জ্বলদর্চি

নোবেলজয়ী টনি মরিসন / সন্দীপ কাঞ্জিলাল

স ন্দী প  কা ঞ্জি লা ল  

"সে বছর শরৎকালে একটাও গাঁদাফুল ফোটেনি। কারণটা, তা যতই চাপা দেওয়ার চেষ্টা করা হোক না কেন, আমরা সবাই জানতাম। তার বাবার বাচ্চা পেটে ধরেছিল পিকালো, তাই তো একটা ফুল ও ফোটেনি সে বছর।"

টনি মরিসন
(১৮/০২/১৯৩১---০৫/০৮/২০১৯)

নিশুতির রাত! সবাই খেয়ে দেয়ে ঘুমিয়ে পড়ছে! চারদিকে নিস্তব্ধ! মাঝে মাঝে রাতজাগা পাখির ডানার ঝাপট! আলোছায়া অন্ধকারে দেখতে পাই, যেন একটি বাচ্চামেয়ে হামাগুড়ি দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে দোতালায়  উঠছে। সারা শরীর থরথর করে কাঁপছে!ঘাম গা বেয়ে নামছে।  বাড়িতে এমন কোন বাচ্চা মেয়েও নেই! তাছাড়া এত রাত্রে? ভয়ে ঘরে ঢুকে ছিটকিনি তুলে দিলাম! দেখি পড়ার টেবিলে তখনও খোলা "বিলাভেড" বলে একটি উপন্যাস।বোকা হাবা নিরক্ষর হাওয়া পৃষ্ঠা নিয়ে খেলছে।সেই সুযোগে বইয়ের  ভেতর থেকে মেয়েটি হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে গেছে। যার উৎসর্গ পত্রে লেখা ছোট্ট একটি বাক্য "সিক্সটি মিলিয়ন এন্ড মোর"। তখনই বুকে ফিরে এলো সাহস। যে বইতে আছে এক কালো দাস মা, যে তার ছোট্ট মেয়েকে নিজের হাতে খুন করেছে। মেয়েকেও যাতে তার মতো দাসত্বের শৃঙ্খল পরতে না হয়।'পিয়া' ছোট্ট মেয়েটি মরে গিয়েও এই উপন্যাসে যে প্রবলভাবে জীবিত। বেঁচে না থেকেও গোটা উপন্যাসটাই আগাগোড়া নিজের কাঁধে বয়ে নিয়ে চলেছে। আর রচয়িতা ১৯৯৩ সালে প্রথম কৃষাঙ্গ মহিলা হিসেবে পেয়েছে "নোবেল" পুরস্কার। ১৯৮৮ সালে "পুলিৎজার"। ২০১০ সালে প্যারিসের আলোকোজ্জ্বল বিদ্বজ্জন   সভায় ফরাসি সাংস্কৃতিক মন্ত্রী 'ফ্রেডেরিক  মিতের', ফ্রান্সের সর্বোচ্চ সম্মান "লা লিজিয়ঁ দ্য অনার" দিতে গিয়ে বলেছেন, ওহিত্তর এক দরিদ্র কৃষাঙ্গ পরিবারের ছোট্ট মেয়েটি তার লেখনীর দ্বারা কীভাবে জিতে নিয়েছে গোটা বিশ্বের হৃদয়। 
এই কালো মেয়েটির নাম "টনি মরিসন"(১৮/১২/১৯৩১-০৫/০৮/২০১৯) যন্ত্রণার গভীরে কেঁদে চলা এক নারীর মর্মন্তুদ কাহিনী। সারা বিশ্ব চমকে উঠেছিল তাঁর রচনার সুখপাঠ্যে। কবিতার চালে যার চলন বড় ছন্দময়। যার নিজের জীবনও উপন্যাসের চেয়ে কোনও অংশে কম নয়। একটা আতঙ্কগ্রস্ত " ট্রমাটাইজড" জীবনের চাপ নিয়ে যার বড় হওয়া। তার পিতা 'জর্জ ডয়োফোর্ড' এর জার্জিয়ার কার্টাসভিলের জীবন ঔপন্যাসিক 'মরিসন' এর আদি পশ্চাৎপট। পনেরো বছর বয়সী 'মরিসন' দেখতে পান, তাঁর দুই কৃষাঙ্গ প্রতিবেশী শেতাঙ্গদের হাতে নিহত হচ্ছে। আবার টনির যখন দু'বছর বয়স বয়স, তিনি দেখলেন তাঁর দরিদ্র শ্রমিক পিতার বাড়িভাড়া বাকী পড়ার জন্য শেতাঙ্গ বাড়িওয়ালা আগুন লাগিয়ে দিচ্ছে বাড়ী ছেড়ে টনি'রা যাতে পথে নেমে আসেন। সে দিনের সেই ভয়ংকর স্মৃতি বড় হয়েও 'টনি' মনে রেখেছে। পরে তিনি লিখলেন, "সেদিন আমার পিতার মুখ একটা পাঠের বিষয়। শীত এসে জেঁকে বসে তাঁর ওপর। তাঁর চোখগুলো বরফের পাহাড়।.... তাঁর কপাল যেন ঠাণ্ডায় জমে যাওয়া ইরি-হ্রদের প্রবাহ"।
