বিজ্ঞানে ঈশ্বরের চিহ্ন
পর্ব ― ৯
পূ র্ণ চ ন্দ্র ভূ ঞ্যা
প্রাণের ধ্বংস
২১ ডিসেম্বর, ২০১২ খ্রিস্টাব্দ। শুক্রবার। গভীর উৎকণ্ঠায় কৃষ্ণের অষ্টোত্তর নামের মহিমা জপ করছে পৃথিবীসুদ্ধ মানুষ। অলৌকিক কর্মকাণ্ডের হাত থেকে পরিত্রাণের আশায়। দেবতা-অসুর সমুদ্র মন্থনে উদ্গত অমৃতের ন্যায় ধরিত্রীর রক্ষাকবচ পাওয়া যাবে কি ? যা পান করলে বা শরীরে ধারণ করলে এ যাত্রায় টিকে থাকবে প্রাণের সলতে। তাই পাল্লা দিয়ে চলছে মন্দিরে মন্দিরে পূজার্চনা-যাগযজ্ঞ, চার্চে প্রার্থনা এবং মসজিদে নমাজ। যেন একমাত্র পরমেশ্বরই পারেন তাদের রক্ষা করতে ! কারণ আজ সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়েছে কাউন্টডাউন। পৃথিবী ধ্বংসের। যেকোন মূহুর্তে ছিন্ন ভিন্ন হবে নীলাভ মেদিনী। মানুষ হয় মৃত্যু বরণ করবে, নতুবা মহাশূন্যে তার অস্থি ভাসবে। অতএব ঈশ্বর বন্দনা ব্যতীত পরিত্রাণের দ্বিতীয় পথ বন্ধ।
ঘটনাটা কী ? ঘটনা হল এ দিন না-কি পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। কোথাও থাকবে না প্রাণের চিহ্ন, জীবনের অস্তিত্ব। নাসা ব্লগ ট্যাগ করে এমনই টাটকা খবর প্রচার করে আসছে বেশ কিছু ইলেকট্রনিক মিডিয়া। বেশ কিছু কাল যাবৎ। যেহেতু নাসা ট্যাগ হয়ে আছে, সাধারণ মানুষের মনে সহজে বিশ্বাসযোগ্য হয় এ হেন সংবাদটি। নিউজ পেপারের প্রথম পাতায়, টেলিভিশনের লাইভ অনুষ্ঠানে, মোবাইল ফোনে সরাসরি যুক্তিতর্ক সহ জুতা সেলাই থেকে চণ্ডীপুজা পর্যন্ত সকল ফিরিস্তির লাইভ টেলিকাস্ট চলে। কোন তথ্যের উপর ভিত্তি করে এমন নিউজ ?
তিনটি সম্ভাবনার কথা বলা হয়েছে। প্রথমত: আজ মায়া ক্যালেন্ডারে অন্তিম দিন। এক পূর্ণ চক্রের অবসান। আজকের পর কোন তারিখ নথিভুক্ত নেই ক্যালেন্ডারে। তাই মায়া সভ্যতার অধিবাসীদের বদ্ধমূল ধারণা আজকের দিনে শেষ হয়ে যাবে পৃথিবী। তারপর নতুনভাবে শুরু হবে সবকিছু।
দ্বিতীয়ত: পৃথিবীর সমান আকৃতির গ্রহ নিবিরু, যা প্ল্যানেট - X নামেও পরিচিত, পৃথিবী লক্ষ্য করে ছুটে আসছে তীব্র বেগে। আজকের দিনে তার আছড়ে পড়ার কথা পৃথিবীর উপর। তখন নিমেষে ধ্বংস হবে গাছপালা, জীবজন্তু, মানুষ ইত্যাদি। বাস্তবে আজ পর্যন্ত এমন গ্রহ দেখা যায়নি।
তৃতীয় সম্ভাব্য কারণ ― ২০১২ সালের শেষে সার্নের লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডরে শুরু হওয়া প্রোটন-প্রোটন সংঘর্ষ। সে-সংঘর্ষে কত পরিমাণ শক্তি উৎপাদন হতে পারে, তার পূর্বাভাস পণ্ডিতদের অনুমান নির্ভর। এই শক্তির হিসেব কতটা বিশ্বাসযোগ্য ? যেমন পরমাণু বোমার বিস্ফোরণের সময় যে পরিমাণ শক্তি নির্গত হওয়ার কথা পণ্ডিতগণ ঘোষণা করেছিলেন, বাস্তবে তার চেয়ে অধিক শক্তি সেদিন বিজ্ঞানীদের গণনা ভুল প্রমাণিত করেছিল। সেদিন ক্ষয়ক্ষতির পরিসংখ্যান ছিল কল্পনাতীত। এবারও হয়ত গণনার অধিক বিপুল শক্তি উৎপন্ন হল এবং সেই উৎপাদিত শক্তি ধ্বংস করে দিল গোটা পৃথিবী ― অমূলক নয় সে-সম্ভাবনাও।
অথচ তারপরেও অবিকৃত অবস্থায় দিব্যি বিরাজ করছে সুজলা সুফলা মেদিনী। অতীতের টাটকা খবর ভুয়া প্রমাণ করে। তাহলে উপরে উদ্ধৃত ঘটনাগুলো কি অস্থির মনের কাল্পনিক প্রোপাগান্ডা ছাড়া অন্য কিছু নয় ? এ কথা সম্ভবত বলাও যাবে না। প্রচলিত গনিতের নিয়ম মেনে একদিন না একদিন পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হবে প্রাণ। হয়ত কোটি কোটি বৎসর পরে ধ্বংস হবে পৃথিবী সুদ্ধ এ সৌর-সংসার। তেমন সম্ভাবনার কথা বিজ্ঞানের ইতিহাসে উজ্জ্বল অক্ষরে লেখা। কিন্তু তার আগেও নিশ্চিহ্ন হতে পারে সবকিছু। তেমন কুড়ি বা তার বেশি সম্ভাব্য কারণ আছে, প্রিয় পাঠক। এই কুড়িটির যেকোন একটি কারণ প্রাণের বিলুপ্ত হওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। আর তেমন সম্ভাবনা থাকলে শেষের সেদিন খুব বেশি দূরে নয়, বন্ধু।
