হাজার বছরের বাংলা গান।। পর্ব-১৩
তু ল সী দা স মা ই তি
বিষ্ণুপুরের গান,বাংলার একমাত্র সংগীত ঘরানা : বাংলা গানে তার প্রভাব
সবগুণ নিধান মহারাজ রঘুনাথ,
তুঅ দরবার সায়ত শোহাওএ।
অনেক গুণিজন চহুঁ চকসে আয়ে,
অওর সব অযাচক পদ পাওএ।।
তুহি দাতা বীর সবকো কর বেপীর,
বিক্রমসে দুরজন সব দূর জাওএ।
তুঅ সম রাজ জগমে নহী দুজো,
ইস লিয়ে বাহাদুর নিশ দিন গুণ গাওএ।
বিষ্ণুপুর রাজা রঘুনাথ সিংহের গুণ বন্দনা করে তান সেন বংশীয় যে সংগীতশিল্পী এই সংগীত রচনা করেছিলেন তিনি বাহাদুর খাঁ। তিনি বিষ্ণুপুর রাজবাড়িতে যে নতুন ধারার ধ্রুপদ প্রবর্তন করেন তাই বিষ্ণুপুর ঘরানা নামে খ্যাত হয়। আগের পর্বে বাংলায় ধ্রুপদ গানের সূচনার কথা বলতে গিয়ে বিষ্ণুপুর ঘরানার আরম্ভকাল নিয়ে বলেছিলাম। পন্ডিতদের লেখায় জানা যায়, অষ্টাদশ শতাব্দীর গোড়াতে সংগীতমুখর ছিল বিষ্ণুপুর মল্লরাজার দরবার। কিন্তু বিষ্ণুপুর ঘরানা যাকে বলা হয় তা ওই শতাব্দীতেই আরোএকটু পরে। সাধারণ ভাবে বলা হয়ে থাকে ১৭৮০ সালের কাছাকাছি সময়। কারণ বিষ্ণুপুরের আদি ধ্রুপদ সংগীতগুরু রামশংকর ভট্টাচার্য ওই সময় তাঁর সংগীতজীবন শুরু করেন। প্রেক্ষিত এরকম, ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর মোগল সাম্রাজ্য পুরোপুরি ভেঙে পড়ে। ইতিমধ্যে ইংরেজরাও ভারত অধিকার করে। অবশিষ্ট মোগলেরা একে অপরের সাথে ক্ষমতা দখলের লড়াই শুরু করে। এই সময় দিল্লির দরবারে যে সমস্ত সঙ্গীতজ্ঞ ছিলেন তাঁরাও দেশীয় বিভিন্ন রাজদরবারে আশ্রয় লাভ করতে থাকেন। তানসেনের পুত্র বিলাস খাঁ এর বংশধর সঙ্গীতজ্ঞ বাহাদুর খাঁ দিল্লির দরবার থেকে বিষ্ণুপুরে আসেন এবং মল্লরাজ দ্বিতীয় রঘুনাথ সিংহ তাঁকে বিষ্ণুপুরে সংগীত শিক্ষার জন্য বেতন দিয়ে নিয়োগ করেন। সঙ্গে ছিলেন বিখ্যাত মৃদঙ্গ বাদক পীরবক্স। বাংলার সংগীতের ইতিহাসে এই ঘটনা যুগান্তকারী। তারপর থেকেই বিষ্ণুপুর ক্রমশ ধ্রুপদ চর্চার বড়ো কেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠে। বাহাদুর খাঁ এর প্রথম শিষ্য ছিলেন রামশংকর ভট্টাচার্য ।
