জ্বলদর্চি

নতুন চাঁদের স্বরলিপি/ শু ভ্রা শ্রী মা ই তি

    ফটোগ্রাফি - সৈয়দ  স্নেহাংশু  


নতুন চাঁদের স্বরলিপি

শু ভ্রা শ্রী  মা ই তি

চাঁদের গায়ে নরম জোছনার স্বরলিপি।
একটা পূর্ণচাঁদের স্বরলিপি লিখব বলে
হৃদয়কে অনুভব করেছিলাম কবেই।
কলমে ভরেছিলাম নদীজলের কোমল কল্লোল।
আদর করে ভাসিয়েছিলাম কৃষ্ণা দ্বাদশীর চাঁদের শাম্পান আলতো ঢেউয়ে।
মাটিমাখা পাড়ের সবুজ রেখা ছুঁয়ে ছুঁয়ে এঁকে রেখেছিলাম
জলঝাঁঝির গন্ধমাখা এক আলোর কবিতা।

ভোরের মিঠে রোদের কাছে চেয়ে নিয়েছিলাম
কার্তিকের খেত আর ফলন্ত ফসলের উপমা।
যেভাবে চাঁদগুঁড়ো জমা হত শস্যমাখা ইঁদুরের ঠোঁটে।
যেভাবে দুধ এসে জমা হত সোনালী ধানের বুকে
সেভাবেই ভরে নিতাম কবিতার মন নবান্নের মিঠে স্বাদে
ধূপছায়া রোদ আর জোছনাকে ভালবেসে।

তখনও সন্ধ্যা নামত দিগন্তের নাভি ছুঁয়ে ধীর পায়ে।
ক্লান্ত ঘুঘুর ডানা চুঁয়ে ঝরত গুঁড়ো গুঁড়ো চাঁদ আলো জীবনের দেশে।
তুলসীতলার মাটি ছুঁয়ে সন্ধ্যার শাঁখের শব্দ যেভাবে মিশে যেত মসজিদের আজানের সুরে
সেভাবেই মিশে যেত আমার কবিতাখানি
জোনাকের আলোমাখা চাঁদফুল স্বপ্নের দেশে।

এখন চাঁদের বুকে কাটাকাটি দাগ বেদনার কূপ খুঁড়ে চলে।
চরকা থেমে গেছে কবেই,জং ধরা মরিচার বেশে।
চাঁদবুড়ী জ্বরে কাঁপে শুধু,পেঁজা তুলো স্বপ্নেরা ভয়ে মরে।
তবু এক রুগ্ন চাঁদ আজও ওঠে আকাশের গায়ে।
আজও ফেরে ক্লান্ত ডানা দিনান্তের দেশে।
শুধু কলরব থেমে গেছে কিছু।
নির্জন নীরবতা ঝরে পড়ে পালকের মতো
হেমন্তের শূন্য হাওয়ার দেশে।

এখানে ধানের তুষে মৃত্যুগন্ধ মিশে আছে জানি।
রাতপেঁচা ডেকে যায় চাঁদহীন জানালার পাশে।
রোদে মেলা ধানে,ভেজা ভেজা সন্দেহ বাতাস
চুপিচুপি পা রাখে পাগড়ী আঁটা শমনের বেশে।
সব ধান এখনও হয়নি শুকানো, রোদের রঙ গেছে বুড়িয়ে
মাঠে মরাই-এর কত কাজ বাকি, এখনো রয়েছে সব ছড়িয়ে।

এখন গাছেরা কাঁদে অসহায় জঙ্গম স্হবিরতায়।
ঝাঁঝরা ফুসফুসে কাক এসে ডাকে কর্কশ স্বরে।
নিভে আসা চাঁদ আলো বিষণ্ণতার চাদর মুড়ে নিলে
অনন্তের ডাক শুধু ভেসে আসে অন্য পার থেকে।
ডাক এলে চলে যেতে হয় বহুদূরে।
নষ্টচাঁদের কবিতায় অনুভব কেঁদে মরে।