পৃথিবী থেকে প্রাণ বিলুপ্তির কারণগুলো চারটি আলাদা আলাদা শ্রেণীতে ভাগ করা যায় ―
(a) প্রাকৃতিক বিপর্যয়
(b) মনুষ্য সৃষ্ট বিপর্যয়
(c) ইচ্ছাকৃত স্ব-নিধন
(d) আমাদের বিরুদ্ধে চালিত বৃহত্তর শক্তি
■ প্রাকৃতিক বিপর্যয় :
●(০১) গ্রহাণু প্রভাব :
১৯০৮ সালের ৩০-শে জুন। সময় সকাল ৭:১৪ -এর আশপাশ। রাশিয়ার মধ্য সাইবেরিয়া অঞ্চল তাইগার পাইন বনভূমিতে ঘটে গেল এ যাবৎ কালের সবচেয়ে বড়সড় প্রাকৃতিক দুর্যোগ। আছড়ে পড়ল গ্রহাণু। আকারে একশ মিটার লম্বা উল্কাপিণ্ডের সরাসরি আঘাতে বায়ুস্তম্ভ ফেটে যাওয়ার কারণে বিস্তীর্ণ অঞ্চল , প্রায় ২১৫০ বর্গকিমি জায়গা জুড়ে নিশ্চিহ্ন অরণ্য। এ হেন দুর্ঘটনার ক্ষমতা হিরোশিমায় নিক্ষিপ্ত হাজার এ্যাটম বোমার সমান।
ছোট বড় এমন আরও অনেক বস্তুপিণ্ড আছড়ে পড়েছে পৃথিবীর বুকে। কত শত গ্রহাণু তো সংঘর্ষ এড়িয়ে হারিয়ে গেছে শূন্যস্থানের অন্ধকারে। অল্পের জন্য রক্ষা পেয়েছে পৃথিবী। এই তো সেদিন ১৬ অগাস্ট ২০২০, দক্ষিণ ভারত মহাসাগরের ১৮৩০ মাইল উপর দিয়ে ২০২০QG নামের উল্কাপিণ্ড ছুটে আসছিল এদিকে। ভাগ্যের জোরে ধাক্কা মারেনি। উল্কাবৃষ্টি কিন্তু পরীক্ষার প্রশ্ন পত্রের মতো একবার না, বারবার ফিরে আসবে। একসঙ্গে একঝাঁক উল্কা বিভিন্ন জায়গায় আঘাত হানলে টিকবে তো প্রাণের অস্তিত্ব ?
●(০২) গামা রশ্মি ফেটে যাওয়া :
গামা রশ্মি আসলে উচ্চ কম্পাঙ্কের তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ। এক্স-রশ্মির চেয়ে অধিক ক্ষমতা এই তরঙ্গের। গ্যাসের অণু-পরমাণু সহজে আয়নিত হয় এর প্রভাবে। এর উৎসস্থল পরমাণুর নিউক্লিয়াস। ইউরেনিয়াম, রেডিয়াম, থোরিয়াম প্রভৃতি প্রাকৃতিক তেজস্ক্রিয় মৌল। এদের নিউক্লিয়াস খুব অস্থির। সহজে উপাদান প্রোটন ও নিউট্রনে ভেঙ্গে যায়। নিউক্লিয়াসের ভাঙনে, আইনস্টাইনের E=mC^2 নিয়ম মেনে, নিউক্লিয়াসের অতিরিক্ত ওজন শক্তি হিসেবে নির্গত হয়। এই শক্তি গামা বিকিরণ।
ব্রম্ভাণ্ডে গামা রশ্মি ফেটে পড়ার ঘটনা দূরের গ্যালাক্সিতে ঘটে। গ্যালাক্সির দুটো সংকুচিত তারার সংঘাতে তৈরি হতে পারে গামা বিকিরণ। এ হেন বিকিরণের ক্ষমতা ১০ কোয়াড্রিলিয়ন (১০^১৬) সৌর কিরণের সমান। তাই ১০০০ আলোকবর্ষ দূরে এমন ঘটনা ঘটলেও এ বিকিরণের ঢেউ সূর্যের মতো তীব্রতায় পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে আছড়ে পড়বে। তখন বায়ুর নাইট্রোজেন পরিনত হবে নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইডে। এই অক্সাইড ওজোন স্তরে ফুটো তৈরি করবে। সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি ওই গর্ত ভেদ করে পৌঁছে যাবে ভূপৃষ্ঠে। মানুষ ত্বক ক্যান্সারে আক্রান্ত হবে। ধ্বংস হবে সমুদ্রের লক্ষ লক্ষ ফোটোসিন্থেটিক প্ল্যাঙ্কটন। প্ল্যাঙ্কটনের অভাবে বাতাসে অক্সিজেন সরবরাহ হ্রাস পাবে।
●(০৩) শূন্যতার পতন
আধুনিক কসমোলোজীর মতে, একটি বিন্দু থেকে ব্রম্ভাণ্ডের জন্ম। বিগ-ব্যাঙ সময়কার ঘটনা-বর্তমানের পর সেই বিন্দু প্রসারিত হচ্ছে আলোকীয় বেগে। দূর দূরান্তে ব্রম্ভাণ্ডের সীমানা বাড়িয়ে চলছে। আর তাই ব্রম্ভাণ্ড আজকের অবস্থায় পৌঁছেছে। মহাবিশ্বের সীমা আলোর গমন পথের দ্বারা নির্ধারিত হয়, শূন্যস্থানের নিজস্ব পরিমাপ দিয়ে নয়। প্রসারিত হয়ে যত বেশি দূর আলো পৌঁছবে, সেটাই স্পেসের শেষ সীমা হিসাবে গণ্য হবে। তাই প্রতিদিন শূন্যস্থানের পরিধি বাড়ছে, ডপলার চ্যুতি তেমন ইঙ্গিত দেয়।
