জ্বলদর্চি

এক মুঠো রোদ /পর্ব-- ৩ /স্বপন কুমার দে

 চিত্র-শুভদীপ ঘোষ

এক মুঠো রোদ
পর্ব-- ৩

স্বপন কুমার দে

ঘুম ভাঙতেই হাত ঘড়িটার দিকে দৃষ্টি গেল মল্লিকার। সর্বনাশ! ছ'টা বেজে পাঁচ! মানে পঞ্চাশ মিনিট লেট।সকালে ঘুম থেকে উঠে সংসারের যাবতীয় কাজ সেরে বাবাকে কিছু খেতে দিয়ে ছুটতে হয় টিউশন পড়াতে। সাতটা থেকে সাড়ে ন'টা। একই বাড়িতে তিনটে ছেলেমেয়ে -- দু'জন ক্লাস সেভেন, একজন পড়ে এইটে। একসঙ্গে তিনটে বিষয়,-- গণিত, ভৌতবিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান। সপ্তাহে তিনদিন। মাসের শেষে তিন হাজার টাকা। যতক্ষণ পড়ায়, নিজেকে নিংড়ে দেয়। এতটুকু ফাঁকি নেই। যে বাড়িতে পড়ায় তারাও ব্যবসায়ী লোক। সব হিসেব বুঝে নেয়।রেজাল্ট ভালো না হলে দু'কথা শুনিয়ে দেয়। এভাবেই চলছে বছর দুই। সময় এবং নিষ্ঠা, দুটো জিনিসই বেশ সতর্কতার সঙ্গে এতদিন মেইনটেইন করে চলেছে মল্লিকা। কিন্তু আজ টিউশন পৌঁছতে তার আধ ঘণ্টা দেরি হয়ে যাবে। কোনোদিন কোনও অজুহাত দেখায় নি সে,আজও নয়। গতকাল বাবাকে কোলকাতায় ডাক্তার দেখিয়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতেই রাত পৌনে বারোটা। তারপর হাত পা ধুয়ে চাট্টি মুড়ি খেয়ে ঘুমোতে ঘুমোতে প্রায় সাড়ে বারোটা। তাই হয়তো শরীরের প্রচণ্ড ক্লান্তি বশতঃ ঘুম ভাঙেনি।

যাই হোক, কিছুক্ষণের মধ্যেই বাথরুম সেরে,ঘর ঝাঁট দিয়ে চা বসায়। নিজে খায়,বাবার জন্য সশপ্যানে ঢাকা দেয়।রাস্তার ট্যাপ থেকে জল নেয়।বাথরুমে বাবার জন্য জল রাখে। সবশেষে, বেরোনোর আগে বাবাকে ঘুম থেকে তুলে দেয়।

লোকে বলে,দিননাথ সামন্তর ফাটা কপাল সারাজীবনও আর জোড়া লাগল না। গরিব চাষি পরিবারের ছেলে, তাও আবার চার বোনের পর। হাইস্কুলে পড়তে পড়তেই বাবাকে হারায়। ততদিনে দুই দিদির বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। মা বেচারা বাকি দুই দিদির বিয়ে দিতে গিয়ে গরিবের শেষ সম্বল আড়াই বিঘা জমি বিক্রি করে দেন। তখন থেকেই ভিখারি অবস্থা। প্রথম প্রথম পরের ঘরের ফাই ফরমাশ খাটা লোক হিসেবে দিনুকে একটা বাড়িতে ঢুকিয়ে দেন। এতে কাজ অনেক বেশি কিন্তু পয়সা অনেক কম।অতএব সেটা ছেড়ে দেয়। তখনই ট্রেনে হকারি করার ভাবনাটা তার মাথায় উঠে আসে। পরিচয় করে নিতাইদার সাথে। নিতাইদা অন্য পাড়ায় থাকে নিজের প্রয়োজনেই দিনু তার সঙ্গে আলাপ করে।কথাবার্তায় বেশ চৌখস দিনুকে দেখে নিতাইদার ভালো লাগে। সেই নিতাইদাই একদিন হাতে ধরে এই লাইনে নিয়ে আসে।

🍂

এমনিতে এই পেশা লাভজনক হলেও এখানে কম্পিটিশন অনেক। তারপরে আছে জুলুম, দাদাগিরি। সংগঠনে নাম লেখাতে হয়, নয়তো দু'দিনও টিকতে পারবে না। প্রচুর পরিশ্রমও করতে হয়।