এখানে এখন পর্ণমোচী ঋতুরা শুধু কথা বলে।
চোখে চোখে বান আসে,ঢেউ ওঠে দিনে আর রাতে।
এখন চাঁদের পরিযায়ী বুকে মৃত্যুগন্ধী ক্ষত।
ঘরে ফেরার রাস্তা ফেলেছে হারিয়ে।
শূন্য চুলার ধিকি ধিকি আঁচে আজ
খিদের আগুনে চাঁদ শুধু জ্বলে পোড়ে।
শরীরে শরীরে তবু কাঁটারোদ খিদে আর তাপে বাড়ে।

চন্দ্রমুখীর ঘর আজকেও খালি
মরা চোখে তাও সে কাজল আঁকে।
জোছনা বন্দী কোয়ারেনটাইন সেলে
কেউ আসে না তাকে ফিরিয়ে নিতে।
কত কাঁচা পাতা উড়ে গেছে আজ নষ্টরাতের ঝড়ে
পিপিই পরা কালো কালো মুখ কড়া নাড়ে দরজাতে।

তারারা আজ ভীষণ অবিশ্বাসী।
পাঁচিল তুলেছে যে যার মতো করে।
আলোর আলাপ বন্ধ হয়েছে জানি
চাঁদ আজ তাই কাঁদে দীর্ঘশ্বাসে।
এত চলে যাওয়া,এত কালো শোক,দূরত্ব ঘরে ঘরে
হাতের পরে হাত রাখা যে কতটা কঠিন,বুঝেছি তা মনে প্রাণে।

পাহাড় পাহাড় মেঘ জমেছে আকাশে আর মনে
শ্রাবণ তবু নেয়নি কাছে ডেকে।
তীব্র দহনে মেঘমাটি মেখে মরা চাঁদ কেঁদে ওঠে।
চাঁদের অসুখ বেড়েই চলে দিনে রাতে।
জবাব দিয়েছে ডাক্তার মাথা নেড়ে
হিম হিম ফোঁটা জমাট বেঁধেছে ভেন্টিলেশন কাঁচে।
কবিতা এখন ফসলশূন্য মাঠ। 
কথার আগাছা এখানে ওখানে বাড়ে।
আড়াআড়ি শোয়া কাঁটাপ্রাচীরের মাঝে
নষ্টচাঁদের কথকতা জমে ওঠে।

তবু রাধু বোষ্টমীর খঞ্জনি বাজে ঠুং ঠুং।
তবু জ্বলে ওঠে জোনাকেরা ঝোপে ঝাড়ে।
বীরু পাগলা গান ধরেছে রাতে,
ভীরু জোছনা লেগে থাকে তার ঠোঁটে।
গরম ভাতের গন্ধে জেগেছে বাতাস
উনুনের ধোঁয়া জীবনের কথা বলে।
এত মায়া প্রাণে,এত মায়া গানে,
ফুলে জেগে ওঠে ভোর।
প্রজাপতি পাখা ডানা ছড়িয়ে 
রঙ মাখে উতরোল।

মায়ের মুখে আজ বোধনের আলো।
বৈরাগী সুর একতারাতে বাজে।
নষ্টচাঁদের কাজল মুছে গিয়ে
পুব আকাশে ফুলেরই রঙ লাগে।
সাজিয়ে নিলাম জীবনপুজোর থালা।
আলপনাতে লক্ষ্মীপায়ের ছবি।
শিশিরজলে ধুইয়ে নেওয়া চোখে
আশার অমল প্রদীপ জ্বেলে রাখি।
আসুক যে ঝড়, ঝঞ্ঝা,তুফান ভারি
বাঁচার মন্ত্রে বেঁধেছি দহন সুখ।
হাত রেখেছি আজকে হাতের পরে
 আলোর গানে ভরেছি গহন বুক।

সেই আশ্বাসে,শ্বাসে বিশ্বাসে কবিতা যে পথ চলে
নতুন চাঁদের স্বরলিপিতে অনুভব কথা বলে।

   ফটোগ্রাফি - সৈয়দ  স্নেহাংশু  

Post a Comment

0 Comments