এখন আমরা সকলে মহাবিষ্ফোরণের ঘটনা-বর্তমানের ভবিষ্যৎ আলোক শঙ্কুর মধ্যে অবস্থান করছি। ভবিষ্যৎ আলোক শঙ্কু এখন প্রসারণ দশায় রয়েছে। প্রসারণের শেষে শুরু হবে সংকোচন। সংকুচিত হতে হতে শূন্যস্থান পুনরায় একটি বিন্দুর আকার নেবে। আর এটাই বিগ-ক্রানচ। বিগ-ক্রানচের মধ্য দিয়ে শূন্যতার পতন সম্পূর্ণ হবে।
●(০৪) দুর্বৃত্ত ব্ল্যাক হোল
ব্ল্যাক হোল ব্রম্ভাণ্ডের তেমনই এক কালো দৈত্য যে তার কাছাকাছি আসা সমস্ত বস্তুকে শুধু গিলে খায়, একফোঁটা উগরে বের দেয় না। শুধু বস্তু নয়, ভরহীন আলোকেও নিমেষে উদরস্থ করে। তারকার মৃত্যু জন্ম দেয় আস্ত এক ব্ল্যাক হোলের। এ বিষয়ে পরে আরও বিস্তারিত আলোচনা হবে, প্রিয় পাঠক।
প্রতিটি গ্যালাক্সি হাজার হাজার এ রকম ব্ল্যাক হোলে ভর্তি। আমাদের আকাশ-গঙ্গায় ১০ মিলিয়ন থেকে এক বিলিয়ন ব্ল্যাক হোল আছে। আমাদের সবচেয়ে কাছের ব্ল্যাক হোলটি প্রায় ১১০০ আলোকবর্ষ দূরে। আকাশ গঙ্গার কোন একটি ব্ল্যাক হোলের কাছাকাছি পৃথিবী আসলে, তাকে আস্ত গিলে খাবে সে কালো দৈত্য।
●(০৫) দৈত্য সৌর শিখা :
হঠাৎ একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে হয়ত দেখব মোবাইলে সিগন্যাল নেই, স্যাটেলাইট কম্যুউনিকেশন ভেঙে পড়েছে, আবহাওয়ার পূর্বাভাস কাজ করছে না, বাতাসে আগুনের গোলা। পুরো পৃথিবীর যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন সৌর ঝড়ের সৌজন্যে।
সৌর ঝড় কী ? পৃথিবীর সব শক্তির উৎস হল সূর্য। তার অভ্যন্তরে প্রতিনিয়ত ঘটছে এক ঘটনা। নিউক্লিয় সংযোজন। দুই-এর বেশি হাইড্রোজেন নিউক্লিয়াস সংযুক্ত হয়ে অপেক্ষাকৃত ভারী হিলিয়াম নিউক্লিয়াস তৈরি করে। এ হেন বিক্রিয়ায় প্রচুর শক্তি মুক্ত হয়। সেই শক্তিই সৌর বিকিরণ। এমন মাঝে সৌর কলঙ্কে প্রতিনিয়ত ঘটছে ছোট বড় বিস্ফোরণ। এই বিস্ফোরণে তৈরি হচ্ছে বড় বড় তরঙ্গ, যা ছিটকে বের হচ্ছে সূর্য থেকে, সবদিকে। ছিটকে বেরিয়ে আসা এই বিকিরণ হল সৌর ঝড়। তা থেকে তৈরি হতে পারে বিপুল মাত্রার চৌম্বকীয় ক্ষেত্র। তখন ক্ষতিগ্রস্ত হয় টেলি-কম্যুউনিকেশন, পাওয়ার গ্রিড ও জিপিএস ব্যবস্থা। আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশনে বিজ্ঞানীদের জীবন সংশয় দেখা যায়। খুব বড় সৌর ঝড়ে বায়ুমণ্ডলে ইলেকট্রন ও প্রোটনের ব্যবহার বদলে যায়। বাতাসে আগুনের গোলা তৈরি হতে পারে। সেই গোলা মাটিতে নেমে এলে সবকিছু পুড়ে ছাই হবে নিমেষে।
●(০৬) ভূ-চৌম্বক ক্ষেত্রের ওলটপালট:
আগের পর্বে আমরা জেনেছি পৃথিবীর আউটার কোরের লোহা ও নিকেল মিশ্রিত গলিত লাভার ঘূর্ণনে যে তড়িৎ প্রবাহ সৃষ্টি হয়, তেমন পরিবর্তী প্রবাহ থেকে ভূ-চৌম্বক ক্ষেত্রের আবির্ভাব। কিন্তু এ হেন চৌম্বকক্ষেত্রে নাকি ফাটল ধরেছে। এমনই অভিমত নাসার ভূ-বিজ্ঞানীকুলের। গত শতাব্দীর সাতের দশকে বিজ্ঞানীরা লক্ষ্য করেন ভূ-চৌম্বকক্ষেত্র ক্রমশ দুর্বল হতে শুরু করে। তখনই এই চৌম্বক ক্ষেত্রের ফাটল ধরা পড়ে। ফাটল তৈরি হয়েছে দক্ষিণ আমেরিকা এবং দক্ষিণ আটলান্টিক মহাসাগরের উপরে থাকা পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্রে। এর নাম 'সাউথ আটলান্টিক অ্যানোমালি' (S.A.A.)। সম্প্রতি ফাটলটি ভেঙ্গে দু'টুকরো হয়েছে বলে বিজ্ঞানীদের সন্দেহ।
এমন সন্দেহের কারণ কী ?
