হারিয়ে যাওয়া ঝিঁঝি পোকা || পর্ব-৯
সু দ র্শ ন ন ন্দী
আমাদের ছোটো গাঁয়ে ছোটো ছোটো ঘর
থাকি সেথা সবে মিলে কেহ নাহি পর।
পাড়ার সকল ছেলে মোরা ভাই ভাই
একসাথে খেলি আর পাঠশালে যাই।
বড় হচ্ছি শহরে। নামে শহর হলেও গ্রামীণতা তার অঙ্গেই। খড়ের চালা ছেড়ে টিনের চালায় এলাম। নাতিপুতিরা যাতে খাঁটি দুধ পায় সেজন্য ঠাকুমা একটি গাই পাঠিয়েছিলেন গ্রাম থেকে। গোয়ালের ব্যবস্থা হল ঘরের পাশে। শহরে এসেও পেলাম গ্রামের স্বাদও। কারণ এই শহরের প্রান্তেও বন জঙ্গল। সাত সাতটি বড় বাঁধ। যমুনা বাঁধ ছিল ঘরের কাছেই। ছিল বেল কয়েত খেজুর আম জাম কুল কাঁঠাল সব গাছই। বরং ঘুড়ি ওড়ানো, ফুটবল খেলা নতুন আনন্দের সাথী যা গ্রামে ছিল না। গ্রামের বাঁধের মতোই যমুনা বাঁধে ঘণ্টা তিন স্নান করা তথা খেলা ছিল বাঁধা, বিশেষ করে গরমের ছুটিতে। আবার মাঝে মাঝেই ছুটতাম গ্রামে। ফলে গ্রাম ছেড়ে আসার দুঃখটা অতটা তীব্র ছিল না। তবুও শহরে বেশি দিন থাকলে মন চলে যেত গ্রামে। গ্রাম থেকে আত্মীয় স্বজনের আসা যাওয়া লেগেই থাকত। ফোন ছিল না। তাই সকাল থেকে বিকাল কেউ না কেউ শহরে বিভিন্ন কাজে এসে আমাদের ঘর ঘুরে যেত। ফলে রান্নাঘরে মাকে একপ্রকার সারাদিনই হাড়ি হাতে বসে থাকতে হত। এতো কষ্টেও অভিযোগ শুনিনি কখনো। ভর্তি হলাম বিষ্ণুপুরের গোপালগঞ্জে বুড়াশিবতলা ইশকুলে। স্কুল ব্যাগ ছিল না। ত্রিভুজ আকারের কাপড়ের টুকরোয় থাকত লেজের মতো দড়ি। বই মুড়ে বগলে করে নিয়ে যেতাম। তখন দড়ি দেওয়া প্যান্টের চল। বলা হত সরকা দেওয়া প্যান্ট। সর সর করে খোলা যেত বলে নামকরণ কিনা জানি না। তবে সেসময় পছন্দ অপছন্দ বলে কিছু ছিল না। বিষ্ণুপুরে বাবা আবদুল কাকার দোকানে মাপ দিতে পাঠিয়ে দিতেন। তারপর ছিট কিনে দিয়ে আসতেন। চিন্তায় থাকতাম জামাটা কতটা ঢিলে করবে বা প্যান্টটা দড়ি থেকে প্রমোশন পেয়ে বোতাম পাবে কিনা। করালি বাবু ছিলেন আমাদের হেডমাস্টার মশায়। চতুর্থ শ্রেণির বৃত্তি পরীক্ষা । আমাদের থেকে তিনি চিন্তিত ছেলেরা রেজাল্ট কেমন করবে। আলাদা করে ক্লাস নিতেন তিনি।
সংসারে অভাব ছিল। আনন্দের বিন্দুমাত্র অভাব ছিল না। বাড়িতে ভাইবোনেরা এক সাথে মানুষ হচ্ছি। গ্রাম থেকে আসা কাকা জ্যাঠা, মামা মাসি, ঠাকুমা, দিদিমা দাদু নিয়ে গমগম করত। ছিল পাড়া কালচার। সবাই সবাইকে চিনত। এখন যেমন ফ্ল্যাট কালচারে কেউ কাউকে চেনে না, ঠিক তার উল্টো। দেশের বাড়ির পুরো গ্রাম বা বিষ্ণুপুরের একটি পাড়া ছিল যেন একটি পরিবার। পাড়ার সকলেই ছিলাম ভাই ভাই।
শহরে এসে থাকতাম ভাড়া বাড়িতে। ছোট্ট টিনের চালার ঘর, বারান্দা আর নামের নাম একটা রান্নাঘর। উপরে এসবেস্টস। বাড়ি ভাড়া কুড়ি টাকা। মনে আছে বাড়িওয়ালা একবার আর তিন টাকা বাড়াতে বলায় বাবা মায়ের চিন্তায় ঘুম ছুটে গিয়েছিল। আসলে গ্রামে ছিলাম একসাথে। সুখ দুঃখ সব ভাগ করে নিত সবাই মিলে। পড়ার তাগিদে, মানুষ হবার তাগিদে শহরে এসে সুখের দেখা না পেলেও দুঃখে পাশে দাঁড়াবার কেউ নেই। একান্ন আর এক পরিবারের মানে তখন যেন অনুধাবন করতে শিখলাম। আবার গ্রামে থাকলে ক্রমবর্ধিষ্ণু সংসারের ফলে জমির উপর চাপ। পেট বাড়ে, জমি বাড়ে না। তাই গ্রাম থেকে শহরে মানুষ আসবে, শহর থেকে যাবে মেট্রো সিটিতে এ যেন সমাজ বিজ্ঞানের নিয়ম মেনেই। আর এভাবে আলগা হতে থাকে নাড়ি থেকে রক্তের সম্পর্ক। ‘আমাদের পরিবার’পরিবর্তিত হয় ‘আমার পরিবার’ দর্শনে। অর্থনীতি যেন কান ধরে সমাজকে বাধ্য করায় নুইতে। থাক সে কথা।
তখন এম বি বি এস ডাক্তার বাদ দিয়ে এল এম এফ (লাইসেনশিয়েট ইন মেডিক্যাল ফ্যাকাল্টি) ডাক্তারদের রাজ ছিল। ডিপ্লোমা ডাক্তার। মোহিনী ডাক্তার ছিলেন আমাদের ঘরোয়া ডাক্তার। হামাল দিস্তায় ওষুধ গুঁড়ো পুরিয়া করে দিতেন আর শিশিতে মিক্সচার। তবে আপদে বিপদে বিষ্ণুপুরের মহকুমা হাসপাতাল ছিল। অগতির গতি।
1 Comments
পড়লাম
ReplyDeleteভালো লাগলো