জ্বলদর্চি

সাম্প্রতিক কাশ্মীর প্রশ্নে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উক্তি বিকৃত করে প্রচার শুধু তাঁকে অপমান নয় ভয়ঙ্কর অপরাধও! /দুর্গাপদ ঘাঁটি

সাম্প্রতিক কাশ্মীর প্রশ্নে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উক্তি বিকৃত করে প্রচার শুধু তাঁকে অপমান নয় ভয়ঙ্কর অপরাধও! 

 দুর্গাপদ ঘাঁটি 

কাশ্মীরে জঙ্গি বাহিনী কর্তৃক  সাধারণ পর্যটকদের হত্যা করার ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে দেশে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের মনোভাব সৃষ্টির প্রবল প্রচেষ্টা চলছে।ফেক ছবি বানিয়েও মিথ্যা প্রচারও চলছে । নাগরিক নিরাপত্তার ন্যূনতম দায়দায়িত্ব পালন যে সরকার পালন করে নি, সেই প্রশ্নের সঙ্গে এ প্রশ্নও উঠেছে যে, কাশ্মীরের মানুষ এই হত্যার নিন্দা জানিয়ে যে মিছিল করেছে, নানা জায়গায় তারা সেনা বাহিনী আসার আগেই আক্রান্তদের পাশে দাঁড়িয়েছে ----- সুকৌশলে সেই সব ঘটনা আড়ালে রেখে উগ্র ধর্মান্ধতার প্রচার করা হচ্ছে বেশ কিছু সংবাদ মাধ্যমে। মনীষীদের উদ্ধৃতিকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বিকৃত করেও উপস্থাপন করা হচ্ছে। 
"২৯ এপ্রিল কাশ্মীরে ঘৃণ্য হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার আহ্বানে 
বহু স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন,  গণসংগঠন, নাগরিক কমিটি কিছু রাজনৈতিক দল সারা দেশের সঙ্গে এই রাজ্যেও মিছিল করছে এবং আরো নানা  সচেতনতামূলক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। 
রবীন্দ্রনাথের উদ্ধৃতি গুলোর বিকৃতি কীভাবে ঘটানো হয়েছে তার একটি নমুনা এবং তার যথাযথ উত্তর নীচে দেওয়া হলো।------
 আশ্চর্য হলাম গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের সেই সময়ের কিছু উক্তি দেখে : 
১/যে মুসলমানকে আজ ওরা প্রশ্রয় দিচ্ছে সেই মুসলমানেরাই একদিন মুষল ধরবে। 
(অমিয় চক্রবর্ত্তীকে লেখা চিঠি, ১৫.১১.১৯৩৪, চিঠিপত্র :১১)
২/ চল্লিশলাখ হিন্দু একলাখ মুসলিমদের ভয়ে মারাত্মকভাবে অভিভূত। 

🍂
ad

( আনন্দবাজার পত্রিকায় সাক্ষাৎকার, ৫.৯.১৯২৩)
৩/যদি মুসলমান সমাজ মারে আর আমরা পড়ে পড়ে মার খাই, তবে জানব, এ সম্ভব করেছে শুধু আমাদের দুর্বলতা।
(রবীন্দ্র রচনাবলী, জ.শ.স,১৩ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩১৭,কালান্তর)
৪/ কোনো বিশেষ প্রয়োজন না থাকলেও হিন্দু নিজেকেই মারে, আর প্রয়োজন থাকলেও হিন্দু অন্যকে মারতে পারে না। আর মুসলমান কোনো বিশেষ প্রয়োজন না ঘটলেও নিজেকে দৃঢ়ভাবে রক্ষা করে, আর প্রয়োজন হলে অন্যকে বেদম মার দিতে পারে।
