জ্বলদর্চি

বিজ্ঞানে ঈশ্বরের চিহ্ন- ১০

বিজ্ঞানে ঈশ্বরের চিহ্ন

পর্ব ― ১০ 

পূ র্ণ চ ন্দ্র  ভূ ঞ্যা

মহাকালের ফসিলস

এই অপূর্ব সুন্দর ব্রম্ভাণ্ডের শুভ জন্মক্ষণটি কবে ? পণ্ডিতদের মতে ১৩.৮ বিলিয়ন বছর আগে একটি বিস্ফোরণ থেকে এই মহাজাগতিক বিশ্বের জন্ম। কেন ? কোন তথ্য বা তত্ত্বের ওপর নির্ভর করে তারা এমন স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছলেন ? কোন টাইম মেশিনে চড়ে আলোকের বেগে  অতীত ভ্রমণ করলেও তো কোটি কোটি বছর লেগে যাবে সে-ক্ষণে পৌঁছতে ? তাহলে কীভাবে সম্ভব নির্ভুল গণনা ?

পৃথিবীর বয়স নির্ণয়ের সময় আমরা ইউরেনিয়াম-লেড ডেটিং গণনার সাহায্য নিই। কারণ অস্থির ইউরেনিয়াম মৌলের অর্ধজীবনকাল অনেক বেশি। প্রায় ৪৫০ কোটি বছর। তাই ৫০০ কোটি বছর বয়সের পৃথিবীর জন্মকাল নির্ণয়ে কোন সমস্যা হয়নি। ভূ-ত্বকের একখণ্ড শিলায় যত ইউরেনিয়াম অবশিষ্ট আছে তার সঙ্গে ইউরেনিয়াম-ক্ষয়ে-সৃষ্ট সিসার ওজন অনুপাত থেকে পৃথিবীর বয়েস নির্ণয় করা বেশ সহজ কাজ। কিন্তু ব্রম্ভাণ্ডের বয়স ? নৈব নৈব চ। অত সহজ না ব্যাপারখানা। আবার নিরবচ্ছিন্ন সময় একটানা লেগে থাকার পর পেলেও পেতে পারি সে অমূল্য রতন। 

এমন কোন জিনিস আছে যা বিগ-ব্যাঙ সময় থেকে আজ পর্যন্ত শূন্যস্থানের অন্ধকারে লুকিয়ে আছে ? তারই সন্ধানে পণ্ডিতরা হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন দীর্ঘ সময়। অবশেষে সাফল্য আসে ১৯৬৪ সালের ২০শে মে তারিখে। সেদিন বিজ্ঞানীদ্বয় পেনজিয়াস এবং উইলসন ঘোষণা
                                
করেন, মহাকাশের ফসিলস-এর খোঁজ তাঁরা পেয়ে গেছেন। 
                                   
এ হেন ফসিলস-এর পতনহার গণনা করে সহজে অনুমান করা যায় ব্রম্ভাণ্ডের বয়স কত।  কিন্তু মহাকাশের ফসিলস ? সে আবার কী জিনিস ?

আসলে বিগব্যাঙ বিস্ফোরণকালে ক্ষুদ্র কিন্তু নব্য ব্রম্ভাণ্ড খুব উচ্চ শক্তির তড়িৎচুম্বকীয় বিকিরণে পরিপূর্ণ ছিল। তখন না ছিল পদার্থ অথবা না কোন ভর। দশদিকে কেবল আলো আর আলো। সেই আলো থেকে সবার প্রথম জন্ম নেয় ওজনহীন পদার্থ। তারপর সমতার নীতি ভেঙে পদার্থে ভরের আগমন ঘটে। শূন্যস্থানে এখনও সে-খেলা প্রতিনিয়ত চলে। অত্যাধিক উত্তাপে বিকিরণ থেকে জন্ম নিচ্ছে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম কণিকা ও কণা থেকে বিকিরণ। অবশ্য এ হেন বিনিময়ের একটি সূচনা শক্তি (Threshold Energy) আছে। যে কোন শক্তিতে বিকিরণ থেকে যেমন কণা ও বিপরীত কণা জন্ম নেয় না, আবার বাহ্যিক কারণ ছাড়া পারটিক্যাল-অ্যান্টিপারটিক্যাল জোড়া লেগেও জন্ম নেবে না আলোক তরঙ্গ। আবার প্রত্যেক কণার সূচনা শক্তিও আলাদা আলাদা রকমের, সামঞ্জস্য নেই একজনের সঙ্গে অন্যের। যে পরিমাণ ন্যুনতম শক্তিতে বিকিরণ থেকে প্রোটন জন্ম নেয়, সেই একই ক্ষমতায় ইলেকট্রন জন্মায় না। বরং তার থেকে অনেক কম শক্তি পেলে ইলেকট্রন তৈরি করা যায়। আমাদের আলোচ্য বিষয় অবশ্য তা নয়।

