জ্বলদর্চি

মণিপুরের মা /সুবোধ সরকার

 
সেমিকোলনের আত্মজীবনী -১১

"INDIAN ARMY RAPE US" 

সা য় ন

নগ্ন অপমানের ইতিহাস লেখেন 'মণিপুরের মা'

অন্তর্গত জগৎটা পর্দা কিংবা পার্লামেন্ট খোলার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের সামনে উঠে আসে। আমার তোমার আপনার জগৎটা কেমন - তার রূপ ও আঙ্গিকের বস্তুবাদী অবয়বের রূপকথাময় চেতনা সেখান থেকে যুক্তির চেতনায় উত্তরণ ঘটবে - এক একটি চরিত্রের চাওয়া পাওয়ার মাধ্যমে। ভাষা কিভাবে দেহের আকার নেবে, দেহ হয়ে উঠবে একটা গোটা দেশ। 

দেশ কিভাবে গঠিত হয়? হ্যাঁ, আপনাকেই বলছি বলুন। 

কিভাবে মানুষের ব্যবহারিক বিন্যাস কাঠামোকে নতুন করে চিনিয়ে দিতে পারে? এক ব্যক্তির মধ্যেও কী লুকিয়ে থাকতে পারে গোষ্ঠীর সামগ্রিক চেতনা? এই ভিত্তির উপর দিয়ে একজন মানব শিল্পী ও বিপ্লবীর মন কিংবা মীমাংসা খুঁজবো  সত্তার মানবিকী চিন্তা বিকিরণের মধ্যে দিয়ে - এরই নাম দিলাম কবিতা।
 
বাক্ কিংবা বাক্যের উপর দিয়ে যখন বিস্তর কাপড় ঢাকা থাকে ভবিষ্যতের জন্য তখন হৃদয়কে নামিয়ে আনতে হয় রাস্তায়। 
পৃথিবীর চিন্তা ক্ষেত্রে যখন পচন আর পানায় ভরে যাচ্ছে , সমাজ ভূমি যখন জ্বলে উঠছে আগুন আর রক্তের মেলবন্ধনে তখন এমন কিছু মানুষের দিকে ফিরে তাকাতে হয় যারা জ্বালিয়ে দিতে পারে শত সূর্যের অরুণ আলো। কবিতায় তাঁদের খুঁজে নেবো ঠিক।

 আধুনিক বিশ্বের যন্ত্রজাগরনের উষা ক্ষেত্রের উত্তরাধিকার নিয়ে, একজন কবি তার বন্ধুর কাছে দুটো অনুরোধ করেছিলেন " এক, আমাকে আইরম শর্মিলা চানুর সঙ্গে দেখা করিয়ে দিতে হবে। দুই, আসাম রাইফেলস এর হেডকোয়ার্টার এর সামনে নিয়ে যেতে হবে। শর্মিলার সঙ্গে দেখা করার পারমিশন পাওয়া যায়নি। জানতাম পাওয়া যাবে না। আমাকে দেওয়া হয়নি। " (ভারত সরকার আইনটা রেখেছে কেন?) 
 " রক্তবমি করছিলাম 
দেওয়ালে লেখা পড়ছিলাম 
বাঁচতে হলে বাঁচাতে হয় আগে 
পৃথিবী জুড়ে যেমন করে 
মা-লক্ষ্মীরা জাগে। " (গুজরাটে কোজাগরী) 

সমস্ত কবিতাই একটা জেদ। খাতার পৃষ্ঠা থেকে গনগন করছে আগুনের তাপ ....সাদা পাতা যদি ভলক্যানো না হয় তাহলে সেই মূল্যহীন পাতা ছিঁড়ে ফেলে দাও। কে বলল? কে বলল কথাটা... আমি আইরম শর্মিলা চানু, ১০ বছর আমার নাকের ভিতর দিয়ে বয়ে চলেছে আত্মহত্যাকারী কৃষকের শেষ নিঃশ্বাস, আমার নলের ভিতর দিয়ে বয়ে চলেছে ভারভারা রাওয়ের কবিতার আগুন। এই নলের ভিতর দিয়ে বয়ে চলেছে নর্থ-ইষ্ট এর ধর্ষিত মেয়েদের রক্তস্রোত। এই নলই এখন রাষ্ট্রিয় নাশকতা, ইনসারজেন্সি ও অন্যদিকে "আচ্ছে দিন " এর মাঝে একটি বর্ডার লাইন। এইরকম বর্ডারের উপর দাঁড়িয়ে আমি কবিতা পাঠ করি 'মনিপুরের মা' ..... মাথার পিছনে একটা বন্দুকের নল! হল্ট....
 আসাম রাইফেলস থেকে পরপর বন্দুকের নল তখন আমার দিকে। ভারি বুটের আওয়াজ ঘিরে ধরছে।

