শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ সঙ্গীতামৃত
পর্ব - ১
সুদর্শন নন্দী
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণদেব বলেছেন ব্যাকুল হয়ে গান গাইলে ঈশ্বর দর্শন হয়।
তাঁর সঙ্গীতপ্রিয়তার কথা ভক্তমাত্রই অবগত আছেন। ভক্তদের সাথে ঈশ্বরের আলোচনা করতে করতে গান গাইতেন তিনি আর গাইতে গাইতে সমাধিস্থ হয়ে যেতেন। অন্য ভক্তদেরও বলতেন গান গাইতে। গানের সাথে হত আনন্দ নৃত্য। শ্রীরামকৃষ্ণ স্বামীজীর গান খুব পছন্দ করতেন। তিনি এলেই দু-চার কথার পর তাঁকে গান গাইতে বলতেন। কিছুক্ষণ গান শোনার পর হয়তো ভাবস্থও হয়ে পড়তেন, চোখ দিয়ে আনন্দাশ্রু পড়ত। নেচেছেন, সকলকে নাচিয়েছেন। তিনি গান গাইতেন লোকশিক্ষার জন্যে। সকলের মধ্যে ঈশ্বরীয় ভাব জাগানোর জন্যে। কারণ তাঁর দর্শনই হল ইশ্বরলাভ জীবনের উদ্দেশ্য। সেজন্য ইশ্বরকে ব্যকুল ভাবে ডাকতে হবে। প্রাণ খুলে চেষ্টা করতে হবে তাকে লাভ করতে হবে। আর ঈশ্বরলাভের আরেকটি পথ তাঁর গান গাওয়া। গানের মধ্যে তাঁকে ভালবাসা। শুধু গান গাওয়া নয়, ভক্তদের সাথে কথাপ্রসঙ্গে উল্লেখ করেছেন বিভিন্ন গানেরও।
ঈশ্বর লাভে সঙ্গীত-শক্তির প্রভাব কি হতে পারে তা দেখিয়েছেন শ্রীচৈতন্যদেব। পনেরো শতকে চৈতন্যদেবের আবির্ভাবে কীর্তন গানে অসামান্য বেগ সঞ্চারিত হয়। তিনি ছিলেন নামকীর্তনের প্রচারক। চৈতন্যদেব বুঝতে পেরেছিলেন যে, নারী-পুরুষ ও বয়স নির্বিশেষে সঙ্গীতের আবেদন সর্বাধিক এবং কোনো কঠিন বিষয়ের প্রতি অশিক্ষিত কিংবা স্বল্পশিক্ষিত জনগণকে আকৃষ্ট করার সহজতম উপায় হচ্ছে সঙ্গীত। তাই ঈশ্বর-সাধনার সহজতম পন্থা হিসেবে তিনি বেছে নেন কীর্তনকে।
সঙ্গীত প্রসঙ্গে স্বামী লোকেশ্বরানন্দ ঠাকুরের বিষয়ে বলেছেন-‘তিনি নিজে গান গাইতেন, অপরকে গাইতেও উৎসাহ দিতেন। কথামৃতে দেখি তাঁর কথায় কথায় গান। কেন এত গান? কারণ গানের ভেতর দিয়ে শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর মর্মকথা বলেছেন। অন্য কোন ভাষা দিয়ে যা প্রকাশ করা যায় না। শ্রীরামকৃষ্ণকে বুঝতে গেলে তাঁর কথা ও গান দুই-ই নিতে হবে। কথার চেয়ে গান যেন সুগভীর, যেন অতলস্পর্শী। বহু কথার পরিবর্তে গানের একটা লাইন বা কয়েকটা কথা যেন বেশী ভাব প্রকাশে সক্ষম। শ্রীরামকৃষ্ণের কণ্ঠে ঐ কথাগুলি যেন আরও সজীব, এর সরল। গভীরতম যে অনুভূতি তা কোন ভাষায় কখনও প্রকাশ করা যায় না। কবিতা বা গানের ভেতর দিয়ে একটু-আধটু প্রকাশ পায়”। শ্রীরামকৃষ্ণ ছোটবেলা থেকেই সুকণ্ঠ ছিলেন। ভজন-কীর্তন তখন গ্রামাঞ্চলে প্রচলিত ছিল। শাক্ত, শৈব, বৈষ্ণব, বাউল ও বহু প্রকারের লোকগীতি শুনতে পাওয়া যেত। ঠাকুরও সেসব রস আস্বাদন করে বড় হয়েছে্ন। আমরা জানি শ্রীরামকৃষ্ণ শ্রুতিধর ছিলেন। একবার একটা গান শুনলেই তাঁর মুখস্থ হয়ে যেত। কথায় কথায় সেই সব গান বেরিয়ে আসত, যেখানে যে গান মানায়। পল্লীবাসীরা মুগ্ধ হয়ে শুনত সেই সব গান। আনন্দের হাট বসিয়ে দিতেন গানের মাধ্যমে। সব রকম ভাবের গান গাইতেন তিনি। গাইতেন মন প্রাণ ঢেলে । ভক্তরা সেই অমৃত সুধা পান করে নিজেদের ধন্য করেছেন। পৌঁছেছেন ঈশ্বর ভাবনার দোর গড়ায়।
