জ্বলদর্চি

অ্যাঁতেলেকত্যুয়েল বনাম আঁতেল -১১

অলংকরণ- প্রান্তিকা মাইতি  

অ্যাঁতেলেকত্যুয়েল বনাম আঁতেল -১১

স ন্দী প  কা ঞ্জি লা ল

বুদ্ধিজীবী ও ক্রিটিক 

'নোয়াম চমস্কি' একজন অগ্রগণ্য 
 ভাষাতত্ত্ববিদ, দার্শনিক, সামাজিক সমালোচক ও রাজনৈতিক এক্টিভিস্ট। তিনি বলেছেন, "বিশেষজ্ঞ  মানে বুদ্ধিজীবী নয়।" আগের পরিচ্ছেদে বুদ্ধিজীবী সম্বন্ধে একটি ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করেছি। বুদ্ধিজীবীর কাজ হচ্ছে সবসময় কোনো ঘটনাকে নিরপেক্ষ ভাবে বিশ্লেষণ এবং সমালোচনা করা। আর এই সমালোচনা যদি নিছক সমালোচনার জন্য অথবা নিজেকে পন্ডিত জাহির করার জন্য হয়, তবে তার পরিণতি ভয়ংকর হতে বাধ্য। তাই এই পরিচ্ছেদে আমি চেষ্টা করবো সমালোচক বা ক্রিটিক কাকে বলে? 
সমালোচক বা ক্রিটিক জ্ঞানের সম্ভাবনাকে অনুসন্ধান করে। সাধারণ অর্থে ক্রিটিক শব্দটি ব্যবহৃত হয় কোনো যুক্তি, গ্রন্থ বা দর্শনের এক নিরবচ্ছিন্ন সমালোচনা অর্থে। যেখানে সমালোচক এক বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিষয়টি পর্যালোচনা করেন। কারণ কোনো সত্যই নিত্য নয়, মানুষের নিজের কোনও সত্ত্বা নেই, প্রতি ক্ষেত্রে সম্ভাব্য বিকল্প থাকে, মানুষকে বাছতে হয়। কিন্তু এই বেছে নেওয়ার পদ্ধতির কোন স্থায়ী সূত্র নেই। সূত্র থাকুক আর না থাকুক, তবু আমাদের বেছে নিতে হয় এগিয়ে যাওয়ার জন্য বা নিজেদের নতুন নির্মাণের জন্য। যারা এই বাছার দায়িত্বে থাকেন তাদের আমরা ক্রিটিক বলবো। ক্রিটিকরা আবার দার্শনিক ও বুদ্ধিজীবী। 
এই ক্রিটিক শব্দটি ব্যবহৃত হয় কোনো যুক্তি, গ্রন্থ বা দর্শনের নিরবিচ্ছিন্ন সমালোচনা অর্থে। যেখানে সমালোচক একটি বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি  থেকে বিষয়টি পর্যালোচনা করেন। যেটা তিনি সমালোচনা করলেন, কেন করলেন তার ব্যাখ্যাও উপস্থিত করেন। যেমন দেশে কোন একটি আইন পাশ হলো সে আইনটি মানুষের অহিতকর। শুধু অহিতকর বললে তো হবে না। তাকে যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করতে হবে সেটি অনিষ্টকারক। আবার ক্রিটিককে দুভাগে ভাগ করা হয়। তার একটি  অতিবর্তী সমালোচনা। অতিবর্তী সমালোচনা তার নিজস্ব নিয়ম, নিজে তৈরি করে এবং সেই নিয়মগুলিকে 'বাইরে থেকে' সমালোচনার জন্য ব্যবহার করে। অন্তবর্তী সমালোচনা রচনার অন্তর্নিহিত অসংগতিকে সমালোচনা করে রচনার নিজস্ব শর্ত মেনেই। 