(রবীন্দ্র রচনাবলী, জ.শ.স, ১৩ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩১৭,কালান্তর)
৫/ এই ধর্ম যেখানে গেছে সেখানেই আপনার বিরুদ্ধধর্মকে আঘাত করে ভূমিস্যাৎ করে তবে ক্ষান্ত হয়েছে। ভারতবর্ষের উপরেও এই প্রচণ্ড আঘাত এসে পড়েছিল এবং বহু শতাব্দী ধরে এই আঘাত নিরন্তর কাজ করেছে।
(রবীন্দ্র রচনাবলী, জ.শ.স, ১২ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪০৮,শান্তিনিকেতন)
৬/হিন্দু মুসলমানের মধ্যে যে একটা পার্থক্য আছে তাহা ফাঁকি দিয়া উড়াইয়া দিবার জো নাই।
(রবীন্দ্র রচনাবলী, জ.শ.স, ১৩ খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৮২, পরিচয়)
৭/ইতিহাসে দেখা যায়, নিরুৎসুক হিন্দুগণ মরিতে কুণ্ঠিত হয় নাই। মুসলমানেরা যুদ্ধ করিয়াছে, আর হিন্দুরা দলে দলে আত্মহত্যা করিয়াছে।
(ঐ, পৃষ্ঠা ৪৮৫,ইতিহাস)
৮/প্রতিদিন নিম্নশ্রেণীর হিন্দুরা মুসলমান এবং খৃস্টান হতে চলেছে। কিন্তু ভাটপাড়ার চৈতন্য নেই। একদা ঐ তর্করত্নদের প্রপৌত্রীমণ্ডলীকে মুসলমান যখন জোর করে কলেমা পড়াবে তখন পরিতাপ করার সময় থাকবে না।
(হেমন্তীবালা দেবীকে লেখা চিঠি, ১৬.১০.১৯৩৩, চিঠিপত্র-৯)
যেখানে রবীন্দ্রনাথের মতো কবি মুসলিমের সম্পর্কে সজাগ ছিলেন সেখানে বর্তমান খারাপ পরিস্থিতিতে থেকেও কীভাবে হিন্দু মুসলিম ভাই ভাই এসব উচ্চারণ করি? অবাক হই, হতবাক হই।
রবীন্দ্রনাথকে জানার কতো বাকি আছে...
[: ১) যে ধর্ম মানুষে মানুষে বিভেদ ঘটায়, ঘৃণা সৃষ্টি করে সে ধর্মকে মানি না - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ( মানুষের ধর্ম)
২) ভারতবর্ষ কোন এক জাতির একচেটিয়া সম্পত্তি নয়, হিন্দু -মুসলমান সব জাতির মিলিত ভূমি।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ( সমাজ প্রবন্ধ সংকলন)
৩) সত্যিকারের ভারতবর্ষ হিন্দু - মুসলমানের মিলনের ভারতবর্ষ 
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ( National ism)
৪) জাতীয়তাবাদকে যদি আমরা ধর্ম করে তুলি তবে মানুষের ধর্মকে হারিয়ে ফেলব।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর 
( Nationalism)
৫) মানুষে মানুষে মিলনের মধ্য দিয়েই ভারতবর্ষের আত্মা বিকশিত হবে, ভেদবুদ্ধি দিয়ে নয়।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর 
( ভারতবর্ষের ইতিহাস)

কিছু বিপদজনক ব্যক্তি প্রমাণ করতে চাইছে রবীন্দ্রনাথ সাম্প্রদায়িক। তাদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে বাংলার চাড্ডিসম্প্রদায়। স্বরচিত রবীন্দ্রসঙ্গীতের মতো, আগের বাক্য পরের বাক্য হাপিশ, ফেক উদ্ধৃতি।
