জ্বলদর্চি

উদ্ভিদনামে পূর্ব মেদিনীপুরের গ্রামনাম ( পর্ব - ১)

উদ্ভিদনামে পূর্ব মেদিনীপুরের গ্রামনাম ( পর্ব - ১)


ভা স্ক র ব্র ত  প তি

সবুজ বনানীর দেশ বঙ্গদেশ। চারিদিকে কত গাছপালা। স্থান বিশেষে গাছেরও তারতম্য লক্ষ্য করা যায়। কোথাও কোনাে বিশেষ ধরনের গাছের আধিক্য থাকে। কিন্তু আমরা তেমনভাবে সেইসব গাছ নিয়ে খুব একটা আলােচনা করিনা। আমাদের পরিবেশের আশেপাশের কত গাছ, সে সম্পর্কে তেমন একটা আগ্রহও দেখাইনা। অথচ, এইসব গাছ তথা তৃণরাজি, গুল্মরাজি এবং বৃক্ষকুল অনেক সময় আমাদের সংস্কৃতি, ইতিহাস এবং দৈনন্দিন জীবনের সাথে জড়িয়ে রয়েছে গ্রামনামের সাথে।

মানুষের পিতৃদত্ত নাম বিস্মৃতির গভীরে ডুবে যায়। মৃত্যুর পরে হারিয়ে যায় সেই নাম। কারও কারও নাম অমর হয়ে থাকলেও সবার ক্ষেত্রে তা প্রযােজ্য নয়। আপামর মানুষের নাম কে-ই বা খোঁজ রাখে ? কিন্তু গ্রামের নাম থেকে যায়। যতদিন সেই গ্রামে জনজীবন থাকে অথবা গ্রামটি কোনাে না কোনাে কারণে সরকারি প্রকল্পের আওতায় থাকে (জনমানবশূন্য হলেও) ততদিন ওই গ্রামের নাম বজায় থাকে। কিছু ক্ষেত্রে তা অবশ্য পরিবর্তন ঘটে। কখনও মানুষই পরিবর্তন ঘটায়, আবার কখনও উচ্চারণের ভেদে তা পরিবর্তিত হয়।

ড. বঙ্কিম মাইতি জানিয়েছেন, “স্থাননাম - শাব্দিক অভিধা। তা আর্যভাষী ও প্রাক আর্যভাষী জনের মুখের ভাষার দান। বহু শতাব্দীর জনপ্রবাহের স্মৃতি তাতে স্তরে স্তরে সজ্জিত। অভিধানে তার সব কিছুর হদিস মেলেনা। বিকৃতি ও রূপান্তরের ফলে তার আদিরূপটিও হারিয়ে গেছে। একদা সেই সজীব ভাষাকে আশ্রয় করে জনপদবাসীর বৈষয়িক ও আত্মিক অভিজ্ঞতার যে পরিচয় ফুটে উঠেছিল, তাকে উৎখনিত করে আধুনিক মনের দরবারে পৌঁছিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব লোকবিজ্ঞানীদের কাছে গভীর প্রীতির বিষয়।”

একসময় মানুষ বনে বসবাস করত। বনের পাতা, ফুল, ফল খেত। গাছের ডালে পশু শিকার করত। অর্থাৎ বনাঞ্চল-ই ছিল মানুষের পরম বন্ধু। ধীরে ধীরে মানুষের উন্নয়ন ঘটেছে। বনবাস ছেড়ে মানুষের বসবাসের অবস্থান আধুনিক হয়েছে। তার জন্য মানুষ শুরু করেছে অবাধ বৃক্ষচ্ছেদন। জ্বালানির জন্য কাটা হচ্ছে গাছ। জায়গার জন্য কাটা হচ্ছে বন। খাল বিল ভরিয়ে পঞ্চত্ব প্রাপ্তি ঘটানাে হচ্ছে বহু জলজ উদ্ভিদের। ক্রমশঃ কমছে গাছের সংখ্যা এবং বনাঞ্চলের পরিমাণ। একসময় গাছের নানা অংশ থেকে প্রাপ্ত অংশ তথা জড়িবুটি ব্যবহৃত হত চিকিৎসায়। ফলে তখন গাছের প্রতি মােহ থাকত। আজ সেই অবস্থান নেই। চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নয়ন হয়েছে। গ্রামীণ ভেষজ চিকিৎসা এখন অনেকটাই ব্যাকফুটে। যার দরুন গাছ নিয়ে আগ্রহ কমছে। কিছু ক্ষেত্রে অবশ্য সরকারি উদ্যোগে গাছ লাগানাের কর্মসুচি জারি থাকলেও তা যে প্রয়ােজনের তুলনায় অতি নগণ্য, তা বুঝছেন পরিবেশবিদরাও। এখন কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এবং কিছু বৃক্ষপ্রেমী মানুষ জন নিজেদের উদ্যোগে বিভিন্ন স্থানে বৃক্ষরোপণের উদ্যোগ নিয়েছেন। এমতবস্থায়, একটি জিনিস আমাদের নজর এড়িয়ে যাচ্ছে। তা হ’ল গাছের নামে গ্রামের নাম।