এ হেন ব্রম্ভাণ্ডের সৃষ্টিলগ্নে দু'রকম জিনিসের অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায় ― প্রথমতঃ বিকিরণ এবং দ্বিতীয় বিস্ফোরণের পর অসমতা থেকে আবির্ভূত ভরযুক্ত কণিকা ইলেকট্রন, প্রোটন, কোয়ার্ক ইত্যাদি। পদার্থের এই প্রাথমিক স্থিতিশীল কণাসমূহের মধ্যে একমাত্র প্রোটন কণার ক্ষয় আছে। কিন্তু সেই প্রোটন কণার বিনাশ দেখার সৌভাগ্য বোধ হয় মহাবিশ্বে কারও পক্ষে সম্ভব না। কারণ তার দীর্ঘ জীবনকাল। একটি প্রোটনের আয়ু ১০^৩১ বছর বা তার বেশি। আর এখন ব্রম্ভাণ্ডের বয়স মাত্র ১৩.৮ × ১০^১০ বছর। সেক্ষেত্রে বিগব্যাঙের অব্যহতি পরে যে প্রোটনের আবির্ভাব, তার লয় দেখতে হলে আমাদের ১০^৩১ বছর বা তার বেশি সময় অপেক্ষা করতে হবে। অথচ পণ্ডিতদের অনুমান তার অনেক আগেই শুধু পৃথিবী কেন, এই ব্রম্ভাণ্ড থেকে ভ্যানিশ হয়ে যাবে প্রাণের স্পন্দন। তখন না থাকবে জীবন, না থাকবে গ্রহ-তারা-নক্ষত্রের আলাদা অস্তিত্ব। পড়ে থাকবে নিকষ কালো কিছু বস্তু।

তাছাড়া প্রোটন ক্ষয়ের নিখুঁত হিসাব কষে একদম বিগ-ব্যাঙ বিস্ফোরণকালে পৌঁছনো সম্ভব কি ? সম্ভবত না। বড়জোর বিস্ফোরণের অব্যহতি পরে প্রোটনের উৎপত্তি কালে পৌঁছনো যেতে পারে, এর বেশি নয়। 
                                   
সুতরাং ব্রম্ভাণ্ডের বয়স নির্ণয়ের একমাত্র সঠিক ও শেষ উপায় হল বিগব্যাঙ সময়কালে উৎপন্ন তড়িৎচুম্বকীয় বিকিরণের সন্ধান করা। তার ছেড়ে যাওয়া পথের চিহ্ন ধরে হয়তো বা তার নিকট পৌঁছনো সম্ভব হতে পারে। কিন্তু এত উচ্চ শক্তির বিকিরণের সাক্ষাৎ শূন্যস্থানের খোলা জায়গায় এখন পাওয়া অসম্ভব। একমাত্র কোন নক্ষত্র বা তারকার পেটের মধ্যে লুকিয়ে থাকতে পারে সে।  সেখানেও সমস্যা আছে। তারকার অভ্যন্তরে যে বিকিরণ, তার ভাঙাগড়া নির্ভর করে একটি ঘটনার ওপর। তা হল নিউক্লিয় সংযোজন। এ হেন সংযোজন প্রক্রিয়ায় উৎপাদিত শক্তির মধ্যে খুবই ক্ষুদ্র থেকে উচ্চ কম্পাঙ্কের শক্তি মিশে থাকে। তা থেকে বিশ্বের শুরুর সময়ের বৃহৎ শক্তি শনাক্ত করা মুশকিল। জটিলও বটে। তাই তেমন শক্তি তারার গর্ভে খোঁজ করে লাভ নেই। খোঁজ পেলেও তাকে সনাক্ত করা চাট্টিখানি কথা নয়। তাছাড়া বিগব্যাঙের উচ্চ কম্পাঙ্কের শক্তি বিশ্বের প্রসারণের ফলে এতদিনে নীচু কম্পাঙ্কের শক্তিতে নিশ্চয়ই পরিনত হয়েছে। কারণ প্রসারিত হতে হতে ব্রম্ভাণ্ড এমন একটি আয়তনে পৌঁছে গেছে এখন, আদিম বিকিরণের লাল সরণের অর্থাৎ শক্তি তরঙ্গের কম্পাঙ্ক কমে তার তরঙ্গদৈর্ঘ্য অধিক মাত্রায় বেড়েছে। এমন বিশালাকার তরঙ্গের কম্পাঙ্ক এখন মাইক্রোওয়েভের পাল্লায় পাওয়া সম্ভব।  