অভিযোগ ১/যে মুসলমানকে আজ ওরা প্রশ্রয় দিচ্ছে সেই মুসলমানেরাই একদিন মুষল ধরবে। (অমিয় চক্রবর্ত্তীকে লেখা চিঠি, ১৫.১১.১৯৩৪, চিঠিপত্র :১১)
উত্তরঃ মূল চিঠিটি পড়ে দেখুন। পরাধীন ভারতের অত্যাচারী শাসক ইংরাজ হল “ওরা”। সত্যিই কবির কথা ফলেছিল। মুসলমানরা ধর্মনিরপেক্ষ হিন্দুর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মুষল ধরেছিল ইংরেজের বিরুদ্ধে। হিন্দু মহাসভার লোকেরা ছিল দালাল। তারা স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল।
অভিযোগ ২/ চল্লিশলাখ হিন্দু একলাখ মুসলিমদের ভয়ে মারাত্মকভাবে অভিভূত। ( আনন্দবাজার পত্রিকায় সাক্ষাৎকার, ৫.৯.১৯২৩)
উত্তরঃ এটি পুরোপুরি ফেক। ২০১৬ থেকে স্বস্তিকা এই প্রচার চালাচ্ছে। রবীন্দ্র রচনাবলীর কোথাও এটি পাওয়া যাবে না। বরং রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, “হিন্দুজাতিও এক হিসাবে মুসলমানদেরই মতো। অর্থাৎ, তারা ধর্মের প্রাকারে সম্পূর্ণ পরিবেষ্টিত। বাহ্য প্রভেদটা হচ্ছে এই যে, অন্য ধর্মের বিরুদ্ধতা তাদের পক্ষে সকর্মক নয়– অহিন্দু সমস্ত ধর্মের সঙ্গে তাদের non-violent non-co-operation।”
রবীন্দ্র রচনাবলী নেটেও পাওয়া যায়। রবীন্দ্রনাথের নামে ঘৃণা ছড়ানো কীটদের কথায় বিশ্বাস না করে নীচে ক্লিক করে নিজেই দেখে নিন।
https://rabindra-rachanabali.nltr.org/node/9827
অভিযোগ ৩/যদি মুসলমান সমাজ মারে আর আমরা পড়ে পড়ে মার খাই, তবে জানব, এ সম্ভব করেছে শুধু আমাদের দুর্বলতা।(রবীন্দ্র রচনাবলী, জ.শ.স,১৩ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩১৭,কালান্তর)
উত্তরঃ এটাও মিথ্যা।
৩ নম্বর পয়েন্টটিতে যে বাক্যটির উল্লেখ করা হয়েছে, যেখানে বলা হচ্ছে, ‘যদি মুসলমান সমাজ মারে আর আমরা পড়ে পড়ে মার খাই, তবে জানব, এ সম্ভব করেছে শুধু আমাদের দুর্বলতা।’, এই লাইনটি ‘কালান্তর’-এর ‘স্বামী শ্রদ্ধানন্দ’ প্রবন্ধ থেকে নেওয়া। কী সুচতুরভাবে শুধুমাত্র এই একটি লাইনকে তুলে এনে, কথার আগুপিছু কিছুকে না দেখিয়ে পুরো ভিন্ন বার্তা প্রেরণ করা হচ্ছে, সেকথা ভাবলেও শিউরে উঠতে হয়। এই প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ পরিষ্কার বলছেন—