আমরা জানি, প্রতি এক লক্ষ বছর পরে পরে পৃথিবীর ভূ-চৌম্বক মেরু অদলবদল হয়। অর্থাৎ উত্তর মেরু বনে যায় দক্ষিণ মেরু আর দক্ষিণ মেরু উত্তর মেরুতে। শুধু তাই নয়, প্রতি দু'শ বছরে ভূ-চৌম্বক ক্ষেত্রের প্রাবল্য ৯% হ্রাস পায়। এই হ্রাসের হার এখন আরও বেড়েছে। ফাটলের জায়গায় গত ৫০ বছরে ৮% হারে দুর্বল হয়েছে পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্র।
এর কারণ সম্ভবত ভূ-প্রাকৃতিক, পণ্ডিতদের মতে। প্রথমত পৃথিবীর চৌম্বক উত্তর মেরু ও চৌম্বক দক্ষিণ মেরু সঠিক দিশায় নেই। সঠিক স্থান থেকে দূরে তার অবস্থান। দ্বিতীয়ত পৃথিবীর একেবারে অন্দরে গলিত লাভাস্রোত আর চৌম্বক অক্ষ একটু বেশি ঝুঁকে থাকার জন্যই এই ফাটলের সৃষ্টি হয়েছে ও বৃদ্ধি ঘটছে।
এ হেন ঘটনার ফল হবে মারাত্মক। ফাটলের ফাঁক গলে সৌর কণা, সৌর বিকিরণ ও মহাজাগতিক রশ্মি সরাসরি ওই অঞ্চলে প্রবেশ করবে আর ধ্বংস হবে প্রাণ।
●(০৭) আগ্নেয়গিরি থেকে ব্যাসল্ট শিলার অগ্ন্যুৎপাত:
১৭৮৩ সালে আইসল্যান্ডে 'লাকি আগ্নেয়গিরি' (Laki Volcano)-র অগ্ন্যুৎপাত শুরু হয়। উত্তপ্ত গলিত লাভা তিন ঘণমাইল এলাকায় ছিটকে পড়ে। লাভার ছাই, ধোঁয়া ও বন্যায় প্রায় ৯০০০ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়।
পৃথিবীর অভ্যন্তরে এমন লাভার উদ্গীরণে সমূদ্রের জলরাশি টগবগ করে ফুটতে শুরু করবে। মারা যাবে জলজ প্রাণীকুল। ধ্বংস হবে জলের বাস্তুতন্ত্র।
●(০৮) বিশ্ব মহামারী :
করোনা মহামারীর প্রত্যক্ষ কুপ্রভাব বিশ্বের মানুষ আজ অবগত। কোভিড-১৯ একটি মারণ ভাইরাস। খুব ছোঁয়াচে রোগ। প্রথম শনাক্ত হয় চিনের উহান প্রদেশে। নভেম্বর-ডিসেম্বরের মাঝামাঝি। তারপর গত দশ মাসে তার আতঙ্কের ঢেউ ছড়িয়ে পড়েছে পৃথিবীর কোনে কোনে। নাকানি চোবানি খাচ্ছে বিভিন্ন দেশের সরকার, প্রশাসন, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলো। অধিকাংশ দেশে ধীরে ধীরে ভেঙে পড়ছে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা। ইতিমধ্যে লক্ষ লক্ষ মানুষ ভাইরাসে আক্রান্ত। প্রতিদিন মুড়ি মুড়কির মতো মানুষ মরছে। প্রিয়জন হারানোর থেকেও বেশি হারে আতঙ্কিত হচ্ছে আবালবৃদ্ধ। আক্রান্তের ভয়ে।
জীবাণুর এমন সরাসরি কালো প্রভাব এর আগেও নেমে এসেছে পৃথিবীর বুকে। চতুর্দশ শতকে প্রতি চারজনের মধ্যে একজন ইউরোপিয়ানের মৃত্যু হয়েছে কালো প্লেগের জন্য। ১৯১৮ - ১৯১৯ সালে ইনফ্লুয়েঞ্জা জ্বরে কমপক্ষে দু'কোটি মানুষ মারা যায় বিশ্ব জুড়ে। ১৯৮০ থেকে ১৯৯২ পর্যন্ত আমেরিকায় ছোঁয়াচে রোগে মৃত্যুর হার বেড়ে হয় ৫৮% । গত অর্ধ শতাব্দীর অধিক সময় ধরেও এইডস ভাইরাসের ভ্যাকসিন, টিকা বা ঔষধ আবিষ্কার হয়নি, সচেতনতা ছাড়া। স্থানাভাবে এমন আরও অনেক মহামারী অনুল্লেখ থেকে গেল।
অদূর ভবিষ্যতে হয়ত বায়ু-জল বাহিত ছোঁয়াচে এমন একটি ভাইরাস বা জীবাণু আসবে, তার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার কোন উপায় থাকবে না।
■ মনুষ্য সৃষ্ট বিপর্যয়
●(০৯) বিশ্ব উষ্ণায়ন :
