জ্বলদর্চি

জন্মজয়ন্তীতে জ্যোতির্ময় নন্দ / মন্মথনাথ দাস


জন্মজয়ন্তীতে জ্যোতির্ময় বন্দনা          
(৬-৯,১৯০৮--৫,১১,১৯৯৬)        
           

ম ন্ম থ না থ  দা স

রাত্রির অবিরাম তপস্যা যেমন আলোকিত এক দিবসের প্রত্যাশায়, তেমনি সংকট-আকীর্ণ প্রতিটি সমাজ কালোত্তীর্ণ মহাজীবনের মধ্যে অনুসন্ধান করে নবজীবনের দিশা। জন্মদিনে জ্যোতির্ময় বন্দনা সেই আলোকেরই সাধনা। যেনাহং নামৃতাস্যাম্ কিমহং তেন কুর্যাম্'--মৈত্রেয়ীর মুখনিঃসৃত এই মহৎ জিজ্ঞাসা যুগে যুগে বহুচিত্তে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয়েছে, 'রাজপুত্র পরিয়াছে ছিন্নকন্থা, বিষয়ে বিরাগী পথের ভিক্ষুক'। পণ্ডিতপ্রবর জ্যোতির্ময় নন্দের জীবনেও আমরা প্রত্যক্ষ করি সেই সত্যের উজ্জ্বল প্রকাশ।

 মেদিনীপুর জেলার কাঁথি মহকুমার একটি গ্রাম সূয়াদীঘি। গ্রামদেবী মুগেশ্বরীকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা সেখানকার মুগবেড়িয়া জনপদের জমিদার নন্দন তিনি। জ্যোতির্ময় নন্দ। পিতা বিরজাচরণ, মাতা লক্ষ্মীপ্রিয়া দেবী। পিতামহ দানবীর গঙ্গাধর নন্দ। ভোগৈশ্বর্যের তরঙ্গে তরঙ্গে জীবনতরণী ভাসাবার অফুরন্ত আকর্ষণ। অথচ ভোগের সরণিতে পা রাখলেন না জ্যোতির্ময়। টোল,হাইস্কুল এবং সংস্কৃত কলেজে পাঠ নিয়ে প্রথম শ্রেণিতে সংস্কৃত অনার্স । পিতামহের পরলোকগমনে(১৯৩০)এম,এ,পড়া ছেড়ে গৃহবাসী। প্রথাগত শিক্ষা থেকে সরে এলেও জ্ঞানসাধনায় তাঁর ছেদ পড়েনি কখনো। বিষয় বিষ কণ্ঠে ধারণ করেই তিনি সংস্কৃতের নানা শাখায় কৃতবিদ্য হয়ে অর্জন করেছেন বেদান্ততীর্থ, স্মৃতিবিশারদ ও জ্যোতিষরত্ন উপাধি। জ্ঞানতাপস জ্যোতির্ময় জ্ঞানের আলোকে পেয়েছিলেন ভূমানন্দের আস্বাদ। পরিণত বয়সে বৈষ্ণবাচার্য রামদাস বাবাজীর পদপ্রান্তে দীক্ষা নিয়ে হয়ে উঠেছিলেন বৈষ্ণব। বৈষ্ণব সমাজের দৃষ্টিতে 'ভক্তিচক্রবর্তী'। আবার এই অমৃতআস্বাদ কেবল আপনাতে শেষ হয়ে যায় না, সমগ্র সমাজকে নিয়ে যায় উত্তরণের পথে। আত্মনো মোক্ষার্থং জগদ্ধিতায়চ। সকলকে দিতে হবে জ্ঞানের আলো। কিন্তু কেমন সে জ্ঞান? দ্বে বিদ্যে বেদিতব্যে, পরা চৈব অপরা চ। কেবল অধ্যাত্মজ্ঞান নয়, লৌকিক শিক্ষারও প্রয়োজন । সেই আদর্শে পিতামহ-প্রতিষ্ঠিত মুগবেড়িয়া গঙ্গাধর হাইস্কুল, বেলদা গঙ্গাধর একাডেমি, ললাট গঙ্গাধর পাঠশালা(হাইস্কুল) প্রভৃতির পরিচালনায় দিয়েছেন বলিষ্ঠ নেতৃত্ব। উদ্যোগী সহকর্মীদের নিয়ে গড়ে তুলেছেন মুগবেড়িয়া গঙ্গাধর মহাবিদ্যালয়। সেখানে পরিচালনার পাশাপাশি অধ্যাপনাও করেছেন (অবৈতনিক)কিছুকাল। প্রপিতামহ প্রতিষ্ঠিত ভোলানাথ সংস্কৃত মহাবিদ্যালয়ে অধ্যক্ষ ছিলেন আমৃত্যু। এমন কি এই প্রতিষ্ঠান কেন্দ্রীয় সরকারের অনুমোদনে শাস্ত্রী ও আচার্য পাঠক্রমযুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে উন্নীত হলে(১৯৭৮) সেখানেও তিনি কিছুকাল পালন করেছেন অধ্যক্ষের দায়িত্ব।  সাংগঠনিক নৈপুণ্যে তিনি বহুবার রাজ্য সরকারের 'বঙ্গীয় সংস্কৃত শিক্ষা পরিষদের' সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। তারকেশ্বর মন্দির ট্রাস্ট, নিখিলবঙ্গ সংস্কৃত সেবিসমিতি প্রভৃতিতেও যুক্ত ছিলেন নেতৃত্ব স্তরে ।