রোজগার হচ্ছিল সেখান থেকে। মা ছেলের বেশ ভালোভাবেই চলে যাচ্ছিল। সপ্তাহে একটা দিন বিশ্রামও নিত ঘরে বসে।কিন্তু ঐ যে বলে কপাল। একদিন কলতলায় পা পিছলে পড়ে কোমরের হাড় ভাঙল মায়ের। প্রথমে হাসপাতাল, তারপর বাড়িতে তিনমাস শুয়ে থাকা। যা কিছু টাকাপয়সা জমিয়েছিল দিনু, সব ফাঁকা হয়ে গেল। দিদিরা পালা করে মায়ের কাছে এসে থাকতে লাগল। আর দিনু প্রতিদিনের হাড়ভাঙা খাটুনির রোজগার সংসারে ঢেলে দিতে লাগল। তিন মাস পরে মা অনেকটা সুস্থ হলো। বিছানা ছেড়ে উঠে টুকটাক কাজ করতে লাগল, কিন্তু আগের সেই কোমরের জোর আর পেল না।
দিদিরাই বা আর ক'দিন এভাবে পড়ে থাকে তারাও যে যার সংসারে বাঁধা পড়ল। বাড়িতে থেকে গেল অল্প সুস্থ মা আর হকার ছেলে।

এভাবেই অভাবের সংসারে বছর তিনেক পরে ঘরে বৌ এল।সুখ এল। গরিবের ঘরের মেয়ে,গৌরির হাতের ছোঁয়ায় সংসার ভরে উঠল। শাশুড়ি পুরোপুরি বিশ্রাম নিল।ভোরে উঠে সংসারের হাজারও কাজ সামলে স্বামীর জন্য চাট্টি গরম গরম ভাত রেঁধে দেয়।সেই খেয়ে প্রতিদিন সকালে দিনু বেরিয়ে পড়ে কাজে। সারাদিন পরিশ্রমের পর সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে একই রকম আদর যত্নে খুশিতে ভরে উঠে জীবন। তারপর হঠাৎই একদিন হার্ট অ্যাটাকে মা চলে গেল।মা মারা যাবার পর তারা মফঃস্বল ছেড়ে শহরের এক ধারে বস্তি অঞ্চলে চলে আসে। জোড়া পুকুর বস্তি।শহরের অর্থগৃধ্নু মানুষের লোলুপ দৃষ্টি তখনও পর্যন্ত এই জায়গার ওপর পড়েনি। মূলত দৈহিক পরিশ্রমজীবি মানুষেরা যাইহোক মাথা গোঁজার ঠাঁই টুকু এখানে খুঁজে নিয়েছে। দিননাথও তাদের মতোই একজন। নিজেদের কাছে যেটুকু পুঁজি ছিল, তা দিয়ে দু'কামরার ছোট্ট টিনের বাড়ি তৈরি করে। ততদিনে তাদের একটি ফুটফুটে মেয়ে হয়েছে। ফুলের সাথে মিলিয়ে নাম রাখা হয়েছে 'চন্দ্রমল্লিকা'।কিছুটা যত্নে আর অনেকটাই অযত্নে প্রতিপালিত হয় ছোট্ট ফুলের মত মেয়েটি। মায়ের চেয়ে বাবার আস্কারাই বেশি পায় মেয়ে।সকালে বাবা স্কুলে পৌঁছে দেয়, নিয়ে আসে মা। প্রতিদিন বাড়ি ফেরার পথে মেয়ের জন্য কিছু না কিছু নিয়ে আসবেই হকার দিননাথ সামন্ত। এ ব্যাপারে বৌয়ের বকুনি টলাতে পারেনি তাকে।
"তোমার আস্কারাতেই মেয়েটা কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে। তুমিই খারাপ অভ্যাস তৈরি করছো।একদিন বুঝবে। "
মুখ কাঁচুমাচু করে দিনু বলে," আহা,ঐটুকুই জিনিস। কতই আর দাম হবে? মেয়ে কেমন হাসছে দেখছো? দিন দিন ভারী দুষ্টু হয়ে যাচ্ছে।" বলেই আনন্দে ডগমগ হয়ে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে। "একদিন এই মেয়েই রোজগার করে আমাদের খাওয়াবে। এই আমি বলে রাখলাম। মিলিয়ে নিও আমার কথা।"

কথাগুলো মনে পড়তেই একটা গভীর শ্বাস পাঁজর কাঁপিয়ে বেরিয়ে আসে। যাকে নিয়ে জীবনের এত কোলাহল, এত ভালোবাসা সেই মানুষটাই আর আমাদের মধ্যে নেই।

