জ্বলদর্চি

শ্রমিক পর্ব: করোনা কালের এক নির্মম অপমানের ইতিহাস

কার্টুন - সুদেষ্ণা রায়চৌধুরী    


শ্রমিক পর্ব:
করোনা কালের এক নির্মম অপমানের ইতিহাস

তু ল সী দা স  মা ই তি


দুর্ভিক্ষপীড়িত দেশ
রক্তচক্ষু রাজার শাসন
শকুনি বিশ্বস্ত বন্ধু
মুঠোয় শিথিল সিংহাসন।।

কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের লেখা। কবিতার এই পংক্তিগুলো লেখার পরে কয়েক দশক কেটে গেছে। কিন্তু প্রাসঙ্গিকতায়   সে আজও উজ্জ্বল। অন্তত গত কয়েকমাসের ঘটনাবলি তাই- ই বলে। স্বাধীনতার পর একটা দেশের রাজনৈতিক সামাজিক নানান বিবর্তন ঘটেছে অর্থনীতিসহ অন্যান্য  ক্ষেত্রগুলির কাজকর্ম ও রীতিনীতির ধরণও বদলেছে। উন্নয়নশীল দেশে ভোগবাদী মানসিকতাকে কাজে লাগিয়ে কর্পোরেট পৃথিবী দাপিয়ে বেড়িয়েছে। এমনই এক সময়কালে এসে গেল কোভিড- ১৯ নামক অতিমারীর থাবা। সারাপৃথিবী বিপর্যস্ত হয়ে অসহায়। সমগ্র পৃথিবীর এই ঝড়ের সঙ্গে আমাদের দেশ ভারতেও ছড়িয়ে পড়েছে অতিমারীর অনিবার্য সংক্রমণ একথা আমাদের জানা।  না কোনো দর্শন,রাজনীতি,অর্থনীতি ,সমাজনীতি -ইত্যাদি বিষয়ের পন্ডিত হিসেবে নই, খুব সাধারণ একজন মানুষ হিসেবে কিছু কষ্টকর অনুভূতি প্রকাশের দায় থেকেই এ লেখার অবতারণা।

চীন,ইতালি ইরান,স্পেন সহ নানান দেশ  যখন আক্রান্ত হচ্ছে আমাদের দেশ নিশ্চিন্তে ছিল।কিন্তু পরেই যখন আছড়ে পড়লো জীবাণুর ঢেউ তখনই কেমন একটা অগোছালো হয়ে উঠলো দেশটা। করোনাকালে  বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থার নির্দেশ ও আক্রান্ত দেশগুলির অভিজ্ঞতা নিয়েই পথ নির্ণয় করলো ভারত। অনিবার্যভাবেই লকডাউন । সারাদেশের মানুষ ঢুকে গেলো বাড়িতে। আর তার পরেই শুরু হলো আর এক যুদ্ধ। দেশশুদ্ধ মানুষকে রাজা রানীরা  উৎসাহিত করেই করোনা মোকাবিলায় ঝাঁপিয়ে পড়লেন। সব হয়তো ঠিক ছিল। জনগণ ও বাড়িতে বসে নিশ্চিন্তে ভেবে নিলো এই লকডাউনের অস্ত্রেই জীবাণু ঘায়েল হয়ে যাবে।কিন্তু যতদিন যায় দেশের সাধারণ মানুষ,,যারা দিন এনে দিন খায়.একটুখানি  কাজের জন্য দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে  বেড়ায়,বেমালুম তাদের কথা ভুলে গেল রাষ্ট্র। শরীরের দগদগে ক্ষতকে যেমন আটকে রাখা  যায় না দেশের চরম দারিদ্র্যও খুলে বেরিয়ে পড়ল রাস্তায়। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা শ্রমিক আটকে পড়লো লক ডাউনে নয়, ক্ষুধার রাজ্যে। দেশ যখন যুদ্ধ করছে করোনার সাথে,শ্রমিকরা  তখন লড়াই শুরু করলো বাঁচার। জীবন ও জীবিকার এক বিপন্ন দ্বন্দ্ব।এক অভূতপূর্ব পরস্থিতি তৈরি হলো সারাদেশে। এর জন্য আমাদের অভাগা দেশ রাজ্য কেউ প্রস্তুত ছিল কি? দেশের লক্ষ লক্ষ শ্রমিক কাজ হারিয়ে অসহায়। হাহাকার করছে। তাদের দুর্দশা র চিত্র সমগ্র বিশ্ব দেখলো। আর হাজার প্রশ্নের মুখোমুখি এনে ফেললো রাষ্ট্রকে। রাজপথ দখল করলো কর্মহীন খাদ্যহীন মানুষ।হাজার হাজার কিলোমিটার পথ হাঁটার এই ইতিহাস আসলে একটা অপমানের ইতিহাস।তাদের নাম 'পরিযায়ী'।  এই অদ্ভুত নামে তাদের সম্মান বাড়েনি। এও এক ধরণের অপমান।দেশের মানুষ দেশে কাজ করে। দেশের সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যায়। দেশ নির্মাণের তারা প্রধান সৈনিক ।তাদের বলা হলো পরিযায়ী।কি অদ্ভুত লাগছে না! এই নামেই তো  আসলে আছে উদাসীনতা।

