জ্বলদর্চি

আধুনিক চিত্রশিল্পের ইতিহাস -১০

আধুনিক চিত্রশিল্পের ইতিহাস -১০

শ্যামল জানা


ফভইজম—

ঐতিহাসিকভাবে নতুন কিছু ঘটলে, সে বিজ্ঞানের আবিষ্কার বলি, বা অভিনব কোনো সৃষ্টির বিষয় বলি, তার সুত্র ধরে পর পর একই রকম ঘটনা ঘটতে থাকে ৷ কিন্তু তা একই রকম হলেও ক্রমশ উন্নত থেকে উন্নততর হতে থাকে৷ যেমন এরোপ্লেন ৷ রাইট ভ্রাতৃদ্বয় বিশ শতকের সূচনায় যে এরোপ্লেন আবিষ্কার করেছিলেন, সেই এরোপ্লেন ক্রমশ উন্নত হতে হতে আজ একশো বছর পেরিয়ে কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে, তা সবার জানা ৷

ঠিক এইভাবে, ১৮৭৪ সালে ইম্প্রেশনিস্টরা আধুনিক চিত্রকলার সূত্রপাত ঘটালেন ৷ তাঁরা ছবি আঁকার পদ্ধতিটাই আমূল বদলে দিলেন ৷ এই বদলানোর ক্ষেত্রে তাঁদের মূল হাতিয়ার ছিল তুলি চালনা(Brushing) বা তুলির পোঁচ(Brush stroke)৷ এই তুলির পোঁচের মূল দর্শন ছিল— প্রত্যেকটি তুলির পোঁচ ও তার রঙটি স্বতন্ত্রভাবে বোঝা যাবে, কেউ কারোর সঙ্গে মিশবে না ৷ পরবর্তীকালে যে পোস্ট-ইম্প্রেশনিজম ও তার ভেতরে একাধিক ইজমের জন্ম দিলেন যাঁরা, তাঁরা ইম্প্রেশনিস্টদের সঙ্গে বহু ক্ষেত্রেই দ্বিমত পোষণ করেছিলেন ৷ কিন্তু তাঁদের প্রত্যেকেই ইম্প্রেশনিস্টদের তুলি চালনার বা তুলির পোঁচের দর্শনের সঙ্গে একমত ছিলেন ৷ কেউই দ্বিমত পোষণ করেননি ৷ শুধু তাইই নয়, এই তুলির পোঁচের দর্শন ঠিক রেখেও ইম্প্রেশনিস্টদের তুলনায় তুলির পোঁচ আরও কত অভিনব করা যায়, আরও কত দুঃসাহসী হওয়া যায়, তারও একটা ধারাবাহিক প্রবল প্রয়াস দেখা গিয়েছিল ৷ এবং তা সফলও হয়েছিল ৷ 

তুলির পোঁচ ও রং নির্বাচন-এর বিষয়টি বিবর্তিত হতে হতে এই ফভইজম-এ এসে একেবারে চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছিল(ওপরের ছবি) ৷ বলা যায় বিপ্লবে পরিণত হয়েছিল ৷ এই সূত্রে ফভিস্টরা আগের সমস্ত কনসেপ্ট ভেঙে তছনছ করে দিয়েছিলেন ৷ একেবারে নতুনভাবে ভেবেছিলেন তাঁরা ৷

ফ্রেঞ্চ ভাষায় “Les Fauves” মানে বন্যজন্তু ৷ এখান থেকেই ফভইজম কথাটি নেওয়া হয়েছে ৷ ১৯০৫ সালে ফ্রান্সের “সালোঁ দতোঁ” নামের এক বিখ্যাত আর্ট গ্যালারীতে একেবারে নতুন ধরনের এক প্রদর্শনী হচ্ছে শুনে তা দেখতে যান তৎকালীন বিখ্যাত ফরাসি শিল্প-সমালোচক লুই ভোজেল ৷ তিনি প্রদর্শনীকক্ষে ঢুকে দেখেন— অদ্ভুত সব ছবি— ছবিগুলিতে তুলির পোঁচ অত্যন্ত প্রকটভাবে দেখা যাচ্ছে, এবং সেই পোঁচ সাংঘাতিকভাবে এলোমেলো বা অনিয়ন্ত্রিত ৷ শুধু তাইই নয়, ছবিগুলি চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়ার মতো প্রচণ্ড বা সর্বোচ্চ চড়া রং-এ আঁকা ৷ আবার, হলের মাঝখানে রয়েছে ব্রোঞ্জের একটা ছোট্ট ভাস্কর্য৷ তিনি তখন অত্যন্ত কৌতুক করে ফ্রেঞ্চ ভাষায় বলে উঠেছিলেন— Ah, Donatello au milieu des fauves(ইংরাজিতে— Ah Donatello caged among the wild beasts)৷ এই কৌতুককর উক্তি থেকেই ইয়োরোপে জন্ম নিল এক শক্তিশালী শিল্প আন্দোলনের নামকরণ— “ফভইজম”৷ 