গাছ নেই। অথচ সেই গাছের নামের সৃষ্ট গ্রামনাম রয়ে গেছে। বেঁচে আছে কেবল গাছটির নামের স্মৃতি। তারাপদ সাঁতরা লিখেছেন,—“জঙ্গল সাফাইয়ের ধাক্কায় পড়ে যেসব প্রয়ােজনীয় যা অপ্রয়োজনীয় গাছ আজকে চিরতরে হারিয়ে গেল, তাদের এলাকাগত নাম ও পরিচয়ও আমরা লিখে রাখিনি ; অথচ এই পশ্চিমবাংলার কোনাে কোনাে স্থানে এমন সব বহুমূল্য ও অতিপ্রয়ােজনীয় যেসব গাছের অস্তিত্ব ছিল, সেগুলি অনুসন্ধানের অভাবে স্বভাবতই প্রাপ্তিস্থান সম্পর্কে অনুল্লেখ বা অজানিত থেকে গেছে"। বৃক্ষ উচ্ছেদের কর্মসূচিতে কোনাে এলাকা থেকে হয়তাে হারিয়ে গেল কোনাে বিশেষ গাছ। অথচ সেই গাছের নামে সৃষ্ট ওই এলাকার নাম বা গ্রামনামটি রয়ে গেল মানুষের মুখে কিংবা সরকারি খাতায়।

গ্রামনামের উৎপত্তির কারণ হিসেবে অমিয়কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় মােট ১৫ টি সম্ভাব্য কারণ উল্লেখ করেছেন। এর মধ্যে গাছপালা সংক্রান্ত গ্রামনামও রয়েছে। এই বঙ্গে গাছের নামে গ্রামনামের অভাব নেই। আসলে প্রকৃতিপ্রেমী বাঙালি গাছকেও তাঁর জীবনযাপনের অঙ্গ হিসাবে বেছে নিয়েছে। আত্মার আত্মীয় করে ফেলেছে কখনও। এই গাছ তাই বহুক্ষেত্রে মানুষের বসতের চারপাশে সন্ধান দিয়েছে বহু গ্রামনামের। কখনও গাছের নানা প্রতিশব্দ দিয়ে, আবার কখনও বা বিশেষ বিশেষ গাছ, লতা, গুল্ম, তৃণ, শাক, সবজি, ফুল, শস্য ও ফল সংক্রান্ত অজস্র গ্রাম নাম মিলবে রঙ্গভরা বঙ্গদেশে। তারাপদ সাঁতরা মন্তব্য করেছেন, "গাছকে কেন্দ্র করে একসময় যে নামকরণ করা হয়েছিল, সে গাছ হয়তাে ওই সব গ্রামে আজ আর খুঁজে পাওয়া যাবে না, কিন্তু গ্রামনামের মধ্যেই ওইসব গাছের নাম আজও টিকে রয়েছে এবং সে সব গাছের নাম ভুলতে চাইলেও ভােলা যে সম্ভবপর নয় তা গ্রামের নামকরণ থেকেই স্পষ্ট হয়"।

এ রাজ্যে গাছের নামে গ্রামনাম রয়েছে এরকম সবচেয়ে বেশি গ্রামগুলির নাম চিহ্নিত করেছেন অমিয় কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়। সেগুলি হল তেঁতুলিয়া (রাজ্য ৩২ টি, মেদিনীপুর ১৪ টি), জামবনী (রাজ্য ২৭ টি, মেদিনীপুরে ২০ টি), শিমুলিয়া (রাজ্যে ৩৩ টি, মেদিনীপুরে ১৪ টি), শালবনী (রাজ্যে ২৭ টি, মেদিনীপুরে ২২ টি), পাকুড়িয়া ইত্যাদি। এ ছাড়া কুল, কেঁদ, তাল, বাঁশ, বট, ধান, আম, ছাতিম-এর নামে বিভিন্ন আঙ্গিকে অসংখ্য গ্রামের নাম মিলবে। বিভিন্ন জেলাতেও তা ভুরি ভুরি। যেটুকু তথ্য মিলেছে, তাতে কাঁঠালের নামে ১৬ টি, খেজুরের ৩৪ টি, নারকেলের ১১ টি, শজিনার ৮ টি, আকন্দর ১৩ টি, বাবলার ১৩ টি গ্রামনাম আছে। এর বাইরে অত্যল্প গাছ বা স্বল্প পরিচিত গাছ হিসেবে বেত-এর নামে ৩৫ টি, উলু-র ৭ টি, আলকুলি বা নিঙ্গুশ-এর ৯ টি, হােগলার ১১ টি, নল-এর ৪৫ টি, কুশ-এর ৬৩ টি, কাশ-এর ৩২ টি, শােলা-র ১১ টি, শর-এর ৩৭ টি গ্রামনাম বিদ্যামান! শুশনি-র মতাে গেঁয়াে শাকের নামে মিলবে ২৯ টি গ্রামনাম। ভাবা যায়! খোঁজ নিলে দেখা যাবে কুমড়াের নামে ১৭ টি, বেগুনের নামে ১৬ টি, হলুদের নামে ২২ টি, কচুর ১৮ টি, লাউয়ের ১৯ টি গ্রামনাম রয়েছে। 