কতটা পথ পেরোলে তবে পথিক বলা যায়' -।  এই প্রশ্ন আজ ও প্রাসঙ্গিক। খুব ছোটো ছিলাম যখন তখন শুনতাম আগেকার মানুষ নাকি হেঁটে শত শত কিলোমিটার যাতায়াত করেছে। দীর্ঘসময় পরে একথা আর ভাবাই যায় না। কিন্তু আজ ইতিহাস আবার উঠে এসেছে। করোনা সংকটকালে যখন লকডাউন চলছে সমগ্র দেশে ,তখন কাজ হারিয়ে অসহায় শ্রমিকদের অনেককেই দেখলাম পথ হাঁটছে। মানসিকভাবে তারা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে নিজের ঘরে প্রিয়জনের কাছে ফিরতে তারা শত শত কিলোমিটার হাঁটবে। এ যেন পথের এক করুন মূর্তি।ছোটো ছোটো ছেলেমেয়ে নিয়ে ভারী ভারী ব্যাগপত্র নিয়ে হাঁটছে। আমাদের দেশের শ্রমজীবী মানুষ। খাবার নেই, জল নেই, সব রকমের অনিশ্চয়তা তাদের সঙ্গী।তারপরে করোনা আক্রান্ত হওয়ার ভয়। যেখানে গিয়ে পৌঁছাবে সেখাকার মানুষজনই বা এই করোনা ভীতি অতিক্রম করে তাদের গ্রহণ করবে কিনা  তারও ভয় নিয়ে তারা পথ হাঁটছে। শুধু হাঁটছে নয় মরছে।কাতারে কাতারে মানুষ অসুস্থ হয়ে,পদপিষ্ট হয়ে ,অনাহারে মারা যাচ্ছে। কত নির্মম দৃশ্যাবলী।আবাল- বৃদ্ধ- বনিতা পথিকের সঙ্গী শূন্য উদর ও চরম অনিশ্চয়তা।শিশু কোলে মা হাঁটছে।বৃদ্ধা মাকে কাঁধে নিয়ে হাঁটছে পুত্র।স্যুটকেসের ওপর ঘুমিয়ে আছে সন্তান।পিতা টেনে নিয়ে যাচ্ছে তাকে অনন্ত পথ। অন্তঃস্বত্বা স্ত্রীকে রাস্তায় গাছ কেটে দোলা তৈরি করে তাতে চড়িয়ে পথ হাঁটছে।এসব দৃশ্য দেখছে  নির্বিকার দেশ। রক্তে ভিজে গেল এই যাত্রা পথ ।ঘুমিয়ে পড়েছে শ্রমিক রেললাইনে এক ঝাঁক শ্রমিকের উপর দিয়ে চলে গেল ট্রেন।ট্রাকসুদ্ধ একদল শ্রমিককে নির্মম ভাবে পিষে দিয়ে গেল আর একটা খুনি ট্রাক।স্টেশনে অনাহারে মরে যাওয়া মায়ের মৃতদেহ নিয়ে খেলছে অবোধ শিশু। এমন কত ঘটনা।সিনেমার দৃশ্যকেও  হার মানায়। 

তাদের রাজ্যে রাজ্যে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য কত টানাপোড়েন।কে দেবে রেলের ভাড়া তা নিয়ে তর্জা।ফেরার পর ও নানান বিভ্রান্তি।
সবই আজ জানা। অপমান ও অবহেলার দীর্ঘ ইতিহাস।

