জ্বলদর্চি

পথ যখন সঙ্গী -৬

পথ যখন সঙ্গী  (মুরুগুমা ড্যাম) পর্ব - ৬ 

ন রে ন  হা ল দা র
 
পুরুলিয়া জেলার ঝালদা ব্লকের অন্তর্গত বেগুনকোদর নামক এক আদিবাসি গ্রামের পাশে সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক পরিবেশে স্থিত একটি জলাশয় এই মুরুগুমা ড্যাম। এটি কংসাবতীর একটি উপনদীর উপর স্থিত। চারিদিকে সবুজ বনরাজি, তার একদিকে একটি ছোট্ট টিলা। প্রকৃতি যেন সমস্ত সৌন্দর্য দিয়ে সাজিয়ে রেখেছে এ জলাশয়কে। বর্ষার সময় এ জলাশয় কানায় কানায় পরিপূর্ণ থাকে তার ভয়ংকর মূর্তি নিয়ে। বাঁধ যদি কোনো কারণে ভেঙে যায় তো আর রক্ষা থাকবে না।
মেদিনীপুর থেকে সকাল ৫টা ১০এর খড়্গপুর-রাঁচী মেমু ধরে ঝালদা গিয়ে নামলাম দুপুর ১২টার দিকে। সেখান থেকে শেয়ার অটো ভাড়া করে মুরুগুমা, প্রায় দেড় ঘণ্টার পথ। তবে সবাই মুরুগুমা যাবে না। তারা সবাই প্রায় নিত্য যাত্রি। ঘন্টা খানেক চলার পরে অটো ফাঁকা হয়ে গেল। এখন কেবল আমরা আড়াই জন। এবারে সঙ্গে স্ত্রী ও তিন বছরের মেয়েও ছিল। অতএব পুরো ফ্যামিলি। দুপুরের খাবার কথা অটো ড্রাইভারকে জিজ্ঞাসা করলে সে রাস্তার ধারে একটা বাড়ির সামনে গাড়ি দাঁড়করিয়ে দিল। হোটেল নয়, একটা বাড়ি, সেখানেই বেঞ্চ বিছিয়ে ঘরোয়া খাবার ব্যবস্থা করা আছে। খেয়ে নিলাম। 
মুরুগুমা গিয়ে যখন পৌঁছুলাম তখন প্রায় বিকেল। এবারেও আগে থেকে রেস্ট হাউস বুক করিনি। তবে ভাগ্য ভালো বনপলাশিতে একটি রেস্ট হাউস পেয়ে গেলাম।      
এই জায়গাটি এখনও পর্যটকদের জন্য বহুল প্রচারিত হয়নি। এ জায়গাটিকে সেভাবে পর্যটন স্থল বলা যায় না, বরং বলা যায় নিরিবিলিতে একটু সময় কাটানোর জায়গা। প্রতিনিয়ত নাগরিক জটিলতায় মন এবং শরীর যখন অবসন্ন, তখন এরকম একটি নিরিবিলি জায়গায় কিছুটা সময় কাটিয়ে গেলে মন এবং শরীর দুটোই ফ্রেস হতে বাধ্য। 
এখানে তেমন জনমানব নেই। ড্যামের পশ্চিম প্রান্তে বনের ভিতর বনপলাশ ও পলাশবিতান নামে দুটি মাত্র রেস্ট হাউস। আমরা ছিলাম বনপলাশের একটি মাটির কুটিরে। তিন পাশে ফাঁকা ছোটো মাঠ আর বন। আশেপাশে কোনো মানুষের বসতি নেই, হাটবাজার নেই, গাড়ী-ঘোড়া নেই, আছে শুধু প্রকৃতির কুজন। 
দুটো রেস্ট হাউসের দশটি কুটিরে থাকা আগন্তুকদের সম্বন্ধে খোঁজ নিয়ে জেনেছিলাম কারো উদ্দেশ্যই এ জায়গা ঘোরা বা দেখা নয়, উদ্দেশ্য কিছুটা সময় কাটিয়ে যাওয়া। আরেকটা আশ্চর্য এই চৌত্রিশ বছরে আমরাই সবচেয়ে নবীন আগন্তুক, যারা জায়গাটা দেখতে এসেছে!
সন্ধ্যা নামতেই শুরু ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। অনতি দূরের টিলাগুলো মেঘে না কুয়াশায় ঢেকে গিয়েছে, বুঝতে পারা যায় না। তবে যেন একটা চাদর বিছিয়ে দিয়েছে টিলার উপর, যেমন সিকিম বা সিমলা বেড়াতে গেলে দেখা যায়। সন্ধ্যা নামতেই চারিদিক অন্ধকার। কেবলমাত্র দশটা কুটিরের ভিতর আবছা আলো। এখন বাহির আর মন এক। ভেতর থেকে যেমন প্রতিটা মানুষ একা তেমনি এইখানে, এই মুহূর্তে বাইরে থেকেও একা। এ একার কোনো দোসর নেই, কারো সাড়া পাওয়া যাবে না হাজার চিৎকার করলেও। কষ্ট-দুঃখ-বেদনা-আনন্দ সব একাকার হয়ে গেছে প্রকৃতির সঙ্গে। আমি নির্বিকার। সৃষ্টি কর্তাকে ধন্যবাদ এ প্রকৃতি দেখার সুযোগ দিয়েছেন তিনি আমাকে। 

Post a Comment

0 Comments