জ্বলদর্চি

অ্যাঁতেলেকত্যুয়েল বনাম আঁতেল - ১৬

   অলংকরণ- প্রান্তিকা মাইতি 


অ্যাঁতেলেকত্যুয়েল বনাম আঁতেল
(পর্ব --১৬)

স ন্দী প  কা ঞ্জি লা ল 

বুদ্ধিজীবী ও গণিকাবৃত্তি--১ 

প্রথমেই বলবো একটু চোখ বুজে মনে মনে একটা ছবি আঁকতে। ছবিটি হলো, একটি কিশোরী হবু হবু সন্ধ্যায় কলেজ থেকে ফিরছে, আর একদল কাঁচা মাংসের তরতাজা শিকারী ওৎ পেতে আছে তার মাংস ভক্ষণের। তরুণীটি এলো! শিকারীরা শিকার করলো, মেয়েটি মারা গেল। শিকারীরা মনোরম খাওয়ার খেয়ে ঢেকুর তুলতে তুলতে চলে গেলো। তারপর গ্রামবাসী রাগে ফেটে পড়লো। সঙ্গে সঙ্গে রাজ্য জুড়ে সাধারণ মানুষ ভাবছে এর একটা প্রতিবাদ হওয়া দরকার। তখন সমাজে বিশেষ গণ্যমান্য কিছু ব্যক্তির আহ্বানে একটি মিছিল সংগঠিত হল। মিছিলের অজস্র পায়ের পদাঘাতে শহরের রাস্তা থরহরি কম্পমান। এবার চোখ খুলে ভাবুন। সে সময় কিছু মানুষ রাজনীতির ভেদাভেদ ভুলে সেই মিছিলে পা বাড়িয়েছিলেন। সেই মিছিলে যারা হেঁটেছিল তাদের উদ্দেশ্য ছিল পরিষ্কার। একটা অন্যায়ের প্রতিবাদ! সেখানে গৌণ ছিল ক'জন বিখ্যাত মানুষ মিছিলে যোগ দিয়েছিল তার হিসাব কষা। এদের লক্ষ্য ছিল এই ঘটনাকে সমস্ত মানুষের কাছে তুলে ধরা। আর অবস্থান ছিল সমস্ত ক্ষমতার বৃত্তের বাইরে দাঁড়িয়ে সমস্ত অন্যায় কার্যকলাপের বিরোধিতা করা। এরা অন্যায়ের বিরুদ্ধে সমবেত মানুষের কণ্ঠস্বর। 
কিন্তু যখন দেখা গেল, কিছু মানুষ বা তথাকথিত বুদ্ধিজীবী  যখন বলেন, ঐ মিছিলে আমাদের  মনোমত লোকজন ছিল না, তাই আমরা যাইনি। তার ফলে  দাঁড়ালো, এই বুদ্ধিজীবীরা নিরপেক্ষ, সর্বজনীন বুদ্ধিজীবীও হয়ে উঠতে পারেননি। এই বুদ্ধিজীবী স্বাধীনও নন, সমদর্শীও নন। নিজের গোষ্ঠী ক্ষমতায় থাকলে আজকের এই দলদাস বুদ্ধিজীবীর চোখ বন্ধ করে থাকেন। আবার তাদের পছন্দের দল ক্ষমতায় না থাকলে ন্যায় সত্যের জন্য লড়াই করবেন। অবশ্য সাধারণভাবে বাঙালি বুদ্ধিজীবীরা কোনোদিন গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা পালন করেনি। এদের অধিকাংশ সামান্য অর্থ, পদ ক্ষমতালোভী এবং ভীতু। তাই এই সব বুদ্ধিজীবীরা কোনদিন মানুষের আস্থা অর্জন করতে পারেনি। 
বুদ্ধিজীবীদের কথা বলতে গেলে মনে পড়ে, দার্শনিক 'ফুকো' প্রতিষ্ঠিত "প্রিজন ইনফরমেশন গ্রুপ" এর কথা। ফরাসিতে থাকে বলা হত, 'জি.আই.পি'(G.I.P)। এটি ১৯৭১ সালের ৮ই ফেব্রুয়ারী প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে "ফুকো" বলেছিলেন, ফরাসি কারাগারের অবস্থা অসহনীয়, সেখানে বন্দীদের সাথে কুকুর শৃগালের মতো ব্যবহার করা হয়। ফলে কারাগারে ভিতর কি ঘটছে সে সম্পর্কে তথা জানাটা জরুরি এবং জি.আই.পি. এর কাজ হবে হবে সেই সম্বন্ধে তথ্য সংগ্রহ করা। তথ্য সংগ্রহের জন্য প্রশ্নপত্র বিলি করা হত। তার উত্তর নিয়ে যখন বিভিন্ন জায়গায় প্রতিবাদ সভা হচ্ছে, তখন 'তুল' কারাগারের এক ডাক্তার 'এডিথ' উত্তরের লেখেন, কারাগারে পরিকল্পিত হিংসার প্রয়োগ, শারিরীক নির্যাতন, চিকিৎসার সুব্যবস্থা না থাকা, খাওয়ার নিম্নমান প্রভৃতি কারণে কারাগারে আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ছে। একথা জানানোর ফলে, 'এডিথ'কে চাকরী ছাড়তে বাধ্য করা হয়। 