যে দেশে লক্ষ লক্ষ যানবাহন স্তব্ধ হয়ে আছে রাস্তার ধারে ধারে তারা যেন সভ্যতার এই ব্যতিক্রমকে ব্যঙ্গ করছে। যখন ইতালি, যুক্তরাষ্ট্র, স্পেন প্রভৃতি দেশের মতো আমাদের দেশে আক্রান্তের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়নি।  যখন এই দেশে হাজার আক্রান্ত হাজার পেরিয়েছে মাত্র। মানুষ বাড়িতে আছে। দেশ লড়ছে করোনার বিরুদ্ধে সবই ঠিকঠাক। কিন্তু তখন  এই পথের  ছবিটা কি কষ্ট দেয় না? পথের এই কাহিনি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে কি দেখিয়ে দিচ্ছে না যে  আমরা এখনো প্রান্তিক মানুষের জন্য  তেমন পরিকাঠামো গড়ে তুলতে পারিনি?

করোনা না হলে সবার চোখে এত মানুষের অসহায়তার দিকটা আমাদের চোখেই পড়তো না হয়তো। রাস্তায় রাস্তায় শহরের মোড়ে মোড়ে এত নিরন্ন মানুষ আজও আমাদের কী ইঙ্গিত করে? সব ঠিক থাকলে আজ  হয়তো আই.পি.এল হয়ে যেত।
কোটি কোটি টাকার আলোতে ঝলমল করে উঠতো দেশ। সব ঠিক থাকলে আজ কত উৎসব হতো। শুধু চোখে পড়তো না এই দিন আনা দিন খাওয়া - নিরন্ন মানুষের এই অসহায়তার রূপখানি।

একদিন করোনা হয়তো  চলে যাবে।একদিন হয়তো পৃথিবী শান্ত হবে।  এই বিষয়  নিয়ে কত লেখা হবে।উপন্যাস,গল্প ,কবিতা ,নাটক, প্রবন্ধ ইত্যাদি ।কোটি কোটি টাকা খরচ করে সিনেমাও নির্মিত হবে। কিন্তু এই অতলান্ত যন্ত্রণার ইতিহাস থেকে যাবে বহুকাল।

স্বাধীনতা  প্রাপ্তির পর এই দেশে দেশপ্রেমের চর্চা হয়নি। বৈষম্য দূর করার কথা ভাবাই হয়েছে মাত্র। কতটুকু তার সফল হয়েছে? দশকের পর দশক কৃষক ও শ্রমজীবী মানুষের প্রতি উদাসীনই থেকেছি আমরা, তাই আজ কঠিন সময়ে তাদের ছবিটা আমাদের এত ভাবাচ্ছে।

আজ আমাদের ভাবা উচিত, কী করা দরকার ছিল, কী করা উচিত আগামী কাল।

এই সংকটে আর একবার আমরা দেখছি, দেশে সমস্ত রকমের গোঁড়ামি কত প্রকট। ধর্মীয় গোঁড়ামি, রাজনৈতিক গোঁড়ামি, দুটোই প্রবল। সঙ্গে অন্ধত্ব। এর থেকেই জন্ম নিচ্ছে সঠিক ও নিরপেক্ষ মূল্যায়নের অভাব। তাই ভুলে গেছি তাদের কথা। যারা আজ খাবার যোগাচ্ছে। উৎপাদন কাজের সঙ্গে যুক্ত থেকে যারা সভ্যতাকে টিকিয়ে রাখার যুদ্ধ করছে তারাই আজ বিপন্ন।
আজ করোনার সাথে লড়াইয়ের মাঝেই সেই মানুষগুলো  যাতে একটু আলো পায় তারও ব্যবস্থা হোক।

  কবির কথাতেই বলি- 
 আমরা তো সামান্য লোক/আমাদের শুকনো ভাতে   লবণের ব্যবস্থা হোক।"



Post a Comment

1 Comments

  1. কান পাতলেই শুনতে পাই গুমরে ওঠা কান্না , অসহায় মায়ের আর্তি , পরিযায়ী শ্রমিকদের পায়ে ফোঁসকা, রাজ‍্য থেকে রাজ‍্যে ঘরে ফেরা কিশোরীর নিথর শরীর , কিংবা প্লাটফর্মে মৃতামায়ের শরীর আঁকরে থাকা শিশু দের আকুলতা।
    তবুও সমাজ চুপ করে আছে , পিঠ বাঁচিয়ে নিজের মতো থাকছে । একটু জেগে ওঠার সময় হয়েছে এখন , আর নয় , ভিতের গোড়া আলগা হতে দাওয়া যাবে না , তাহলে উপর থেকে ধস নেমে সমাজ মাটিতে মিশে যাবে ।।

    ReplyDelete