জ্বলদর্চি

আগাথা ক্রিস্টি (১৫/০৯/১৮৯০-১২/০১/১৯৭৬)

"মানুষের জন্য মানুষ কথাটা বারবার প্রমাণিত হওয়া সত্ত্বেও,আমরা সবাই মানুষ হতে পারিনা"


আগাথা ক্রিস্টি
(১৫/০৯/১৮৯০-১২/০১/১৯৭৬)

স ন্দী প  কা ঞ্জি লা ল

১৯৩২ সাল! মার্কিন পাইলট 'চার্লস লিণ্ডবার্গ' ছুটি কাটাতে নিউ জার্সি শহর থেকে দূরে গ্রামের বাড়িতে। সঙ্গে স্ত্রী, কুড়ি মাসের ছেলে 'চার্লস অগাস্টাস লিণ্ডবার্গ' আর কয়েকজন পরিচারক। এই নিয়ে সাজানো সুখের সংসার। কাটছিলও বেশ, হঠাৎ এলোমেলো হাওয়া, সব ওলট-পালট! মার্চ ১, রাত দশটা। চিৎকার করে উঠলো পরিচারক। জুনিয়র অগাস্টাস বেপাত্তা! তার ঘরে জানালার কাছে মুক্তিপণের চিঠি, খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন। থানা পুলিশ গোয়েন্দা সবাই নড়েচড়ে বসলো। তোলপাড় মার্কিন জনতা। কিছুতেই কিছু হলো না। দাবি মতো মুক্তিপণ দেওয়া হল। কিন্তু ছোট্ট ছেলেটা? সে কোথায়? অপহরণের তেতাল্লিশ দিন পরে এল দুঃসংবাদ। গ্রামের বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে পাওয়া গেল, সেই ছোট্ট শরীরটার থেঁতলে দেওয়া মৃতদেহ। বহু তদন্ত তল্লাশির পর গোয়েন্দারা সহমত হলেন খুনী ধরার একমাত্র উপায়, মুক্তিপণ হিসেবে দেওয়া 'গোল্ড সার্টিফিকেট।' প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট  নির্দেশ দিলেন, দেশজুড়ে যত গোল্ড সার্টিফিকেট রয়েছে, সব জমা দিতে হবে কোষাগারে। সার্টিফিকেটের নম্বর মিলিয়ে জাল গোটানো শুরু। ধরা পড়লো 'ব্রুনো রিচার্ড হপ্টমান', বছর পঁয়ত্রিশের, পেটানো চেহারা এক জার্মান যুবক। জার্মানিতে ডাকাতির মামলাতেও অভিযুক্ত সে। এই সত্য ঘটনা অবলম্বনে উপন্যাস 'মার্ডার অন দ্য ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেস', প্রকাশকাল ১৯৩৪। লেখকের নাম-- আগাথা ক্রিস্টি।
আগাথা ক্রিস্টি ১৫ই সেপ্টেম্বর ১৮৯০ সালে ইংল্যান্ডের টার্কিতে জন্মান এক ধনাঢ্য পরিবারে। বাবা 'ফ্রেডিক বোহমার' জন্মসূত্রে আমেরিকান। মা 'ক্ল্যারা বোহমার' আইরিশ। বিত্তশালী পরিবারের সন্তান হিসেবে আগাথা ক্রিস্টি প্রাচুর্যের মধ্যে বড় হয়েছেন। ছোটবেলা পড়াশোনার সাথে সাথে পিয়ানো বাজানো শিখেছিলেন। ছোটবেলা থেকে বই পড়ার নেশা। তাঁর বাবা ১৯০১ সালে ৫৫ বছর বয়সে মারা যান। তখন 'ক্রিস্টি'র বয়স মাত্র ১১ বছর। 