১৯৩১ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারী আমেরিকার ওহায়োর এক আফ্রো-মার্কিন পরিবারে জন্মান "ক্লো আর্ডেলিয়া ওফর্ড"। বারো বছর বয়সে ক্যাথলিক ধর্ম গ্রহণ করে, নিজের নাম পাল্টে "অ্যান্টনি" করে নেন "ক্লো"। সেই "অ্যান্টনি" থেকে "টনি"। হাওয়ার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়, জামাইকার স্থপতিবিদ 'হ্যারল্ড মরিসন'কে বিয়ে করেন ১৯৫৮ তে। ১৯৬৪ তে বিয়ে ভেঙে যায়। সেই থেকে নামের সঙ্গে থেকে যায় "মরিসন" পদবি। যখন বিবাহ বিচ্ছেদ হয় তখন তাদের দুটি সন্তান। কিন্তু লালন পালনের ভার পড়লো একা মরিসনের ওপর। ভোর চারটায় ঘুম থেকে জেগে উঠতেন। সংসার শুরুর আগে শুরু করতেন উপন্যাসের ঘর সংসার। তবু তিনি ক্লান্ত হননি। কারন তিনি জানতেন পৃথিবীকে তার অনেক কথা জানানো বাকি।
ছাত্রজীবনে 'মরিসন' এর দুজন প্রিয় লেখক ছিলেন, "জেন অস্টিন" এবং "তলস্তয়"। সেই সময় 'জেন অস্টিন' এর উপন্যাসে নারীর অবস্থা নিয়ে লিখে তিনি শিক্ষকদের চমকে দেন। আবার এম.এ ক্লাসে 'উলফ' এবং 'ফকনার' এর সাহিত্যকর্ম নিয়ে গবেষণা করেন। তিনি প্রমাণ করেন উপন্যাস, জীবনের ঠিক পাশ ঘেঁষে চলে যাওয়া একটি স্পষ্ট রেখা। প্রিস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার পেশায় যোগ দেওয়ার আগে, তিনি বিশ্ববিখ্যাত প্রকাশনা সংস্থার সম্পাদনা করে গোটা বিশ্বকে চমকে দেন। তিনি এই সময় প্রকাশ করেন "মহম্মদ আলী"র জীবনী। 'হেনরি ডুমাস','আ্যঞ্জেলা ডেভিস' এর সাহিত্যকর্ম। তার মনে দাগ কেটে যায় বর্ণবাদী হামলায় ১৯৬৮ সালে নিহত 'হেনরি ডুমাস' তার কবিতা ও গল্প প্রকাশ করার দায় নিজের কাঁধে তুলে নেন। 
তার বিখ্যাত উপন্যাসগুলি হল, দ্য ব্লুয়েস্ট আই(১৯৭০), সুলা(১৯৭৩), সং অফ সলোমন(১৯৭৭), টার বেবি(১৯৮১), বিলাভেড(১৯৮৭) ইত্যাদি। 'মরিসন' বলেন, " আমি কোনো গ্রাম বা সম্প্রদায়ের কিংবা আপনাদের জন্য লিখি না।...আমার লেখালেখির কাজটাকে হতে হবে অবশ্যই রাজনৈতিক। লেখায় রাজনৈতিক প্রভাব থাকলে লেখকের গায়ে দাগ কেটে দেওয়া হয়। আমার অনুভূতি ঠিক এর উল্টো- সে ধরনের প্রভাব না থাকাটাই বরং কলঙ্কের"। 
একই পৃথিবীতে একই হাওয়া জলে কেউ সুন্দর, আরাম আর বিলাসিতার জীবন। একই আয়না, একজনের মুখ সৌন্দর্য তার কাছে গর্বের বিষয়, অন্যজনের মুখ তার নিজের কাছে হয়ে উঠছে অভিশাপ। একশ্রেণির মানুষের জীবন স্বর্গতুল্য, আরেক শ্রেণির মানুষের জীবন চলমান নরক। তাই বোধ হয় লেখক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, "ঈশ্বর থাকেন ঐ গ্রামের ভদ্রপল্লিতে, এখানে তাহাকে খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে না"।
