করোনা প্রসঙ্গ: পরিযায়ী শ্রমিক
শা ন্ত নু প্র ধা ন
বর্তমান সময়ের প্রেক্ষিতে করোনার প্রভাব যেভাবে দিন দিন বেড়ে চলেছে তার পাশাপাশি যে খবর টেলিভিশন বা সংবাদপত্রের খুব বেশি আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে, সেটি হচ্ছে দেশের পরিযায়ী শ্রমিকদের দুরাবস্থার চিত্র। প্রথম কথা বলার এই যে,পরিযায়ী শ্রমিক কারা? এ নিয়ে একটা বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। যারা কাজের সন্ধানে বাইরে গেছে সকলেই কি পরিযায়ী শ্রমিক হতে পারে এ প্রশ্ন জাগা কিন্তু স্বাভাবিক । আমরা সকলেই জানি, কিছু শ্রেণির পাখি আছে যারা একটি নির্দিষ্ট সময়ে বিশেষ স্থানে এসে হাজির হয়। আর তা দেখার জন্য ভিড় করে বহু পর্যটক। এই সকল পাখিদেরকে আমরা 'পরিযায়ী পাখি'হিসেবে জানতাম। অনুরূপভাবে, পরিযায়ী শ্রমিক বলতে আমাদের সাধারণ ধারণা ছিল বিভিন্ন মরশুমে ফসল রোপন ও কাটা কিংবা তৎরূপ কাজের জন্য বিভিন্ন সন্নিহিত এলাকা থেকে শ্রমিকরা নগদ অর্থে রোজগারের জন্য দল বেঁধে যারা কাজের সন্ধানে অন্যত্র যেত। কাজের শেষে পুনরায় নিজেদের স্থায়ী নিবাসে ফিরে আসত। এমনকি এরা পুরুষানুক্রমে অনেক এলাকা কিংবা বাড়িতে যে কাজ করে আসছে সেকথাও আমাদের অজানা নয়। যেমন ধরুন সুন্দরবন অঞ্চলের অনেক মানুষ নির্দিষ্ট মরশুমে অন্ধ্রপ্রদেশ কিংবা হাওড়া ও হুগলিতে ধান রোপন ও কাটার কাজে প্রতিবছরই যায়।ফলে এক জায়গার স্থায়ী নিবাসী অন্য স্থানে রূপান্তরিত হয় 'পরিযায়ী শ্রমিক'-এ। এই জাতীয় শ্রমিকে রূপান্তরিত হওয়ার বিশেষ কারণ- দীর্ঘদিন কর্মসংস্থানের অভাবে শিক্ষিত-অশিক্ষিত নির্বিশেষে কর্মপ্রার্থীরা দলগত ভাবে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে কাজ পাওয়ার আশায় যাওয়া এবং যে কোনো ধরনের পেশার সঙ্গে যুক্ত হওয়া এদের লক্ষ্য। আর তাৎপর্যের দিক হল এরা নিজেদের অঞ্চলে যে সকল কাজ সহজে করতে পারে না তারা বাইরে গিয়ে অনায়াসেই সেই কাজের সঙ্গে যুক্ত হতে পারে। তবে এরা যেখানেই যায় সেখানকার পরিবেশকে মানিয়ে নিয়ে পরিশ্রম করে উপার্জনের দু'পয়সার মুখ দেখে। কিন্তু এই করোনা আবহে সমস্ত শ্রমিকগোষ্ঠীর একই চেহারা সামনে আসতেই 'পরিযায়ী শ্রমিক ' কথাটির যে সংজ্ঞা বা অর্থ এতদিন ধরে বহন করত তার অবস্থান ও প্রেক্ষাপট এক নিমেষেই যেন গেল বদলে। যে সাধারণ শ্রমিকরা কাজের সন্ধানে বাইরে গেছে এবং সেখানে উপার্জনের সুযোগ-সুবিধা করে অনেক দিন ধরেই বসবাস করছে। এমনকি তাদের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি একটু স্বাভাবিক হলে বাড়ির আপনজনদেরকেও সেখানে নিয়ে গেছে। অর্থাৎ তাদের মূল পরিবার থেকে তারা এখন বিচ্ছিন্ন জীবন-যাপনে অভ্যস্ত ।