বর্তমান সময়ের একটি বড় সমস্যা বিশ্ব উষ্ণায়ন ― পরিবেশ উত্তপ্ত হওয়া। প্রতি দশ বছর অন্তর পরিবেশের উষ্ণতা গড়ে এক ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়ছে। এর কারণ কলকারখানা, জ্বালানি দহন, দাবানল থেকে বাতাসে কার্বন ডাই অক্সাইড ((CO2), মিথেন (CH4), ক্লোরো-ফ্লুরো কার্বন (CFC), কার্বন মনোক্সসাইড (CO) প্রভৃতি গ্যাসের উদ্গীরণ। এরা গ্রিন হাউস গ্যাস নামে পরিচিত। দিনকে দিন বায়ুতে এসব গ্যাসের শতকরা পরিমাণ ক্রমশ বাড়ছে। বিশেষত কার্বন ডাই অক্সাইড। আজ থেকে একশ বছর আগে বাতাসে যে পরিমাণ কার্বন ডাই অক্সাইড গ্যাস ছিল, এখন তার কয়েক'শ গুণ বেশি আছে। বছর বছর পরিবেশ সম্মেলন করেও বিশ্বের উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলো গ্রিন হাউস গ্যাস উদ্গীরণ হার হ্রাস করার সমঝোতায় আসতে পারেনি। এর ফলে বন্যা, খরা, সাইক্লোন, সমুদ্র উপকূলীয় এলাকায় প্লাবনের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ সারা বছর লেগে আছে। বরং ক্যুৎসিত কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি করছে এক দেশ আর এক দেশের বিরুদ্ধে।
অথচ আমরা সকলেই আবহাওয়া পরিবর্তন সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। এ বিষয়ে এক নিষ্পাপ সুইডিশ চতুর্দশী গ্রেটা থুনবার্গ-এর প্রতিবাদ-লড়াই অনুসরণ যোগ্য। বড়দের চোখে চোখ রেখে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে সে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছে ― 'কী সাহস আপনাদের ? আপনাদের অন্তঃসারশূন্য কথা দিয়ে আপনারা আমার শৈশব, আমার স্বপ্ন চুরি করে নিয়েছেন। কোন সাহসে এখনও আপনারা অন্যদিকে তাকিয়ে আছেন, এবং এখানে (রাষ্ট্রসংঘের ক্লাইমেট অ্যাকশন সামিট) এসে বলছেন যে আপনারা যথেষ্ট করেছেন, যখন প্রয়োজনীয় নীতি বা সমাধানের চিহ্নমাত্র দেখা যাচ্ছে না ?' গ্রেটার কথায়, পরিবেশ বদল রুখতে যথেষ্ট পদক্ষেপ নিচ্ছেন না পৃথিবী। বিশ্বজুড়ে নেতারা এই পৃথিবীর শিশুদের চোখে চূড়ান্ত অসফল এবং আগামী প্রজন্মের কাছে তারা বিশ্বাসঘাতক।
●(১০) বাস্তুতন্ত্রের ভাঙন :
২০১৯ সালের জুন–জুলাই মাসে বিশ্বের প্রথম সারির সব সংবাদ পত্রের হেডলাইন ছিল ― 'পৃথিবীর হৃদয় জ্বলছে'। এই পৃথিবীর হৃৎপিণ্ড হল আমাজন অরণ্য। সেখানে আগুন লেগেছে। হু হু করে পুড়ছে গাছপালা, কীটপতঙ্গ, বনজ প্রাণী। জঙ্গলের জীবজন্তু প্রাণ বাঁচাতে, সীমাহীন ভয়ে ছুটে আসছে জঙ্গল ছেড়ে রাস্তায়, লোকালয়ে নতুবা ঝলসে যাচ্ছে আগুনে। বিশ্বের সবাই হা-হুতাশ করছে। আসলে পৃথিবীর এক চতুর্থাংশ অক্সিজেন আসে এখান থেকে এবং সমপরিমাণ কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করে। শুধু তাই নয়, অরণ্যের বাস্তুতন্ত্র লোপ পাবে। আর তার ধীর কিন্তু সুদূরপ্রসারী অদৃশ্য প্রভাব পড়বে গোটা পৃথিবীর ওপর। সেজন্যে এত হাহাকার !
কিন্তু বিশ্বজুড়ে প্রতি বছর কারণে-অকারণে যে ৩০,০০০ হাজার প্রজাতি (species)-র জীব বিলুপ্ত হচ্ছে, তার বেলা ?