বাবার মৃত্যুর শোক কাটিয়ে উঠে, তিনি তাঁর লেখালেখির জগৎকে কবিতা ও সঙ্গীত দিয়ে শুরু করেন। অপেশাদার শিল্পী হিসেবে থিয়েটারে অভিনয়ও করেন। ১৯১৮ সালে 'ক্রিস্টি'' বিয়ে করেন 'আর্চিবাল্ড' নামে এক বৈমানিককে। তাঁদের বিয়ের কিছুদিন পর প্রথম মহাযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। মিত্র শক্তির হয়ে জার্মানদের বিরুদ্ধে লড়তে 'আর্চিবাল্ড'' ফ্রান্সে চলে যান। এদিকে 'ক্রিস্টি' স্বদেশের মাটিতে যুদ্ধে সক্রিয় অংশ গ্রহণ করে, যুদ্ধক্ষেত্রে তিনি নার্স ও ফার্মাসিস্ট হিসেবে যুদ্ধাহত সৈনিকদের সেবাযত্ন করতে থাকেন। এইসময় তিনি বলতেন, "মানুষের জন্যই মানুষ কথাটা বারবার প্রমাণিত সত্য হওয়া সত্ত্বেও,আমরা সবাই মানুষ হতে পারি না।"
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে এক ডিসপেনসারিতে কাজ করতে করতে তাঁর প্রথম ইচ্ছে হয় গোয়েন্দা কাহিনি লেখার। যেহেতু তিনি ডিসপেনসারিতে কাজ করতেন, তাই বিষ সম্পর্কে ধারণা থেকে তিনি ভাবলেন প্রথম গোয়েন্দা কাহিনিতে খুন হবে বিষ দিয়ে। তিনি প্রথম এক কালো দাড়ি ভদ্রলোককে দেখে ঠিক করলেন, তাঁর গোয়েন্দা হবে এরকম দেখতে। সেই সময় বেলজিয়াম থেকে উদ্বাস্তুদের দেখেছিলেন। তাই তাঁর গোয়েন্দা হবে অবসরপ্রাপ্ত বেলজিয়াম পুলিশ অফিসার। ডিম্বাকৃতি মাথা, জবরদস্ত একজোড়া গোঁফ, ছোটখাটো পরিপাটি মানুষ। আর উত্তেজিত হলেই তার মুখ থেকে বেরোবে অনর্গল ফরাসি ভাষা। জন্ম নিলেন  গোয়েন্দা 'এরকুল পোয়ারোর।' তাঁর প্রথম উপন্যাস 'দ্য মিস্টিরিয়াস অ্যাফেয়ার অ্যাট স্টাইলস্।" লেখা হল ১৯১৬ তে। প্রথম পাণ্ডুলিপি ফেরত দিল 'হডর অ্যার স্টটনা' শেষ পর্যন্ত  'বডলি হেডের জন' উপন্যাসটি ছাপলেন ১৯২০ সালে। তারপর আর 'আগাথা ক্রিস্টি'কে ফিরে তাকাতে হয়নি। 
ক্রাইম বা গোয়েন্দা কাহিনির উৎস সন্ধান করতে গিয়ে শ্রদ্ধেয় 'সুকুমার সেন' মন্তব্য করেছিলেন, "ক্রাইম কাহিনি অর্থাৎ ডিটেকটিভ গল্প-উপন্যাস আধুনিক কালে, উনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে সৃষ্টি, সে ধারণা বোধ করি অনেকেরই আছে। এ ধারণা যথার্থ বলবো যদি সে গল্পকাহিনী পুলিশী ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠার পরে রচিত হয়ে থাকে।" গোয়েন্দা কথাটি প্রথম অক্সফোর্ড ডিকশিনারিতে স্থান পায় ১৮৪৩ সালে। তবে এর আগেও ১৮৩৩ সালে 'ভিদোচ' নামে এক ফরাসি কুখ্যাত জেল খাটা আসামি একটি গোয়েন্দা সংস্থা খুলেছিলেন। সেই সব কাহিনি নিয়ে তিনি একটি আত্মজীবনী লেখেন। যা পুরোটাই রহস্যে মোড়া। এরও অনেক আগে ফ্রান্সের দার্শনিক 'ভলটেয়ার' একটি বই লিখেছিলেন ১৭৪৭ সালে, 'জাদিগ উলা ডেস্টিনি' নামে। তাতে এক রাজার এক উট হারিয়ে যায়, রাজার সৈন্য সামন্ত একজন লোকের কাছে উটের সবিস্তর বর্ণনা শুনে, সেই লোকটির কাছে উটটি ফেরত চায়। কিন্তু লোকটি বলে সে উটটিকে দেখেনি। তখন তাকে রাজার কাছে আনা হয়। সে রাজাকে বলে, মহারাজ উটটার বাঁ চোখ যে খারাপ তাঁর কারণ উটটির দুদিকে চমৎকার ঘাস ছিল, কিন্তু উটটি কেবল ডান দিকের ঘাস খেয়েছে, আর বাঁ পা যে খোঁড়া তা বলেছিলাম ওর চলার ধরণ দেখে। আর ফোকলা দাঁত কারণ ওর ঘাস চিবানো দেখে বলেছিলাম। আমি উটটিকে দেখিনি মহারাজ। 
