মার্কেজের খোঁজে
(পঞ্চম পর্ব)
মলয় সরকার
আজ আবার হাজির হয়েছি আমার গল্পের ঝুলি হাতে নিয়ে। আসুন সবাই আড্ডা মারা যাক, আড্ডা মারি সেই বিরাট সাহিত্যিকের চলাফেরার জগতকে নিয়ে-
Iglesia de Santo Domingo নামের যে চার্চ, তার নাম থেকেই বোঝা যায় যে সন্ত দোমিঙ্গোর নামেই এটি উৎসর্গীকৃত।
কিন্তু স্থাপত্যে বা গঠনের বৈচিত্র্যে খুব গুরুত্ব না থাকলেও অন্যান্য দিক থেকে এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এটিই নাকি শহরের সবচেয়ে পুরানো চার্চ , যেটি ১৫৩৯ সালে তৈরী হয়েছিল স্প্যানিশদের হাতে।
আসলে ১৫৩১ সালে Pedro de Heredia এর বিজয়ের পর তাঁর হাত ধরে একদল মানুষ এসেছিল ধর্ম প্রচারের জন্য। ক্রমশঃ এখানে শহর প্রতিষ্ঠা হয়ে বেশি মানুষ খ্রীষ্ট ধর্ম গ্রহণ করলে, তাদের ধর্মোপদেশ দেওয়ার জন্য একটা স্কুল বা স্থায়ী আস্তানার প্রয়োজন হল। তখন তাদের মধ্যে, San Jose’ র তত্বাবধানে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা হয়। তাঁকে লোকে Saint Dominic বলে ডাকত, কারণ তিনি ডোমিনিকান রিপাব্লিকের মানুষ ছিলেন।প্রথমে এটি খুব কাঁচা ভাবে তৈরী হয়। সেটি অবশ্য এই জায়গায় নয়, Plaza de los coaches নামে একটি জায়গায়। সেটি পরে তেরো বছরের মধ্যেই সেটি আগুনে পুড়ে যায়।আসলে তখন এটি তৈরী হয়েছিল খুবই কাঁচা ভাবে, প্রথম পত্তন তো! তার পর ১৫৫২ সালে এটির পাকাপোক্ত পত্তন হয় এই জায়গাটিতে।যেহেতু এর প্রতি শাসকদের খুব কৃপাদৃষ্টি ছিল না, এর অর্থ যোগাড় হয় খুব ধীর গতিতে। ফলে এটি পাকাপাকি ভাবে স্থায়িত্ব হতে বা তৈরী হতে সময় লেগেছিল দেড়শো বছর, ১৬৩০ সালে।
🍂
এর যে একেবারে উপরে গম্বুজাকৃতি চূড়াটা, সেটি কিন্তু চট করে দৃশ্যমান হয় না, সামনে পিছনে উঁচু বাড়িঘর থাকার জন্য।সেটা অবশ্য মোটেই আমাদের দেশের ব্রিটিশ পদ্ধতির সরু ছুঁচালো নয়। বরং ইটালিয়ান পদ্ধতির বা স্প্যানিশ পদ্ধতির, গম্বুজাকৃতি চূড়া।
এর সামনের গঠন ভঙ্গী মোটেই আহামরি নয়।সামনেটা কচ্ছপের পিঠের মত অর্ধগোলাকার।ছাদের সঙ্গে বেল টাওয়ার যেটি তৈরী হয়, তাও মোটেই শক্ত পোক্ত হয় নি। ফলে তাতে ফাটল ধরে ।মাঝে অনেক ঝড় ঝাপটা গেছে এর উপর দিয়ে।শেষে ১৯৭০ সালে এর আবার পুরো সংস্কার হয়।আপাততঃ সম্ভবতঃ বেল টাওয়ারে বাদুড়ের বাসা আর ঘণ্টাটা ঝোলানো আছে চার্চের মধ্যেই ঢোকার দরজার পাশে । একধারে একটি তাকে একটি ঘন্টা নয়, তিনটি ছোট বড় ঘন্টা আছে।
