জ্বলদর্চি

চিত্রশিল্পী যোগেন চৌধুরী-র সাক্ষাৎকার নিয়েছেন অর্ণব মিত্র

চিত্রশিল্পী যোগেন চৌধুরী-র সাক্ষাৎকার নিয়েছেন অর্ণব মিত্র 


চিত্রশিল্পী যোগেন চৌধুরী কলাভবনের প্রাক্তন অধ্যাপক, রাজ্য চারুকলা পর্ষদের সভাপতি, প্রাক্তন রাজ্যসভার সদস্য ও শিল্পকলা বিষয়ক পত্রিকা  'আর্টইস্ট’- এর সম্পাদক।
 
অর্ণব মিত্র:  আপনি কলাভবনের বা বিশ্বভারতীর সাথে দীর্ঘকাল যুক্ত ছিলেন। রবীন্দ্রনাথের প্রভাব আপনার জীবনে ও কাজে কিভাবে এসেছে যদি বলেন?

যোগেন চৌধুরী: আমার পরিবার যখন পূর্ববঙ্গ থেকে আসে তখন আমার বয়স বেশ কম। পূর্ববঙ্গ থেকে এসে আমরা যেখানে থাকতাম সেখানে একটি সাংস্কৃতিক আবহাওয়া ছিল। সেখানে একটি অনুষ্ঠানের জন্য পোস্টার তৈরি করেছিলাম রবীন্দ্রনাথের পুরো জীবন নিয়ে—সে সবের প্রদর্শনী করি। আমরা ইস্ট-বেঙ্গল থেকে এসে যেখানে থাকতাম আর কী, —সেখানে অধিকাংশই শিক্ষিত শ্রেণির পূর্ববঙ্গের লোকজন থাকত। আমরা ওখানে বিভিন্ন ধরনের সংগঠন করি যেখানে রবীন্দ্রজয়ন্তী পালন করতাম। একই সঙ্গে আমরা নানারকম সাহিত্যপত্র তৈরি করেছি। পত্রিকা প্রকাশ করতাম ও সেইসব নিয়ে ব্যস্ত থাকতাম। এবং আমাদের ওখানে একটা গোষ্ঠী তৈরি হয়েছিল যারা শিল্পচর্চা ও সাহিত্যচর্চা নিয়ে মগ্ন থাকত। আমার মনে হয় এইসব এক দীর্ঘ ইতিহাস। 

অর্ণব: রবীন্দ্রনাথের ছবিতে দেখি ফ্লাওয়ার ভাস এঁকেছেন আর আপনিও এঁকেছেন। আপনার ফ্লাওয়ার ভাস বেশ জনপ্রিয়। এর মধ্যে কি মিল আছে। মানে ছবি আঁকার জন্য বিষয় বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ কি কখনো আপনাকে প্রভাবিত করেছেন !

যোগেন:  ওই সাদৃশ্যটা আছে কিন্তু আমি ফ্লাওয়ার ভাস রবীন্দ্রনাথের ছবির কথা মনে করে আঁকিনি। ওটা আমি নিজের মত করে আঁকতে গেছি – তখন নানারকম জিনিস এঁকেছি। তার মধ্যে ফ্লাওয়ার ভাসও এসেছে। মানুষের মুখ ও চেহারা এসেছে। সুতরাং সেইখানে যেটা আমাকে আকর্ষণ করে তা হল রবীন্দ্রনাথের ছবি। আলাদা করে আমাকে আকর্ষণ করে—তার মধ্যে যে স্পিরিটটা ওয়ার্ক করে —একটা ঐশ্বরিক যোগাযোগ আছে যে বিষয়টা— অন্য কারো ছবিতে আমি পাই না। আমাকে আকর্ষণ করে সব থেকে বেশি। রবীন্দ্রনাথের ছবিকে হুবহু আমার ছবিতে নিয়ে আসার কথা ভাবিনি।আর ছবিটা সম্পূর্ণটাই আমার নিজের জীবনের যে অবস্থা – ইস্টবেঙ্গল থেকে আসি বাস্তুহারা হয়ে এসেছি- সেই অবস্থাটাই, অভিজ্ঞতাটাই আমার ছবিতে এসেছে বেশি—ওইটাই। বাইরে থেকে যে মিল পাই সেটা সত্যি নয়।
 
অর্ণব: আপনি তো দিল্লিতে চাকরি করতেন ও বাংলায় চলে এলেন। আপনার কাজের মধ্যে বাংলার পারিপার্শ্বিক অবস্থার আবহ ও বাংলার ধরণটা পাওয়া যায় –একটা প্রান্তিকতাও আছে ও নিজস্ব স্টাইলটাও পাওয়া যায়। এটা কিভাবে তৈরি হল যদি বলেন !