সে বারের ঘটনাস্থল ইংল্যান্ড। ১৯৩০ সাল। কর্ণওয়াল প্রদেশের এক গ্রাম, অদূরেই ছোট্ট জনপদ ট্রেনহর্ন। সেখানে একা থাকেন এক বিধবা 'সারা অ্যান হার্ন।' আড্ডা দেওয়ার সঙ্গী জুটল উইলিয়াম টমাস ও তাঁর স্ত্রী অ্যালিস। পড়শি এই দম্পতির সঙ্গে বেশ ভাব জমল। একদিন চড়ুই ভাতের আয়োজন। আমন্ত্রিত উইলিয়াম ও তাঁর স্ত্রী। হার্ন নিয়ে গেলেন যত্ন করে বানানো স্যামন মাছের স্যান্ডউইচ আর স্যালাড। কিন্তু তা মুখে দিয়েই বিপত্তি। উইলিয়াম ও অ্যালিস দুজনেরই শরীর কেমন যেন করে উঠলো। ঠিক দু'দিন পরে অ্যালিসের মৃত্যু হল। এখানেই রহস্য। প্রাথমিকভাবে পড়শীদের সন্দেহের তির গেল হার্নের দিকে। পড়শিদের মধ্যে কানাকানি। অ্যালিসের মৃত্যুর ঠিক আগের দিন রাতে হার্ন এক পড়শি মহিলাকে বললেন, "ওঁরা ভাবছেন, আমিই খাবারে বিষ মিশিয়েছি।" অ্যালিসের ভাই সরাসরি অভিযুক্ত করলেন হার্নকে। খোঁজ শুরু হল হার্নের। ইতিমধ্যে পাহাড়ের এক খাদে হার্নের পোশাক মিলল। সকলে ভাবলেন, তাঁর অপমৃত্যু ঘটেছে। কিন্তু হার্ন তখন বহাল তবিয়তে অন্য এক শহরে, এক স্থপতির বাড়িতে পরিচারিকার কাজ করছেন। গ্রেফতার হলেন হার্ন। তবে আদালতে দীর্ঘ সওয়াল-জবাবের শেষে প্রমাণিত হল, হার্ন খুনী নন। কিন্তু খুনী কে বা কারা, সে উত্তর অধরাই রয়ে গেল। কিন্তু উত্তরটা ধরে ফেললেন ক্রিস্টি। তাঁর উপন্যাস, "স্যাড সাইপ্রেস" এ। বাস্তবের ঘটনার মতো এই উপন্যাসে ও বিষ (এ ক্ষেত্রে মরফিন) ও খাবারই ছিল খুনের উপকরণ। মেরি জেরার্ড নামে বছর একুশের এক তরুণী দুপুরের খাবার খেয়ে বিষক্রিয়ায় মারা যান। কবর থেকে তার দেহ তুলে জানা গেল, মেরি যাঁর কাছে থাকতেন, সেই লরা ওয়েলম্যান নামে মহিলাটির ও বিষে মৃত্যু হয়েছে। এই ঘটনাতেও প্রাথমিক সন্দেহে লরার আত্মীয় এলিনরকে অভিযুক্ত করা হল। কাহিনিতে এত দূর পর্যন্ত বাস্তব ঘটনার ছায়া দেখা যায়। কিন্তু এর পরেই প্রেমও এরকুল পোয়ারের গোয়েন্দাগিরি সংযোজন করলেন ক্রিস্টি। তাঁর রহস্যের বুনটে দেখা গেল এক নতুন চরিত্র। নার্স জেসি হপকিন্স। ক্রমে জাল ছিঁড়ল রহস্যেও। 
