জ্বলদর্চি

লেখক স্মরণজিৎ চক্রবর্তী’র সাক্ষাৎকার জ্বলদর্চি পত্রিকার পক্ষ থেকে মৌসুমী ঘোষ

প্রথম প্রথম আমার মনে হতো প্রথম প্রেমের পরের প্রেমগুলো অতটা জোরদার নয় কিন্তু এই কুড়ি বছরে আমার অভিজ্ঞতা পাল্টে আমি বুঝেছি প্রেম সবসময়ই জোরদার — সে প্রথম দ্বিতীয় কী তৃতীয়…’

লেখক স্মরণজিৎ চক্রবর্তী’র সাক্ষাৎকার জ্বলদর্চি পত্রিকার পক্ষ থেকে মৌসুমী ঘোষ

মৌসুমী: দাদা, আপনি পাঠকপ্রিয় লেখক। এই পাঠকপ্রিয়তা কি আপনাকে কখনো কোনোভাবে বিব্রত করেছে?

স্মরণজিৎ:  আমি সবার থেকে একটু অন্তরালেই থাকি। বছরে এক-দু’দিন বুকফেয়ারে পাঠকদের সঙ্গে দেখা হয়। যারা আমার বই কেনেন, তারা আমার সঙ্গে দেখা করবেন, তাদের অনুভবের কথা বলবেন, সই নেবেন, এটাকে আমি আমার ডিউটির মধ্যেই মনে করি। আজকাল রাস্তায় কেউ কেউ চিনতে পারে তবে সবাই যে এসে কথা বলে তাও নয়। আমি গত পঁচিশ বছর লিখছি। তারমধ্যে গদ্য লিখছি কুড়ি বছর। এরমধ্যে শেষের কিছু বছর পরিচিতি বেড়েছে। তবে সেটাও খুব সামান্য। অতটা বিব্রতের ব্যাপার নয়।

মৌসুমী : আপনি কি ছোটো থেকেই ভেবেছিলেন লেখক হবেন?

স্মরণজিৎ : না, না, আমি খুব সাধারণ, নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে। আমরা তখন মফফসলে থাকতাম। তাই ভাবতেই পারিনি লেখক হব। বরঞ্চ ভেবেছিলাম, ফুটবল প্লেয়ার হব। সেটা তো হতে পারিনি। তারপর ভেবেছিলাম, কার্টুনিস্ট হব। সেটাও হতে পারিনি। সাধারণ মধ্যবিত্ত মানুষ কি আর লেখক হবার মতো বিলাসিতা দেখাতে পারে? পারে না তো। তার কারণ লেখক হলে তো প্রচুর টাকা রোজগারের ব্যাপার নেই। আমাদের তো আগে অন্ন সংস্থান করতে হবে।  
শীর্ষেন্দু বাবু, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়, তাদের কাছে পৌঁছানোর কথাতো স্বপ্নেও ভাবতাম না। ছোটোবেলায় এদের বই পড়ে মনে হতো এঁরা তো অনেক বড়ো মাপের মানুষ। লেখক হওয়া তো অনেক বড়ো ব্যাপার, স্বপ্নটা অতদূর পৌঁছোতোই না। তবে লিখতে ভাল লাগতো। লিখে গেছি।

মৌসুমী:  অদম্য সেনকে কেন সকলে আপনার উপন্যাসের অন্য চরিত্রদের থেকে আলাদা বলে ব’লে আপনার মনে হয়?  