ভারতবর্ষের অধিবাসীদের দুই মোটা ভাগ, হিন্দু ও মুসলমান। যদি ভাবি, মুসলমানদের অস্বীকার করে এক পাশে সরিয়ে দিলেই দেশের সকল মঙ্গলপ্রচেষ্টা সফল হবে, তা হলে বড়োই ভুল করব। ছাদের পাঁচটা কড়িকে মানব, বাকি তিনটে কড়িকে মানবই না, এটা বিরক্তির কথা হতে পারে, কিন্তু ছাদ-রক্ষার পক্ষে সুবুদ্ধির কথা নয়। আমাদের সবচেয়ে বড়ো অমঙ্গল বড়ো দুর্গতি ঘটে যখন মানুষ মানুষের পাশে রয়েছে অথচ পরস্পরের মধ্যে সম্বন্ধ নেই, অথবা সে সম্বন্ধ বিকৃত। বিদেশীর রাজ্যে রাজপুরুষদের সঙ্গে আমাদের একটা বাহ্য যোগ থাকে, অথচ আন্তরিক সম্বন্ধ থাকে না। বিদেশীয় রাজত্বে এইটেই আমাদের সবচেয়ে পীড়া দেয়। গায়ে-পড়া যোগটা দুর্বলতা ও অপমান আনে। বিদেশী শাসন সম্পর্কে যদি এ কথা খাটে তবে স্বদেশীয়দের সম্বন্ধে সে আরও কত সত্য। এক দেশে পাশাপাশি থাকতে হবে, অথচ পরস্পরের সঙ্গে হৃদ্যতার সম্বন্ধ থাকবে না, হয়তো বা প্রয়োজনের থাকতে পারে— সেইখানেই যে ছিদ্র— ছিদ্র নয়, কলির সিংহদ্বার। দুই প্রতিবেশীর মধ্যে যেখানে এতখানি ব্যবধান সেখানেই আকাশ ভেদ করে ওঠে অমঙ্গলের জয়তোরণ। আমাদের দেশে কল্যাণের রথযাত্রায় যখনই সকলে মিলে টানতে চেষ্টা করা হয়েছে— কংগ্রেস প্রভৃতি নানা প্রচেষ্টা দ্বারা, সে-রথ কোথায় এসে থেমে যায়, ভেঙে পড়ে? যেখানে গর্তগুলো হাঁ ক’রে আছে হাজার বছর ধরে।
আমাদের দেশে যখন স্বদেশী-আন্দোলন উপস্থিত হয়েছিল তখন আমি তার মধ্যে ছিলেম। মুসলমানরা তখন তাতে যোগ দেয় নি, বিরুদ্ধ ছিল। জননায়কেরা কেউ কেউ তখন ক্রুদ্ধ হয়ে বলেছিলেন, ওদের একেবারে অস্বীকার করা যাক। জানি, ওরা যোগ দেয় নি। কিন্তু, কেন দেয় নি। তখন বাঙালি হিন্দুদের মধ্যে এত প্রবল যোগ হয়েছিল যে সে আশ্চর্য! কিন্তু, এতবড়ো আবেগ শুধু হিন্দুসমাজের মধ্যেই আবদ্ধ রইল, মুসলমানসমাজকে স্পর্শ করল না! সেদিনও আমাদের শিক্ষা হয় নি। পরস্পরের মধ্যে বিচ্ছেদের ডোবাটাকে আমরা সমাজের দোহাই দিয়ে গভীর করে রেখেছি।
অভিযোগ ৪/ কোনো বিশেষ প্রয়োজন না থাকলেও হিন্দু নিজেকেই মারে, আর প্রয়োজন থাকলেও হিন্দু অন্যকে মারতে পারে না। আর মুসলমান কোনো বিশেষ প্রয়োজন না ঘটলেও নিজেকে দৃঢ়ভাবে রক্ষা করে, আর প্রয়োজন হলে অন্যকে বেদম মার দিতে পারে।(রবীন্দ্র রচনাবলী, জ.শ.স, ১৩ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩১৭,কালান্তর)
উত্তরঃ কালান্তর আপনার বাড়িতেই আছে। দেখে নিন। মিথ্যা প্রচার করছে ওরা। রবীন্দ্রনাথকে আমরা চিনি ও জানি একজন সমন্বয়বাদী ধারণায় বিশ্বাসী ব্যক্তি হিসেবে। ব্যক্তিজীবনের ক্ষেত্রে, দেশ বা সমাজের সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে তাঁকে সমন্বয়বাদী রূপে দেখা গেছে। এখানেও বোধহয় ছিল সমন্বয়ের চেষ্টা। উন্নত, আধুনিক ভারতবর্ষ বিনির্মাণে ইংরেজ ভূমিকা নেবে – দীর্ঘদিন এমন বিশ্বাস তিনি লালন করেছেন। একাধিক প্রবন্ধে তা প্রকাশ পেয়েছে। পেয়েছে ইংরেজের ঐতিহাসিক ভূমিকা সম্বন্ধে তাঁর বিশ্বাস। ভাবেননি যে, উপনিবেশবাদী শোষক কখনো উপনিবেশকে স্বদেশ হিসেবে ভাবে না।