কৌতুক করে বললেও ফভিস্টদের উদ্দেশ্যটি সঠিকভাবেই বুঝিয়েছিলেন ভোজেল ৷ ফভিস্টরা ছবি আঁকার সময়ে যখন ক্যানভাসে তুলির পোঁচ(Brush stroke) দিতেন, তা ঠিক বন্যজন্তুদের মতোই বন্য, হিংস্র ও অনিয়ন্ত্রিত হত ৷ আর, যতটা চড়া করা সম্ভব, ততটাই চড়া রং তাঁরা ছবিতে ব্যবহার করতেন, এবং অনেকাংশে তা বাস্তবতাকেও ছাড়িয়ে যেত(ছবি-১) ৷

 এই কারণে ফভইজমকে শিল্পকলায় “সহিংস বিপ্লব”ও বলা হয় ৷ তবে, এঁদের তুলির পোঁচের দর্শনটি ছিল এ রকম— যে, যে ছবিটি আমি আঁকছি, সেই ছবি যেন বদলে না যায়(অর্থাৎ, শিব গড়তে গিয়ে যেন বাঁদর না হয়ে যায়), মাত্র এই সচেতনতাটুকু তাঁরা মাথায় রেখে, তাঁদের তুলি চালনা ও রঙের প্রয়োগ ছিল স্বতঃস্ফূর্ত ও অনিয়ন্ত্রিত ৷ তবে, এই অনিয়ন্ত্রিত প্রসঙ্গে তাঁদের একটি নিজস্ব দর্শন ছিল ৷ যে, একটি হাত যত অনিয়ন্ত্রিতভাবেই তুলি চালাক না কেন, সেই হাতকে অদৃশ্যভাবে পরিচালনা করে সেই মানুষটির জ্ঞান শিক্ষা রুচি সৌন্দর্যবোধ ইত্যাদি ৷ যত অনিয়ন্ত্রিতই হোক না কেন, একজন শিক্ষিত মানুষের তুলির পোঁচ, আর, একজন অশিক্ষিত মানুষের তুলি পোঁচ সব সময় আলাদা হবে ! এবং তা বোঝাও যাবে ৷ 

১৯০৪ সালে এই ফভইজম-এর সূত্রপাত করেন— আঁরি মাতিস ও আঁদ্রে দেরায়াঁ ৷ এবং ১৯১০ সালের মধ্যেই তার ইতি ঘটে যায় ৷ আরও নির্দিষ্ট করে বললে ১৯০৫ থেকে ১৯০৮ ৷ এবং তাঁরা তিনটি মাত্র প্রদর্শনী করতে সক্ষম হয়েছিলেন ৷ অথচ, ফভইজমকেই শিল্পক্ষেত্রে সবচেয়ে শক্তিশালী আন্দোলন হিসেবে চিহ্নিত করা হয় ৷ এ রকমটা ঘটল কেন ? আরও বিস্ময়ের ব্যাপার হল— মাতিস ও দেরায়াঁদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন সেই সময়ের অধিকাংশ বিশ্ববিখ্যাত শিল্পীরা ৷ কে নেই ? অ্যালবার্ট মারকুই, চার্লস কামোইঁ, লুই ভালতাত, জাঁ পুয়ে, মাউরিস দে ভ্লামিঙ্ক, আঁরি ম্যাঙ্গুইন, রাউল দাফি, ওথোঁ ফ্রায়েস্জ, জর্জেস রাওয়াল্ট, জাঁ মেটজিঞ্জার, কীস ভান দনজেন, আর জর্জেস ব্রাক ৷       (ক্রমশ)


Post a Comment

1 Comments

  1. ফভইজম কিভাবে ছবির জগতে আলোরণ তুলেছিল তার বৈজ্ঞানিক
    ব্যাখ্যা আমাদের ঋদ্ধ করে। এই
    রং ব্যবহারের নান্দনিকতার মধ্যে
    অদ্ভুত ভাবে মেধা-জ্ঞান-শিক্ষার
    মেলবন্ধন ঘটছে কেবল মাত্র রঙের
    পোচের সুচারু ব্যবহারে। এটাই আমাদের আকর্ষণ করে।আমরা
    তন্ময় হয়ে থাকি পাঠ মুগ্ধতায়।

    ReplyDelete