স্মরণজিৎ:  অদম্য সেন আমার থ্রিলার উপন্যাসের চরিত্র। সাধারণত আমি সামাজিক উপন্যাস লিখি আর আমি বেশিরভাগ সময় বড়োদের জন্য লিখি। এসমস্ত কিছুর বাইরে দাঁড়িয়ে অদম্য সেন একটি থ্রিলার ক্যারেকটার। বাংলায় থ্রিলার বা গোয়েন্দা গল্প যখন লেখা হয় তখন যে ভাল মানুষ তাকে প্রোটাগনিস্ট করে লেখা হয়। কিন্তু এখানে অদম্য সেন একটি খারাপ কাজ করা লোক। সে আইনের বাইরে বেআইনি কাজ করে, সমাজে যাকে খারাপ কাজ বলে। সেখানে থেকেও আল্টিমেটলি এন্ড অফ দ্য স্টোরি সে কোনো না কোনো একটা ভাল কাজও করে। আমার মনে হয় সেজন্যই অদম্য সেন অন্যদের থেকে আলাদা।  

মৌসুমী:  আপনার উপন্যাসের চরিত্রদের নাম নিয়ে আপনার যে রিসার্চ তা কি আপনি সচেতন ভাবে প্রথম থেকেই করেন?

স্মরণজিৎ: আমার মনে হয় লিখতে গেলে এমন কিছু এলিমেন্ট দরকার হয় যা একদিকে আবহ তৈরি করে অন্যদিকে মানুষের আগ্রহটা উস্কে রাখে। আমি কুড়ি বছর গদ্য লেখা শুরু করেছি অথচ কুড়ি বছর পরেও আমাকে এই প্রশ্ন শুনতে হয়। অর্থাৎ এই কাজটা কুড়ি বছর ধরেও ইন্টারেস্ট বজায় রেখেছে। 
মহাভারতে অর্জুনের নাম অর্জুন না হয়ে রাখাল হলে সেই ইমপ্যাক্ট কিন্তু আসতো না। ফলে শেক্সপিয়ার সাহেব যতই বলুন নামে কি আসে যায়, নামে অনেক কিছু আসে যায়। শোলে সিনেমায় গব্বর সিং-এর নামের মধ্যে এমন একটা এলিটারেশান (ব্ব) আছে, বা রিং আছে, যে আপনার শুনলেই মনে হবে এ লোকটা পাঁচজনের থেকে আলাদা। তাছাড়া আমরা যখন লিখি তখন আমাদের তো কোনোকিছু ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক, মঞ্চ সজ্জা, কোনো ক্যামেরা কিচ্ছু থাকে না, আমাদের ভাষা বা শব্দটাই শুধু আছে। ফলে শব্দটাকে এমন ভাবে ইউস করতে হবে যাতে তা নানান ভাবে দ্যোতনা সৃষ্টি করে। সেই জন্য আমি অন্যধরনের নাম নির্বাচন করি চরিত্রদের। 

মৌসুমী:  সোশাল মিডিয়া এসে প্রেমের সংজ্ঞা বদলেছে। অথচ আপনি সোশাল মিডিয়া থেকে দূরে। তাহলে বর্তমান প্রজন্মের প্রেম কীভাবে উপন্যাসে ধরেন?

স্মরণজিৎ:  যখন সোশাল মিডিয়া ছিল না তখনও প্রেম ছিল, এখন সোশাল মিডিয়া সহ প্রেম আছে। আমার কাছে ব্যক্তিগতভাবে অনেক ইয়াং (২০ থেকে ৩৫ এর মধ্যে) ছেলেমেয়ে আসে। আড্ডা হয় আমাদের। আমার বয়স ৪৬+ কিন্তু আমার মন এখনো টিনেজারের মতোই আছে। সুতরাং অসুবিধা হয়না লিখতে। 

মৌসুমী:  প্রেম আপনার উপন্যাসের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। নর-নারীর স্বাভাবিক আকর্ষণজনিত প্রেম ছাড়াও বর্তমানে নারী-নারী বা পুরুষ-পুরুষ যে প্রেমের বহিঃপ্রকাশ দেখা যাচ্ছে সে বিষয়ে আপনার অভিমত কী?