পড়ুন, নীচে ক্লিক করেঃ
https://www.kaliokalam.com/রবীন্দ্রনাথের-স্বদেশভাব/
একটা রেফারেন্স ভুল থাকলে বলবেন। আপনার বাড়িতেই আছে রবীন্দ্র রচনাবলী। নইলে পাড়ার লাইব্রেরিতে। রবীন্দ্রনাথের অপমান মানেই আপনার অপমান।
অভিযোগ ৫/ এই ধর্ম যেখানে গেছে সেখানেই আপনার বিরুদ্ধ ধর্মকে আঘাত করে ভূমিস্যাৎ করে তবে ক্ষান্ত হয়েছে। ভারতবর্ষের উপরেও এই প্রচণ্ড আঘাত এসে পড়েছিল এবং বহু শতাব্দী ধরে এই আঘাত নিরন্তর কাজ করেছে।(রবীন্দ্র রচনাবলী, জ.শ.স, ১২ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪০৮,শান্তিনিকেতন)
উত্তরঃ
এখানে কবি মুসলমান সাম্রাজ্যবাদীদের প্রতি তাঁর ঘৃণাকে ছুঁড়ে দিচ্ছেন। সুলতানি ইতিহাস পড়লেই জানা যাবে, ভারতবর্ষের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে হিন্দুমন্দির, জৈনমন্দির ধ্বংস করে তার উপরে উঠেছে মসজিদ। অতএব, বিরুদ্ধ ধর্মকে আঘাতের কথা একবর্ণও কি মিথ্যে? বরং এখানে তিনি বলেছেন যে ওই সুলতানি আমলেও কবির, নানক, রবিদাস, দাদুদয়ালের মতো সাধকগণ আবির্ভূত হয়েছিলেন, তাঁরা মানুষকে মুক্তির পথ দেখিয়ে গেছেন। রবীন্দ্রনাথ এখানে বলছেন-
সত্যের আঘাত কেবল সত্যই গ্রহণ করতে পারে। এইজন্য প্রবল আঘাতের মুখে প্রত্যেক জাতি, হয়, আপনার শ্রেষ্ঠ সত্যকে সমুজ্জ্বল করে প্রকাশ করে, নয়, আপনার মিথ্যা সম্বলকে উড়িয়ে দিয়ে দেউলে হয়ে যায়। ভারতবর্ষেরও যখন আত্মরক্ষার দিন উপস্থিত হয়েছিল তখন সাধকের পর সাধক এসে ভারতবর্ষের চিরসত্যকে প্রকাশ করে ধরেছিলেন। সেই যুগের নানক, রবিদাস, কবীর, দাদু প্রভৃতি সাধুদের জীবন ও রচনা যাঁরা আলোচনা করছেন তাঁরা সেই সময়কার ধর্ম-ইতিহাসের যবনিকা অপসারিত করে যখন দেখাবেন তখন দেখতে পাব ভারতবর্ষ তখন আত্মসম্পদ সম্বন্ধে কী রকম সবলে সচেতন হয়ে উঠেছিল।
ভারতবর্ষ তখন দেখিয়েছিল, মুসলমানধর্মের যেটি সত্য সেটি ভারতবর্ষের সত্যের বিরোধী নয়। দেখিয়েছিল ভারতবর্ষের মর্মস্থলে সত্যের এমন একটি বিপুল সাধনা সঞ্চিত হয়ে আছে যা সকল সত্যকে আত্মীয় বলে গ্রহণ করতে পারে। এইজন্যেই সত্যের আঘাত তার বাইরে এসে যতই ঠোকুক তার মর্মে গিয়ে কখনো বাজে না, তাকে বিনাশ করে না।
 
অভিযোগ ৬/হিন্দু মুসলমানের মধ্যে যে একটা পার্থক্য আছে তাহা ফাঁকি দিয়া উড়াইয়া দিবার জো নাই।(রবীন্দ্র রচনাবলী, জ.শ.স, ১৩ খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৮২, পরিচয়)