স্কুল কলেজের শিক্ষা মানুষকে দেবে জীবিকার সন্ধান, তারপরে চাই দেহাতীত জগতের শিক্ষা, অধ্যাত্ম জ্ঞান। সেই জ্ঞান বিতরণে জ্যোতির্ময় ছিলেন অতন্দ্র। সারা রাজ্যে, এমনকি বিহার ও ওড়িশার অসংখ্য বিদগ্ধজনের সভায় ভাষণ দিয়ে বেড়িয়েছেন। বনান্তরালে থেকেও ফুল যেমন আপন সুবাসে ডেকে আনে মধুকরদের, তেমনি পণ্ডিতপ্রবর জ্যোতির্ময় আপন গুণে টেনে এনেছিলেন অসংখ্য বঙ্গগৌরব মানুষকে। ড.রমা চৌধুরী,ড.হিরন্ময় বন্দ্যোপাধ্যায়, অধ্যাপক জনার্দন চক্রবর্তী, ড.শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, ড.সুনীতি কমার চট্টোপাধ্যায়, বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্র, স্বামী লোকেশ্বরানন্দ, স্বামী রঙ্গনাথানন্দ প্রমুখ বিদগ্ধজনেরা ছিলেন তাঁর বিশেষ গুণগ্রাহী। কেবল ভাষণে নয়, বহু ব‌াংলা এবং সংস্কৃত কবিতা ও প্রবন্ধে তাঁরা পেয়েছেন পণ্ডিতপ্রবরের মনীষা ও কবিত্বশক্তির অসামান্য পরিচয়। বহু লেখা প্রকাশিত হয়েছে উদ্বোধন, প্রণব, উজ্জীবন, জাহ্নবী, পথের আলো, বিশ্ববাণী প্রভৃতি পত্র পত্রিকায়। প্রকাশিত হয়েছে ব্রহ্মবিদ্যা পদাবলী(৩খণ্ড), ভজন মঙ্গলম্, বিরজাচরণ ধ্যান, মঙ্গলালোক, মঙ্গলভারতী, ছয় স ভাবনা, জ্যোতির্ময় রচনাঞ্জলি প্রভৃতি গ্রন্থ।

   সংস্কৃত ভাষার মত বাংলা ভাষাকে তিনি অত্যন্ত মর্যাদার চোখে দেখতেন। মহাপ্রভুর আবির্ভাব জয়ন্তী উপলক্ষ্যে কলকাতার দেশপ্রিয় পার্কে লক্ষাধিক মানুষের সভায় উদ্বোধনী ভাষণে তিনি বলেছিলেন, শ্রীচৈতন্যদেব যে ভাষায় কথা বলতেন সেই ব‌াংলা ভাষাও 'দেবভাষা' । শাস্ত্রকথা কেবল পণ্ডিতদের জন্য নয়, তা সর্বসাধারণের।তাঁদের কাছে এই শাস্ত্রকে  সহজভাবে পৌঁছে দিতে পণ্ডিতপ্রবর জ্যোতির্ময় বাংলা গদ্যপদ্যের আশ্রয় নিয়েছেন। এই পথ ধরেই তিনি স্বামী  স্বরূপানন্দ পরমহংসদেবের চরিত্রগঠন আন্দোলনে সেনাপতির ভূমিকা পালন করেছেন। সমাজের দুর্নীতি ও ব্যভিচার তাঁকে পীড়িত করেছে। তিনি বুঝেছেন---'শিক্ষিত দুর্জন দেশে যত ক্ষতি করে, অশিক্ষিত দুষ্টজন তত নাহি পারে।' তিনি চেয়েছেন--'সত্যানন্দ সাধুসঙ্গ সদ্ধর্ম সম্প্রীতি, স্বাস্থ্য ও সংহতি  এই ছয় 'স'-তে  স্থিতি, বিশ্ববাসী নরনারী যদি লাভ করে, নির্মল আনন্দ হবে দুঃখ যাবে দূরে।' এই আদর্শ প্রচারে তিনি জনপদে প্রতিষ্ঠা  করেছেন গীতাজয়ন্তীসহ নানা ধর্মচর্চার আসর এবং সদ্ধর্ম ভারতী প্রতিষ্ঠান। শাস্ত্রকথা কেবল তাঁর  মুখের কথাই ছিল না, তিনি ছিলেন এর আচরণসিদ্ধ 'আচার্য'। অশন-বসনে ছিলেন অনাড়ম্বর। দুবেলা দুটি নিরিমিষ আহারে তাঁর পরম পরিতৃপ্তি। ভাগবতের কথা তুলে প্রায়ই বলতেন, জিতং সর্বং জিতে রসে। রসনার সংযমই সংযমের সেরা। খাদ্যে ও বাক্যে তাঁর সংযম ছিল অসামান্য। শাস্ত্রবিদ বলেই পুরোহিতসমাজের গোঁড়ামি থেকে মানবতার মুক্তিতে ছিলেন সতত সোচ্চার। সকল শ্রেণির মায়েদের ডেকে বলেছেন, ঘরের পূজা নিজেরাই কর, নাই বা জানলে মন্ত্র। তাঁদের শক্তিময়ী হওয়ার ডাক দিয়েছেন--'তাঁর মূর্তি নারীগণ স্নেহদা অন্নদা,‌ অশিষ্ট জনেতে হউন কঠোরা ভয়দা।' জাতিধর্মের চেয়ে মনুষ্যত্বকে, ধর্মের আচারের চেয়ে সুনীতিকে বড় করে দেখেছেন।                

   আজকের জাতীয় সংকট ও মূল্যবোধের বিপর্যয়ের দিনে পণ্ডিতপ্রবর জ্যোতির্ময়ের আদর্শ থেকেই প্রজ্বলিত করতে হবে আমাদের জীবনবর্তিকা। সেই অঙ্গীকারে তাঁর ১১৩-তম জন্মদিনে তাঁর পদপ্রান্তে নিবেদন করি  আমাদের বিনম্র প্রণাম।

Post a Comment

0 Comments