স্কুলে থাকার সময়ে তাঁর এক শ্বেতাঙ্গ সহপাঠিনী জিজ্ঞাসা করেছিল--'তোমার চোখ আমাদের মতো নীল নয়।তুমি নিশ্চয় চাও,তোমার চোখও এ রকম সুন্দর নীল হোক।' কুড়ি বছর পরেও সেই নীল চোখের স্বপ্ন তাড়া করে বেড়াত কালো চোখের কালো মেয়েটিকে।নীল চোখ, সোনালি চুল, সাদা চামড়ার বাইরেও যে একটা জগৎ আছে, নির্মম কিন্তু অপরুপ, শিকলে বাঁধা, কিন্তু ডানায় ভর দিয়ে উড়ানে প্রস্তুত, তাই বারবার লিখেছেন উনি। 
নিপীড়িত মানুষদের জীবন নিয়ে লেখা তাঁর উপন্যাসগুলো সেই হাহাকারময় জীবনের ছবি আঁকে। তেমন একটি উপন্যাস "দ্য ব্লুয়েস্ট আই"। বারো বছরের ছোট্ট কালো মেয়ে 'পেকালো' কেবল কালো তাঁর গায়ের রং নয়, কালো তাঁর জীবনের অভিশাপ। তার মা তাকে ভালোবাসে না। সে ইচ্ছা করে কাঁদে তার মায়ের ভালোবাসার জন্য। অতটুকু মেয়ে, যার জীবন শুরুই হলো না, কেন সে জীবনকে পর করে দিল? কেন বা জীবন তাকে প্রত্যাখ্যান করলো? চূড়ান্ত অবহেলার শিকার হয়ে লিঙ্গ বৈষম্যের জন্য 'পেকালো' র সমাজে ঠাঁই হয় না। সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন  হয়ে বন্দী জীবন বেছে নেয় মেয়ের জন্য। অনেক মনের হত্যা দিয়ে, মানবতার চরম পতন দিয়ে, শুধু সাদা চামড়ার একজোড়া নীল চোখ কীভাবে সমাজে সম্মান আর বেঁচে থাকার সমস্ত উপকরণ পায়, তাই জানিয়ে এই উপন্যাসের চরম পরিণতি। বাস্তবের এমন দগদগে চিহ্ন দেখার জন্য তৈরি ছিল না মানুষ। তাই নিউইয়র্কের 'সিটি ইউনিভার্সিটি' এটাকে ব্ল্যাক- স্টাডিজ বিভাগ পাঠ্যতালিকায় নিয়ে এল। কয়েকটি কলেজও সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত করল। তখনই বিশ্ব জানালো 'টনি মরিসন' আত্মপ্রকাশ ঘটছে আগুন হয়ে জ্বলে ওঠার জন্য। 
লেখালেখির সঙ্গে কোথাও যেন একটা সম্পর্ক রয়েছে সত্তার সংগ্রামশীলতার। পরিস্থিতি যত বেরি, তত লেখকসত্তার উন্মেষ ঘটে। "ব্রেইটেনবাখ" তাই বলেন, "লেখালেখি হলো বেঁচে থাকার প্রচেষ্টা এবং চেতনা ও সংবেদনার প্রসারণ"। যতই রুদ্ধতা আসুক তা লেখককে কোনোভাবেই কব্জা করতে পারে না। তাই 'মরিসন' এর জন্য লেখালেখিটা অর্থপূর্ণ বর্তমান, আপন পৃথিবী নির্মাণ। 
তার চতুর্থ উপন্যাসটার 'টার বেবি'(১৯৮১) তে দেখান শ্রেণি, বর্ণ এবং লিঙ্গায়ন ক্ষমতার এক অসাধারণ প্রতিফলন। এটি যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি দেওয়া কৃষাঙ্গ জনগোষ্ঠীর বেদনা। শৈশব থেকে 'মরিসন' জানতেন শেতাঙ্গরা কৃষাঙ্গ ছেলেমেয়েদের, বিশেষত কালো মেয়েদের 'টার বেবি' (আলকাতরা মেয়ে) বলে ডাকতো। এই উপন্যাসের বড় সার্থকতা, কৃষাঙ্গরা এতে প্রধান চরিত্র হলেও এটি কেবল তাদের কাহিনী হয়ে থাকেনি। এটি অভিবাসীয় পূর্ব ইউরোপীয়, দক্ষিণ এশীয় কি লাতিন আমেরিকার জনগোষ্ঠীর জীবনের উপসংহার। ১৯৮৭ থেকে ১৯৯৭ 'মরিসন' এর জীবনে ট্রিলজির দশক। ১৯৮৬ তে বেরোয় 'বিলাভেড'। ১৯৯২ 'জাজ' এবং ১৯৯৭ সালে 'প্যারাডাইস'। 