এখন লড়াইটা বুলেট আর একটা কবিতার মাঝখানে, একদিকে থমথমে পাহাড় আর উপত্যকার মাঝে বন্দুকের দিকে কবিতা একটা কাগজ ছুঁড়ে মারে - লেখা - " Assam Rifles had been deployed under the Armed process (special process) Act, 1958"

  " যা খুশি তাই করতে পারে আর্মি আর 
   পুলিশ, পথে কার্ফ্যু, জ্বলে চারমিনার 
   কারও কিছু বলার নেই, ..." ( মনিপুরের মা) 

প্যারামিলিটারি বলল- ' এই শালা, এসব কি বলছিস তুই! কে লিখেছে এইসব লেখা ! কি বই দেখি ! 
আমি - "মনিপুরের মা" , সুবোধ সরকার। আপনাদের চোখে দেশদ্রোহী। আমরা বলি বাংলা কবিতার ডিনামাইট ! 

আসতে আসতে আমরা "কালমহুয়ার বনে" র মধ্যে ঢুকে পড়ছি। এই 'আমি'র কোনও লিঙ্গ নেই, নেই কোনও জাত। আছে শুধু ক্ষমতা আর শোষণের মধ্যে দাবা খেলা। জঙ্গল থেকে বুনো বার হয়ে আসে, তার সঙ্গে ১০ জনের কোরাস কবিতা আর তীর ।

আমার মাথায় মিলিটারি বন্দুক = মিলিটারির পিঠের কাছে বুনোর দলের তীর! 

ধনুকের ছিলার মতো তার টানটান কন্ঠস্বর - 

বুনো - তিরধনুকে কাজ হবে না 
         মাটিতে পোঁতো মাইন
         আমরা নাকি জানিনা কিছু
         জানি না কোন আইন? 
         অনেক দিন সহ্য করেছি 
         লাঠির পর লাঠি
 এখন আমি বাঁকুড়া চাই, আকাশ চাই
ফেরত চাই আমার ঘটিবাটি 

কোরাস : ফেরত চাই ঘাস 
              ফেরত চাই পাতা 
        ফেরত চাই সব ছেলেকে 
      জেলখানার থেকে। 
                       (কালমহুয়ার বনে:পৃষ্ঠা ৪২-৪৩) 
- সবাই এই বইটা থেকে বিভিন্ন অংশ তুলে নিয়ে আমাদের দিকে ছুঁড়ে দিচ্ছে ছুরি। কি আছে এই বইয়ের মধ্যে।

- বইয়ের পাতায় পাতায় ল্যান্ডমাইন ছড়ানো আছে ।  মলোটভ ককটেলের মতো আমি শুধু কবিতাগুলো পৌঁছে দেব তাদের হাতে যাদের জীবন মানে রুটি আর ভাতের জন্য লড়াই। রাষ্ট্র যে কাজটা মিলিটারি পুষে করে থাকে, আমি সেই কাজটাই কবিতা দিয়ে করি। 

২০০৫ থেকে ২০২০ পর্যন্ত " বাঁকে জল নিয়ে ইতিহাস ধরে হাঁটি " হেঁটে চলেছি আজও। সারা দেশ জুড়ে অত্যাচর, ছোট থেকে বড়ো আকারের ভয়, সামান্য দুটো রুটির জন্য অক্লান্ত কাজ, ঘরে ঘরে সম্পর্কের ভাঙন, মুখের ভাষাকে কেড়ে নেওয়া, জঙ্গল পাহাড়কে "হাতে হোক ভাতে হোক মারো বাড়াভাতে" এই আইন নিয়ে জনগনের চোখে ঠুলি পরিয়ে রাখার কথা বলে যায় এই কবিতা। এখন আপনি বলুন বন্দুকবাবু - কবিতাগুলো কে লিখেছে আপনি? না দেশ? 
আমি তো শুধু আপনাদের কালো ইতিহাস পাঠ করছি। 
" কী হচ্ছে? কী হচ্ছে জানেন না আপনারা?
যদি কাল আসাম রাইফেলস আপনাদের
জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে ঢুকে পড়ে
রবীন্দ্রনাথের সামনে দাঁড়িয়ে হস্তমৈথুন করে?
কী রকম লাগবে আপনাদের? 
যদি কাল গডি়যা়হাটা রোডে মাস্টারমশাইকে
ছাত্রদের সামনে ন্যাংটো করে
উঠবোস করায়? কেমন লাগবে? 
যদি কাল আপনাদের শঙ্খ ঘোষের মেয়েকে
তুলে নিয়ে যায়? কেমন লাগবে? 
( ইবমচা সিং)
উত্তর আছে কোনও? 
এবার আপনাদের আধুনিক পৃথিবীর নৃশংস  ইতিহাসের পাঠ , আপনি শুনবেন,জানবেন - যা দেখে গোটা পৃথিবী প্রার্থনা করেছিল নিজেদের চোখের আলো মুছে দিতে । 

