জ্বলদর্চি

হলদে গোধূলির বাইপাসে পদশব্দ এতই নির্জন/ মনোতোষ আচার্য

হলদে গোধূলির বাইপাসে পদশব্দ এতই নির্জন

ম নো তো ষ  আ চা র্য

গোধূলির অস্তরাগ ও কবির অকৃতার্থতা যখন আবেগ-মধুর সম্পর্কের জন্ম দেয় তখনই প্রবল হয়ে ওঠে অস্তিত্ব চেতনা। প্রকৃতিগত ও আত্মগত দুটি আয়নাকে মুখোমুখি রেখে কবিতার চলনে এক অদ্ভুত মায়াময়তা অনেক ক্ষণ পাঠককে জারিয়ে রাখে। আর তখনই সন্ধ্যার ভেতর জেগে থাকা মৃত অক্ষরেরা সূর্য ছিঁড়ে খাবার বাসনায় উদগ্রীব হয়। তিন পঙক্তির আশ্চর্য সঙ্গমে চিড় ধরা চাঁদের আলোয় জেগে ওঠে চরাচর। সময় ও সমাজের বর্ণময় বাইপাসে খুঁজে পাই জন্মনিরোধক ও রাতের অন্তঃসার। অকপট আত্মকথনের সাংকেতিকতায় কায়ার হাত ধরে হেঁটে যায় ছায়ার আলিম্পন । হলদে গোধূলির বাইপাস জুড়ে 'হারানো কথারা কালো দাগে ভরা।'   

কথার নির্যাস যদি কবিতার ছায়াপথ তৈরি করে তবে সেই গোধূলির অস্তরাগে মিশে যায় কামনার রজস্বলা নদী। তিন পঙক্তির কবিতার শরীরে দুলে ওঠে তারুণ্যের নস্টালজিয়া। আসলে কবিতার মতো করে কিছু স্পর্শ 'নাভি ভরা শুকতারা'র আলো খুঁজতে চায়। শব্দ ব্যবহারে পরিমিতিবোধ ও ছন্দ-অলংকার-রূপকল্পের কারুকাজে কবিতাগুলি জাদু বিকিরণ করে চলেছে। পরিণতমনস্ক পাঠক খুঁজে পাবেন স্মৃতি-মেদুর নৈঃশব্দ্যের ভিটে। কবিতাকে বহুরৈখিক করে তোলার কাজে কবির প্রয়াস লক্ষণীয়। সময় প্রবাহের সমকালীনতায় ঠোক্কর খেতে খেতে গোধূলির সংলাপগুলি কোথাও কোথাও বেশ চড়া সুরে কানে বাজে। 

গ্রাম-মফস্বলের কবিতার সাথে বেশ কিছুকাল যাপনের সূত্রে অসীম ভুঁইয়ার কবিতার সাথে আমার আলাপ। বেশ কয়েকটি কবিতার বই পড়ার পর আমার নজরে আসে ২০১৮ সালে প্রকাশিত 'হলদে গোধূলির বাইপাস' কাব্যগ্রন্থটি। শূন্য দশকের মধ্য-প্রহরে যার প্রথম কবিতার বই 'মৃত্যু ও রক্তের আলাপন'(২০০৬)। পেশায় স্কুল-শিক্ষক অসীম ভুঁইয়া ভাষাবিজ্ঞানচর্চায় নিরলস থেকেও কবিতার দিকে স্বতোৎসার সৃজনের নৌকা বাইতে দ্বিধাহীন। বহুচর্চিত অনুকরণের শস্তা পথ মাড়াতে চায় না। তাই যূথবদ্ধ চিন্তনের দাসত্ব থেকে তার লেখা পৃথক কোনো ইশারা দিয়ে চায়। অধুনান্তিক চেতনার পথে তার কোনো বাধা নেই।    

হলুদ রঙটি শুভদ্যোতক। অনুভব-শক্তি, প্রাণশক্তি ও সম্ভাবনার প্রতীক হিসেবে প্রাচীনকাল থেকে এই রঙের স্বতন্ত্র তাৎপর্য রয়েছে। এই কারণেই কী তাহলে হলুদ রঙের প্রতি কবির মাত্রাধিক আসক্তি। 'হলুদ' বা 'হলদে' বিশেষণ ব্যবহার করে এই সংকলনে চারটি কবিতার শিরোনাম রচিত হয়েছে। নাম কবিতা 'হলদে গোধূলির বাইপাস' ছাড়া 'হলুদ পাখি' শীর্ষক দুটি কবিতা ও 'হলুদ পাতা' শীর্ষক একটি কবিতা। উক্ত চারটি কবিতায় হলুদ বিশেষণটি স্বতন্ত্র ব্যঞ্জনায় ঋদ্ধ। হলুদ পাখিকে ঘিরে লোকায়ত জীবনে নানা লোককথা চলিত রয়েছে। স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে কবিতাটিও বিরোধাভাস নিয়ে উজিয়ে যায় সেই টানে -- " গাছের ডালে হলুদ পাখি / নীচে স্তব্ধ বিকেল / রাত নামলেই উড়ে আসে বিষণ্ণতার ই-মেল।" ( হলুদ পাখি)      