উত্তরঃ রেফারেন্স ফেক। পুরোটা সুন্দর করে নীচে লেখা আছে। পড়ে নিন।
আমাদের দেশে ভারতবর্ষীয়দের মধ্যে রাষ্ট্রীয় ঐক্যলাভের চেষ্টা যখনই প্রবল হইল, অর্থাৎ যখনই নিজের সত্তা সম্বন্ধে আমাদের বিশেষভাবে চেতনার উদ্রেক হইল তখনই আমরা ইচ্ছা করিলাম বটে মুসলমানদিগকেও আমাদের সঙ্গে এক করিয়া লই, কিন্তু তাহাতে কৃতকার্য হইতে পারিলাম না। এক করিয়া লইতে পারিলে আমাদের সুবিধা হইতে পারিত বটে, কিন্তু সুবিধা হইলেই যে এক করা যায় তাহা নহে। হিন্দু - মুসলমানের মধ্যে যে একটি সত্য পার্থক্য আছে তাহা ফাঁকি দিয়া উড়াইয়া দিবার জো নাই। প্রয়োজনসাধনের আগ্রহবশত সেই পার্থক্যকে যদি আমরা না মানি তবে সেও আমাদের প্রয়োজনকে মানিবে না।
হিন্দু মুসলমানের মধ্যে সকল দিক দিয়া একটা সত্যকার ঐক্য জন্মে নাই বলিয়াই রাষ্ট্রনৈতিক ক্ষেত্রে তাহাদিগকে এক করিয়া তুলিবার চেষ্টায় সন্দেহ ও অবিশ্বাসের সূত্রপাত হইল। এই সন্দেহকে অমূলক বলিয়া উড়াইয়া দিলে চলিবে না। আমরা মুসলমানকে যখন আহ্বান করিয়াছি তখন তাহাকে কাজ উদ্ধারের সহায় বলিয়া ডাকিয়াছি, আপন বলিয়া ডাকি নাই। যদি কখনো দেখি তাহাকে কাজের জন্য আর দরকার নাই তবে তাহাকে অনাবশ্যক বলিয়া পিছনে ঠেলিতে আমাদের বাধিবে না। তাহাকে যথার্থ আমাদের সঙ্গী বলিয়া অনুভব করি নাই, আনুষঙ্গিক বলিয়া মানিয়া লইয়াছি। যেখানে দুইপক্ষের মধ্যে অসামঞ্জস্য আছে সেখানে যদি তাহারা শরিক হয়, তবে কেবল ততদিন পর্যন্ত তাহাদের বন্ধন থাকে যতদিন বাহিরের কোনো বাধা অতিক্রমের জন্য তাহাদের একত্র থাকা আবশ্যক হয়,— সে আবশ্যকটা অতীত হইলেই ভাগবাঁটোয়ারার বেলায় উভয় পক্ষেই ফাঁকি চলিতে থাকে।
মুসলমান এই সন্দেহটি মনে লইয়া আমাদের ডাকে সাড়া দেয় নাই। আমরা দুই পক্ষ একত্র থাকিলে মোটের উপর লাভের অঙ্ক বেশি হইবে বটে, কিন্তু লাভের অংশ তাহার পক্ষে বেশি হইবে কি না, মুসলমানের সেইটেই বিবেচ্য। অতএব মুসলমানের এ কথা বলা অসংগত নহে যে আমি যদি পৃথক থাকিয়াই বড়ো হইতে পারি তবেই তাহাতে আমার লাভ।
অভিযোগ ৭/ইতিহাসে দেখা যায়, নিরুৎসুক হিন্দুগণ মরিতে কুণ্ঠিত হয় নাই। মুসলমানেরা যুদ্ধ করিয়াছে, আর হিন্দুরা দলে দলে আত্মহত্যা করিয়াছে।(ঐ, পৃষ্ঠা ৪৮৫,ইতিহাস)
উত্তরঃ এটি রবীন্দ্রনাথ কোথাও বলেননি। হিন্দুরা আত্মহত্যাকারী আর মুসলমান যোদ্ধা—এমন কথা হিন্দুদের ছোটো করে। কোথাও কবি বলেননি এই কথা। এই ভারতের গৌরবগাথায় হিন্দু বীরদের কথাও তিনি সশ্রদ্ধায় উল্লেখ করেছেন নানা জায়গায়। ঘৃণা প্রচারকারীরা রবীন্দ্রনাথ পড়েনি।
আসল টা পড়ুন