যোগেন: বাংলার সাথে আমার যোগাযোগটা তৈরি হয়েছে ইষ্ট বেঙ্গলে থাকার সময় থেকেই – এখানে যখন আসি পার্টিশনের সময় – তখন আমার বয়স নয়-দশ বছর হবে। সুতরাং পূর্ববঙ্গে থাকার সময় কম বয়স থেকেই আমার বাংলার সাথে যোগাযোগ তৈরি হয়। ওখানকার দুর্গাপূজা ওখানকার থিয়েটার ওখানকার জীবনযাত্রা সব কিছুই আমার জীবনকে প্রভাবিত করেছে।

অর্ণব: এই যে বাংলার প্রতি আপনার আলাদা একটা আকর্ষণ—যে কারণে আপনি বাংলায় ফিরে এলেন এই ব্যাপারটা কি আপনার কাজে নিজস্ব স্টাইল তৈরি করতে সাহায্য করেছে—এই জায়গার প্রতি টান থেকে। দিল্লি থেকে সোমনাথ হোরও চলে এসেছিলেন, শিল্পী পরিতোষ সেনও বিদেশ থেকে ঘুরে এসে সেই বাংলায় বসেই কাজ করেছেন।আপনি যখন চলে এলেন সেটা কি বাংলার প্রতি, বাংলার সংস্কৃতির প্রতি, বাংলার মাটির প্রতি টানেই চলে এলেন বোধহয় !

যোগেন: আমি দিল্লিতে থাকতেই পারতাম। আমি তো ওখানে খুব ভালোভাবে ছিলাম। রাষ্ট্রপতি ভবনের কিউরেটর ছিলাম। থাকার জায়গা হিসেবে বড় কোয়ার্টার দিয়েছিল তার সাথে বড় গার্ডেন ছিল। তার সাথে চাষ করার জমি ছিল। সে সবের মধ্যে আমার দিল্লিতে যথেষ্ট যোগাযোগ হয়েছিল—কিন্তু তা সত্ত্বেও শান্তিনিকেতনের প্রতি আমার একটা আগ্রহ ছিলই— রবীন্দ্রনাথের জায়গা বলে। রবীন্দ্রনাথের প্রতি আমার যে আকর্ষণ সেইটা আমাকে শান্তিনিকেতনে নিয়ে আসে। 

অর্ণব: আজকের এই সময়ে আর্টের যে পরিবেশ তা সম্বন্ধে এই প্রশ্ন। বর্তমান সময়ে মডার্ন আর্ট-এর নামে যে কাজ হচ্ছে ইন্সটলেশন ইত্যাদি তাতে সমকালীন বিদেশি শিল্পীদের প্রভাব আছে বোঝা যায়। বাংলার নতুন প্রজন্মের শিল্পীরাও এই কাজে ডুবে আছে। এই কাজ প্রাণহীন লাগে এবং বুঝতে না পেরে এই কাজ থেকে দর্শকও মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। আপনার যে গ্যালারী (চারুবাসনা) তাতে আর্ট কলেজ থেকে যারা সদ্য বেরোচ্ছে তাঁদের প্রদর্শনী হচ্ছে— সেগুলো দেখি। আনন্দবাজারে চিত্র-প্রদর্শনীর যে সমালোচনা প্রকাশিত হচ্ছে তা পড়ি।এখনকার আর্টের ছেলেমেয়েরা এমনকি কলাভবনের ছাত্রছাত্রীরাও বিদেশি প্রভাবে কাজ করছে – সেগুলো আপনি কিভাবে দেখেন! মেনে নিতে পারেন! বর্তমান সময়ে বেশির ভাগ শিল্পীরা ইন্টারনেট থেকে দেখে কাজ করছে ( ফটো রিয়েলিজম, ইন্সটলেশন ইত্যাদি)। এই কাজ থেকে দর্শক সরে যাচ্ছে। আপনার প্রজন্মের শিল্পীরা অন্যভাবে কাজ করেছেন। আর তরুণ প্রজন্মের কাজে বিদেশি প্রভাব খুব বেশি। নিজস্বতা কম। এই পরিবর্তন সম্বন্ধে যদি কিছু বলেন। 