ধানের মতাে অর্থকরী ফসলের নামে গ্রামনাম থাকবে না তা কি হয় ? এ রাজ্যে এই নামে গ্রামনাম আছে ১২৮ টি। নিরীহ ভালাে শস্য মুগ, মুসুর, ছোলা, কলাই, তিল-ও গ্রামনাম সৃষ্টিতে ব্যবহৃত হয়েছে বারংবার। এ রাজ্যে কাপাসের ২৭ টি, তিলের ৭৩ টি, পাটের ৬২ টি এবং সরিষার নামে ২৫ টি গ্রামনাম দেখতে পাওয়া যাবে। এ ছাড়া ফুল হিসেবে সবচেয়ে বেশি গ্রামনাম তৈরি হয়েছে চাঁপা ফুলের (৩৪ টি) নামে। অথচ এই ফুলটি আজ দেখতে পাওয়া যায়না তেমনভাবে। শালুক, অশােক, পলাশ, কাঞ্চন, শিউলি, পদ্ম ফুলের নামেও রয়েছে গ্রামনাম। ফুল-কে আমরা বলি কুসম। স্রেফ 'কুসুম' শব্দ দিয়েই আছে ৬০ টি এবং 'ফুল শব্দ দিয়ে ১১০ টি গ্রামের নামকরণ হয়েছে। 

রাজ্যের বিভিন্ন জেলার মতাে পূর্ব মেদিনীপুর জেলাতেও উদ্ভিদের নামে এরকম বহু গ্রামনাম মিলবে। এইসব গ্রামনামগুলি থেকেই গাটা জেলার একটা ভূপ্রকৃতিগত অবস্থান বােঝা সম্ভব হবে বলে আমার ধারণা। সেখানকার মৃত্তিকা, জলবায়ু, উর্বরতা, কৃষিকাজ, মানুষের জীবন জীবিকা সম্পর্কে একটা ধারণা তৈরি হবে উদ্ভিদনামে সৃষ্ট গ্রামনামগুলি থেকে। এখানে গাছকে কেন্দ্র করে কীরকম লৌকিক আচার এবং সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে তাও কিছুটা আঁচ পাওয়া যাবে। গাছকেন্দ্রিক জনজীবন কতখানি প্রভাবিত করেছে জেলাকে, তাও জানা যেতে পারে। সর্বোপরি গাছের নাম যুক্ত গ্রামটিতে বর্তমানে সেইসব গাছের প্রাধান্য বা প্রভাব কেমন তার আঁচ মিলবে। এজন্য দরকার নিবিড় ক্ষেত্রসমীক্ষা। পূর্ব মেদিনীপুর জেলাতে ২৫ টি পঞ্চায়েত সমিতির ২২৩ টি গ্রাম পঞ্চায়েতে এবং ৫ টি পৌর এলাকাতেই উদ্ভিদনামে গ্রামনায় ছড়িয়ে রয়েছে। 
এবার আসি জেলায় ব্লক ভিত্তিক কী কী গ্রামনাম রয়েছে যার সাথে উদ্ভিদ বা গাছের সংসর্গ রয়েছে।

পাঁশকুড়া ১নং ব্লক : পলসা, ডালপাড়া, শিমূলহান্ডা, ক্ষীরাই, পুরুল, খেজুরতলা, খসরবন, কলাগেছ্যা, কেন্দুয়াটা বা কেন্দুয়াড়া, চাঁপাডালি, পাকুড়িয়া, মুগদাঁড়ি, আমডুবি, বেনাগলিশা, বেগুনবাড়ি, ভাটাচক, পলতাবেড়িয়া, বেলদা, আমড়াগােয়াল, আখােয়াড়, মেচগ্রাম, অর্জুনদা, গুড়চাকুলী, চাউল্যাকুড়ি। 

পাঁশকুড়া ২নং ব্লক : পারুলিয়া, সজনাগেছিয়া, ছাতিন্দা, বেতবেড়িয়া, মান্দারগেছিয়া, আমলহান্ডা, কূলহান্ডা, কলাগেছিয়া, মেচেদা। 

ময়না ব্লক : বৈতালচক, তিলখােজা, হােগলাবেড়িয়া, নারিকেলদা, কলাগেছিয়া।

নন্দকুমার ব্লক : শ্যাওড়াবেড়িয়া জালপাই, বৈঁচবেড়িয়া, নারিকেলদহ বা নারিকেলদা, বেতকল্লা, পিঁয়াজবেড়িয়া, চক শিমূলতলা, খেজুরবেড়িয়া, মান্দারবাড়িয়া। 

শহীদ মাতঙ্গিনী ব্লক : হােগলা, পাকুড়িয়া, ক্ষারুই, আস্তাড়া, জামিত্তা, ডুমরা, হলদিচক। 

মহিষাদল ব্লক : সরবেড়িয়া, বেতকুণ্ডু, তেঁতুলবেড়িয়া, কাপাসএড়া, কাঞ্চনপুর জলপাই, চাঁপি।

তমলুক ব্লক : শিমুলিয়া, হিজলবেড়িয়া, নিমতৌড়ি, পদুমপুর, কুলবেড়িয়া, বঁহিচাড়, তমলুক, কাঁকুড়আড়া, পদুমবসান, কলাতলা। 

কাঁথি-১ নং ব্লক : আকন্দি, বেতগেড়িয়া, জামনা, জুনবনি, জুনপুট, কাদুয়া, করাঞ্জি, বেতবনি, উলুবেড়ে, সরিষবেড়িয়া, তেঁতুলমুড়ি, বেলতলিয়া, পলতাবেড়িয়া, আমড়াতলিয়া, কাপাসদা, কূলবেড়িয়া, আখগেড়্যা, সিমাগেড়িয়া, চাউলখােলা, ছনবেড়্যা, বরুনাবেড়্যা, অনলবেড়্যা।