নগ্ন মায়ের দেহে লেখা আধুনিক ভারতের ইতিহাস :

১৫ ই জুলাই ২০০৪ । ইতিহাস দেখবে ভারতবর্ষের চরমতম লজ্জা। থাংইয়াম মনোরমাকে দেশ বিরোধী চিহ্নিত করে আসাম রাইফেলস প্যারামিলিটারি ফোর্স গণধর্ষণ করে এবং তারপর তার দেহ ছিন্নভিন্ন করে দেয় বুলেটের আঘাতে । ক্ষমতার দাসত্বের কাছে গোটা দেশ যখন অন্ধ হয়ে আছে, ১২ জন মা তখন রাস্তার উপর কাপড় খুলে ছুঁড়ে ফেলে দিল - 
- আহ্! থামুন 
- না থামবো না, শুনতে আপনাকে হবেই। ওই কাপড়টাই আমাদের গণতন্ত্রের মুখ।

 ১৫ জুলাই, ২০০৪ ,মনোরমার উপর  পাশবিক অত্যাচারের বিরুদ্ধে মায়েরা শুধু মুখই খুলল না, যে বুকে স্তন্যপান করিয়েছে সন্তানকে সেটাও মুক্ত করে কাঙ্গলা ফোর্ট আসাম রাইফেলস এর গেটের সামনে ১২ জন রাষ্ট্রের অন্ধকার মুখটা খুলে দিল - 

            "INDIAN ARMY RAPE US " 

  " নগ্ন উঠে দাঁড়াল আমার মনিপুরের মা 
এই মায়ের দুচোখ থেকে চোখ পেয়েছি 
আরশিনখ ভাষা পেয়েছি, পেয়েছি সা রে গা মা 
নগ্ন উঠে দাঁড়াল আমার মনিপুরের মা। " 

সেই ১২ জন মা জ্ঞানেশ্বরী , তারুনি, রামানি, যামিনী,   নাজ্ঞাবি, ইমেবহল, মোমন, ইবেতোমি, জীবনমালা, তোমবি, সোরো, এবং মেমা ...... আর সেই সঙ্গে আমার মা। সবাইকে নগ্ন করে দিতে পিছপা হয় না কেন্দ্রীয় ক্ষমতা। 

"উঠে দাঁড়ান মনিপুরের মা
উঠে দাঁড়ান স্তন্যদায়িনীরা 
পৃথিবী দেখ্, মায়ের বুকে ক'খানা উপশিরা ! 
কেমন লাগে নগ্ন হলে তোর নিজের মা ? "

তাদের কন্ঠস্বর আজও রাতের পর রাত আমার কানে ভেসে আসে - "আমরা সবাই মনোরমার মা " - আমি বলি তোমরা তো আমারও মা। আমি তোমাদের পাশে দাঁড়াতে পারিনি। যখন বন্দী হয়ে আছি ঘরের মধ্যে , হাইওয়ের ধার দিয়ে যাওয়া ট্রাক থামিয়ে , এক একজন মা সন্তানের খাবারের জন্য, দুর্বল স্বামীর জন্য নগ্ন হয়েছে বহু পুরুষের কাছে। একবার যদি ভারত সরকারের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে পারি মনে হয় আঙুল তুলে বলি - বলিউডের বাজার চলার জন্য অভিনেত্রীর স্ক্যান্ডেল প্রচার করা যায়, মৃত অভিনেতার দেহ নিয়ে ব্যবসা করা যায়, কয়েকশো কোটি টাকা দিয়ে IPL ক্রিকেট চালানো যায়, কিন্তু দেশের মড়কে গরীব মানুষের জন্য একটু ভাত, দুটো রুটি দেওয়া যায় না বলুন? বাড়িতে ফিরে গেলে আপনার মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে পারেন তো? পারেন না, কারণ আপনি জানেন আপনার মা তাহলে বলবে - 
" যেখানে আজ মায়েরা হাঁটে নগ্ন হয়ে মিছিলে 
স্থলনায়ক, জলনায়ক তোমরা তখন কী করছিলে? 

ভাবছ নাকি তোমার মা এখনও আছেন পরমা ? 
পুড়ে গিয়েছে, পুড়ে গিয়েছেন ... 

সব মায়ের মধ্যে থাকা নিজের সেই বড়ো মা । " 
(মনিপুরের মা)

Post a Comment

1 Comments