যোগেন: ব্যাপারটা হচ্ছে যে— কাজ ভালো হবে creator, সে যদি sensitive হয়, তার মধ্যে সমস্ত element গুলো ঠিক থাকে। তাহলে সে ভালো কাজ করতে পারে। এবং বাইরের influence টাকে সে কিভাবে গ্রহণ করবে সেটাও তাঁর নিজস্ব decition-নিজের ভাবনা থেকে আসে। আমার মনে হয় এখানে প্রচুর ভালো ভালো শিল্পী আছেন যারা এর মধ্যেই ভালো কাজ করছেন। নাম আমি এই মুহূর্তে বলব না। যে দেখে তাকেও তৈরি হতে হয়। যে সমালোচনা করবে তাকেও তৈরি হতে হয়। বাইরের থেকে কেউ যদি কিছু গ্রহণ করে যার মধ্যে প্রাণ নেই, সত্যিকারের realization নেই— ওই কাজগুলো টেকে না । নতুন কাজ হবে। শিল্পী যে জায়গায় থাকে—যে সমাজের সাথে সে যুক্ত তার প্রভাব তার কাজে পড়বেই। যারা ভালো কাজ করবে তাদেরটা রয়ে যাবে। তাঁদের সম্বন্ধে বলা হবে ভবিষ্যৎ-এ তাঁরা বাংলার শিল্পতে contribute করেছে। সারা পৃথিবীতে যেমনই শিল্পচর্চা হোক না কেন যে আঁকছে তাঁর নিজের অভিজ্ঞতাটাই সব থেকে বড়।
 
অর্ণব: বাঙালি শিল্পীদের নিয়ে সিনেমা তৈরি হয় বেশ কম। যেমন কয়েক বছর আগে বলিউডের পরিচালক গোবিন্দ নিহালনি শিল্পী রাজা রবি বর্মার জীবন নির্ভর ছবি তৈরি করেছিলেন। নাম ‘ রঙ রসিয়া’। বাঙালি পরিচালক শৈবাল মিত্র ‘চিত্রকর’ নামে শিল্পী বিনোদ বিহারী মুখোপাধ্যায়-এর জীবন ভিত্তিক ছবি তৈরি করেছিলেন।  ভাস্কর রামকিঙ্কর বেজ খুব বড় একজন শিল্পী—নাটকীয় ব্যক্তিত্ব  পশ্চিমবঙ্গের এমন একজন শিল্পী যাঁকে নিয়ে অনেক আগেই সিনেমা হয়ে যাওয়ার কথা কিন্তু এখনও অবধি হয়ে উঠল না। আপনি যেহেতু পশ্চিমবঙ্গ সরকারের রাজ্য চারুকলা পর্ষদের চেয়ারম্যান ও একজন শিল্পী হিসেবে ও রাজ্যসভার সদস্য হিসেবে কোনো শিল্পীর জীবন ভিত্তিক সিনেমা তৈরির প্রকল্পকে কখনো বাস্তবায়িত করার কথা ভেবেছেন!

যোগেন: এইগুলো যে creator তার তরফ থেকে আসা দরকার। সত্যজিৎ রায় বা মৃণাল সেনের মত পরিচালকেরা এরকম করতে পারত। তারাই বেছে নেবে। আমি কিছু একটা বললাম আর হয়ে গেল এরকম না, আমার মনে হয় inspired হয়ে করা দরকার। গৌতম ঘোষের আছে এরকম, সিনেমা না বোধহয় – interview আছে—শিল্পীদের।আমি এসবের দিকে যাবই না। ফিল্ম তৈরির ঝকমারি অনেক। technical ব্যাপার অনেক জানতে হয়। কেউ যদি করে আমি support করব। গৌতম ঘোষ করতে পারে।

অর্ণব: আপনি কবিতাও লেখেন, কবিতার অলংকরণ করেন ও কাব্যগ্রন্থের প্রচ্ছদও করেন। আপনার করা কবিতার অলংকরণ বিভিন্ন পত্রিকায় দেখেছি। কবি অগ্নি রায় এর ‘পার্ক স্ট্রীট পদাবলী’ কাব্যগ্রন্থের অলংকরণ করেছেন। কবি দেবাশিস চন্দের কবিতার অলংকরণ করেছেন। গতবছর শঙ্খ ঘোষ-এর কবিতার অলংকরণও রবিবার পত্রিকায় দেখেছি। আপনি কি নিয়মিত কবিতার অলংকরণ করেন।

যোগেন: যেমন যেমন যোগাযোগ হয় তেমন করি। শঙ্খদাকে চিনতাম তাই তাঁরটা করেছি আর কী। তবে আমি regular illustrator নই। কেউ অনুরোধ করলে করি।  