ক্রিটিক এর উদ্দেশ্য যা সাধারণভাবে উহ্য বা গোপন থেকে যাবে তাকে স্পষ্ট করে তোলা এবং দিনের আলোয় পাবলিক পরিসরে যাচাই করা। আরো সহজ করে বললে,জ্ঞানের মধ্যে কি মিথ্যা প্রবেশ করছে, জ্ঞান নিজের ব্যবহারের মাত্রা কোথায় ছাড়িয়ে গেছে এবং কোন ক্ষমতার সাথে জ্ঞান সম্পর্কিত। দার্শনিক 'কান্ট'এর মতে ক্রিটিকের মৌলিক দায়িত্ব জ্ঞানকে জানা। যেমন আমার যদি চিকিৎসা শাস্ত্রে জ্ঞান থাকে, তবে ভুল চিকিৎসা হলে আমি তার সমালোচনা করবো। অন্যভাবে বললে, 'কান্ট' এর লক্ষ্য হলো ক্রিটিকের মাধ্যমে জ্ঞানকে জানা। আবার দার্শনিক 'ফুকো' জ্ঞানের সীমানাকে অতিক্রমণ বোঝাল। কিন্তু কেউই শুধুমাত্র সমালোচনার জন্য ক্রিটিক হন না। অর্থাৎ সমালোচনা করব বলেই ক্রিটিক, এরকম কাজ সচরাচর ক্রিটিক করে না। ক্রিটিক তখনই সক্রিয় হয় যখন জ্ঞান ও ক্ষমতার ভারসাম্য নষ্ট হয়। সে প্রশ্ন করতে বাধ্য হয়, আমি এদের দ্বারা, এইসব উদ্দেশ্যের জন্য, এইসব পদ্ধতির সাহায্যে, এদের দ্বারা শাসিত হব কি-না? তাই ক্রিটিকের প্রথম সংজ্ঞা বলা যেতে পারে, বেশি শাসিত না হবার কৌশল। শাসনতন্ত্রের কৌশলকে প্রশ্ন করাই ক্রিটিকের উদ্ভাবনার সংকেত দেয়। বস্তুতঃ ক্রিটিকের আধুনিক ধারণার জন্ম শাসনতন্ত্রকে প্রশ্ন করেই। 
ক্ষমতা কোন বিষয়ের? যে সত্য স্থির করে বা সংজ্ঞা দেয়, ক্রিটিক সেই সত্যকে চ্যালেঞ্জ করে। এককথায়, ক্রিটিক হল এক স্বেচ্ছাচার শাসন বিরোধিতার কৌশল। আবার অনেকে অন্যের নির্দেশ ছাড়া চিন্তাশক্তি ব্যবহার করার সাহস পায় না। তবে তা চিন্তাশক্তির অভাব নয়, নিজের চিন্তা শক্তি প্রয়োগের জন্য সাহসের অভাব। তাই 'কান্ট' এর মন্ত্র হল, নিজের চিন্তা শক্তি ব্যবহার করার সাহস রাখো। 'কান্ট'একে বলেছেন 'আলোকপ্রাপ্তি'।'আলোকপ্রাপ্তি' এর মূলমন্ত্র হল 'জানার স্পর্ধা রাখো', 'জানার জন্য মনোবল ও দুঃসাহস রাখো'। তবে আনুগত্য ও যুক্তির পরিসরকে আলাদা রাখতে হবে। যেমন তুমি তোমার ট্যাক্স বেশি হয়েছে বলে, ট্যাক্স নিয়ে তর্ক বির্তক করো, কিন্তু ট্যাক্স দাও। 'বাধ্য থাকো, তুমি তোমার যুক্তি প্রয়োগ করার যত সুযোগ চাও, পাবে'। 
'কান্ট'এর মতে দুটো জীবন, একটা প্রাইভেট জীবন, অন্যটি পাবলিক জীবন। তাঁর মতে প্রাইভেট জীবনে মানুষ 'মেশিনের নগন্য অংশ' বই কিছু নয়। একজন প্রশাসক বা সমাজের একটি অংশ যারা প্রশাসনের অধীন, তাদের অবস্থান একটা গণ্ডির মধ্যে। যেখানে যুক্তির স্বাধীন ব্যবহার সম্ভব নয়। পাবলিক পরিসর হল, যখন মানুষ যুক্তি প্রয়োগ করছে (মেশিনের নগন্য অংশ নয়) যুক্তি সম্মত মানুষ হিসেবে। মানবতার সদস্য হিসেবে তখন যুক্তির ব্যবহার মুক্ত, স্বাধীন। তখন সে কোনো কর্তৃত্বের অধীন না হয়ে যুক্তি প্রয়োগ করে।'ফুকো' বলেন, তার নিজের মতে ক্রিটিক হল স্বেচ্ছা অ-বশ্যতার এক প্র্যাকটিকাল কৌশল। 