'ফুকো' বলেন 'এডিথ' হলেন বুদ্ধিজীবীর আদর্শ। তিনি বুদ্ধিজীবীকে ভাবতেন অধরা গেরিলা বাহিনী। বুদ্ধিজীবী ভবিষ্যতের ব্লুপ্রিন্ট প্রচার করে না। সে সবসময় গতিশীল এবং জানে না কোথায় গিয়ে সে পৌঁছবে বা কাল কী ভাববে। বুদ্ধিজীবীর কাজ সমবেত রাজনৈতিক ইচ্ছা বা উইলকে নির্ধারণ করা বা গড়ে দেওয়া নয়, অন্যের রাজনৈতিক ইচ্ছা গঠন করাও নয় অন্যের কী করা উচিত সেটাও বলা নয়। তাঁর কাজ মানুষের মানসিক অভ্যাসগুলিকে নাড়া দেবেন, মানুষের ভাবনার ধরণ নিয়ে প্রশ্ন তুলবেন। বুদ্ধিজীবীর কাজ হল মানুষকে এটা প্রদর্শিত করা যে তাঁরা নিজেকে যতটা স্বাধীন ভাবেন, তার চেয়ে অনেক বেশি স্বাধীন থাকা যায়। তাঁরা যাকে সত্য বলে গ্রহণ করেছেন, তারও সমালোচনা করা যায় এবং তা ধ্বংসও করা যায়। বুদ্ধিজীবী মানুষের মনের গঠনের ছাঁচকে পরিবর্তন করবেন। 
এক অর্থে বুদ্ধিজীবীর কোনো 'লিডিং রোল' নেই। এই ভূমিকা তাঁর পালন করার কথাও না এবং এর কোনো প্রয়োজনও নেই। বরং বুদ্ধিজীবীর মনে রাখা উচিৎ জনসাধারণ অজ্ঞ নন, তাদেরও যথেষ্ট জ্ঞানবুদ্ধি আছে। সমস্যা হল এই যে, জনসাধারণের জ্ঞানের প্রকার, তাদের জ্ঞানের লোকাল ও পপুলার ফর্মগুলিকে ধারাবাহিকভাবে অবজ্ঞা করা হয়েছে- অনুপযুক্ত, বাতিল ঘোষণা করা হয়েছে, অনাস্থা প্রকাশ করা হয়েছে, অবৈধ বলে রায় দেওয়া হয়েছে। কাজগুলি হয়েছে সেই প্রতিষ্ঠানগুলির দ্বারা যাদের মাধ্যমে সমাজে এক বিশেষ 'সত্যের বিধি' প্রচলিত এবং যার অন্দরে বুদ্ধিজীবীও অবস্থান করেন। সুতরাং জনসাধারণের নিজেদের জ্ঞানের জন্য বুদ্ধিজীবীর প্রয়োজন নেই। জনসাধারণ যেটা জানেন সেটা খুব ভালোভাবেই জানেন এবং সে জানাটা ব্যক্ত করার ক্ষমতাও তাদের আছে। কিন্তু ক্ষমতার সিস্টেম এই জ্ঞান ও ডিসকোর্সকে নিষিদ্ধ করে, অবরুদ্ধ করে, বাতিল করে রেখেছে। আর, বুদ্ধিজীবীরা নিজেরাই এই ক্ষমতার মাধ্যম, বাহক ও প্রতিনিধি। কিন্তু একজন ডাক্তার রোগীকে বাইরে থেকে পর্যবেক্ষণ, পরীক্ষা করতে পারেন- বুদ্ধিজীবীর কোনো 'বাইরের অবস্থান' নেই। যে রোগ তিনি সারাতে চান, তিনি নিজেও সেই রোগে আক্রান্ত। এই প্রসঙ্গে বলি জ্ঞান কিন্তু ক্ষমতার কোনো সুপারস্ট্রকচার নয় বরং উৎপাদন-নির্ভর, প্রযুক্তি-নির্ভর সমাজের এক অত্যাবশ্যক অঙ্গ। কিন্তু ক্ষমতা ও জ্ঞান এক বস্তু নয়, এরা পরস্পর সম্পর্কিত কিন্তু এদের মধ্যে কার্যকরণ সম্পর্ক নেই। সর্বজনীন বুদ্ধিজীবী বস্তুত ক্ষমতার খেলাই নিজের খেলা ভেবে খেলেন। তাই বুদ্ধিজীবীর কাজ হল ক্ষমতার বিভিন্ন প্রকারের বিরুদ্ধে লড়াই করা, যে ক্ষমতা তাকে এক অবজেক্ট-এ পরিণত করেছে। বুদ্ধিজীবী কোনো প্রফেট নন, তিনি রেফারি নন, বিচারক ও নন, তিনি মানুষকে বলবেন না, "শোনো, আমার কাছে এসে বোসো, আমি যেটা বলছি সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ।" বুদ্ধিজীবীর কাজ কোনো বিশেষ অবস্থায় সমাধান দেওয়াও নয়, কারণ এই কাজের মাধ্যমে তিনি সেই বিশেষ ক্ষমতার ব্যবস্থাকেই সাহায্য করবেন, হয়তো মজবুত ও করবেন। এইজন্যই বুঝতে