হুমায়ূন আহমেদঃ সায়েন্স ফিকশনের ভুবনে || প্রথম পর্ব
প্র শা ন্ত ভৌ মি ক
হুমায়ূন আহমেদের সায়েন্স ফিকশনের মুগ্ধ পাঠক বর্তমান সময়ের জনপ্রিয়তম এবং অন্যতম প্রভাববিস্তারী লেখক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “হুমায়ূন ভালো লেখক, খুবই ভালো লেখার হাত। তাঁর গদ্যটা একটু অন্য রকম। আমার তো ভালোই লাগে। ওঁর যে কয়টা লেখা পড়েছি ভালোই লেগেছে। বিশেষ করে সায়েন্স ফিকশনগুলো খুব ভালো। ও নিজে সায়েন্সের লোক তো। পলিমার সায়েন্সের ওপর তাঁর ডক্টরেট আছে। কাজেই এদিক দিয়ে ওঁর সায়েন্স ফিকশনগুলো খুবই ভালো।”
হুমায়ূন আহমেদ বেশকিছু সায়েন্স ফিকশন রচনা করলেও তাঁর সায়েন্স ফিকশনগুলোতে বিজ্ঞানের কচকচানি থেকেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল মানবিকতা। বাংলাদেশের প্রথম সায়েন্স ফিকশন ‘তোমাদের জন্য ভালবাসা’র লেখক হুমায়ূন আহমেদ বরাবরই নিজেকে রাশিয়ান সায়েন্স ফিকশনের ভক্ত বলে দাবি করেছেন। অনেক জায়গাতেই তিনি বলেছেন, বিজ্ঞান খুবই রহস্যময় একটি ব্যাপার। “ওমেগা পয়েন্ট’ বইয়ের ভূমিকায় লিখেছেন- ‘ওমেগা পয়েন্ট বিষয়টা শুধু জটিল বললে ভুল বলা হবে, বেড়াছেড়া লেগে যাবার মতো জটিল। শেষ পর্যন্ত জটিল চিন্তাগুলি লিখে ফেলতে পেরেছি এটাই বড় কথা। বিজ্ঞানে উদ্ভট বলে কিছু নেই। বিজ্ঞান রূপকথার জগতের চেয়েও অনেক রহস্যময়।’’
তবে সাহিত্যের মূল স্রোত থেকে সায়েন্স ফিকশনকে আলাদা করে দেখতেন সাহিত্য বোদ্ধারা। এ নিয়ে হুমায়ূন আহমেদ তাঁর ‘সায়েন্স ফিকশন সমগ্র’-এর ভূমিকায় লিখেন- ‘বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর পাঠকদের নিয়ে অবহেলার দৃষ্টিতে তাকানোর নিয়ম আছে। পাঠক সমাজে এরা সর্বনিম্নে অবস্থান করে। ধরা হয়ে থাকে সাহিত্যের মহানবোধ ... ইত্যাদি ইত্যাদি থেকে এরা বঞ্চিত। কোনো পাঠক একবার বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী পড়া শুরু করলে ভাঙ্গা গ্রামোফোন রেকর্ডের মতো সেখানেই আটকে থাকে। পাঠক আর বেড়ে ওঠেন না। আমার জন্যে এটা বিরাট দুঃসংবাদ কারণ আমি বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর অতি ভক্ত পাঠক। যখন পড়ার মতো কল্পকাহিনী পাই না তখন নিজেই লিখি যেন পড়তে পারি।‘
হুমায়ূন আহমেদ সর্বমোট ১৪টি সায়েন্স ফিকশন উপন্যাস লিখেছেন। এছাড়াও বেশকিছু ছোটগল্প লিখেছিলেন। ১৯৭২ সালে প্রকাশিত প্রথম সায়েন্স ফিকশন ‘তোমাদের জন্য ভালোবাসা’ বইতে বিজ্ঞানকে ছাপিয়ে প্রধান হয়ে ওঠে জীবন আর মনুষ্যত্ব। যেখানে পৃথিবী মুখোমুখি হয় এক মহাদুর্যোগের। মহান বিজ্ঞানী ফিহা এই পরিস্থিতিতে উদাসীন জীবন কাটাতে লাগুলেন। সব মিলিয়ে একটি টানটান উত্তেজনার কাহিনি।
‘ওমেগা পয়েন্ট’ বইটি কোয়ান্টাম মেকানিক্সের উপর ভিত্তি করে লেখা। কোয়ান্টার রসায়ন হুমায়ূনের পিএইচডির বিষয়। কোয়ান্টাম মেকানিক্স একই ব্যক্তির একই সঙ্গে দুই জায়গায় থাকার সম্ভাবনাকে অস্বীকার করে না। এই উপন্যাসের সবচেয়ে অবাক করা দিক হল মানবীয় ক্ষমতাসম্পন্ন রোবট। আমরা জানি, রোবট তৈরি হয় কম্পিউটার থেকে। তাতে কোন মানবীয় গুণাবলি থাকা একেবারেই অসম্ভব। কিন্তু হুমায়ূনের রোবটের আবেগ থাকে। এই উপন্যাসে আধ্যত্মিক এবং বৈজ্ঞানিক দুই ক্ষেত্রেই ওমেগা পয়েন্টকে অতীব গুরুত্ব সহকারে দেখা হয়। কোয়ান্টাম মেকানিক্সের এই তত্ত্বে বলা হয় পুরো মহাবিশ্ব একসময় একটি সিঙ্গুলারিটি তথা একক অবস্থায় চলে আসবে।
‘নিষাদ’ নামের উপন্যাসটি মিসির আলি সিরিজের উপন্যাস। যাতে মুনির নামের এক যুবকের কাহিনি বলা হয়েছে, যে কিনা দাবি করে পাশাপাশি দু’টি জগতে তার জীবন চলছে। এক জগতে সে সুখী, আরেক জগতে অসুখী। কোয়ান্টাম মেকানিক্স বলে, বস্তুকণা একই সাথে বিভিন্ন দশায় থাকতে পারে। কাজেই আমাদের এই মহাবিশ্বের মতো অসংখ্য মহাবিশ্ব থাকতে পারে, ঐ মহাবিশ্বে আমাদের প্রতিরূপও থাকতে পারে।
‘নলিনী বাবু বিএসসি’ উপন্যাসটি একজন সাধারণ শিক্ষককে ঘিরে, যিনি একই সঙ্গে দু’টি জগতে বসবাস করতেন। দু’টি জগতের মধ্যে তুলনাতেও যাচ্ছিলেন। তবে ‘নিষাদ’ উপন্যাসের সাথে এই উপন্যাসের একটা পার্থক্য রয়েছে। ‘নিষাদ’-এ মুনীর প্যারালাল জগৎ থেকে কিছু জিনিস নিয়ে আসতে পেরেছিল। কিন্তু নলিনী বাবু আনতে পারেন নি। এই উপন্যাসে নতুন তত্ত্ব পাওয়া যায়- প্যারালাল ইউনিভার্স থেকে কোন জিনিস আনা অসম্ভব।
0 Comments