স্মরণজিৎ:   মানুষের একটাই তো জীবন। সুতরাং যার যাকে ভালো লাগে সে নারী-নারী বা পুরুষ-পুরুষ, যাই হোক সমলৈঙ্গিক প্রেম হোক কী অসমলৈঙ্গিক প্রেম হোক, প্রেমটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমার বিভিন্ন লেখার মধ্যে এই সমলৈঙ্গিক প্রেম কিন্তু এসেছে। এত হানাহানির মধ্যেও যে প্রেম বেঁচে আছে এটাই খুব ইম্পর্ট্যান্ট। তার ফলে আমার মতে নিজেকে ছাপিয়ে অন্যকে যে কেউ ভালোবাসছে সেটা খুব ইম্পর্ট্যান্ট। আমরা যে স্যাক্রিফাইস করি বা যে সাফারিং-এর মধ্যে দিয়ে যাই, কষ্ট পাই দুঃখ পাই, তাও যাকে বাসছি ভালো তার ভালোটা চাই। এখানে লিঙ্গটা আমার কাছে ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয়।
মৌসুমী:  আপনার সমস্ত উপন্যাসেই প্রেমই প্রতিপাদ্য বিষয়। আপনার কাছে প্রেমের সংজ্ঞা কী প্রথম থেকে আজো একই? 

স্মরণজিৎ:  প্রেমের সংজ্ঞা ঠিক কী আমি জানি না। আমার কাছে যেমন আগুনের শিখা কী বা তার সংজ্ঞা কী, জানতে চাইলে বলতে পারব না তেমন এটাও পারব না। তবে আমি কুড়ি বছর আগে ভাবতাম যে জীবনে একটাই প্রেম হবে এবং সেটাই মানুষকে সারা জীবন বয়ে নিয়ে যেতে হবে। এই কুড়ি বছরে আমি আমার চতুর্দিকে অনেক কিছু দেখেছি, দেখার পর মনে হয়েছে কোন প্রেম হয়তো তার কাঙ্খিত লক্ষে পৌঁছাল না তারপরও তার জীবনে অন্য কাউকে ভাল লাগতে পারে। কুড়ি বছর আগে যে ছেলেটা এক্স কাউকে ভালোবাসছে, সেই ছেলেটাই আবার কুড়ি বছর পরে অন্য কাউকে ভালোবাসছে, সেটাও কিন্তু সত্যি। প্রথম প্রথম আমার মনে হতো প্রথম প্রেমের পরের প্রেমগুলো অতটা জোরদার নয় কিন্তু এই কুড়ি বছরে আমার অভিজ্ঞতা পাল্টে আমি বুঝেছি প্রেম সবসময়ই জোরদার — সে প্রথম দ্বিতীয় কী তৃতীয়…  

মৌসুমী: মানুষের ব্যস্ততার জন্য উপন্যাস, বড়োগল্পের থেকে ছোটোগল্প এমনকি অণুগল্প বেশি লিখছেন লেখকরা। উপন্যাস বড়োগল্পের জনপ্রিয়তা কি তাহলে আগের থেকে কমে আসছে বলে আপনি বিশ্বাস করেন? 

স্মরণজিৎ :  কমতে পারেনা। এখনো মোটা মোটা বইই বেশী বিক্রি হয়। অনুগল্প অনুগল্পের জায়গায়, ছোটোগল্প ছোটোগল্পের জায়গায়, আবার উপন্যাস উপন্যাসের জায়গায়। কেউ কারোর পরিপূরক নয়। এই যে আজকে এখন বৃষ্টি হচ্ছে, আজকে উপন্যাস পড়ার দিন। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে শীর্ষেন্দু বাবুর নতুন কোনো বড়ো উপন্যাস যদি পেতাম পড়তাম। গল্প উপন্যাস কবিতা প্রত্যেককটা আলাদা মুড ক্রিয়েট করে। আমি নিজে উপন্যাস লিখতে সবচেয়ে পছন্দ করি। আমাকেতো সবাই বলে, দাদা আরো বড়ো করে লেখো।  

মৌসুমী:  কম্পাস, ওম, দোয়েল সাঁকো, পাল্টা হাওয়া, জোনাকিদের বাড়ি — এই উপন্যাসগুলো নিয়ে আপনার উপন্যাস প্রেমীরা যে নাম্বারিং করে সে বিষয়ে আপনার কী অভিমত? 