কষ্ট হয় না কেন, রাজনৈতিক দলগুলি সেইসব বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে এত আগ্রহী, যাদের কাছে সব কিছুর সমাধান আছে। এইভাবে রাজনীতি ও তাদের পার্টনারের মধ্যে এক সম্পর্ক তৈরি হয়। বুদ্ধিজীবী একটি প্রস্তাব দিলেন, পার্টি সেটার সমালোচনা করল, অথবা অন্য একটি প্রস্তাব তৈরি করল। বুদ্ধিজীবীর এই যে ভূমিকা, কখনো রাজনৈতিক দলের অলটার ইগো, কখনো ডাবল, কখনো বা অ্যালিবাই, এই ভূমিকা কখনোই গ্রহণযোগ্য নয়। গণিকাবৃত্তি কাকে বলবো? যে পুরুষ অথবা নারী দেহ কামনা, বাসনা অর্থের বা অন্য কারণে অপরের ভোগের বস্তু। অর্থাৎ নিজ পতি বা পত্নী ব্যতীত অন্য কারও সাথে পবিত্র বা ধর্ম্মীয় অর্থ বা অন্য কোনো কারণে দেহকে কাম প্রবৃত্তি নিরসনের জন্য ব্যবহার করতে দেয়। আরও সরলভাবে বললে টাকা বা অন্য কিছুর কারণে অন্যের হাতে নিজের দেহকে তুলে দেয়। সেইভাবে বুদ্ধি গণিকা বলতে তাদেরকে বুঝবো যারা টাকার বিনিময়ে নিজের বিবেক, বুদ্ধি, মনুষ্যত্ব, মেধাকে বিক্রি করে দিয়ে বাকস্বাধীনতার অপব্যবহার করে। বিভিন্ন মিডিয়াতে বা টকশোতে শাসক শ্রেণির পক্ষে বা অন্যায়ের পক্ষে গলা ফাটান, তাদের সূক্ষ্ম বুদ্ধির কৌশলে, বিভিন্ন মনীষীর কথা তুলে ধরে স্ট্যাণ্ডবাজি করে মানুষের চেতনা বা ইতিহাসকে বিকৃত করা। 
সাম্প্রতিক লক্ষ্য করলে দেখতে পাওয়া যায়, অনেক ব্যক্তি নিজেকে নিজেই একজন বুদ্ধিজীবী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছেন বা বিভিন্ন মিডিয়া কিছু কিছু ব্যক্তিকে টার্গেট করে তাদের নামের আগে বেশ কিছু বিশেষণ যোগ করে সর্বশেষ বুদ্ধিজীবী টাইটেল দিয়েই তবে ছাড়ছে। বুদ্ধিজীবীর দায়িত্ব যেখানে শাসকগোষ্ঠীর ভুল ধরিয়ে দেওয়া, এদের কাজ হচ্ছে তাদের মনোরঞ্জন করা। তার ফলে এই সব গণিকা বুদ্ধিজীবীদের জন্য  পদ-পদবি ও পুরষ্কার বরাদ্দ থাকে। এদের মধ্যে যে জিনিসটি সবচেয়ে প্রকট, সেটি চিন্তার দারিদ্র্য, মননের দৈন্য। জনস্বার্থবিরোধী কর্মকাণ্ডের জন্য শাসক শ্রেণিকে যখন প্রশ্নের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর দায়িত্ব বুদ্ধিজীবীদের তখন তারা হয় স্তুতিসর্বস্ব রম্য রচনা লিখেছেন,  না হলে বিরোধীদের মুণ্ডপাত করে সংবাদপত্রের পাতার পর পাতা ভরাচ্ছেন। স্পেসের পর স্পেস নষ্ট করছে অনলাইন নিউজপোর্টাল গুলোর। টেলিভিশন চ্যানেল গুলো ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় ব্যয় করছে। এরা নিন্দার পরিবর্তে স্তুতি, সমালোচনার পরিবর্তে কৌশলে প্রশংসায় ব্যস্ত। কোন সমস্যার সমাধানের চেয়ে নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনার পাশাপাশি নিজেকেই আলোচনার মূল বিষয়ে পরিণত করছেন। 
শুধু তাই নয়, এই গণিকাবৃত্তি তালিকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক থেকে শুরু করে যারা দু একটা কবিতা কোথাও লিখেছে, বা সদ্য স্কুলের গণ্ডি পার হওয়া প্রায় কিশোরটিও নাম লেখাচ্ছে। বুদ্ধিজীবীর মিছিলেও এই সব গণিকারা বুক ফুলিয়ে হাঁটছে। এখন দেখতে হবে এর জন্য দায়ী কারা? (ক্রমশ)

Post a Comment

0 Comments