অর্ণব: আপনার লেখালেখির জগত সমন্ধে কিছু বলুন। চিত্রকলা নিয়ে আপনার ধারাবাহিক লেখা ‘কি আঁকছি কেন আঁকছি’ দেশ পত্রিকায় পড়েছিলাম। এছাড়া আপনার শিল্প- বিষয়ক আরও বিভিন্ন লেখা রয়েছে। আপনি ‘Art east’ নামের একটি পত্রিকাও বার করেন। এই পত্রিকাতে নিয়মিত শিল্প- বিষয়ক লেখা বেরুচ্ছে। এমনিতে আমরা দেখি চিত্রকলা- বিষয়ক লেখার পাঠক বেশ কম। আপনি কি কখনো এই পত্রিকাটি বাংলায় বের করার কথা ভেবেছেন। 

যোগেন: আমরা বাংলায় বের করার কথা ভেবেছি।দু’একজনকে দায়িত্বও দিয়েছিলাম কাজগুলো করতে—কিন্তু ততটা এগোয়নি। আমি মুলত ইংলিশটা দেখাশুনা করি। এই কারণে যে আমরা চাই যে আমাদের কথা বাইরে যাক।আমাদের রাজ্যের বাইরে যাক। ইন্ডিয়া লেভেলে সবাই যাতে জানতে পারে। এখন আমার শিল্প- বিষয়ক একটা বই প্রায় রেডি হয়ে গেছে। ছাপার জন্য দিতে হবে।‘কি আঁকছি কেন আঁকছি’ আনন্দবাজার থেকে নিয়েছে। ওটা বই আকারে বেরবে । এছাড়া একটি বই দেবভাষা থেকে বেরবে সামনের মাসে। ১৯৬০ সাল থেকে শিল্পকলা নিয়ে আমার যা লেখা আছে তার একটি সংকলনের প্রথম খণ্ড। এরপর বাকি খণ্ডগুলো বেরবে পরপর। 

অর্ণব:  আপনার প্রিয় বিদেশি ও ভারতীয় শিল্পীদের নাম বলবেন যারা আপনার কাজকে প্রভাবিত করেছে! 

যোগেন: পিকাসো আমার খুব প্রিয় শিল্পী। সারা পৃথিবীতে এত বিখ্যাত উনি যে সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। পিকাসোর কাজ নানান কারণে আমার ভালো লাগে। পিকাসো প্রথম থেকেই খুবই skilled। technically খুবই ক্ষমতাশালী। পিকাসোর ক্ষেত্রে যে বিবর্তনগুলো ঘটেছে – সেগুলো খুবই exceptional – অন্য কোনো শিল্পীর মধ্যে এতটা পাওয়া যায় না। ওঁর প্রত্যেকটা পর্যায়ের কাজ খুবই inspiring। এছাড়া আমি পছন্দ করি আঁরি রুশো-কে। একটা fantasy নির্ভর যার কাজ। দালির থেকেও আমি রুশোকে বেশি পছন্দ করি। রুশোর কাজের মধ্যে একটা নিবিড়তা আছে। দালির কাজ gigantic ও তার মধ্যে একটা jark আছে।এছাড়া আমার মাতিশ বেশি ভালো লাগে- রঙ ও তার design sense- এর জন্য। এছাড়া আমার প্রিয় শিল্পী হলেন পল ক্লী। ভালো লাগে ওঁর কাজের জ্যামিতিক কোয়ালিটি ও কম্পোজিশন। 
ভারতীয় শিল্পীদের মধ্যে ভালো লাগে রামকিঙ্কর, বিনোদবিহারী, রবীন্দ্রনাথ – শৈলজা মুখার্জী। এরপর আসবে হুসেন। হুসেনকে 2nd position- এ দেবো। হুসেন খুবই পাওয়ারফুল। অমৃতা শেরগিলও বেশ ভালো। তারপর তায়েব মেহতা। অর্পিতা সিংহ-এর কাজ ভালো লাগে। sudhir patyabardhan ও Bhupen khakar-এর কাজ ভালো লাগে। Sculptureদের মধ্যে ভালো লাগে হিম্মত শাহ। কমবয়সি শিল্পীদের মধ্যে ভালো লাগে কলাভবনে আমার ছাত্রী মিঠু সেন (বর্তমানে দিল্লিবাসি) ও কলকাতার শিল্পী প্রদোষ পাল-এর কাজ।

অর্ণব: আপনার সাথে কথা বলে আমি সমৃদ্ধ  হলাম, ভালো থাকবেন। নমস্কার। 

যোগেন: আপনারাও ভালো থাকবেন। ধন্যবাদ।

🍂
ad

Post a Comment

0 Comments