স্মরণজিৎ :  কোনো কোনো উপন্যাস হয়তো পাঠকদের ভালো লাগে আমার ততটা ভালো লাগে না। তবে যে লেখা হয়ে গেছে তা নিয়ে আমি খুব বেশি চিন্তা করিনা। নতুন যা লিখব সেসব মাথার মধ্যে আছে।  
মৌসুমীঃ  ক্রিস-ক্রশ, পাতা ঝরার মরশুম, রসগোল্লা নিয়ে যেসব সিনেমা হয়েছে তা কি আপনাকে স্যাটিস্ফাই করেছে? 

স্মরণজিৎ : আমার মনে হয়েছে আমি যেমন লিখেছি ছবিগুলো তেমন হয়নি। তবে ‘রসগোল্লা’তে আমি পাভেলের সঙ্গে কাজ করেছি। পুরোনো কলকাতা নিয়ে আমার চিরদিন আগ্রহ ছিল। নবীন চন্দ্র দাসের গল্প আর রসগোল্লার গল্প নিয়ে তৈরী হয় সেইটি। তবে মূলত এন্টারটেনমেন্ট যাতে হয়, হার্ড ফ্যাক্ট যেন মূল গল্পের রসকে নষ্ট না করে সেদিকে আমরা নজর রেখেছিলাম। আমরা রসগোল্লা ভবন, যেটা রবীন্দ্র সরণীতে নবীন চন্দ্র দাসের বাড়ি, সেখানে গিয়ে ওদের গল্প শুনেছি, সেইসব জেনে নিয়ে আমাদের গল্প তৈরী করতে হয়েছে।  

🍂

মৌসুমী:  ছোটো পত্রিকা বা লিটিল ম্যাগাজিন সম্পর্কে আপনার ধারণা বা অভিজ্ঞতার কথা শুনতে আগ্রহী। 
স্মরণজিৎঃ  আমার নিজের লেখালেখির শুরু লিটিল ম্যাগাজিন থেকে। ১৯৯৭ সালে আমার প্রথম লেখা ছাপা হয়েছিল ‘সংবর্তিকা ১৯ দিনে’ বলে একটি লিটিল ম্যাগাজিনে। সম্পাদক ছিলেন রাজীব মিত্র। তারপর দীর্ঘ সময় ধরে আমি লিটিল ম্যাগাজিনে লিখেছি। যারা নতুন লিখছেন এবং যারা লিখে নাম করেছেন সমস্ত ধরনের লেখকদের জন্য খুব আরামের জায়গা লিটিল ম্যাগাজিন। ১৯৯৯ সাল থেকে ২০০৪-০৫ প্রায় ছয় বছর আমি লিটিল ম্যাগাজিন বার করেছি। কবিতা গদ্য প্রবন্ধ সাক্ষাৎকার নেবার জন্য আমি নিজে সবার কাছে যেতাম। আমাদের পত্রিকার নাম ছিল ‘সন্দর্ভ’। যেদিন সংখ্যা বেরিয়ে হাতে আসতো সেদিনটা ছিল খুবই আনন্দের।   

মৌসুমী :  আপনার সমসাময়িক লেখকদের মধ্যে আপনি কার কার লেখার ভক্ত? 

স্মরণজিৎ : ২০০৫ সালের পরে একটা কী দুটো শীর্ষেন্দু বাবুর উপন্যাস পড়েছি। আর জয়দার একটা পড়েছি। গল্প উপন্যাস আমার পড়া হয় না। তাই আমার বলা সম্ভব হচ্ছেনা কার লেখা কেমন।


Post a Comment

0 Comments