কেউ কেউ বলে থাকেন তখন বৃন্দাবন ও মথুরা ধ্রুপদ কেন্দ্র ছিল। সেখানকার সংস্কৃতির সাথে বিষ্ণুপুরের একটা যোগ ছিল। এই পরিসরে কোনো একজন আচার্যস্থানীয় সংগীতগুরু পুরীতীর্থে যাচ্ছিলেন শিষ্যমণ্ডল সহযোগে। পুরী যাওয়ার পথেই বিষ্ণুপুর রাজ্য। পথে এই সংগীত গুরু সদলেই বিষ্ণুপুর রাজবাড়িতে মল্লরাজ চৈতন্য সিংহের সাথে পরিচয় লাভ করেন।এবং রাজার অনুরোধে এই প্রবীণ আচার্য সংগীত পরিবেশন করেন। এই আসরেই উপস্থিত ছিলেন রাজার সভাপন্ডিত গদাধর ভট্টাচার্যের পুত্র রামশংকর ভট্টাচার্য। গানে মুগ্ধ হন রাজা সহ সকলে। পুরী থেকে ফেরার পথে পুনরায় রাজবাড়িতে আসেন। রামশংকর তখনই গান শেখার জন্য যোগাযোগ করেন। আর নিয়মিত গান শেখানোর জন্য আচার্য বিষ্ণুপুরেই অবস্থান করেন। অনেকেই মনে করেন তখন থেকেই ধ্রুপদ গানের শুরু। এই আলোচনার সূত্রে বলা যায় বিষ্ণুপুর ঘরানার সূচনার ইতিহাস নিয়ে একটা বৃহত্তর বিতর্ক আছেই। তবে বাহাদুর খাঁয়ের বিষ্ণুপুর আগমন ও প্রথম ধ্রুপদ শিল্পী যে রামশংকর এ বিষয়ে সবাই একমত।
একটা কথা এই আলোচনার প্রসঙ্গে খুব জরুরি যে, বিষ্ণুপুরে ঘরানার সূচনার আগেও বিষ্ণুপুর রাজবাড়িতে ও আশেপাশে সংগীত চর্চা পূর্ণভাবেই ছিল। প্রবন্ধরীতির কীর্তন সহ নানান প্রকার সংগীতের চল ছিল। মল্লরাজা হান্বিরএর আমলেই বৃন্দাবন থেকে নবদ্বীপের পথে আসা পুঁথি চুরির ঘটনায় বৈষ্ণব সাধক শ্রীনিবাস আচার্য বিষ্ণুপুরে চলে আসেন। তাঁর প্রতি রাজা ও রাজ্যবাসী আকৃষ্ট হন। বৈষ্ণব রাজ্য রূপে দীক্ষা নেয় বিষ্ণুপুর। হান্বির নিজেও বৈষ্ণব ধর্ম গ্রহণ করেন। বৈষ্ণব পদাবলী ও বৈষ্ণব শাস্ত্র চর্চা রাজ্যের সর্বত্র শুরু হয়। সঙ্গে সংগীত। নরহরি চক্রবর্তী সহ বহু বৈষ্ণব সংগীত শাস্ত্র রচয়িতার গান বাংলার অন্যান্য অঞ্চলের সঙ্গে বিষ্ণুপুরেও ছড়িয়ে পড়ে। এই রাজ্যের বহু পদাবলী সঙ্গীত রচয়িতার গানেও প্রবন্ধ রীতির সংগীত
রস প্রকাশ পায়। গীতসংগ্রহসার, ভক্তি রত্নাকর,গীতচন্দ্রোদয়, প্রভৃতি গ্রন্থে ভারতীয় সংগীতের মর্মে বৈষ্ণব লীলার নানান আঙ্গিক প্রকাশ পায়। তাছাড়াও সংগীতমাধব, নরোত্তমবিলাস, সারাবলী, অনুরাগবল্লী, কৃষ্ণকর্ণামৃত ইত্যাদি গ্রন্থে বৈষ্ণব রস ও সংগীত রীতির নানান কথা বিস্তৃত আছে। রাগসহ তালেরও নানান উল্লেখ আছে। এসব ই এই অঞ্চলে অনুশীলিত হত বোঝা যায়। মল্লরাজ হান্বিরের দুটি বৈষ্ণব পদ পাওয়া যায়। রাজা গোপাল সিংহেরও বৈষ্ণব পদ পাওয়া যায়।
এই বৈষ্ণব আবহেই বিষ্ণুপুর ঘরানার সূচনা। স্বাভাবিক ভাবেই বাইরে থেকে আসা সংগীতধারা নতুন একটা বৈশিষ্ট্য নিয়ে গড়ে উঠবে একথা বলাই যায়। তবে মৃদঙ্গ করতাল যোগে গাওয়া পুরোনো রীতির কীর্তন গানের সাথে নতুন প্রচলিত ধ্রুপদ সংগীতের পার্থক্য অনেকটাই। পাখোয়াজ এসরাজ বীণা যোগে এই নতুন ধ্রুপদ। বলাবাহুল্য, এই গানেই মেতে উঠলো বিষ্ণুপুর।
