কবিতার তৃতীয় ভুবনে, কণ্ঠে – উচ্চারণে
পর্ব – ৩আ র ণ্য ক ব সু
আবৃত্তিযোগ্য কথাটার অর্থ কী?
কবিতা এমন সত্যি চোখে চোখ রাখে
কবিতা এমন ইচ্ছে লজ্জা দিয়ে ঢাকে
কবিতা বন্ধু হয়ে ভাঙা খেয়াঘাটে
কবিতাকে আলো দিয়ে সূর্য নামে পাটে।
প্রিয় কবিতা বন্ধুরা, বিগত দুটি পর্বে কবিতার কাছে নতজানু আত্মসমর্পণের অনুভূতি লিখেছি। আপনাদের ভালো লেগেছে, কেননা এই কলমটি তাঁরাই পড়ছেন যাঁদের কবিতার প্রতি একটি অনিবার্য প্যাশান আছে। আমি এবারে কবিতার ব্যবহারিক দিক, অর্থাৎ আবৃত্তিশিল্প নিয়ে কথা বলতে চলেছি। বেশ কয়েক বছর আগে একটি সামাজিক নিমন্ত্রণে গিয়ে অদ্ভুত অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হই। আমাকে চিনতে পেরে একজন ভদ্রমহিলা নমস্কার করে খুব সুন্দরভাবে বললেন – আমি একজন আবৃত্তিশিল্পী। আপনার কবিতা আমার খুব ভালো লাগে। আমাকে আপনার কিছু আবৃত্তিযোগ্য কবিতা যদি পাঠিয়ে দেন খুব ভালো হয়। শুনে আমি একই সঙ্গে বিস্মিত ও দিশাহারা। তবু সেই সুন্দরী মহিলার সামনে কোনোমতে টাল সামলে দাঁড়িয়ে যথাসম্ভব মাথা ঠান্ডা রাখবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু হলে কী হয়! কবির অন্তরে যেমন ফুলের বাগান থাকে, তেমনি ঠোঁটকাটা দাঁড়কাকের কর্কশ আওয়াজটাও থাকে। আমি দুম করে বলে ফেললাম (শুনেছি সুন্দরী মহিলাদের সামনে কঠোরতা প্রকাশ রোম্যান্টিক পুরুষদের পক্ষে শোভন নয়) – আচ্ছা ম্যাডাম, আবৃত্তিযোগ্য কবিতা ব্যাপারটা একটু বুঝিয়ে বলবেন? ভদ্রমহিলা স্মার্টলি উত্তর দিলেন – মানে যে কবিতা সকলেই সহজে বুঝতে পারবে, সেটা ছন্দে লেখাও হতে পারে, গদ্যেও হতে পারে। মানে এককথায় মানুষ আমার কবিতা শুনে আমাকে দারুণভাবে উৎসাহিত করবে। আমার গলার আওয়াজ তখন পুরোপুরি দাঁড়কাক দখলে নিয়ে নিয়েছে। আমি বললাম – আপনি জীবনানন্দ দাশের মুখোমুখি হলে একথা বলতে পারতেন? ভদ্রমহিলা বুঝলেন হাওয়া খারাপ, তাই, একটু আসছি বলে সরে গেলেন। আমার তাঁকে বলা হলোনা – মাননীয়া, আপনি শম্ভু মিত্রের কণ্ঠে রবীন্দ্রনাথের নীলমণিলতা শুনেছেন? জীবনানন্দের বোধ অথবা হাওয়ার রাত শুনেছেন? কিংবা মনপ্রাণ এক করে মধুবংশীরগলি শুনেছেন?
প্রিয় কবিতা বন্ধুরা, গত শতকের চল্লিশের দশকে নাট্যাচার্য শম্ভু মিত্র যখন হাজার হাজার মানুষের সামনে শুধু কণ্ঠস্বরকে সম্বল করে জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রের মধুবংশীরগলি আবৃত্তি করতেন (যে দীর্ঘ কবিতার প্রায় নব্বইভাগ অংশ অনাটকীয় এবং বর্ণনামূলক, শুধু শেষের দশভাগ অংশ চূড়ান্তভাবে নাটকীয় ও মর্মস্পর্শী), তখনতো মানুষ প্রশ্ন করেননি এই কবিতার আবৃত্তিযোগ্যতা সম্পর্কে! আসলে আমরা বোধহয় কবিতা পড়বার অভ্যাসটাই ভুলতে বসেছি। পারফর্মাররা শুধু গলা খেলিয়ে কিছু অতিনাটকীয় মুহূর্ত মাইক্রোফোনের সামনে উগরে দিয়ে (কীবোর্ডের সহযোগিতায়) দর্শকের চটজলদি বাহবা পেতে অতিরিক্ত উৎসাহী হয়ে পড়েছেন। সুকণ্ঠের অধিকারী হলে নারী বা পুরুষ, যেকোনো শিল্পীই পারেন গ্রহণযোগ্য কোনোকিছু পরিবেশন করতে। আমি বিনীতভাবে অনুরোধ করবো, বাংলা সাহিত্যের যে সমস্ত কবিরা রাতের পর রাত জেগে, খাতায়-কলমে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের মহাকাব্য লিখে গেছেন, কালরাত্রি – মহারাত্রির গভীরতম অন্তরমহলে প্রবেশ করে শব্দের প্রতিমা নির্মাণ করেছেন; আজকাল সুদূর মফস্বলে বসেও সেইসব কবিদের শ্রেষ্ঠ কবিতা বা নির্বাচিত কবিতার বইগুলো এখন অনায়াসেই সংগ্রহ করতে পারেন।
শুধু কোনো বিখ্যাত কবিতার পাতা জেরক্স করে আবৃত্তিশিল্পী হবার চেষ্টা করবেন না। আমরা অনেক ফূর্তিতে পয়সা ওড়াই, সেই অর্থের একটা অংশ ব্যয় করে কবিতার বই কিনুন এবং দিনের মধ্যে কয়েকঘন্টা কবিতা পড়বার অভ্যাস তৈরী করুন। সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে আপনি হয়তো ইতিমধ্যেই একজন তথাকথিত “প্রখ্যাত বাচিকশিল্পী” হয়ে উঠেছেন, কিন্তু আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বলুনতো, আপনার বাড়িতে কতগুলো কবিতার বই আছে? কবিতার সরস্বতী আপনার শোকেসে কতগুলো কাব্যগ্রন্থের পাতায় পাতায় আপনাকে প্রতিদিন হাতছানি দিয়ে ডাকছেন?
আসলে কবিতা কবিতাই। সব কবিতাই আবৃত্তিযোগ্য, যদি তেমনকরে বলতে পারা যায়। কথাগুলো তিতো লাগলে আমাকে ক্ষমা করবেন। পরের সপ্তাহে আবার আপনাদের মুখোমুখি হবো।
0 Comments