'এডগার অ্যালেন পো'র 'শেভালিয়র দুপ্যাঁ' গল্প দিয়ে সম্ভবত অপরাধসাহিত্য বা ক্রাইম ফিকশনের পথ চলা শুরু হয়েছিল, উনিশ শতকের চল্লিশের দশকে। ১৮৬৮ তে এই একই ধারায় লেখা 'উইল্কি কলিন্স' এর 'দ্য মুনস্টোন' উপন্যাসটি দারুণ জনপ্রিয় হয়েছিল। তবে অপরাধসাহিত্যের জনক হিসেবে সাধারণভাবে শার্লক হোমসের স্রষ্টা স্যার 'আর্থার কনান ডয়েলে'এর (১৮৫৯-১৯৩০) নামই করা হয়।  বিংশ শতাব্দীর প্রথম দু তিন দশককে গোয়েন্দা কাহিনির স্বর্ণযুগ বলা হয়। এই সময়ই 'চেস্টারটন' লেখেন 'ফাদার ব্রাউন' সিরিজের গল্পগুলি। ফাদার ব্রাউন একজন নিরীহ রোমান ক্যাথলিক পাদ্রী যিনি রহস্যের সমাধান করেন ফেলুদার মতো মগজাস্ত্র ব্যবহার করে। হোমস-উত্তর খুব বেশি গোয়েন্দা কিন্তু শার্লক হোমসকে টেক্কা দিতে পারেননি। তা হলে কি জাদু 'ক্রিস্টি' রসে যে তিনি খুব তাড়াতাড়ি হয়ে উঠলেন পৃথিবীর জনপ্রিয়তম লেখক? অনেকের মতে তো বাইবেল ও শেক্সপীয়ারের পর 'ক্রিস্টি'র বই-ই সারা বিশ্বে সবচেয়ে বেশি অনূদিত হয়েছে। আসলে আগাথার উপন্যাস পাঠযোগ্যতার প্রায় সব উপকরণেরই সমাহার। ঝরঝরে মেদহীন গদ্য, হাল্কা হাস্যরস, রোমান্সের ছোঁয়া আর শেষ না জানা অবধি নামিয়ে রাখা যায় না এমন এক জমজমাট রহস্য। তবে তার আসল তুরুপের তাস হল যে তাঁর উপন্যাসের শেষে ঘটনা আকস্মিক মোড় নেয় এবং সবচেয়ে কম সন্দেহজনক ব্যক্তিই খুনী প্রমাণিত হয়। আগাথার দুঃসাহসিক পরীক্ষা নিরীক্ষার বিস্ফোরক উদাহরণ সেই উপন্যাসগুলি যেখানে কথক নিজেই খুনি যেমন 'দ্য মার্ডার অফ রজার অ্যক্রয়েড' বা 'এন্ডলেস নাইট।' 'মার্ডার অন দ্য ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেস' এ আবার ট্রেনসুদ্ধ মানুষ এক অপরাধীকে শাস্তি দেয়। আগাথার গোয়েন্দা উপন্যাসগুলিতে শ্বাসরোধকারী অপরাধের আবহ নেই। তাই ট্রেনে, প্লেনে, কলেজের অফ পিরিয়ডে, অলস দুপুরে বা বর্ষার সন্ধ্যায়, আঠারো থেকে আশি সব বয়সের কাছেই পরম উপাদেয় এই উপন্যাসগুলি। 
অপরাধ কত বিচিত্র হতে পারে তা বোধ হয় এই অনন্য প্রতিভাময়ীর বইগুলো না পড়লে অজানাই থেকে যেত। শুধু খুনের ধরনে নয়, ক্রিস্টি র বইতে খুনের মোটিভেও আছে অফুরন্ত বৈচিত্র্য। ক্রিস্টি র গোয়েন্দা কাহিনিতে,  গোড়ার দিকের গুলোতে আছে লর্ড, লেডি, ধনী মানুষের ছড়াছড়ি। আছেন মধ্যবিত্ত মানুষ ও যেমন অ্যান, টমি, টাপেন্স ববি বা ভিক্টোরিয়ার মতো অল্পবয়সী অপেশাদারি গোয়েন্দা। আছে মিরেল্ বা নাদিনার মতো পেশাদার নর্তকী, 'এম' নামে পরিচিত জার্মান গুপ্তচর, এমনকি জুলিয়া ও জেনিফারের মতো স্কুলের ছাত্রী ও। ড্রাইভার, বাটলার, মেইড, মালীদেরও তাঁর উপন্যাসে একটা বড়ো ভূমিকা থাকে। তবে অপরাধী সর্বদাই আসছে মধ্য বা উচ্চবিত্ত সমাজ থেকে  এবং বাইরে থেকে সে ভদ্র, শিক্ষিত, অমায়িক, বুদ্ধিদীপ্ত আলাপচারিতায় পটু। এটা কি ধরনের এডওয়ার্ডিয় উন্নাসিকতা নাকি সমাজের নীচের তলার যে লবণাক্ত হিংসার জগতটাকে তিনি নিজে ভালো করে চিনতেন না সেটাকে এড়িয়ে গিয়ে পরিচিত জগতের মধ্যেই অপরাধী খোঁজ?