সংগীতের কাঠামো,গায়নরীতি দেশের অন্য ঘরানার সংগীত থেকেও ভিন্ন প্রকৃতির ছিল বলেই নতুন ঘরানা। বিষ্ণুপুর ঘরানা। নির্দিষ্ট গীতরীতির বৈশিষ্ট্য মেনে শিষ্য পরম্পরাগত ভাবে এই সংগীত চলতে থাকে। বিষ্ণুপুরে তৈরি হয় কিছু সাংগীতিক পরিবার। ক্রমশ তা গোষ্ঠীগত ভাবে বা সমগ্রের আকর্ষণে প্রসার লাভ করে ও জনপ্রিয়তা পায়। আঠারো শতকে সূচনা হলেও প্রায় দুই শতকেরও বেশি সময় ধরে নিজস্ব ভঙ্গিতে ও গতিতে চলতে থাকে এই প্রকার গান। দেশের অন্যান্য অঞ্চলের ঘরানার সাথে যে পার্থক্য এই প্রকার রীতি কে আলাদা করেছে তারও কয়েকটি দিকে আলোকপাত জরুরি। বিষ্ণুপুর ঘরানার ধ্রুপদ"সরল,অলংকার-বিরল,গমকাদির প্রবল্যবিহীন এবং বাঁটের আতিশয্য বর্জিত"। সংগীতের কাঠামোতে চারটি তুকের ব্যবহার এবং তাকে পরিবেশনে বিশেষ গায়নরীতি। রাগ রূপেও কিছু নিজস্ব বৈশিষ্ট্য গানের ধারায় ভিন্নতা এনেছে- "বিষ্ণুপুর ঘরানার বসন্তরাগে শুদ্ধ ধৈবতের প্রয়োগ। ভৈরবের অবরোহনে কোমল নিষাদের স্পর্শ। রামকেলিতে কড়ি মধ্যমের বর্জন। পূরবীতে শুদ্ধ ধৈবত। বেহাগে কোমল নিষাদের ব্যবহার। এমনি নানা স্বকীয়তা নিয়ে গড়ে উঠেছে বিষ্ণুপুর বা বিষ্ণুপুরের আঞ্চলিক ধ্রুপদ ধারা। অথচ এর সৃষ্টির মূলে কেন্দ্রীয় ভারতের সংগীত ধারাই প্রবহমান।"
দীর্ঘায়ু রামশংকর ভট্টাচার্য বিষ্ণুপুরে বহুকাল ধ্রুপদ চর্চা করেন। তিনি প্রথম বাংলা ভাষায় ধ্রুপদ গান রচনা করেন। তাঁর রচিত রাজবিজয় রাগে তেওড়া তালে নিবদ্ধ "অজ্ঞান তম নিকরে গাঢ় ময়ি পতিতে"গানটি বাংলাভাষায় লেখা প্রথম ধ্রুপদ গান। বাংলা গানের ইতিহাসে এটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। এবং বহু শিষ্য তাঁর কাছে তালিম গ্রহণ করেন। যদুভট্ট তার মধ্যে অন্যতম। যিনি তেরো থেকে পনেরো বছর পর্যন্ত বিষ্ণুপুরে ধ্রুপদ সংগীত চর্চার পর কলকাতায় সংগীত চর্চা করেন। তাঁর সঙ্গীত প্রতিভা বাংলা ছাড়িয়ে ভারতের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। ভারতীয় সংগীতের ইতিহাসে তিনি এক উল্লেখযোগ্য নাম। ভারতের বিভিন্ন রাজবাড়ি ও জমিদার বাড়িতে তিনি গান শেখানোর কাজে নিয়োজিত হয়েছিলেন। কাশ্মীর,ত্রিপুরা জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িসহ,কুচিয়াকোল, পঞ্চকোট,বিষ্ণুপুর,পাতকুম, পঁচেটগড় তার