"বিলাভেড" উপন্যাস তাকে এনে দেয় "পুলিৎজার" পুরষ্কার। এই উপন্যাসের মূল চরিত্র 'সেথ' নামে একজন নারী ক্রীতদাস। মালিকের অত্যাচার থেকে বাঁচতে যে পালিয়ে যায়। ধরা পড়ে দু বছর বয়সী মেয়ে ও মা।'সেথ'কে নিয়ে যেতে চায় । "সেথে" র স্বামীকে মেরে ফেলে তাকে ধর্ষণ করে মালিক। কিন্তু নিজের মতো সন্তানকেও ক্রীতদাস করতে চায় না। তাই বাচ্চা মেয়েটির গলা কেটে হত্যা করে। তারপর কারাবাস। ১৯৮৮ সালে পায় "পুলিৎজার" পুরষ্কার। এই বছর বইটি সিনেমা হয়। যাতে অভিনয় করে বিশিষ্ট কৃষাঙ্গ ব্যক্তিত্ব 'অপরাহ্ উইনফ্রে'। বইটির লাখ লাখ কপি বিক্রি হয়। ১৯৮১-২০০৬ এই পঁচিশ বছরে সর্বাধিক বিক্রি বই ছিল "বিলাভেড"।
" টনি মরিসন" এর সব উপন্যাস গুরুত্বপূর্ণ। জীবনে মোট এগারোটি উপন্যাস লিখেছেন। বর্বরতা, শিশুহত্যা, যৌনতা এবং সন্ত্রাস এসবের স্রষ্টা "মরিসন" নন। এতকাল এদের স্রষ্টাদের কাঠগড়ায় কেউ তোলেনি। আর এই বিশাল অন্যায় যে ক্ষমার অযোগ্য এবং তার প্রতিবাদ হওয়া প্রয়োজন, এইসব বিশ্বকে জানিয়েছেন "মরিসন"। 
তাই তার মুকুটে একটার পর একটা সোনার পালক। " পুলিৎজার" পুরষ্কার -১৯৮৮। সাহিত্য 'নোবেল' -১৯৯৩। আমেরিকান বুক অ্যাওয়ার্ড বিজয়ী। "ন্যাশনাল হিউম্যানিটিজ" মেডেল -২০০০। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সম্মান "প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অফ ফ্রিডম"-২০১২। তাঁর হাতে তুলে দেন রাষ্ট্রপতি 'বারাক ওবামা'
যখন মানুষ চাওয়া পাওয়া ক্ষমতা ইচ্ছা অনিচ্ছা সব হারিয়ে একাকীত্বে ভোগে। তখন সে চায় এক নির্ভরযোগ্য হাত। যে হাত থেকে পড়বে আনন্দের সুধা-ধারা! "কনফুসিয়াস" এর কথায়, "নৈঃশব্দ্য সেই বন্ধু যে কখনও / বিশ্বাসঘাতকতা করে না"। এগারোটি উপন্যাস লিখে, ৫ই আগস্ট ২০১৯ সেই নৈঃশব্দের হাত ধরলেন ৮৮ বছরের " টনি মরিসন"। আঁধার কাটিয়ে আলোর দিকে যাত্রা করলেন। তাই তো তিনি বলেছিলেন, "আমাদের মৃত্যু হবে এটাই হয়তো জীবনের অর্থ। কিন্তু আমরা ভাষা চর্চা করি, সেটার মাধ্যমেই হয়তো আমরা আমাদের জীবনের পরিমাপ করি।কারণ মৃত্যুই যেমন জীবনের চরম ব্যঞ্জনা,ভাষা তেমনই জীবনের"।

Post a Comment

3 Comments

  1. অসাধারণ লেখা।

    ReplyDelete
  2. দ্য ব্লুয়েস্ট আই পড়ার সময় মরিসনকে যতটা জেনেছিলাম তার চেয়ে অনেক গভীরে জানলাম এই লেখাটি পড়ে। ধন্যবাদ। এরকম লেখা আরও চাই।

    ReplyDelete
  3. পড়লাম।ভাল লেখা

    ReplyDelete