জ্বলদর্চি

কবিতার ভুবন


কবিতার তৃতীয় ভুবনে, কণ্ঠে – উচ্চারণে

আ র ণ্য ক  ব সু


যেখানে বেদনাবোধে থমকে দাঁড়াই,
সেখানে কলম কিছু লিখে যেতে চায়;
যদি সেই কাব্যচ্ছ্বটা তোলপাড় আনে
শতকণ্ঠে সেই ঝড় ভাবনা কাঁপায়।


শব্দের উচ্চারণকে অনেকেই ব্রহ্মের উপলব্ধির সঙ্গে তুলনা করেন; শব্দকে ব্রহ্ম বলেন। আমি সেই আধ্যাত্মিক ধারণার মধ্যে না গিয়েও বলতে পারি – শব্দ এক সাংঘাতিক অস্ত্র, যা দিয়ে মানুষের চেতনা কে হাসি কন্নার হিরা পান্নায় ভরে দেওয়া যায়। ওই যে লোকে বলেনা – কথায় বাঁচি কথায় মরি! আমার মতো বাংলা ভাষার একজন দীন কবিকে (যার প্রায় চার দশকের বাচিক চর্চা আছে) অনুরোধ করা হয়েছে, শব্দ নিয়ে সেই বাঁচা মরার কথা কয়েক পর্বে লিখতে। বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত, বসন্ত, আবার গ্রীষ্ম - পৃথিবীর সব অসুখের নিরাময় হয় সার্থক কবিতায় অথবা কবিতার মতো সুন্দর জীবনে। আমি অনেক ভেবে দেখেছি – ভালোবাসা ও কবিতা শব্দ দুটির কোনো প্রতিশব্দ হয়না। আসুন, আমরা কয়েক পর্বে সেই ভালোবাসা মাখা কবিতার, আর কবিতা - ছোঁয়ানো ভালোবাসার কথা বলি।

    কবিতার শুধু নিজস্ব ভুবনটুকু থাকলেই কোনো ক্ষতি ছিলোনা; কিন্তু সে তো আরও দুটি ভুবনের দিকে হাত বাড়ায়। আধুনিক দাদাগিরির ভাষায় কবিতাকে বেশ লম্বা হাতের মালিক বলেই বলা যেতে পারে। বন্ধুরা, কথাটা কেন বললাম জানেন? যখন কোনো একজন মানুষ নিজের নিভৃতের অন্তরমহলে বসে সম্পূর্ণ একাকীত্বের অন্ধকারে নিজের দশটা আঙুলকে মোম শিখা করে জ্বালিয়ে, পুড়তে পুড়তে, আনন্দ - বেদনা – বিষাদের কথা লিখে রাখেন, এবং লিখতে লিখতে একসময় ক্লান্তির অন্তিমে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েন; তখন তাঁর অর্ন্তলীন মনোভাব কবিতা হয়ে ফুটে ওঠে। অথচ তাঁর মাধুকরীর ঝুলিতে একটা তিন টাকার পেন আর দশ টাকার প্যাড ছাড়া কিচ্ছু নেই ! তবু সেই সামান্য সঞ্চয়টুকুই তাঁকে দিয়ে কিছু লিখিয়ে নিল। পরদিন সকালে তাঁর সেই সৃষ্টি দুচোখ ভরে দেখতে দেখতে বিস্মিত হওয়ার কী এক আশ্চর্য প্রহর! বন্ধুরা, এইটুকু অংশকেই বলি কবিতার প্রথম ভুবন। যেখানে কালি, কলম, মন আর নার্সিসাস কবির জীবন যাপনের অনুভূতি।

    ধরা যাক, সেই ব্যক্তিকবি তাঁর সদ্যজাত কবিতাটিকে যত্নে খাম বন্দি করে অথবা মেইল করে জ্বলদর্চির মতো কোনো ভালোলাগা – ভালোবাসার পত্রিকায় পাঠিয়ে দিলেন এবং তা প্রকাশিত হল। সেই পত্রিকা ক্রমশ হাতে হাতে পৌঁছনোর পর, অজানা অচেনা কবির লেখাটি অনেকের ভালো লেগে গেল। কোনো পাঠক বা পাঠিকা টিভি নেভানো, এ্যান্ড্রয়েড অফ করা গভীর রাতে কবিতাটি পড়ে নিজেকে হারিয়ে ফেললেন। মনে মনে রবি ঠাকুরকে ধার করে বললেন – ওগো আমারই কবি, তোমারে আমি জানিনে কভু, তোমার বাণী আঁকিছে তবু, অলস মনে অজনা তব ছবি।

ঘুম ভেঙে উঠেই তাঁর মনে হলো, কবিতাটি আমি জোরে জোরে পড়বো, কেমন লাগে নিজের কানেই শুনবো। বেশ কয়েকবার পড়ার পরে, বেশ কয়েকবার চায়ের কাপ শেষ করবার পরে তাঁর হঠাৎ মনে হলো - এই কবিতাটি তার চেয়েও ভালো করে অন্য কোনো আবৃত্তিকার বন্ধু বলতে পারবে। সঙ্গে সঙ্গে তিনি হাতে তুলে নিলেন সুপ্রভাত জানানো মুঠো বা এ্যান্ড্রয়েড ফোনটাকে। সেই বন্ধুকে ফোন করে বসলেন। ব্যস, এই হলো কবিতার দ্বিতীয় ভুবন। যেখানে প্রকাশিত হবার পর ভালোলাগা কবিতাটি আর কবির নিজস্ব বুকের লকারে বন্দি থাকলো না। সেটি কবিতা তখন উন্নতশির পাঠক পাঠিকাদের দখলে।
    এবার সেই আবৃত্তি শিল্পীর হাতে কবির কবিতা। তাঁর কাজকর্ম শিকেয় উঠলো। তাঁর চেতনা ও চর্চিত কন্ঠ তাকে ছুটিয়ে মারতে লাগলো একটি ফুটন্ত মাইক্রোফোনকে সামনে রেখে, হাজার মানুষের মুখোমুখি মঞ্চ থেকে মঞ্চে মঞ্চে। যে মানুষ বহুদিন কবিতার রসগ্রহণ থেকে বঞ্চিত, তিনিও যেন রবীন্দ্রনাথের নব বর্ষার মতো ঝাঁপিয়ে পড়লেন কবিতাটি সংগ্রহ করবার জন্য। এই হলো কবিতার তৃতীয় ভুবন, যেখানে কবি, পাঠক ও বাচিক শিল্পী করোনাহীন, দুঃস্বপ্নহীন মুক্ত মহাপৃথিবীতে একে অপরকে জড়িয়ে ধরলেন। জীবন হয়ে উঠলো কবিতার মতো সুন্দর।

    আজ এইটুকু বলেই থামলাম। পরের সপ্তাহে বাচিক শিল্পকে নিয়ে কথা বলা শুরু করবো।

Post a Comment

1 Comments

  1. খুব সুন্দর লেখা।

    ভালো লাগলো

    ভালোবাসা ও কবিতা শব্দ দুটির কোন প্রতিশব্দ হয়না

    ReplyDelete