●(১১) বায়োটেক বিপর্যয় :
যখন প্রাকৃতিক প্রজাতি সমূহ বিলুপ্ত হয়ে যায়, তখন নিশ্চিতরূপে আমরা কিছু জিনগত প্রযুক্তি তৈরি করতে মনোনিবেশ করি। জিনগত প্রযুক্তির সাহায্যে উন্নত মানের যে বীজ (ধান, গম, বেগুন, বরবটি ইত্যাদি) উৎপন্ন সম্ভব হয়েছে, তা খুব বলিষ্ঠ, সুস্বাদু ও প্রোটিন সম্পন্ন হয়। চিকিৎসা ক্ষেত্রে ডি. এন. এ.-এর মৌলিক ত্রুটি দূর করতে সমর্থ জিন-থেরাপি। যন্ত্রচালিত জীবাণু স্বাস্থ্য সমস্যার সমাধান করেছে।
এতদসত্ত্বেও উন্নত প্রযুক্তির কিছু সম্ভাব্য বিধিনিষেধ আছে। যদিও জিন-প্রযুক্তিতে উৎপন্ন খাদ্যদ্রব্যের গুণগত মান অস্বাস্থ্যকর প্রমাণিত হয়নি, তবু সংশোধিত উদ্ভিদের জিন অন্যান্য প্রজাতির মধ্যে সঞ্চারিত হবার লক্ষণ থাকে। প্রযুক্তিগত শস্য পোকামাকড়ের প্রতিরোধের ক্ষমতা গড়ে তোলে।
এর ফলে পরবর্তী সময়ে অভিযোজিত জীবাণু সকলকে নিয়ন্ত্রণ করা মুশকিল। বিশ্বের বাস্তুতন্ত্রের সমতা বিনষ্ট হয়। এর কুফল ভবিষ্যতের পরিণতি হয়ে যায়।
●(১২) কণা-ত্বরকে দুর্ঘটনা :
পদার্থের ক্ষুদ্রতম অংশ কী ? আজ পর্যন্ত এর সঠিক সম্ভাব্য শেষ উত্তর আমাদের জানা নেই। আবার জানার শেষও নেই। গত বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে যখন আবিষ্কার হয়নি পরমাণুর তিন মৌলিক কণা ইলেকট্রন, প্রোটন, নিউট্রন ; তখন এদের ধরার জন্য যে পারটিক্যাল অ্যাক্সিলেটর ব্যবহৃত হয়েছিল, এখনকার কণা-ত্বরক যন্ত্র তার চাইতে অধিক শক্তিশালী। কারণ বর্তমান মৌলিক কণা কোয়ার্ক, হিগস বোসন ইলেকট্রন-প্রোটনের চেয়ে অনেক গুণ ছোট। এদের ধরতে লক্ষ নিযুত কোটি ক্ষমতার যন্ত্র বানানো দরকার। এখন বিশ্বে যতগুলি কণা-ত্বরক যন্ত্র আছে, সেগুলো MeV থেকে TeV পাল্লার শক্তি তৈরি করতে সমর্থ। যেমন আমেরিকার ফার্মিল্যাবে টেভাট্রন, ইউরোপে সার্নের লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডর বিশেষ উল্লেখযোগ্য। ছোট বড় মিলিয়ে বিশ্বে এখন ৩০,০০০ -এর বেশি পারটিক্যাল অ্যাক্সিলেটর আছে।
পরবর্তীতে কোয়ার্কের চেয়েও ছোট কণা ধরতে আরও শক্তিশালী কণাত্বরক যন্ত্র উদ্ভাবনের নেশায় নেমেছে সার্ন। তার নাম দিয়েছে 'লার্জার হ্যাড্রন কোলাইডর'। এতে TeV (১০^১২ eV) রেঞ্জের থেকেও বেশি শক্তি তৈরি করা মূল লক্ষ্য। এ হেন যন্ত্রে উৎপন্ন হয়ত ক্ষণিকে ধ্বংস করবে সবকিছু।
●(১৩) ন্যানো-টেকনোলজি বিপর্যয় :
১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দে ন্যানো-টেকনোলজির অগ্রদূত কে. এরিক ড্রেক্সলার তাঁর 'ইঞ্জিনস অব ক্রিয়েশন' (Engines of Creation) পুস্তিকায় প্রথম 'Gray Goo' বা গ্রে-গু শব্দবন্ধটি আমদানি করেন। কী এই গ্রে-গু ?
Gray Goo হল বিশ্ব বিপর্যয়ের কল্পনাশ্রয়ী একটি দৃশ্য যেখানে অপ্রতিরোধ্য স্ব-প্রতিলিপি তৈরিতে সক্ষম যন্ত্র পৃথিবীর সব বায়োমাস অধিগ্রহণ করে অধিক মাত্রায় তার অবিকল প্রতিরূপ তৈরি করে। শুধু তাই নয়, পরিবেশে নিজের বাসগৃহ গিলে খায়। এ দৃশ্যকে 'ইকোফ্যাজি' বলে।
হয়ত আগামী কয়েক দশকের মধ্যে বা আরও তাড়াতাড়ি মানুষ খুব ক্ষুদ্র রোবট উদ্ভাবন করবে যে নিজে তার অনুরূপ প্রতিলিপি বানিয়ে একত্রিত করতে পারে। সে রোগীর শরীরে প্রবেশ করে তার সার্জারি করবে, কাঁচামাল দিয়ে দরকারি জিনিস বানাবে বা অন্য পৃথিবী অন্বেষণ করবে। সবই সম্ভব যদি প্রযুক্তি তার চালকের ইচ্ছে অনুযায়ী কাজ করে। অন্যথায় বিপদ আসন্ন।
●(১৪) পরিবেশগত বিষক্রিয়া :
প্রতি বছর এন. আই. এইচ. ক্যান্সার সৃষ্টিকারী দ্রব্যের তালিকা সংশোধন করে। এ পর্যন্ত ২১৮ টি দ্রব্য তালিকায় সংযোজন করা হয়েছে যা থেকে নাকি মারণ রোগ ছড়ায়। সেরকম একটি জিনিস PVC (পলিভিনাইল ক্লোরাইড) পাইপ, ওয়ালপেপার প্রায় প্রত্যেক বাড়ির নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য। এ বস্তু থেকে ছড়িয়ে পড়তে পারে ক্যান্সার। কীভাবে ? এ জিনিসে আগুন ধরলে বা আগুন পোড়ালে ডাইঅক্সিন উদ্গিরণ করে। আর উচ্চ মাত্রায় ডাইঅক্সিন মিশ্রিত ধোঁয়া মানব শরীরে ভ্রুণের বিকাশ বিঘ্নিত করে, প্রজনন ক্ষমতা নষ্ট করে।
কলকারখানার রাসায়নিক বর্জ্য, চাষের কাজে ব্যাপক হারে কীটনাশকের ব্যবহার পরিবেশের যথেষ্ট ক্ষতি করে। ক্লোরিনঘটিত যৌগ মানুষের হরমোন নকল করে। তাই গর্ভাধান হ্রাস পায়।
ভারতে ভূপাল গ্যাস দুর্ঘটনা থেকে ইউক্রেনের চের্নোবিল নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্টে তেজস্ক্রিয় রশ্মি ছড়িয়ে পড়া পরিবেশগত বিষক্রিয়ার ফল।
■ ইচ্ছাকৃত স্ব-নিধন :
●(১৫) বিশ্ব যুদ্ধ :
১৯৪৫ সালের ৬ অগাস্টের হিরোশিমা এবং ৯ অগাস্টের নাগাসাকি ― আধুনিক বিশ্ব ইতিহাসের তাজা দুটি ক্ষত চিহ্ন আজও বহন করে বেড়ায়। এই দুই শহরে ফেলা হয়েছিল দুটো পরমাণু বোমা ― লিটল ম্যান ও ফ্যাট বয়। তার ফলে লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রাণে মারা যায়, প্রচুর প্রাকৃতিক সম্পদ নষ্ট হয়। আর এ সব ঘটেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে।
১৯১৪ থেকে ১৯১৯ সাল পর্যন্ত প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এবং ১৯৩৯ থেকে ১৯৪৫ পর্যন্ত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। প্রভূত সম্পদের ক্ষতি, সামাজিক অবক্ষয়, পরিকাঠামো ভেঙ্গে পড়া ও সর্বোপরি নৈতিক অধঃপতনের সাক্ষী এ যাবৎকালের সেরা দুই মহাযুদ্ধ।
বিশ্বের অনেক দেশ এখন পরমাণু শক্তিধর। তাদের সামরিক কোষাগারে হাজার হাজার পরমাণু বোমা, হাইড্রোজেন বোমা ঠাসা। তেমন দেশগুলোর মধ্যে যুদ্ধ বাধলে দেওয়ালিতে পটকা ফাটানোর মতো হয়ত ফাটবে পরমাণু বোমা। আর তারপর...