কবিতা আলোচনা কিংবা সমালোচনার দেশি বিদেশি বহুবিধ পন্থা সুদীর্ঘকাল ধরে লালিত হয়ে আসছে। সেই বিষয়ে নানা যুক্তি পাল্টা যুক্তি ও রয়েছে। এক্ষেত্রে সমালোচক শুদ্ধসত্ত্ব বসুর যে বক্তব্যটি আমাকে ভীষণ টানে তা হল--- " সমালোচনা-কর্মে সহৃদয়তার বড় বেশী প্রয়োজন, নিন্দা করার দৃষ্টি নিয়ে বা অকারণ স্তাবকতায় গা ভাসিয়ে সমালোচনা করা চলে না। সহৃদয়তার সঙ্গে রসবোধের মেলবন্ধন ঘটা চাই, নচেৎ সমালোচকের বক্তব্য পাঠকের মনে আনন্দ ও সৌন্দর্যের খোরাক জোগাতে পারবে না। সমালোচনার প্রধান দায়িত্ব হলো লেখকের মনকে পাঠকের কাছে তুলে ধরা, লেখকের মানসকে ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করে পাঠকের কাছে পরিচিত করিয়ে দেওয়া।"  বহু স্তর-বিভাজিত বা বহু শিবির-বিভাজিত বাংলা কবিতার পাঠকের কাছে একজন কবিকে পরিচিত করানোর কাজটা আজ আর সহজ কর্ম নয়। তথাকথিত মিডিয়া প্রসাদ থেকে, নাগরিক উন্নাসিকতার প্রাসাদ থেকে বহুযোজন দূরে যে কবির অধিষ্ঠান তার পক্ষে তো আরো কঠিন চ্যালেঞ্জ। একজন নিতান্ত সাধারণ কবিতা পাঠক হিসেবে এই কাব্যের সবগুলি কবিতা একক প্রয়াসে পড়ে ফেলেছি। কোনো বাধা পেতে হয়নি। যাপনের টুকরো টুকরো অনুষঙ্গগুলিকে  সুমিত ধ্বনি মাধুর্যে রূপময় করে তোলার দক্ষতা এককথায় অসাধারণ। " ভাঙা কাচের ভেতর নিজের বিচিত্র রূপ / রং পালটায় সময়ের ক্যানভাসে / দূরে বহুগামী সূর্যে সন্ধ্যা নেমে আসে।"(সন্ধ্যা) এই কবিতায় সূর্যের বহুগামিতা আসলে অধুনান্তিক যাপন মননের ফসল।  

'স্মৃতি' 'সঙ্গম' ও 'কনডোম' এই তিনটি কবিতা হলদে গোধূলির ইন্দ্রজাল থেকে বেরিয়ে সমাজ-বাস্তবতার জীবন্ত দলিল হয়ে উঠেছে। প্রাত্যহিক জীবন দ্বন্দ্বের প্রতিভাসে পঙক্তিগুলি বেশ খানিকটা প্রতিবেদনধর্মী। এ এক জৈবনিক সংবেদ। নৈতিক অবক্ষয়ের ইঙ্গিত আছে কিন্তু নীতি-পুলিশের উচ্চকিত স্বর নেই। সমকালের রূঢ় বাস্তব থেকে পালিয়ে বেড়াবার কোনো ছটফটানি নেই । বরং অকপট কিছু স্বীকারোক্তি চারপাশের বিবর্ণ জগতের অস্তিত্বকে অনেকখানি প্রকট করে। অতিলিখন কিংবা অতিকথন কবির স্বভাব বিরুদ্ধ মনে হয়েছে। যা এই কাব্যগ্রন্থের একটি স্বতন্ত্রতার দিকও বটে। একই শিরোনামাঙ্কিত একাধিক কবিতা মলাটবদ্ধ হওয়ায় পাঠকের সামান্য অসুবিধে হতে পারে। তবে বাকনির্মিতি ও রূপকল্প সৃজনায় মৌলিকত্ব কবিতাকে পাঠনন্দিত করে তুলেছে। মৃগাঙ্ক চক্রবর্তীর ব্যঞ্জনাহীন প্রচ্ছদে ও বইটির সাদামাটা অঙ্গসজ্জায় বিশেষ কোনো মোহিনী নেই। প্রকাশনা শিল্পে আর একটু পেশাদারি মনন আশা করতেই পারি।  তবে কাব্যশরীরে রয়েছে অসীম সৌন্দর্য। 'নাভি-ভরা শুকতারা'র আলোকময় ইশারা।

হলদে গোধূলির বাইপাস
অসীম ভুঁইয়া 
প্রচ্ছদ -মৃগাঙ্ক চক্রবর্তী
প্রকাশক - দিগন্ত
প্রথম প্রকাশ - ২০১৮
মূল্য - একশত টাকা

Post a Comment

1 Comments