সে কবেকার কথা।সে কথা মনে করতে চায়না দিনু, কিন্তু মনের অজান্তেই কখন যে লুকানো ব্যথাটা মাঝে মাঝে জেগে ওঠে তা বুঝতেও পারে না। আর পাঁচটা দিনের মতো সেদিনও একই ভাবে সকাল হয়েছিল। একই ভাবে দিনের ব্যস্ততা, ছোটাছুটি। মেয়ের টিফিন, স্বামীর খাবার তৈরি করা, সবটাই আগের মতোই স্বাভাবিক। দিনের শুরুটা দেখে কেউ আন্দাজও করতে পারেনি তাদের জন্য এতবড় বিপর্যয় অপেক্ষা করছে। দিনু খাবার খেয়ে কাজে বেরিয়ে পড়েছে, মেয়ে রয়েছে স্কুলে। সকালের ব্যস্ততা শেষে গৌরিও কিছু খেয়ে মেয়েকে স্কুল থেকে আনতে বেরিয়েছে। হেঁটে হেঁটে এক কিলোমিটারের মতো রাস্তা যায় আবার ফেরার সময় মেয়েকে হাঁটিয়ে নিয়ে আসে। এটাই প্রতিদিনের রুটিন। আজ কিছুটা রাস্তা যাওয়ার পর তার মনে একটা খটকা লাগল। সবাই যেন একটু বেশি ধরনের সতর্ক। কেমন যেন চারদিক থেকে একটা ফিসফিসানি সুর শুনতে পেল। মনের মধ্যে একটা ভয় জাগতে লাগল। প্রথমেই মনে হল তার মেয়ের কথা। স্কুল থেকে তাকে বাড়ি নিয়ে আসতে হবে।দ্রুত পা চালায় সামনের দিকে। সোজা রাস্তা ছেড়ে এবার সে বাঁক নিল। হঠাৎই শোনা গেল মানুষের মরণ চিৎকার। দুটো দল ছোরা, বোমা, বন্দুক নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। আর উপায় নেই। তাকে পালাতে হবে। ছুটতে শুরু করল। হঠাৎ একটা বোমার আওয়াজ। সব শেষ। গৌরির নিথর দেহটা পড়েছিল রাস্তায়। খবর দেওয়া হয় দিনুকে,মেয়েকে স্কুল থেকে আনা হল। পোষ্ট মর্টেমের পর মৃতদেহটা ফিরে পেল পরিবার। তখন মায়ের দেহ জাপটে ধরে মেয়ের কী আর্ত চিৎকার, দিনুর হাহাকার, পাড়া প্রতিবেশীদের চোখেও জল এনে দিয়েছিল। তারাই যা হোক করে মেয়েকে মায়ের কাছ থেকে নিয়ে ধরে থাকে। তারপর কতদিন রাতে গুমরে গুমরে কেঁদে বালিশ ভিজে গেছে। কতবার মনে হয়েছে, মা তাকে দেখতে এসেছে চুপিচুপি। চোখ খুলে দেখেছে সব অন্ধকার। সেই শোক থেকে বেরিয়ে আসতে দু-তিন বছর লেগে গেছে।

খবরের কাগজে লেখা হয়," দুষ্কৃতীদের ছোড়া বোমার আঘাতে একজন পথচারীর মৃত্যু।" লেখা হয়না পথচারীর পরিচয়, তার পরিবারের কথা।তার আপনজন, তার ভালোবাসার মানুষজন সে কথা লেখা থাকে না। তার মৃত্যু কার জীবনে কী বিপর্যয় নিয়ে এল--এসব বাড়তি কথা লেখা থাকে না।

দুর্ভাগ্য আর দিনু যেন এক সুতোয় গাঁথা। খানিক সুখ আর বিরাট দুঃখ, এই নিয়েই দিননাথ সামন্ত।

বৌ মারা যাওয়ার পর শোক পাশে রেখে আবার কঠোর পরিশ্রম। দিনে দিনে নিজেকে লড়াইয়ের ময়দানে নামিয়েছে। সেই থেকে একটু একটু করে মেয়েকে বড়ো করেছে সে। এখন সেই  ছোট্ট মেয়েটা যথেষ্ট বড়ো হয়েছে।এখন সে মেয়ে  কলেজে পড়ছে। তার জন্য বইপত্র, টিউশন, নোটস--কোনোকিছুই আটকায় না।সেজন্য রোজগার বাড়াতে হয়।

এই অবস্থায় দিনুর কিডনির সমস্যা ধরা পড়ল। এ ডাক্তার সে ডাক্তার করতে করতে এক ভদ্রলোকের বদান্যতায় এন,আর,এস হসপিটালে দেখানো। ট্রেনে হকারি করার সময়ই ঐ ডেলি প্যাসেঞ্জার ভদ্রলোক পরিচিত ছিলেন দিনুর। তিনিই ব্যবস্থা করে দিলেন। সেখান থেকে ডাক্তার দেখিয়ে বাড়ি ফিরতেই কাল এত রাত হয়ে গেল। (ক্রমশ)

Post a Comment

0 Comments