বিগত প্রায় ৪৫০ বছরের মধে এটি একবার দখল হয় ১৫৮৬ তে Sir Francis Drakeএর হাতে, ১৮২৩ সালে ফরাসী সেনাবাহিনীর আশ্রয়স্থল হিসাবে ব্যবহৃত হয়, ১৮৭৫ সালে স্প্যানিশরা একে উদ্ধার করে, আবার পরে গৃহযুদ্ধে এটি বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কার্তাহেনার দেওয়ালঘেরা শহরের মধ্যস্থলে এই চার্চের অনেক ই্তিহাস। শেষে এটি পাকাপোক্ত ভাবে সংস্কার হয় ১৯৭০ সালে।তবে নানা দামী চিত্র ও ভিতরের শিল্প সৌন্দর্য দেখে মন ভাল হয়ে গেল।
এই চার্চের সামনে রয়েছে একটি ব্রোঞ্জের মূর্তি। যেটি রয়েছে ঠিক সামনেই এক প্লাজায়। এই মূর্তির একটি ইতিহাস ও বৈশিষ্ট্য আছে। তা হল এটি হল বিখ্যাত ভাস্কর ফার্নান্দো বোতেরোর (Fernando Botero) তৈরি। ২০০০ সালে এটি কার্তাহেনা শহরকে উপহার দেওয়া হয়। তখন এটা শহরের এই বিখ্যাত ও গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় একটি চৌকো মঞ্চের উপর বসানো হয়।এর নাম হল “ La Gorda Gertrudis”।এটি একটি নগ্ন শয়ান স্থুলাঙ্গী নারীমূর্তি।
এই শিল্পী বোতেরোর সম্বন্ধে তখনও বিশেষ কিছু জানতাম না। পরে বোগোটাতে বোতেরোর মিউজিয়ামে দেখে তবে জানলাম। সে সমস্ত পরে বলব।তবে মূর্তিটি দেখেই যে আমি মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম, এবং আকর্ষিত হয়েছিলাম, সেটা বলতেই পারি। আমি শিল্পবিশেষজ্ঞ নই, সেটা ঠিক,তবে পৃথিবীর বহু ভাস্কর্য ও বিখ্যাত শিল্পীদের সৃষ্টি দেখে দেখে হয়ত আমার মত আনাড়ীদের দৃষ্টিতেও এর আলাদা সৌন্দর্য্যটা ধরা পড়ে। এটা ঠিক, ভাস্কর্য্যের বা শিল্পের ভাষায় এর ব্যঞ্জনা ব্যাখ্যা করা আমার পক্ষে সম্ভব হবে না, তবে পিকাসো আর ফ্রিদা কাহ্লোর বা দিয়েগো রিভেরার, কিংবা রঁদা আর মাইকেল এঞ্জেলোর তফাত আমার বোধ আর চোখ এমনিই বলে দেয়।যেমন গান শোনেন যাঁরা, মালকোশ আর যোগ কি বেহাগ, কিংবা লতার গলা না কি সন্ধ্যার গলা এগুলো কানই বলে দেয়। এর জন্য কোন আলাদা বিশেষ জ্ঞান লাগে না।
আসলে শিল্পের ব্যাখ্যা বা নান্দনিক তত্ব দেবেন শিল্প বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু তার ভাল লাগা বা মন্দ লাগার ব্যাপারটা নির্ভর করে সাধারণ সৌন্দর্য্যপিপাসু মানুষের উপর, তাদের চোখ কান আর বোধের উপর।
