জ্বলদর্চি

কবিতার তৃতীয় ভুবনে- ৪




কবিতার তৃতীয় ভুবনে, কণ্ঠে – উচ্চারণে
পর্ব- ৪

আ র ণ্য ক  ব সু


বই কেনা, বই পড়া, আর কবিতার সরব মুহূর্ত



কবিতাও ছিল আগুনের মতো দহনে
গলার আওয়াজে কেঁপেছে গভীরে গহনে;
কবিতা তো আজও রাত পাহারায় জাগে
শ্রাবণের মেঘে, দোল – ফাগুনের ফাগে।



গত শতকের সত্তর দশকের গোড়ায়, বারাসাত হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে লেখা কবি নবারুণ ভট্টাচার্যের মহাকাব্যিক উচ্চারণ – “এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না” কখনই চুপিচুপি পড়বার বিষয়বস্তু নয়। প্রতিবাদে ফেটে পড়ার দারুণ অগ্নিবান। এই আটজন শহিদের সবাই আমাদের আড়িয়াদহ - দক্ষিণেশ্বর গ্রামের ছেলে। আমাদের স্কুলের সাতজন ছাত্র এবং অঙ্কের তরুণ মাস্টারমশাই শঙ্কর চট্টোপাধ্যায় তাদের মধ্যে অন্যতম। কয়েক বছর পরে, শঙ্করদার বাবা স্থানীয় মেঘনাদ মাঠে একটি প্রতিবাদ সভার আয়োজন করেছিলেন। সেখানে উপস্থিত ছিলেন চিত্রপরিচালক মৃণাল সেন এবং তরুণ কবি (বিজন ভট্টাচার্য ও মহাশ্বেতা দেবীর সন্তান) নবারুণ ভট্টাচার্য। মৃণাল সেনের ঝাঁঝালো প্রতিবাদ আর তারপর নবারুণদার কণ্ঠে এই মৃত্যু উপত্যকা.....

মনে হয়েছিল কোথাও যেন হারিয়ে গেছি। শরীরের সমস্ত অনুভূতি যে কোনো কবিতায় এমনভাবে সাড়া দিতে পারে তার আগে তা বুঝতে পারিনি। সম্বিত ফিরে পেয়ে নবারুণদাকে ধাওয়া করে প্রায় দক্ষিণেশ্বর স্টেশনের কাছে গিয়ে কবিতাটি ভিক্ষা করি। নবারুণদা আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে ব্যাগ থেকে একটি ফোল্ডার এগিয়ে দেন আমার উন্মুখ হাতে। আমার তখন হাতে স্বর্গ পাওয়া সুখ। নবারুণদা ট্রেন ধরতে ছুটলেন আর আমি রাস্তার ল্যামপোস্টের নীচে দাঁড়িয়ে ফোল্ডারটা মেলে ধরলাম চোখের সামনে। সেই সময় কলকাতা কাঁপানো নাটক, অসিত বসুর “কলকাতার হ্যামলেট” নাটকের ফোল্ডার। তাতেই এই পুরো কবিতাটি ছাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। মনে আছে, ঠিক চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে এই কবিতাটি পুরোটা মুখস্থ করেছিলাম। বাড়িতে মা, বাবা, দাদা, দিদিকে শুনিয়েছিলাম সেই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ উচ্চারণ। আমার মতে, এই মৃত্যু উপত্যকা.... বাংলা সাহিত্যের সর্বকালের অন্যতম একটি শ্রেষ্ঠ কবিতা। প্রতিবাদ যখন কবিতার ভাষা খুঁজে পায়, তার চেয়ে বড় অস্ত্র বোধহয় আর কিছু হতে পারেনা। দুনিয়ার ঘৃণ্য খুনীরা যেন কথাটা মনে রাখে। আহা, কী তীব্র সেই অসামান্য কবিতার ভাষা – যে পিতা সন্তানের লাশ সনাক্ত করতে ভয় পায়, আমি তাকে ঘৃণা করি। যে ভাই এখনো নির্লজ্জ স্বাভাবিক হয়ে আছে, আমি তাকে ঘৃণা করি। যে শিক্ষক বুদ্ধিজীবী, কবি ও কেরাণী প্রকাশ্য রাস্তায় এই হত্যার প্রতিশোধ চায় না, আমি তাকে ঘৃণা করি। 

প্রিয় বাচিক শিল্পী তরুণ বন্ধুরা, এই কবিতাটা অবশ্যই সংগ্রহে রাখবেন, জেরক্স করে নয়, নবারুণদার কাব্যগ্রন্থটি দয়া করে কিনবেন। রবীন্দ্রনাথের বলাকা কাব্যগ্রন্থের (যেখান থেকে আধুনিক কবিতার সুত্রপাত) খাপ খোলা ঝকঝকে তলোয়ারের মতো প্রতিবাদী কবিতা - “ঝড়ের খেয়া” নিজে পড়বেন এবং অন্যদের মুখস্ত করে শোনাবেন বারবার এবং বারবার। বুকের মধ্যে যেন শিলালিপি হয়ে থাকে কবি সুকান্তের আঠারো বছর থেকে বোধন।

দেখছেন বন্ধুরা, আমি কেমন এলোমেলো ভাবে কবিতার তৃতীয় ভুবনে ঢুকে পড়েছি! চোখের সামনে ভেসে উঠছে, সেই কবেকার ১৮৬০-৬১ সালের কোনো একটা সকালের কাল্পনিক দৃশ্য। সদ্য ঘুম ভেঙে ওঠা, সময়ের থেকে অনেক অনেক এগিয়ে থাকা কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত গভীর ভাবে শ্বাস গ্রহন করে আবৃত্তি করছেন তাঁরই সৃষ্টি মেঘনাদ বধ মহাকাব্য়ের প্রথম পৃষ্ঠা। বাচিক শিল্পী বন্ধুরা, অমিত্রাক্ষর ছন্দ সবসময় সরব পাঠের ছন্দ। তিনি বলছেন, আর আমি বালকের বিস্ময়ে শুনছি – সম্মুখ সমরে পড়ি, বীর-চূড়ামণি বীরবাহু, চলি যবে গেলা যমপুরে অকালে, কহ, হে দেবি অমৃতভাষিণি, কোন্ বীরবরে বরি সেনাপতি-পদে, পাঠাইলা রণে পুনঃ রক্ষঃকুলনিধি রাঘবারি? কি কৌশলে, রাক্ষসভরসা ইন্দ্রজিত মেঘনাদে - অজেয় জগতে – ঊর্ম্মিলাবিলাসী নাশি, ইন্দ্রে নিঃশঙ্কিলা?.....

    পরের সপ্তাহে কণ্ঠচর্চা হবে আমার আলোচনার বিষয়বস্তু।

Post a Comment

4 Comments

  1. চমৎকার লেখা

    ReplyDelete
  2. সমৃদ্ধ হলাম। আবেগে ভাসলাম। কবিতার জয়। কথারা বেঁচে থাকুক এভাবেই স্মরণে ও মননে।

    ReplyDelete
  3. খুব ভালো লাগলো।সমৃদ্ধ হলাম।আবৃত্তি শিল্প এমন আলোচনায় বলবান হবে আশা রাখি।

    ReplyDelete