কাঁথি-২ নং ব্লক : খাগড়াবনি, ঝাউবনি, চালতি, কেন্দুয়া, ফুলবাড়ি, উত্তর আমতলিয়া, পারুলিয়া, উত্তর আদাবেড়িয়া, কুশবনি, কেশুরকুন্দা, শরপাল।

দেশপ্রাণ ব্লক : কাশমিলি, তালদা, ডুমুরবেড়িয়া, কাকুড়িয়া, বেনামুড়ি, বেলদা, লাউদা, গুয়াগেছিয়া, আমড়াতলিয়া।

সুতাহাটা ব্লক : শিমূলবেড়িয়া, গােলাপচক, খড়িবেড়িয়া, বেগুনবেড়ে, আসৎতলিয়া, জামবেড়ে, দুধ্বাবেড়ে।

নন্দীগ্রাম-১ নং ব্লক : পারুলবাড়ি, শিমুলকুণ্ডু, বৈঁচাবাড়ি, আমগেছ্যা, বাড় জামতলিয়া, আমতলিয়া, চম্পাইনগর, খড়িবেড়িয়া, আকন্দবাড়ি, ফুলনি।

নন্দীগ্রাম-২ নং ব্লক : আশদতলিয়া, আমড়াতলা, তেঁতুলবাড়ি।।

চন্ডীপুর ব্লক : ধান্যশ্রী, কদমতলা, খাগদা, হিঞ্চি, কুলবাড়ি। 

খেজুরি-১ নং ব্লক : কাঁকুড়িয়া, কলাগেছিয়া, বাঁশগােড়া।

খেজুরি-২ নং ব্লক : হলুদবাড়ি, খেজুরি, তালপাটি, চালতাতলিয়া, ফুলবাড়ি, অজানবাড়ি, বটতলিয়া, শিল্যাবেড়িয়া, হিজলী শরিফ, কাশতলা, বড় গরানিয়া, ছােট গরানিয়া।

এগরা-১ নং ব্লক : অর্জুনী, তেঁতুলিয়াগিরি, তেঁতুলিয়া, তেঁতুলমুড়ি, পানিপারুল, উলুয়া, শিমুলিয়া, বেতাহাট, আকন্দি, খাগদা, খেজুরদা, বৈঁচা, এরেন্দা, চাউলদা।

রামনগর-১ ও ২ নং ব্লক : ঝাউগেড়িয়া, তালগাছাড়ি, তেঁতুলিয়া, কিয়াগেড়িয়া, চম্পাবনি, বাঁশবনি, ফুলবাড়ি, অর্জুনি, অশ্বথপুর, করঞ্জি, খইরাপাল।

পটাশপুর-১ নং ব্লক : ডাঙ্গরতুলসী, আমগেছিয়া, নানকার কদমগেড়িয়া, তালডিহা, তালছিটকিনি, কাঁকুড়িয়াডাঙ্গা, বেলদা, খড়িবেড়িয়া, আম্বি।

পটাশপুর-১ নং ব্লক : হিঞ্চিবাড়, নিমজা, বৈঁচা, নলপাদা। 

ভগবানপুর-১ নং ব্লক : হিঞ্চাগেড়িয়া, সরবেড়িয়া, কাঠগেছ্যা, কলাবেড়িয়া, শিমূলিয়া, কূলবেড়িয়া, বেতুলিয়াবাড়, শিউলিপুর, নাটালিয়া, আমড়াতলিয়া, আশুতিয়া, ধানদা, গুড়গ্রাম।

ভগবানপুর-২ নং ব্লক : হরিদ্রাচক, নাটাগেছিয়া, ইক্ষুপত্রিকা, পারুলিয়া, বিরিবাড়ি, বাজকুল, শিমূলদাঁড়ি, শিমূলবাড়ি, চিনাবেড়্যা, অর্জুননগর, চম্পাইনগর, খেজুরগেছিয়া, কেন্দুয়া।

মােটামুটি পূর্ব মেদিনীপুর জেলায় গাছের নামে সৃষ্ট এরকম গ্রামনামের সংখ্যা প্রায় ২০০টি। কোথাও মৌজা হিসেবে তা প্রচলিত। আবার কোথাও জনপ্রিয় বাসস্ট্যান্ড, হাট, পাড়া বা গঞ্জ এলাকার নাম উদ্ভব হয়েছে উদ্ভিদ নামে। হয়তাে বা এক্ষেত্রে কোথাও ব্যবহৃত নকশা বা পড়চাতে সেই গ্রামের নাম উল্লেখ নেই। কেবলমাত্র লােকমুখে তা প্রচলিত হয়ে আসছে।

কীভাবে হয়ে থাকে গাছের নামে নামকরণ ?

সাধারণত যদি কোনাে জনপদ গড়ে ওঠে কোনাে এলাকায় এবং সেখানে যদি কোনাে বৃহৎ এবং প্রাচীন গাছ থাকে, তবে সেই এলাকার পরিচিতিজ্ঞাপক হয়ে ওঠে ওই গাছ। ধীরে ধীরে সেটাই হয়ে ওঠে ওই এলাকার পরিচয়। ওই এলাকার গ্রামের নাম। আবার কোনাে এলাকায় যে গাছের আধিক্য বেশি বা যে গাছ বেশি জন্মে সেই গাছের নামেও এলাকার পরিচিতি গড়ে ওঠে। এ প্রসঙ্গে তারাপদ সাঁতরার মন্তব্য উল্লেখ করা যায় "আমাদের গ্রামের নামকরণ নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করলে দেখা যায়, গ্রামের নাম এসেছে প্রায় নব্বই ভাগ গাছপালা লতাপাতার নাম থেকে। বিষয়টি হ'ল মানুষ যখন বসবাসের জায়গা খুঁজে পেতে গ্রামের পত্তন শুরু করেছে এবং সে বসবাসের স্থানটিকে তাঁরা চিহ্নিত করেছে, সেখানের উল্লেখ্য গাছপালাকে চিহ্নিত করে অর্থাৎ গাছের নিশানদিহি মতে নামকরণ করা হয়েছে নিজ গ্রামের"। 