এই মূর্তি এই প্লাজাটার যে একটা আলাদা মর্যাদা দান করেছে, এটা বলতেই হবে। এর চারদিকে রয়েছে সব নামী নামী রেস্তোঁরা ও ভাল ভাল খাবার দোকান। এ ছাড়া এই প্লাজায় রয়েছে,খাবার নিয়ে বসার জন্য নানা চেয়ার বেঞ্চ, ছাতাওয়ালা টেবিল ইত্যাদি।এ ছাড়াও আছে বেশ কিছু জুয়েলারী, বার, এন্টিক জিনিসের দোকান। ফলে এখানে সব সময়েই সব সময় নানা ধরণের পর্যটক, ভোজনরসিক ইত্যাদির ভিড় লেগেই থাকে।
চার্চের সামনে প্লাজা ,দোকান ও আড্ডা মারার জায়গা
অবশ্য এই প্লাজার আর একটি করুণ ইতিহাস আছে, যা আজ প্রায় সম্পূর্ণ বিস্মৃতির অতলে। তা হল, একসময়, স্পেনীয়রা আসার পর তাদের আধিপত্য বিস্তার করার জন্য ধর্মকে অবশ্যই হাতিয়ার করেছিল৷ যেমনটি ইউরোপীয়ানরা বিজিত প্রায় প্রত্যেক দেশেই করেছিল।
সেটা কিভাবে কাজ করত , বলি । স্প্যানিশরা ছিল ক্যাথলিক খ্রীষ্টান। তারা দেশ থেকে সমস্ত ইহুদী, মুসলিম এমন কি প্রোটেস্ট্যান্ট ক্রীশ্চানদেরও নিশ্চিহ্ন করতে বা ক্যাথলিক ধর্ম গ্রহণ করতে বাধ্য করার জন্য, নানা জিজ্ঞাসাবাদের ছলে কঠিন অত্যাচার চালাত। তাতে, হয় তারা ঐ ধর্ম গ্রহণে বাধ্য হত অথবা, তাদের যন্ত্রণা দিয়ে মেরে ফেলা হত। একে বলা হত Inquisition। অতীতে এই জায়গাটিতে বহুদিন এই কাজকর্ম হত বলে বলা হয়। অনেকে বলেন ,শয়তান বা অত্যাচারিত আত্মারা নাকি আজও এখানে চার্চের আশেপাশে নৃত্য করে বেড়ায়।কাজেই জায়গাটির সম্বন্ধে মানুষের একটা ভীতিজনক ধারণা রয়েছে আজও।
এর থেকে বুঝলাম, ওরাও আমাদের মতই এই সব ভূতপ্রেত আত্মা শয়তান এগুলোকে ভালই বিশ্বাস করে।তবে সাধারণ পৃথিবী যতই বিজ্ঞান বা তার তত্ব নিয়ে যুক্তি তর্কে এগিয়ে যাক, ভিতরে ভিতরে অপবিজ্ঞান , কুসংস্কার ঠিক ফল্গু নদীর মত বয়ে চলেছে সকলের অন্তরালে।
এবার বলি, এই মূর্তিটি নিয়ে একটি মজার রটনা বা প্রচলিত গল্পকথা। বলা হয়, শয়ান নারীমূর্তিটির পীন পয়োধরে কিছুক্ষণ হাত বুলোলে নাকি প্রেমের ক্ষেত্রে সৌভাগ্যবান হওয়া যায়। ফলে বহু মানুষই আগ্রহ ভরে মূর্তির স্তনদ্বয়ে হাত বুলিয়ে প্রেমের ক্ষেত্রে সৌভাগ্যবান হওয়ার কামনা করে। কে আর না চায়, জীবনে এই ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়ে জীবনটাকে জলাঞ্জলি দিতে! এর ফলে মূর্তির অন্য জায়গা কালচে রঙ ধরলেও স্তনদ্বয় ঊজ্বল ও আকর্ষণীয় হয়ে রয়েছে। আমরাও অনেক তরুণকে দেখলাম, এই বেদবাক্য অনুসরণ করতে।( এ ব্যাপার শুধু এখানে নয় , সারা পৃথিবীর বহু নগ্নিকারই এই দুরবস্থা লক্ষ্য করেছি)