আবার জার্মান দার্শনিক 'হাবেরমাস' এর ক্রিটিক তত্ত্ব সত্য ও নৈতিক যুক্তির এক সর্বজনীন দাবির কথা বলে। তার মতে মানুষের তিনটি আগ্রহ বিভিন্ন অনুসন্ধানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। প্রথম আগ্রহ হল বিজ্ঞান, যা কার্য-কারণ সম্পর্ক প্রস্তুত করে, এবং যার ভিত্তি হল বাখ্যা। দ্বিতীয় আগ্রহ হল মনোবিজ্ঞান যা ভাষ্য প্রস্তুত করে, যার ভিত্তি হল বোধগম্যতা, এবং তৃতীয় আগ্রহ হল ক্রিটিকাল জ্ঞান যা মুক্তি ও পরিনত মনস্কতাকে ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে। 
'হাবেরমাস' আরও বলেন, এই তিন ধরনের জ্ঞান ততক্ষণ সক্রিয় যতক্ষণ অবধি দমন পীড়ন তাকে নিয়ন্ত্রণ না করে। অর্থাৎ যার বিশ্লেষণ হবে আলাপ আলোচনায়। 'ফুকো' বলেন, বাস্তব তা কখনো সম্ভব নয়। এ এক ইউটোপিয়া ছাড়া আর কিছু নয়। তিনি বলেন, ক্ষমতার প্রভাব এমন সর্বব্যাপী, ধোঁয়াটে যে, তা মানব জীবনে প্রবেশ করে মানবিকতার চেহারা পাল্টে দেয়। তাই 'হাবেরমাস' পদ্ধতিতে সত্য কখনো বেরুবে না। কারণ  ক্ষমতা তার বিকৃতসাধন ঘটিয়েছে। ক্রিটিকের ভূমিকা তাই ক্ষমতার প্রকরণের সঙ্গে সংগ্রাম করা। আর এভাবেই ক্রিটিকরা নতুন ইতিহাস তৈরি করে। সেই চিন্তায় ভাবিত সাধারণ মানুষ বলে, না আমরা এভাবে শাসিত হতে চাই না। 
মানুষ এই জগতের নিয়মাবলি জানে।  কোন নিয়মাবলি? যে নিয়মাবলি তার জ্ঞানকে সীমিত করেছে। এই নিয়ম আবার আকাশ থেকে পড়েনি, তা মানুষেরই সৃষ্টি।তাই মানুষ সম্পূর্ণ জ্ঞানের দাবি করে, এই সীমাবদ্ধতার জন্য। মানুষ তাই নিজের তৈরি শৃঙ্খলে আবদ্ধ। মানুষ এই সীমাবদ্ধতাকে স্বীকার করা ও একই সঙ্গে অস্বীকার করার চেষ্টা চালায়। 'ফুকো' একে বলেছে, মানুষ ও তার ডাবল বা যমজ। মানুষ নিজে জ্ঞানের শর্ত, আবার জ্ঞানের বিষয়ও বটে। 
তাই ক্রিটিক হল প্রতিরোধের হাতিয়ার, বিশেষত তাদের কাছে যারা বর্তমান নিয়ে অসন্তুষ্ট। ক্রিটিকের প্রধান দায়িত্ব হল জ্ঞানকে জানা। তার ফলে সে স্থিতাবস্থাকে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারে। তাই ক্রিটিক একধরনের প্র্যাকটিস, অথবা প্র্যাকটিসের টেকনিক। আর এটা উদ্ভুত হয়, এইভাবে শাসিত না হওয়ার ইচ্ছা থেকে।
সাফল্য ও সমালোচনার মধ্যে যোগসূত্র আছে। সমালোচকরাই পারেন আংশিক সফল ব্যক্তিদের আরও সফল হওয়ার পথ দেখাতে। 
এক বাজারে বেগুন চল্লিশ টাকা কিলো বিক্রি হচ্ছিল। সবাই সেই দামে  নিয়ে নিচ্ছিল। একজন প্রতিবাদ করে বলল,কাল ছিল ত্রিশ টাকা আজ চল্লিশ কেন? অনেক সমালোচনার পর জানা গেল,চাহিদার তুলনায় যোগান কম।এই আলোচনার ফলে আসল সত্য বেরিয়ে এলো। বিখ্যাত উপন্যাসিক 'অস্কার ওয়াইল্ড' বলেছিলেন, "যারা প্রত্যেক বস্তুর দাম জানেন কিন্তু প্রকৃত দাম জানেন না তারাই সমালোচক"।প্রকৃত দাম জানেনা বলেই তো,সমালোচকরা সমালোচনা করবেন, যা থেকে বেরিয়ে আসে আসল সত্য।

Post a Comment

0 Comments