গাছের নামের সাথে নানা আদ্যপদ এবং অন্ত্যপদ যুক্ত হয়ে গ্রামনামের উদ্ভব হয়েছে। গেড়া বা গেড়িয়া, তলা বা তলিয়া, বাড়, বাড়ি, মুড়ি, পুর, চক, আড়া, নগর, গড় ইত্যাদি যুক্ত হয়ে উদ্ভিদনামে গ্রামনাম বা স্থাননাম রয়েছে। পূর্ব মেদিনীপুর জেলাতেও তা দেখা যায়।


চক  -- সংস্কৃত 'চতুষ্ক' শব্দ থেকে 'চক' কথার উৎপত্তি। যার অর্থ নদীচরের লুপ্তভূমি। উইলসন সাহেব 'চক' এর অর্থ হিসেবে বলেছেন -- প্রধান মৌজা থেকে বিচ্ছিন্ন কোনাে অংশ, যাকে সামান্য খাজনাদায়ী বা নিষ্কর ভূ সম্পত্তি হিসেবে এক সপ্তে গণ্য করা হয়। অতি পূর্বে গ্রামবাসীদের নিকট থেকে নেওয়া জমিতে বাইরের কাউকে পত্তন করলে সে জমি পরিচিত হত 'চক' নামে। চক যুক্ত মৌজার সংখ্যা দুই মেদিনীপুরে রয়েছে অসংখ্য। উদ্ভিদনামের সাথে 'চক' যুক্ত হয়ে পেয়েছে গ্রামনাম। যেমন—হরিদ্ৰাচক, বৈতালচক, ভাটাচক। 

নানকার -- ফার্সি শব্দ 'নান' অর্থাৎ রুটি। মােঘল শাসনে মুর্শিদ কুলি খাঁ-র সময় রাজসেবকদের জন্য নিষ্কর বৃত্তি ভূমিকেই বলা হত 'নানকার'। বঙ্কিম মাইতি বলেছেন—“নবাবী শাসনে জমিদারদের নিজেদের পরিবারের ভরণপােষণের জন্য বিনা রাজস্বে নানকার জমি ভােগ কবার অধিকার পেতেন। নানকার ভূমিতে জঙ্গল থেকে কাঠ কাটার, শিকার করার, জলাভূমিতে মাছ ধরার অধিকার থাকত"। এই নানকার শব্দের সাথে বৃক্ষনাম যুক্ত হয়ে গ্রামনামের উদ্ভব। যেমন—নানকার কদমগেড়িয়া। 

তলা -- ‘তল’ শব্দ (সংস্কৃত) থেকে 'তলা-র উৎপত্তি। এরই অন্যরূপ তলিয়া, তল্যা, তলি ইত্যাদি। যার অর্থ অধােভাগ বা নীচের পিঠ। কোনাে এলাকার গাছের তলদেশ তথা ওই গাছকে সামনে রেখে সৃষ্ট জনবাদই হয়ে উঠেছে উদ্ভিদনামে গ্রামনাম। যেমন—আমড়াতলিয়া, বেলতলিয়া, আসদতলিয়া, বটতলা, আমতলিয়া।

গেছিয়া -- 'গাছ' থেকে সৃষ্ট হয়েছে গেছিয়া, গেছে, গাছিয়া, গাছা শব্দগুলি। গাছের নামের সাথে এই অন্ত্যপদ যুক্ত হয়েছে বহু ক্ষেত্রে। এই অন্ত্যপদ যুক্ত গ্রামনাম আসলে চারপাশের ভূপ্রকৃতির সঙ্গে ওই এলাকার নৈকট্যের পরিচায়ক বলে মনে করেন অমিয় কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়। সংস্কৃত 'গচ্ছ' থেকে উৎপত্তি গাছ শব্দের। যেমন- মান্দারগেছ্যা, আমগেছিয়া, কলাগেছা, সজনাগেছিয়া, তালগাছাড়ি।

গেড়িয়া -- গেড়্যা বা গেড়া শব্দ থেকে ‘গেড়িয়া’, ‘গো-র সৃষ্ট। যার অর্থ গর্ত বা ডােবা। মেদিনীপুর এলাকায় 'গেড়িয়া' অর্থে পুকুরকে বােঝায়। অর্থাৎ এখানে অর্থের ব্যপ্তি ঘটেছে। ভারতচন্দ্রের 'বিদ্যাসুন্দর'-তে 'গেড়ে' শব্দ পাই। মানিক গাঙ্গুলির 'ধর্মমঙ্গল'-তে আছে 'সরােবর ত্যাগ করে পচা গেড়ায় সরে'। 'শিবায়ন' কাব্যে আমরা পাই 'কলম্বীর শাক খেয়ে উজাড়িল গেড়ে'। তবে 'গেড়ে' কথাটির উদ্ভব হয়েছে 'গাড়' থেকে। যার অর্থ গর্ত। এবার উদ্ভিদনামের সাথে এই অন্ত্যপদগুলি যুক্ত হয়েছে। গেড়া বা গেড়িয়া তীরে যেসব গাছের আধিক্য দেখা যায়। যেমন -  কিয়াগেড়িয়া, আখগেড়া, বাঁশগােড়া, হিঞ্চাগেড়িয়া, নানকার কদমগেড়িয়া, ঝাউগেড়িয়া, গিমাগেড়িয়া, বেতগেড়িয়া।