৫০ বছরের লেখিকা জীবনে তিনি দুজন গোয়েন্দাকে নিয়ে ৮০ টিরও বেশি গল্প উপন্যাস লিখেছেন। তাঁর দুটি অসাধারণ গোয়েন্দা চরিত্র, যা আজও মানুষের মনে জীবন্ত। একজন চেহারায় বেঁটেখাটো আত্মম্ভরি 'এ্যরকুল পোয়ারো' অন্যজন প্রায় আশি বছরের বৃদ্ধা মিস 'জেন মারপেল'। যিনি আজীবন কুমারী নেশা বাগান করা আর চেয়ারে বসে কিছু বোনা। বিংশ শতাব্দীর বিংশ দশককে অনেক সময় বলা হয় ইংরেজি সাহিত্যের স্বর্ণযুগ। ইংল্যান্ডের অর্থনৈতিক অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে গোয়েন্দা গল্পের জনপ্রিয়তা তুঙ্গে ওঠে। এই সময় কলম ধরেন অসামান্য প্রতিভাময়ী লেখিকা 'আগাথা ক্রিস্টি'। লেখিকার অসামান্য সৃষ্টির কল্পচরিত্র গোয়েন্দা "পোয়ারো" যাঁর মৃত্যুর পর 'দ্য নিউইয়র্ক টাইমস' এই তথ্যটি শোক সংবাদ হিসেবে প্রকাশ করেছিল।
তার লেখা গল্পগুলো নিয়ে হলিউড সহ বিভিন্ন ভাষায় অনেকগুলো ছবি নির্মাণ হয়। মার্ডার উইথ মিররস (Murder with Mirrors), মার্ডার অন দ্য ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেস (Murder on the Orient Express), দ্য মিরর ক্রাকড ( The Mirror Cracked), মার্ডার, সি সেইড (Murder, She said) উল্লেখযোগ্য সিনেমা।
এমনকি বলিউডে এবং ভারতীয় বাংলা ছবিও নির্মাণ করা হয় তাঁর গল্প অবলম্বনে।
উপমহাদেশের জনপ্রিয় পরিচালক ঋতুপর্ণ ঘোষ "The Mirror Crack'd from side to side" বই অবলম্বনে "শুভ মহরৎ" ছবিটি নির্মাণ করেন। যেখানে পাওয়া গেছে আগাথা ক্রিস্টির জনপ্রিয় চরিত্র "মিস মার্পল" কে। এছাড়া আবারো তৈরি হচ্ছে "কার্ডস এ্যন্ড দ্য টেবিল" অবলম্বনে একটি মুভি, যেখানে পাওয়া যাবে ক্রিস্টির "এরকুল পোয়ারো" কে। 
তবে অপরাধীদের থেকেও আগাথা অনেক বেশি চিন্তিত সেই সব নিরীহ মানুষদের নিয়ে সমাজ যাদের সবসময় নিরাপত্তা দিতে পারেনা আর যারা অপরাধীদের শিকার হয়। "ওয়ান টু বাকল্ মাই শু" তে পোয়ারোর মুখে কি আমরা আগাথার কথাই শুনি না, "I am concerned with the lives of private individuals who have the right not to have their lives taken from them." আগাথা ক্রিস্টির বইগুলো আসলে শুভ ও অশুভ শক্তির সংগ্রামের কাহিনী। 
'মাউস্ট্র্যাপ' নাটকটির কথা না বললে ক্রিস্টির সম্বন্ধে বলা অসম্পূর্ণ থেকে যায়, যারা নাটকের ইতিহাসে এক অত্যাশ্চর্য মাইলফলক এই নাটকটি আগাথার ছোট্ট রেডিয়ো নাটক 'থ্রি ব্লাইন্ড মাইস' এর নাট্যরূপ। ১৯৬২ তে শুরু হয়ে এই নাটকটি আজও লন্ডনে নিয়মিত অভিনয় হয়, এর ২৫,০০০ রজনীও পেরিয়ে গিয়েছে। নিঃসন্দেহে বিশ্বরেকর্ড। 
গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস এর তথ্যানুসারে আগাথা ক্রিস্টি বিশ্বের সর্বকালের সর্বাধিক বিক্রিত বইয়ের লেখক এবং যেকোনো ধরনের সাহিত্যকর্মের সর্বাধিক বিক্রীত লেখক, যে ক্ষেত্রে উইলিয়াম শেক্সপিয়ারই কেবল তাঁর সমকক্ষ। তার বিক্রয় কৃত বইয়ের সংখ্যা প্রায় ৪০০,০০,০০,০০০। শুধু তাই নয়, ১০৩ টি ভাষায় আবার অনুবাদিত হয়েছে তাঁর বই গুলো।
একটি গোয়েন্দা গল্পের মূল বৈশিষ্ট্য হল- 
আপাতদৃষ্টিতে একটি নিখুঁত অপরাধকাণ্ড ঘটেছে। 
পারিপার্শ্বিক ঘটনাবলী না তলিয়ে দেখার ফলে নির্দোষ ব্যক্তিকে অপরাধী সন্দেহ করা হচ্ছে ;
রহস্য উদ্ভাবনে ব্যর্থ অপদার্থ ভোঁতাবুদ্ধি পুলিশ (বা অন্য কেউ) নির্দোষ ব্যক্তি কে আটক বা গ্রেফতার করেছে ;
গোয়েন্দা তার ক্ষুরধার বুদ্ধি বা বিশ্লেষণীশক্তি প্রয়োগ করে রহস্যের মোড় অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিয়েছেন। এই বিশ্লেষণে মনস্তাত্ত্বিক, বৈজ্ঞানিক, সামাজিক, আইনী ইত্যাদি নানান দিকের চিন্তা জড়িয়ে থাকতে পারে ; এবং 
নানান তথ্য ও যুক্তি পর পর সাজিয়ে পাঠককে হতচকিত করে গোয়েন্দা সন্দেহের তালিকায় যে ছিল না তাকেই দোষী বলে ধরতে পেরেছেন। এই বৈশিষ্ট্য সব ক্রিস্টি এর সব উপন্যাসে পাওয়া যায়। 
ক্রিস্টির জীবনীটির একটি স্বতন্ত্র এবং রহস্যজনক পর্ব ছিল তাঁর অন্তর্ধান, যা ১৯২৬ সালের ডিসেম্বরে ঘটেছিল। স্বামী তাকে অন্য মহিলার প্রতি তার ভালোবাসার কথা বলেছিলেন, বিবাহবিচ্ছেদের জন্য জিজ্ঞাসা করলে, তার সাথে ঝগড়ার পরে তিনি ১১ দিন ধরে অন্তর্ধান ছিলেন।
১৯২৮ সালে আগাথা এবং আর্চিবাল্ডের বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে, তবে ইতিমধ্যে ১৯৩০ সালে ইরাক ভ্রমণের সময় তাঁর ভাগ্য, বিশ্বখ্যাত লেখিককে এমন এক ব্যক্তির সাথে নিয়ে আসে যার সাথে তিনি তার জীবনের শেষ অবধি ছিলেন। তিনি ছিলেন অসামান্য প্রত্নতত্ত্ববিদ 'ম্যাক্স ম্যালোভেন'।
১৯৫৬ সালে, ক্রিস্টি দ্বিতীয় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের 'অর্ডার  অফ হোল্ডার' হন। ১৯৬৫ সালে,'ক্রিস্টি' তার আত্মজীবনী নিয়ে লেখা শেষ করেছিলেন, যার সর্বশেষ বাক্যটি ছিল "ধন্যবাদ প্রভু, আমার ভাল জীবন এবং আমাকে যে ভালোবাসা দেওয়া হয়েছিল তার জন্য।"  সাহিত্যিক ক্রিয়াকলাপের ক্ষেত্রে তাঁর সেবার জন্য,'আাগাথা ক্রিস্টি'কে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের "অর্ডার অফ ক্যাভালিয়ারডাম" খেতাব দেওয়া হয়। 
তিনি শুধু লেখিকই ছিলেন না, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি হাসপাতালে নার্স হিসাবে বিনামূল্যে কাজ ও করেন। "দ্য কুইন অফ ক্রাইম" আগাথা ক্রিস্টি ১৯৭৬ সালের ১২ জানুয়ারি ইংল্যান্ড এ নিজ বাসায় মৃত্যু বরন করেন।  তিনি আজও বেঁচে আছেন সবার কাছে। বেঁচে থাকবেন তাঁর লেখা অসাধারণ রহস্য, গোয়েন্দা, রোমান্টিক গল্পগুলো ও সেগুলোর প্রতিটি চরিত্রের মধ্য দিয়ে।

Post a Comment

4 Comments