তাই খোলা আকাশে শূন্যস্থানে যেখানে এখনও পৌঁছয়নি তারার আলো, সেখানে শিকারি বাঘের মতো খুঁজতে হবে তাকে। সেক্ষেত্রে প্রসারণশীল বিশ্বের প্রসারণশীলতার জন্য বিগ-ব্যাঙ সময়কার উচ্চ বিকিরণের উত্তাপ এখন কমে মাইক্রোত‍রঙ্গে নেমে গেলেও এ হেন উষ্ণতার সঠিক মান কত ?
                               
সোভিয়েত-আমেরিকান ফিজিসিস্ট জর্জ গ্যামো (১৯০৪ ― ১৯৬৮) চটজলদি একটি কাগজে হিসেব করে বললেন বিগব্যাঙের অবশেষ এখন বিশ্বের তাপমাত্রা হবে প্রায় ৫০° কেলভিন। সেটা ১৯৪৮ সাল। কিন্তু তাঁর সহযোগী মহাকাশবিজ্ঞানী রালফ আলফার (১৯২১ ― ২০০৭) ও গনিতজ্ঞ রবার্ট হারম্যান (১৯৩১ ― ২০২০) গ্যামোর হিসেবে দু-একটি সংশোধন করে দেখালেন, বিশ্বের পটভূমি বিকিরণের উষ্ণতা হবে প্রায় ৫° কেলভিন। কতটা বিশ্বাসযোগ্য এমন গণনা ?

এবার উন্নততর অ্যান্টেনার সাহায্যে পটভূমি বিকিরণের নির্ভুল উষ্ণতার পাঠ দিলেন বেল ল্যাবরেটরির দুই বিজ্ঞানী অর্নো অ্যালান পেনজিয়াস (জন্ম : ২৬ এপ্রিল, ১৯৩৩) ও রবার্ট উইলসন (জন্ম : ১০ জানুয়ারি, ১৯৩৬)।
                               
    
১৯৬৪ সালে। দশ হাজার ভাগের এক ভাগ সূক্ষ্মতায় অঙ্ক কষে তারা বলে দিলেন, মহাবিশ্ব আসলে ডুবে আছে প্রায় ০.১ সেন্টিমিটার তরঙ্গদৈর্ঘের মাইক্রোত‍রঙ্গে। আর এ হেন মাইক্রোওয়েভ বিকিরণের উষ্ণতা মাত্র ২.৭২৫° কেলভিন বা –২৭০.৪১৫ ℃। এই উষ্ণতা সারা বিশ্বে নয়েজের মতো সবদিকে সমানভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এটাই সম্ভবত মহাবিশ্বের কসমিক মাইক্রোত‍রঙ্গ পটভূমি বিকিরণের সমতুল্য উষ্ণতা। আর একেই মহাকালের ফসিলস নামে চিহ্নিত করেছেন পণ্ডিতগণ। এই আবিষ্কারের জন্যে ১৯৭৮ সালের নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন বিজ্ঞানীদ্বয়। কিন্তু মহাবিস্ফোরণকালের ফসিলের উষ্ণতার পাঠ সঠিক মাত্রায় পরিমাপ কতখানি সম্ভব ? 

পরে ১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দে মহাকাশে পাঠান হল কৃত্রিম উপগ্রহ COBE (Cosmic Background Explorer)। এতে আরও সুক্ষ্ম পরিমাপের জন্য ব্যবহৃত Differential Microwave Radiometer যন্ত্রের রিডিং থেকে CMB (Cosmic Microwave Background ― কসমিক মাইক্রোত‍রঙ্গ পটভূমি) বিকিরণের উষ্ণতার পাঠ লক্ষভাগের একভাগ সূক্ষ্মতায় যাচাই করে নিশ্চিত হলেন পণ্ডিতগণ ― শূন্যস্থানে ছড়িয়ে পড়া ২.৭৩৫ °K উষ্ণতার মাইক্রোত‍রঙ্গ সেই আদিম বিশ্বসৃষ্টির ফসিল, এ বিষয়ে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই।

Post a Comment

0 Comments