বেড়িয়া -- 'বাড়ি' থেকে 'বেড়িয়া', 'বেড়্যা', 'বাড়', 'বাড়িয়া'-র উৎপত্তি। বিশেষ জনপ্রিয় এবং লােকবসতি অর্থে ব্যবহৃত। 'বাড়' অর্থে বেষ্টন করা বা ঘেরা বােঝায়। গ্রামনাম সৃষ্টিতে কখনও 'বাড়' আবার কখনও 'বেড়ে' যুক্ত হয়েছে। যেমন—খড়িবেড়িয়া, শিল্ল্যাবেড়িয়া, বেগুনবেড়ে, ডুমুরবেড়িয়া, উলুবেড়ে, আদাবেড়িয়া, মরিচাবেড়িয়া, সরবেড়িয়া, তেঁতুলবেড়িয়া, কূলবেড়া, রেতবেড়িয়া, চালতাবেড়িয়া, হােগলাবেড়্যা, খেজুরবেড়িয়া, হিজলবেড়া, বৈঁচবেড়্যা, পিঁয়াজবেড়্যা ইত্যাদি দেখা যায়। তেমনি মিলবে বেতুলিয়াবাড়, হিঞ্চিবাড়, বিরিবাড়ি, শিমুলবাড়ি, ফুলবাড়ি, বেগুনবাড়ি ইত্যাদি। এই গ্রামগুলির ক্ষেত্রে বলা যায় কোনাে এলাকায় যেসব গাছ বেশি বেষ্টন করে রয়েছে। যেখানে পলতা গাছের বেষ্টনি রয়েছে তাই-ই পলতাবেড়িয়া। দ্বিতীয়গুলির ক্ষেত্রে যে লােকবসতি এলাকার যে গাছের আধিক্য আছে। যেখানে হিঞ্চা গাছের বাড় বা বসতি বা আধিক্য তাই-ই হিঞ্চিবাড়।

পুর -- এর আভিধানিক অর্থ নগর। ঋগ্বেদ, রঘুবংশ ভট্টিকাব্য- তে 'পূর' শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। সবচেয়ে বেশি গ্রামনাম সৃষ্ট হয়েছে এই অন্ত্যপদ যুক্ত হয়ে। ড. বঙ্কিম মাইতি 'পুর' শব্দের বিস্তার বােঝাতে গিয়ে বলেছেন "প্রাথমিক স্তরে একই কোমের পাশাপাশি কয়েকটি বাড়ি নিয়ে গ্রাম সমুদায় গড়ে উঠত। গ্রামের অভ্যন্তরে প্রতিরক্ষা ব্যুহ ছিল 'পুর'। পরবর্তীকালে রাজধানী, দেবনগরী অর্থেও ব্যবহার হল। একান্ত অর্বাচীন কালে জমিদার বিত্তবান প্রতিষ্ঠিত নতুন বসতি বা পুরানাে বসতির নাম পরিবর্তন করে, ব্যক্তি নামের সঙ্গে যুক্ত করে আভিজাত্যের দাবিদার হয়ে উঠল"। পূর্ব ভারতে ৮ ম - ৯ম শতক থেকেই 'পুর' অন্ত্যপদ যুক্ত স্থাননামের খোঁজ মেলে। উদ্ভিদনামের সাথে 'পুর' যুক্ত হয়ে পূর্ব মেদিনীপুরে অনেক গ্রামনাম সৃষ্টি হয়েছে। যেমন—কাঞ্চনপুর জালপাই, হলদিপুর, পদুমপুর। 

নগর -- অতি পরিচিত শব্দ। যার আভিধানিক অর্থ 'পুরী' বা শহর। গ্রামনাম সৃষ্টির ক্ষেত্রে কোনাে এলাকাকে বােঝাতে নগর ব্যবহৃতহয়। নগর যুক্ত বৃক্ষ নামে গ্রামনামগুলি হল—চম্পাইনগর, অর্জুন নগর।