আর শ্রীশ্রীমা বলছেনঃ ‘আহা, গান গাইতেন তিনি(ঠাকুর), যেন মধুভরা, গানের উপর যেন ভাসতেন! সে গানে কান ভরে আছে। এখন যে গান শুনি, সে শুনতে হয় তাই শুনি।’ ঠাকুরের সে গানের কথা আমরা শুনব কথামৃত থেকে। শুধু কথামৃত নয়, কথামৃতকারের অপ্রকশিত ডায়েরি থেকেও প্রাপ্ত গানের উল্লেখ করব এখানে। এই লেখা ঠাকুরের ভক্ত ও পাঠকদের জন্য যারা আলাদাভাবে ঠাকুরের গান গাওয়া ও গান শোনার বিষয়ে এক জায়গায় সব তথ্য পেয়ে যান। লেখায় শ্রীম কথিত শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ কথামৃতের,(উদ্বোধন) অখণ্ড সংস্করণের (পুনর্মুদ্রণ সেপ্টেম্বর ২০০৯) সাহায্য নিয়েছি, মিলিয়ে দেখার জন্য বেলুড় মঠের পোর্টালের মাধ্যমে অন লাইন সংস্করণে প্রাপ্ত (https://ramakrishnavivekananda.info/) ওয়েব সাইটের সাহায্য নিয়েছি। সাহায্য নিয়েছি স্বামী লোকেশ্বরানন্দের সম্পাদনায় “শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণের প্রিয় সঙ্গীত” ( প্রকাশকঃ রামকৃষ্ণ মিশন ইনস্টিটিউট অফ কালচার, গোলপার্ক, কলকাতা) গ্রন্থটির। এছাড়া মুল্যবান কয়েকটি গ্রন্থ যেমন শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ লীলাপ্রসঙ্গ ( স্বামী সারদানন্দ), শ্রীরামকৃষ্ণ ভক্তমালিকা (স্বামী গম্ভীরানন্দ), শ্রীমা সারদা দেবী (স্বামী গম্ভীরানন্দ)প্রভৃতি গ্রন্থের সাহায্য নিয়েছি। ঠাকুরকে সাষ্টাঙ্গ প্রণামের মাধ্যমে শ্রদ্ধাবনত ঋণ স্বীকার করে নিই যা কিছু বর্ণনা করা হয়েছে তাঁর সবই প্রাপ্ত উক্ত গ্রন্থগুলি থেকে। পাঠকদের উপযোগী নিজের কিছু কথা ভাষা যুক্ত রয়েছে মাত্র।
কথামৃতকার মহেন্দ্রনাথ গুপ্তের সাথে ঠাকুরের দর্শন হয় ১৮৮২র ফেব্রুয়ারিতে। তবে ঠাকুরের গানের উল্লেখ পাই তাঁর আগে যা ভক্তরা কথামৃতকারকে পরে অবগত করান।
আগেই বলেছি, ঠাকুর দক্ষিণেশ্বরে বা ভক্তদের বাড়িতে বা কোন উৎসবে নিজেই যে গান গাইতেন তা নয়, অন্যদেরও গাইতে বলতেন এবং তা ভাল না লাগলে বলতেও কুণ্ঠা বোধ করতেন না। কথামৃতকে ধরেই ঠাকুরের সঙ্গীতামৃতের এই আলোচনা এগোব। হয়তো কথামৃতে উল্লেখিত গান ঠাকুরের লীলাজীবনের সমস্ত গান নয়। কারন কথামৃতে গানের মোটামুটি পাঁচবছরের উল্লেখ পাই। তবে এই পাঁচবছরের উল্লিখিত গানে তার আগের গানও ধরা আছে বলেই বিশ্বাস। কারণ একই গান ঠাকুর একাধিকবার গেয়েছেন। তবে এই আলোচনায় কথামৃতকারের অপ্রকাশিত ডায়েরি যা পরে আলাদাভাবে প্রকাশিত (শ্রী রামকৃষ্ণের অন্ত্যলীলাঃ স্বামী প্রভানন্দ) সেখানকার বর্ণিত গানও উল্লেখ করেছি এখানে। সেই ডায়েরিতে রয়েছে ঠাকুরের এগারো মাসের (২৬.৯.১৮৮৫ থেকে ১৬.৮ ১৮৮৬) দিনলিপি। যে সকল ভক্ত গান গেয়েছেন তাঁর উল্লেখ আমরা কথামৃত থেকে পাই। পাঠকের উৎসাহ মেটাতে সেসকল ভক্তদের আলোচনাও করব সংক্ষেপে।
(অনলাইনের এই ধারাবাহিকে সম্পূর্ণ গানটি উল্লেখ করলে হয়তো একটি গানেই একটি পর্ব শেষ হয়ে যাবে। তাই দু-তিন লাইন উল্লেখ করব গানের। উৎসাহী পাঠক লেখার সূত্র ধরে পুরো গানটি কথামৃত থেকে পেয়ে যাবেন)(চলবে)।
________________________________
এই ধারাবাহিকটি প্রতি সোমবার ও বৃহস্পতিবার প্রকাশিত হবে। নজর রাখুন--
www.jaladarchi.com
1 Comments
চিত্তাকর্ষক রচনা। / পার্থপ্রতিম আচার্য
ReplyDelete