●(১৬) রোবট দখল :
রজনীকান্ত ও ঐশ্বর্য রাই অভিনীত 'রোবট' চলচ্চিত্রে 'চিট্টি'-এর কথা মনে পড়ছে, প্রিয় পাঠক ? সেই চিট্টি যে আদতে একখান স্বয়ংক্রিয় রোবট , মালিকের চোখের আড়ালে নিজের মতো হাজার হাজার প্রতিরূপ রোবট তৈরি করে চ্যালেঞ্জ জানায় নিজের সৃষ্টিকর্তাকে ! নিমেষে সে দখল নিতে চায় প্রেমিকা সহ পুরো সাম্রাজ্য। তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতেই চিট্টির হাজার হাজার প্রতিলিপি তছনছ করে দেয় সবকিছু, এমনকি খুন করতে উদ্যত হয় নিজের মালিককে ?
আগামীতে তেমন সম্ভাবনা দেখব না তো, প্রিয় পাঠক ? এ হেন ঘটনায় শঙ্কিত কোমল হৃদয়। তেমন সম্ভাবনার কথা একবারে উড়িয়ে দিচ্ছেন না কার্নেগি মেলন ইউনিভার্সিটির রোবটিক বিভাগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা হ্যানস মোরাভেক। তাঁর মতে, ২০৪০ সাল নাগাদ মানবের মতো চেতনা সম্পন্ন ও বুদ্ধিমান হবে যন্ত্র। ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (MIT)-র কৃত্রিম ইন্টেলিজেন্স বিশেষজ্ঞ মারভিন মিনস্কি-র অভিমতও একই ― 'মানুষ তার ব্রেন কম্পিউটার-উন্নত মেকানিক্যাল সারোগেটস-এ ডাউনলোড করতে পারবে'।
●(১৭) গণ উন্মাদনা :
গত শতাব্দী থেকে বিশ্বের প্রায় সব জায়গায় শারীরিক স্বাস্থ্য উন্নত হলেও ভেঙ্গে পড়ছে মানসিক স্বাস্থ্য। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)-র রিপোর্ট অনুযায়ী, বিশ্বজুড়ে ৫০ কোটি মানুষ মানসিক ব্যাধিতে ভুগছে। ২০২০ সালের শেষে মৃত্যুর নিরিখে দ্বিতীয় মুখ্য কারণ হবে বিষন্নতা (Depression)। মানুষের বর্ধিত জীবনকালের জন্য তীব্র হচ্ছে সমস্যা। বৃদ্ধ বয়সের অসুস্থতা এবং একাকীত্বের অভিজ্ঞতা বৃদ্ধির ফলে চরম পথ বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছে মানুষ। তথ্য বলছে, ৬৫ বছর বা তার বেশি বয়সের আমেরিকান নাগরিক সামঞ্জস্যহীন আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়।
লস অ্যাঞ্জেলস-এর ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার বায়ো-ফিজিসিস্ট গ্রেগরি স্টক বিশ্বাস করেন, আগামীদিনে চিকিৎসা বিজ্ঞানের সৌজন্যে মানুষের গড় আয়ু হবে দু'শ বছর বা তার বেশি এবং এত দীর্ঘ সময়ে সঞ্চিত সংবেদনশক্তি তার ব্রেনে চাপ ফেলবে। তখন পাল্লা দিয়ে বাড়বে মানবিক অসুস্থতা। আর অবসাদ জনিত মৃত্যুর হার প্রতি বছর লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়বে।
■ আমাদের বিরুদ্ধে চালিত বৃহত্তর শক্তি :
●(১৮) এলিয়েন আক্রমণ :
ভিন গ্রহ থেকে আগত জীবকে এলিয়েন বলে। তাদের গঠন, খাদ্যাভ্যাস, আচার-আচরণ-অভিব্যক্তি, ভাষা, দৈনন্দিন জীবনযাপন পার্থিব জীবের মতো নাও হতে পারে। কিছু এলিয়েন উপকারী বন্ধুবৎসল হতে পারে, আবার অনেকে অপকারী শত্রু !