জালপাই -- লবণ তৈরির ঘটনার সাথে সম্পৃক্ততা রয়েছে জালপাই শব্দের। সরাসরি গাছের সাথে কোনাে সম্পর্ক না থাকলেও পরােক্ষভাবে রয়েছে। যেসব গ্রামে একসময় লবণ উৎপাদন হত, সেইসব গ্রামের নামের সাথে জালপাই শব্দটি যুক্ত হয়েছে। লবণ তৈরি হত সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকাতে। তাই স্বভাবতই জলপাই যুক্ত গ্রামগুলির অবস্থিতিও সমুদ্র তীরবর্তী এলাকাতেই। একসময় ব্রিটিশ শাসনধীন বঙ্গে পূর্ব মেদিনীপুর (তখনকার মেদিনীপুর) জেলাতেই সবচেয়ে বেশি লবণ উৎপাদিত হত। যাঁরা লবণ তৈরি করেন তাঁদের বলা হত 'মলঙ্গী'। তেলুগু-তে ‘পায়' বা 'পাই' শব্দের অর্থ হল শাখা নদী। এই 'পায়' এবং 'পাই' যুক্ত হয়ে এরাজ্যে বহু গ্রামনামের সৃষ্ট হয়েছে। যেমন—জলপাইগুড়ি। অর্থাৎ তিস্তা নদীর ধারে যত এলাকা। তেমনি জালপাইকে ভাঙলে আমরা পাবাে জ্বাল + পাই। 
'জ্বাল' অর্থাৎ জ্বালানি অর্থাৎ নদীর ধারে যেখানে জ্বালানি গাছপালা পাওয়া যেত। লবণ উৎপাদনকারী মলঙ্গীরা যেখানে সমুদ্রের লবণাক্ত জল জ্বাল বা জ্বালানি দিয়ে ফুটিয়ে লবণ তৈরি করত। সেই জ্বালানির জন্য ওই স্থানেরই গাছ গাছড়া শুকনাে করে ব্যবহার করা হত। অতয়েব, 'জালপাই' এর অর্থ দাঁড়ালো জঙ্গল ভর্তি জমি থেকে জ্বালানি সংগ্রহ করতে দেওয়া হ'ত যে এলাকায়। 'জ্বালপাই' শব্দটিই ক্রমশ রূপান্তরিত হয়ে 'জলপাই' হয়েছে। এককথায় জ্বালানি পাওয়া জমি। ১৯২১ সালে কাঁথি থেকে প্রকাশিত 'হিজলী হিতৈষী' পত্রিকার ৯ ই জুন তারিখে 'জালপাই' নানকরণের কারণ বর্ণিত করা হয়েছিল। ওই পত্রিকায় লেখা হয়েছিল নিম্নরূপ—“জালপাই জমির অধিকাংশই জঙ্গল ছিল। 'জাল' শব্দের অর্থ জ্বালানি কাঠ এবং 'পাই' অর্থে বিস্তীর্ণ অনাবাদি ভূমি বােঝায়। 'জালপাই' শব্দের অর্থ FUEL SUPPLYING WASTE LAND । লবণ প্রস্তুতের জন্য এজেন্সী কার্যের জমিগুলি তিন প্রকারে ব্যবহার করা হত। অর্থাৎ কতক জমিতে জোয়ার জল উঠাইয়া লবণ জল ধরিয়া রাখিতে হইত। সেই জল ফুটাইয়া মারিয়া লবণ প্রস্তুতের জন্য সূচনা বা উনুন করিতে কতক ভূমির প্রয়ােজন হইত। ওই তিন প্রকার ভূমিই জালপাই জমি বলিয়া আখ্যাত হইয়া আসিতেছে।”

পূর্ব মেদিনীপুরে যে ২২ টি 'জালপাই' যুক্ত গ্রামনাম রয়েছে সেগুলি হল - শ্যাওড়াবেড়িয়া জালপাই, কাঞ্চনপুর জালপাই, টিরাইপুর জালপাই, কেশবপুর  জালপাই, তেরাপাড়া জলপাই, কেন্দেমারি জালপাই, সােনাচূড়া জালপাই, সমুচক জালপাই, সাউদখালি জালপাই, নরসিংহপুর জালপাই, বাঁশখানা জালপাই, ঈশ্বরদহ জালপাই, বাগুরান জালপাই, সমুদ্রপুর  জালপাই, দামােদরপুর জালপাই, শ্যামপুর জালপাই, রঘুসর্দারবাড় জালপাই, কালীচক জালপাই, শ্যামরায়বাড় জালপাই এবং গােড়াহার জালপাই। এর মধ্যে উদ্ভিদ নামের সাথে 'জালপাই' যুক্ত হয়েছে যে গ্রামগুলি সেগুলি হল বাঁশখানা জালপাই, কাঞ্চনপুর জালপাই এবং শ্যাওড়াবেড়িয়া জালপাই।

পুট -- আভিধানিক অর্থ পাত্র বা আধার, তামিল এবং মালয়লাম ভাষায় রয়েছে 'পুট্টিলা'। তেলুগুতে রয়েছে 'পুটি'। যার অর্থ গভীর পাত্র বা ঝুড়ি। এই 'পুট' অন্ত্যপদ যুক্ত গ্রামনাম বেশি দেখা যায় কাঁথি এলাকায়। ওড়িশা সংলগ্ন তা। যার অর্থ জলাবর্ত সংরক্ষিত গ্রাম। বিভিন্ন উদ্ভিদের নামের সাথে 'পুট' যুক্ত হয়ে সৃষ্ট গ্রামনামগুলি হ'ল - জুনপুট, চেঁচুয়াপুট, বাঘুয়াপুট, কালসিমাপুট, মানকড়াইপুট, বাদিপুট, আলদারপুট। 

বনি --  জনবসতি বাড়লেও জঙ্গল কেটে জনবসতি গড়ে তােলার স্মৃতি কিছু ক্ষেত্রে এখনও বিদ্যমান। অরণ্য ক্রমশ মানুষদের জন্য জায়গা ছেড়ে দিলেও একসময় যে যেখানে তাদের অবস্থান ছিল তার প্রমাণ মেলে গ্রামের নামের সাথে। নতুন নতুন বসতির সেইসব গ্রামনামের সাথে অন্ত্যপদ বা আদ্যপদ হিসাবে যুক্ত থাকে ‘বন', 'বনী’, ‘বনা’, ‘বনি’, ‘বুনী’ শব্দগুলি। যা আসলে অরণ্য সংশ্লিষ্ট থাকার প্রমাণপত্র। এই শব্দগুলি সবই মূল তৎসম শব্দ 'বন'-এর আঞ্চলিক রূপভেদ। যেসব গ্রামনাম পাই তা হল - চম্পাবনি, কুশবনি, জুনবনি, খসরবন, খাগড়াবনি, বাঁশবনি। 

