহাত্ম্য  প্রচারিত হয়। এটা তো আর অস্বীকার করতে পারবি না। ধনপতি, চাঁদ সদাগর, হরিশ্চন্দ্র এদের ক্ষেত্রেও যেমন সত্য, প্রধানমন্ত্রীর ক্ষেত্রেও তেমন সমান সত্য। 
                               তোদের আধুনিক চাকচিক্য জীবনযাত্রায়, চন্দন নগরের আলোক ছটায়, বর্ণময় জীবন যাপনের দ্যুতিতে, অশ্লীলতার বাহারিতে রামকথা একরকম ঝাপসা হতে শুরু করেছিল। ক্ষীয়মাণ রামের সেই মাহাত্ম্য কথায় একবিংশ শতাব্দীতে ফের একবার বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে জ্বলে উঠল। আর এটা ঘটল তোদের প্রধানমন্ত্রীর উজ্জ্বল উপস্থিতির কৃপাধন্যে। তবে এর পিছনে আর কোনও উদ্দেশ্য আছে কিনা, এটা নিয়ে আর প্রশ্ন তুলিস না। এবার ঘুমাবি যা।

আমি: প্রভু!প্রভু! যাবেন না! প্লীজ! এভাবে কি চিরকাল ঘুমিয়েই থাকব? এবারের "দেশ" পত্রিকায় কি লেখা হয়েছে, তা অন্তত শুনে যান! 

না উনি আর শুনলেন না। তিরোধান হয়ে গেলেন। পরবর্তী কালে আর কবে উদয় হবেন সেই প্রত্যাশা নিয়েই ঘুমের দেশে রামরাজ্য থেকে পুষ্পক রথে চড়ে মাঠ, ঘাট, খাল, নদী, কখনও অমরাবতী, কখনও হরিশচন্দ্রের রাজ্যে, কখনও বা সপ্ত মধুকর ডিঙায় চড়ে কেবলই ঘুরে বেড়াতে লাগলাম। মায়ের ডাক আর বৃষ্টির শব্দে ঘুম ভাঙতেই দেখি আকাশ জুড়ে কেবল কালো মেঘের ঘনঘটা। বাতাসের শনশন শব্দে, আর বৃষ্টির ঝিরঝির সুরের মূর্ছনায় পুলকিত মনে  সকাল সকাল উঠে পড়লাম।

 বি:দ্রঃ:-পুরোটাই কাল্পনিক,কাউকে আঘাত দেওয়ার উদ্দেশ্যে রচিত হয়নি।

Post a Comment

0 Comments