এ দিকে অনতিপূর্বে ভারতবর্ষের প্রতিবেশে বহুতর খণ্ডবিচ্ছিন্ন জাতি মহাপুরুষ মহম্মদের প্রচণ্ড আকর্ষণবলে একীভূত হইয়া মুসলমান নামক এক বিরাট কলেবর ধারণ করিয়া উত্থিত হইয়াছিল। তাহারা যেন ভিন্ন ভিন্ন দুর্গম মরুময় গিরিশিখরের উপরে খণ্ড তুষারের ন্যায় নিজের নিকটে অপ্রবুদ্ধ এবং বাহিরের নিকটে অজ্ঞাত হইয়া বিরাজ করিতেছিল। কখন প্রচণ্ড সূর্যের উদয় হইল এবং দেখিতে দেখিতে নানা শিখর হইতে ছুটিয়া আসিয়া তুষারস্রুত বন্যা একবার একত্র স্ফীত হইয়া তাহার পরে উন্মত্ত সহস্র ধারায় জগৎকে চতুর্দিকে আক্রমণ করিতে বাহির হইল।
তখন শ্রান্ত পুরাতন ভারতবর্ষে বৈদিক ধর্ম বৌদ্ধদের দ্বারা পরাস্ত; এবং বৌদ্ধধর্ম বিচিত্র বিকৃত রূপান্তরে ক্রমশ পুরাণ-উপপুরাণের শতধাবিভক্ত ক্ষুদ্র সংকীর্ণ বক্র প্রণালীর মধ্যে স্রোতোহীন মন্দগতিতে প্রবাহিত হইয়া একটি সহস্রলাঙ্গুল শীতরক্ত সরীসৃপের ন্যায় ভারতবর্ষকে শতপাকে জড়িত করিতেছিল। তখন ধর্মে সমাজে শাস্ত্রে কোনো বিষয়ে নবীনতা ছিল না, গতি ছিল না, বৃদ্ধি ছিল না, সকল বিষয়েই যেন পরীক্ষা শেষ হইয়া গেছে, নূতন আশা করিবার বিষয় নাই। সে সময়ে নূতনসৃষ্ট মুসলমানজাতির বিশ্ববিজয়োদীপ্ত নবীন বল সম্বরণ করিবার উপযোগী কোনো একটা উদ্দীপনা ভারতবর্ষের মধ্যে ছিল না।
নবভাবোৎসাহে এবং ঐক্যপ্রবণ ধর্মবলে একটা জাতি যে কিরূপ মৃত্যুঞ্জয়ী শক্তি লাভ করে পরবর্তীকালে শিখগণ তাহার দৃষ্টান্ত দেখাইয়াছিল।
কিন্তু ইতিহাসে দেখা যায় নিরুৎসুক হিন্দুগণ মরিতে কুন্ঠিত হয় নাই। মুসলমানেরা যুদ্ধ করিয়াছে, আর হিন্দুরা দলে দলে আত্মহত্যা করিয়াছে। মুসলমানদের যুদ্ধের মধ্যে এক দিকে ধর্মোৎসাহ, অপর দিকে রাজ্য অথবা অর্থ-লোভ ছিল; কিন্তু হিন্দুরা চিতা জ্বালাইয়া স্ত্রীকন্যা ধ্বংস করিয়া আবালবৃদ্ধ মরিয়াছে– মরা উচিত বিবেচনা করিয়া; বাঁচা তাহাদের শিক্ষাবিরুদ্ধ সংস্কারবিরুদ্ধ বলিয়া। তাহাকে বীরত্ব বলিতে পার কিন্তু তাহাকে যুদ্ধ বলে না। তাহার মধ্যে উদ্দেশ্য অথবা রাষ্ট্রনীতি কিছুই ছিল না।
'মুসলমান রাজত্বের ইতিহাস'
অভিযোগ ৮/প্রতিদিন নিম্নশ্রেণীর হিন্দুরা মুসলমান এবং খৃস্টান হতে চলেছে। কিন্তু ভাটপাড়ার চৈতন্য নেই। একদা ঐ তর্করত্নদের প্রপৌত্রীমণ্ডলীকে মুসলমান যখন জোর করে কলেমা পড়াবে তখন পরিতাপ করার সময় থাকবে না।(হেমন্তীবালা দেবীকে লেখা চিঠি, ১৬.১০.১৯৩৩, চিঠিপত্র-৯)
উত্তরঃ হেমন্তী বালা বলে কেউ ছিল না, কেউ নেই। যিনি ছিলেন তাঁর নাম হেমন্তবালাদেবী। পড়ে নিন কী লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ, ধর্ম নিয়ে। 

Post a Comment

0 Comments