বসান -- মূল শব্দ 'বসানাে' থেকে এসেছে 'বসান' শব্দটি। 'চলন্তিকা' অনুসারে যার অর্থ উপবেশিত করা বা স্থাপন করা। 'কবিকঙ্কন চণ্ডী'-তে মেলে 'বসান নগর' কথাটি। মানিক গাঙ্গুলির 'ধর্মমঙ্গল'-তে পাই ‘বিসাই বসানে সান'। কোনো স্থানে নতুন বসতি স্থাপিত হলে সেই স্থানের পরিচিতি জ্ঞাপক কোনাে চিহ্ন বা বস্তুর সাথে অন্ত্যপদ 'বসান' যােগে সৃষ্ট হয় নতুন গ্রামনাম। দুই মেদিনীপুরে যে'কটি 'বসান' যুক্ত গ্রামনাম রয়েছে সেগুলি হল - পদুমবসান, মুগবসান, কুশবসান, চাপবসান, নকিবসান, নিশ্চিন্তবসান, ব্রাহ্মণবসান, জগাইবসান, জানুবসান, বিরিঞ্চিবসান, উত্তর নাড়াবসান, ঘােড়াবসান, তিপান্নবসান, মানিকবসান, সােমাইবসান, ভান্দুবসান, যুক্তিবসান, রামবসান, গােবিন্দবসান, মাধববসান, নকিবসান, নয়াবসান, শ্রীধরবসান, চকদুর্গাবসান, সাঁতরাবসান, জামবুরবসান, ভগবানবসান, বেতালবসান, রাণীবসান, রঙ্গীবসান ইত্যাদি। এরমধ্যে প্রথম চারটি গ্রামনামের সাথে উদ্ভিদের সংযােগ রয়েছে।

এ প্রসঙ্গে একটি লৌকিক ছড়া পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুরে বহুল প্রচলিত। তা হল "সাত কালুয়া, বারাে বসান, তেরাে দা / যে বলতে পারে সে তমলুকের ছা"। কিন্তু জেলায় ১২ টি 'বসান'যুক্ত গ্রামনামের তুলনায় অনেক বেশিই রয়েছে তা উপরিউক্ত তালিকাই প্রমাণ করে। 

গ্রাম -- এটি একটি পুংবাচক শব্দ। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'বঙ্গীয় শব্দকোষ'তে 'গ্রাম' এর বুৎপত্তি হিসেবে রয়েছে [গ্রস +ম (মন)-ধি, উনাদি সুত্র ; গম্ অ (ঘ)-ৰ্ম্ম, নিপাতিত (অমরকোষ টীকা)]। 'ভাগবত টীকা' অনুসারে 'গ্রাম' শব্দ ব্যাখ্যা করা হয়েছে—“বিপ্রাশ্চ বিপ্রত্যাশ্চ যত্র চৈব বসন্তি তে। স তু গ্রাম ইতি প্রােক্তঃ শুদ্রানাং বাস এব চ।” আবার 'অমরকোষ টীকা'তে পাই "বিপ্রাদিবর্ণ প্রায় প্রাকার পরিখাদিহীন বহু জনবসতি"। জীবানন্দ প্রকাশিত 'শুক্রনীতিসার' অনুসারে পাই-"এক গ্রাম পরিমিত ও সহস্র রৌপ্যমুদ্রারাজস্ব ভূভাগ গ্রাম"। তবে রাজশেখর বসু সংকলিত 'চলন্তিকা'-তে 'গ্রাম' অর্থে গাঁ, পল্লি, লােকালয় বা পাড়াগাঁ বুঝায়। 

মূল সংস্কৃত শব্দ 'গ্রাম' থেকে ‘গাঁ’ বা গাঁও' এর উৎপত্তি। বহু ক্ষেত্রে গ্রামনাম সৃষ্টিতে অন্ত্যপদ হিসেবে এগুলি যুক্ত হয়ে থাকে। 'বঙ্গীয় শব্দকোষ' অনুসারে সংগ্রাম > লি, প্রাকৃত গ্রাম > বা (গা) গাঁ। পূর্ব মেদিনীপুরে উদ্ভিদ সংসর্গ যুক্ত 'গ্রাম' অন্ত্যপদ সহযােগে গ্রামনামগুলি হল—মেচগ্রাম, গুড়গ্রাম ইত্যাদি।
_________________________________________

প্রকাশিতব্য 

উদ্ভিদনামে গ্রাম নাম ( পর্ব - ২)
www.jaladarchi.com 


Post a Comment

6 Comments

  1. অপূর্ব পর্যবেক্ষণ। ধন্যবাদ।

    ReplyDelete
  2. বেশ এগুচ্ছো। নতুন নতুন লেখা পাচ্ছি। নতুন বই কবে পাব।

    ReplyDelete
  3. দারুন ভাবনা। খুবই মজাদার। শুভেচ্ছা রইলো।

    ReplyDelete
  4. খুব সারগর্ভ রচনা। অনেক লুকিয়ে থাকা পরিচয় আলোয় ধরার কৃতিত্ব লেখকের। আনন্দ পেলাম।

    ReplyDelete