মধ্যে অন্যতম। বালক রবীন্দ্রনাথ সরাসরি না হলেও লুকিয়েচুরিয়ে তাঁর গান শুনতেন ও শিখতেন। তাঁর সংগীত প্রতিভা ও গায়নরীতি সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ বিভিন্ন গ্রন্থে উচ্চ প্রশংসা করেছেন। বলেছেন, "বাল্যকালে যদুভট্টকে জানতাম। তিনি ওস্তাদ জাতের চেয়ে ছিলেন অনেক বড়ো। তাঁকে গাইয়ে বলে বর্ণনা করলে খাটো করা হয়। তাঁর রচিত গানের মধ্যে যে বিশিষ্টতা ছিল, তা অন্য কোনো হিন্দুস্থানী গানে পাওয়া যায় না।--- যদুভট্টর মতো সংগীতভাবুক আধুনিক ভারতে আর কেউ জন্মেছে কিনা সন্দেহ।"
বহু সংগীত তিনি রচনা করেন। তিনি পাখোয়াজও দারুণ বাজাতেন। কিছু নতুন বোলও তিনি তৈরি করেছিলেন। বাংলায় তাঁর লেখা কিছু ব্রহ্মসংগীত রয়েছে।
রামশংকরের পুত্র রামকেশব ও শিষ্য কেশবলাল বিষ্ণুপুর ও কলকাতায় চর্চা করেন। রামকেশব কুচবিহার রাজবাড়িতে গায়ক হিসেবে নিযুক্ত হন।
ক্ষেত্রমোহন গোস্বামী রামশংকরের কাছে কিছুকাল সংগীত চর্চা করার পর কলকাতায় যান। সংগীতের অন্যতম ক্ষেত্র পাথুরিয়াঘাটার ঠাকুর বাড়িতে তিনি যান। তাঁর অসাধারণ সংগীত প্রতিভা ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। সৌরীন্দ্রমোহনের সংগীত যজ্ঞে তিনি প্রধান ভূমিকা পালন করেন । ভারতীয় সংগীতে তাঁর অবদান অনেক। কলকাতায় সর্বপ্রথমে যে 'বঙ্গ সঙ্গীত বিদ্যালয়' প্রতিষ্ঠিত হয় তাঁর তত্বাবধায়ক ছিলাম ক্ষেত্রমোহন গোস্বামী। তাঁর রচিত'কণ্ঠকৌমুদি'সহ অন্যান্য সংগীত গ্রন্থগুলি বাংলা ও ভারতীয় সংগীতের ইতিহাসে অমূল্য সম্পদ। রামশংকরের আর একজন শিষ্য দীনবন্ধু গোস্বামী বিষ্ণুপুর ঘরানার গানে খ্যাতি লাভ করেন। ধ্রুপদ ছাড়াও খেয়াল ,টপ্পা, ঠুংরি প্রভৃতি গানে তিনি পারদর্শী ছিলেন। তিনি সংগীতগুরু হিসেবেও স্বীকৃতি লাভ করেন। তিনি বহু সংগীতের রচয়িতা। তাঁর পাঁচ পুত্রও সংগীতে জনপ্রিয় হয়ে উঠতে পেরেছিলেন।
( চলবে)
(বিষ্ণুপুর সংগীত ঘরানা ও বাংলাগানে তার প্রভাব একটি বৃহৎ ক্ষেত্র। এক পর্বে বলা সম্ভব নয়। ছোটো করে বলতে গেলেও বহু কিছু বলা হয় না। আর একটি পূর্ণ পর্বে এই বিষয়ের বাকি আলোচনা থাকবে।)
1 Comments
এতো উন্নত ধরনের সঠিক পর্যবেক্ষণ , এতো ডিটেলিং , এতো সুন্দর পরিবেশন কেবল মুগ্ধতা রেখে গেলাম । তথ্যবহুল এই বিশাল
ReplyDeleteপরিমন্ডলে অনেক অনেক কিছু জানতে পারছি , সঙ্গে থাকছি।