ঋত্বিক রোশন অভিনীত 'কোই মিল গয়া' চলচ্চিত্রে ভিন গ্রহের প্রাণী 'জাদু' খুব বন্ধুবৎসল, উপকারী। দৈহিক বা মানসিক অসুস্থ মানুষের সীমাবদ্ধতা সারিয়ে তাকে পূ্র্ণাঙ্গ মানুষে উন্নীত করে। অপরপক্ষে হলিউড সিনেমা 'প্রিডেটর'-এ জলের ন্যায় স্বচ্ছ অদৃশ্য এলিয়েন বেছে বেছে শুধু মানুষ খুন করে। এরা খুব শক্তিশালী। স্বচ্ছতার জন্য নিজেকে গোগন করার সুচতুর কৌশল আয়ত্তে এদের। তাই খুব ভয়ংকর এ সব জীব। আর এই দ্বিতীয় প্রকার এলিয়েনদের নিয়ে পৃথ্বীবাসীর যত ভয়। কোন একদিন সকালে ঘুম ভেঙ্গে হয়ত দেখব, রাতে অন্ধকারে কোটি কোটি এলিয়েন সমগ্র পৃথিবীর দখল নিয়েছে এবং হিটলারের ইহুদি নিধনের মতো ধরে ধরে মানুষ খুন করছে !
●(১৯) ঐশ্বরিক হস্তক্ষেপ :
ধর্মীয় কারণে প্রতি বছর কতশত মানুষ খুন হয়ে যাচ্ছে বিশ্বে। অধিকাংশ সন্ত্রাসমূলক ক্রিয়াকলাপ ঈশ্বর বিশ্বাস থেকে জন্ম। ঈশ্বরের বাণী ভুলভাবে তথকথিত সন্ত্রাসবাদী মানুষের কাছে উপস্থাপিত হয়। কুয়োর ব্যাঙের মতো সেও তেমন ধারণায় একশ শতাংশ বিশ্বাসী হয়ে পড়ে, বাইরের পৃথিবীর সুন্দর রূপ আর দেখতে পায় না অথবা দেখবার আগ্রহ তার থাকে না। আর তাই ধ্বংসাত্মক পথ বেছে নিতে দ্বিধাবোধ করে না সে।
যদি পরমেশ্বরের সত্যিই এমন ইচ্ছা থাকে, তাহলে তিনি তা প্রত্যক্ষভাবে ঘটাতে পারেন; কেন তিনি ধর্মান্ধ মানুষের সাহায্য নেবেন ? আর এখানেই মনে হয় ঈশ্বরের বদ ইচ্ছা ধরা পড়ে যায়। যদি ঈশ্বরের মনে পৃথিবী বা প্রাণ ধ্বংসের সামান্যতম সম্ভাবনাও থেকে থাকে, তাহলে বিশ্বের সব ধর্মভীরু মানুষের সমষ্টিগত প্রার্থনা কোন কাজে লাগবে না।
●(২০) কেউ জেগে উঠে বুঝতে পারে যে সবকিছু একটি স্বপ্ন ছিল :
একটা খুব বড় জন্তু আপনাকে তাড়া করছে। ধরতে পারলে টুঁটি টিপে মারবে। আপনি হেঁটে-ছুটে পালানোর চেষ্টা করছেন। কোনমতে পারছেন না। আপনি যত জোরে পালানোর চেষ্টা করছেন, সে-জন্তু আরও জোরে আপনার পেছন পেছন ছুটে আসছে। সবশেষে আপনি উড়তে শুরু করলেন। হাল ছাড়ার পাত্র নয় সে। এবারও পিছু নিয়েছে। আসলে তার হাত আকাশ পর্যন্ত বিস্তৃত কি-না। শেষমেশ সে আপনাকে ছুঁয়ে ফেলতেই ধড়াস করে উঠে বসলেন বিছানায়। ভয়ে বিছানার চারপাশে কিছু খুঁজছেন। নিয়ন আলোর আধো-অন্ধকারে দেখলেন আপনার সঙ্গী দিব্যি নাক ডেকে ঘুমোচ্ছে। ফুল স্পিডে পাখা ঘু্রছে। অথচ আপনি ঘামছেন। অস্বাভাবিক হারে। একটু ধাতস্থ হয়ে এক ঢোঁক জল খেলেন। তারপর ভাবলেন, কেউ আসছে না আপনাকে মারতে। এতক্ষণ আপনি একটা স্বপ্ন দেখছিলেন।
আচ্ছা, এই পাহাড়-পর্বত, গাছপালা, জীবজন্তু, মানুষ ইত্যাদি একটা স্বপ্ন নয় তো? যে বা যিনি পৃথিবী বা ব্রম্ভাণ্ডের এই স্বপ্ন দেখছে বা দেখছেন, অকষ্মাৎ ঘুম ভেঙ্গে জেগে দেখবেন – সবকিছু ভ্যানিশ !
আরও দ্রষ্টব্যঃ
উপরের কারণগুলো যথেষ্ট নয়, আরও অনেক অনুল্লেখিত কারণ আছে, প্রিয় পাঠক। যেমন পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ পাতসমূহের সংঘর্ষে সমুদ্রে সৃষ্টি হতে পারে সুনামি। ঘটতে পারে ভয়াবহ ভূমিকম্প। প্রকৃতির নিয়মে নিভে গেল সূর্য, অথবা রেড জায়েন্ট তারকায় পরিনত হল সে। পৃথিবীর কেন্দ্রে উত্তপ্ত লাভা ঠাণ্ডা হয়ে গেল। পঙ্গপাল অতর্কিতে হানা দিল। ইত্যাদি। একশ একটা কারণ। এ সমস্ত অজুহাতে একদিন 'ডুমস-ডে' (Doomsday) অবস্থায় ঠিক পৌঁছে যাব আমরা।
0 Comments