হঠাৎ করে করোনার মতো ব্যাধি শুধুমাত্র মানব জীবনে নয়, সমাজ জীবনে তার প্রভাব এতটাই পড়েছে যে ভারতের মতো দেশেরও অর্থনৈতিক পরিকাঠামো আজ তলানিতে এসে ঠেকেছে ।এমতাবস্থায় সাধারণ শ্রমিক এবং পরিযায়ী শ্রমিকরা ভিন্ রাজ্যে কাজ করতে গিয়ে দু'পক্ষই একটা অর্থনৈতিক সমস্যায় আজ জর্জরিত। এদের বেশির ভাগের রেশন বা আধার কার্ড নিজেদের স্থায়ী নিবাসের। ফলত, দীর্ঘদিন লকডাউনে বিভিন্ন কর্মস্থল বন্ধ থাকায় এই সকল শ্রমিকরা বিভিন্ন রাজ্যে নানাভাবে পর্যুদস্ত হতে থাকে। কোনো রাজ্য সরকার-ই এদের খাওয়ার এবং বাসস্থানের সুউপযুক্ত ব্যবস্থা করতে পারেনি। শ্রমিকরা বিভ্রান্ত হয়ে নিজেদের স্ব-নির্ভর প্রচেষ্টায় যে যেমন করেই হোক বাড়ির পথে রওনা দিয়েছে।পথে মৃত্যুও হয়েছে অনেক শ্রমিকের ।রেললাইনে চাপা পড়ে মারা গেছে আবার কয়েকজন শ্রমিক। দেশের এহেন নজির দেখে সরকার পরে এদের জন্য নানা ধরনের পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়েছে- স্পেশাল ট্রেন চালিয়েছে, খাওয়ারের ব্যবস্থা করেছে,রেশন ফ্রি করে দিয়েছে এবং তারা নিজের এলাকায় ফিরলে ১০০দিনের মতো নানা সরকারি প্রকল্পের কাজের সঙ্গে যুক্ত করার কথা ইতিমধ্যেই ঘোষণা করেছে। কিন্তু সমস্যাটা হল এটাই যে সাধারণ শ্রমিক ও পরিযায়ী শ্রমিকের সামাজিক অবস্থান আজ এক হয়ে দাঁড়িয়েছে ।বহুদিন ধরে যারা কাজের সন্ধানে অন্যত্র গিয়ে তাদের নিজেদের অর্থনৈতিক অবস্থা স্বচ্ছল করে স্বাভাবিক জীবন-যাপন করছিল তারাও বর্তমান সময়ের নিরিখে ভিন্ রাজ্য থেকে নিজের এলাকায় আসতে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু লকডাউন অনেকটা খুলে যাওয়ার পরও যখন এলাকায় সুউপযুক্ত কাজ পাচ্ছে না এবং ভিন্ রাজ্যে তাদের একটা বাসস্থান ও কর্মস্থল থাকায় সাধারণ শ্রমিকরা পুনরায় ফিরে যেতে বাধ্য হচ্ছে। আর সকলে বলছে পরিযায়ী শ্রমিকরা ফিরে যাচ্ছে এটা কিন্তু সদর্থক বক্তব্য নয়।
শ্রমিকদেরকে নিয়ে সরকার যতই উদাসীনতা দেখাক না কেন এরাই বর্তমান অর্থনীতির মূল স্তম্ভ সেকথা ভুলে গেলে চলবে না। শুধুমাত্র ভোট ব্যাংক কিংবা রাজনীতির কথা ভেবে যদি নিজেদের আখের গোছানোর তাগিদে এদের মৃত্যু এবং কষ্টকে অবহেলার চোখে দেখা হয় তাহলে ভবিষ্যতে সমাজকে একটা বড় খেশারত চোকাতে হবে।
1 Comments
"পরিযায়ী শ্রমিক"এর অর্থ যেভাবে বিশ্লেষণ করেছেন তাতে এর অর্থ নিজের কাছে আরো পরিস্ফুট হল। ধন্যবাদ স্যার।
ReplyDelete