বলতে ভুলে গেছি, এখানে নেমেই যে জিনিসটি প্রথম দৃষ্টি আকর্ষণ করল, তা হল,এখানকার সর্বত্র বিচরণ করা শকুনের দল। প্রথমে ভেবেছিলাম, এরাই সেই বিখ্যাত আন্দিজ কন্ডোর বা শকুন। পরে দেখলাম, তা নয়, তবে এরা এখানে কাকের মত বাড়ির মাথায়, গাছের ডালে বাড়ির ব্যালকনিতে সর্বত্র ঘুরে বেড়াচ্ছে। এরা সাধারণতঃ মানুষকে খুব ভয় পায় না। আমাদের দেশীয় শকুনেরই মত, তবে একটু ছোট এবং ঘাড় বা গলাটা বোধ হয় অতটা লম্বা নয়।রংটা কালোই। বেশ অনেকগুলোই দেখা গেল চারিদিকে উড়ে বেড়াচ্ছে।
এখানেই দেখলাম আর এক আশ্চর্য জিনিস।বেশ কৃষ্ণাঙ্গী কয়েকটি মেয়েকে দেখলাম ঊজ্বল হলুদ, ঘন নীল, লাল ইত্যাদির সংমিশ্রণে কুঁচি দেওয়া, বড় ঘাগরাওয়ালা ফ্রক পরে, মাথায় হলুদ রং এর কাপড়ের টুকরো বেঁধে ঘুরছে।ফ্রকের বুকের কাছে ফ্রিল দেওয়া রয়েছে। তাদের মাথায় রয়েছে একটা গামলা ধরণের পাত্র। তাতে রয়েছে বেশ পুরষ্ট কিছু কলা, গোটা আনারস, বড় লেবু ইত্যাদি সুন্দর ফল দিয়ে ভর্তি।কোমরে রয়েছে ওই নীল বা ঊজ্বল কোন কাপড়ের বেল্ট।( দেশের জাতীয় পতাকার রঙে) তারা দু’হাতে ঘাগরা তুলে নৃত্যায়িত ভঙ্গীতে ঘুরছে।
এ ছাড়া মুখে রয়েছে বেশ নিষ্পাপ এক হাসি। তারা ঘুরে বেড়াছে গোটা প্লাজাময়। অনেকে তাদের হাত ধরে ছবি তুলছে। তার বিনিময়ে ওরা পয়সা নিচ্ছে। আমার মনে পড়ল।আমাদের পশ্চিম বাংলায় আজকাল চালু হওয়া শান্তিনিকেতনের সোনাঝুরির মত সাঁওতাল মেয়েরা ওই সাঁওতালী পোষাক পরে বাবুদের বা বিবিদের নাচের সাথে যেমন পা মেলায় ও বিনিময়ে পয়সা নেয়, সেরকমই আর কি! চকমকে ঊজ্বল রঙ আর এদের এখানে এই ভাবে দেখে অবশ্যই আকর্ষণীয় লাগল। এদের বলা হয় প্যালেঙ্কেরো (Palenquero)। এরা আজ সারা কলম্বিয়ার এক মুখ্য পর্যটক আকর্ষণ ও কলম্বিয়ার প্রতীক হিসাবে চিহ্নিত। এরা কিন্তু আসলে মানুষের চাপের কাছে নতি স্বীকার না করে নিজের ধর্ম সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার এক আশ্চর্য প্রতীক।
ক্রমশঃ-
এগিয়ে চলি পথে পথে আপনাদের হাত ধরে। আর চলার পথে সঙ্গী না পেলে কি চলার আনন্দ পাওয়া যায় পুরোপুরি!
বাড়িতে বসেই সংগ্রহ করতে পারেন 👇
0 Comments