ঢেকে রাখা বিষ ফোঁড়া
সৌমেন রায়
চিত্র – সুকন্যা চক্রবর্তী
কাশ্মীরের পেহেলগাও এ সদ্য ঘটে যাওয়া মর্মান্তিক ঘটনায় সকলের হৃদয় বিদারিত। ঘটনাটি প্রবলভাবে নাড়া দিয়েছে ‘সন্ত্রাসের কোন ধর্ম হয় না’ এই বাক্যবন্ধটিকে। ঘটনাটিকে কেন্দ্র করে ঘৃণার লাভা বিকিরণ ঘটছে। পাশাপাশি পাল্টে যাচ্ছে চেনা মুখ ও তার ভাষা। বিষয়টি জটিল এবং গম্ভীর। এ বিষয়ে আমার মত অর্বাচীন ব্যক্তির নতুন কিছু বলার নেই। কিন্তু হৃদয় কেঁপে উঠছে অজানা আশঙ্কায়। তাই দুটো হৃদয়ের কথা বেরোতে চাইছে। আমরা সবাই জানি এই ঘটনার জন্য মুসলমান মাত্রই দায়ী হতে পারেনা। তবু সমাজ যেন আড়াআড়িভাবে ভাগ হয়ে যাচ্ছে। আমার দেশের গর্বের দিন কি ফুরিয়ে আসছে?
প্রতি বছর আবুধাবিতে থাকা বাল্যবন্ধু সিরাজউদ্দিন যে বিজয়া দশমীর শুভেচ্ছা পাঠায় তার মধ্যে তো কোন মালিন্য নেই। কোন এক বিপদে পড়া অভিভাবককে সামান্য সাহায্য করার বিনিময়ে প্রতিবছর ঈদের পায়েস প্রাপ্তি ঘটে। তার স্বাদ তো আমার বাড়ির পায়েসের মতোই। রুকসানা আর ঈশিকার চকলেট ভাগ করে খাওয়া মিথ্যা নয়। সমাজ মাধ্যমে দেখা এক হিন্দু এবং মুসলমান ছাত্রের একসাথে মিড ডে মিল খাওয়া হয়তো সর্বত্র ঘটেনা। কিন্তু সর্বত্র প্রতিটি স্কুলেই সোলেমান এবং সুজনরা পাশাপাশি বসে খায়। ঘৃণার আবহাওয়ায় এইসব ঘটনাগুলোকে অত্যন্ত বায়বীয় লাগছে। এতই ঠুনকো মনে হচ্ছে একদমকায় এগুলো সব না উড়ে যায়। বড্ড ভয় করছে।
কেন এমন ঘটে? একটি কারণ সবাই জানেন। যারা ধর্মের ব্যবসা করে এবং যারা রাজনীতি করে তাদের কাছে ধর্মীয় মেরুকরণ অন্যতম মূলধন। তাতে উলুখাগড়ার প্রাণ গেলে তাদের কিছু যায় আসে না। ইতিহাসে যে কজন উদার শাসকের দেখা পাই তাদের সদিচ্ছার প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেও বলা যায় সেগুলো ছিল তাদের শাসন ব্যবস্থারই অঙ্গ।এই ভয়ঙ্কর খেলা বুঝেছিলেন আদিল ভাই। বুঝেছিলেন এই সন্ত্রাসী আক্রমণ শুধু কিছু হিন্দু ভাইয়ের উপর আক্রমণ নয়। অসংখ্য দরিদ্র কাশ্মীরীর পেটের উপর আক্রমণ। তাই বাধা দিতে গিয়ে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন । তিনি প্রনম্য। আপামর জনসাধারণ সবাই সবটা জানে। কিন্তু বেশিরভাগই আফিমের নেশায় উন্মত্ত। জানা কথা বুঝতে পারে না। তার বাইরে কি কোন কারণ আছে? সাধারণ জনগণের মধ্যে কিছু প্রশ্ন আছে, জিজ্ঞাসা আছে, ধারণা আছে। যেগুলোর উত্তর সহসা পাওয়া যায় না। তাই মনের কোণে জমে থাকে সাম্প্রদায়িকতার অন্ধকার। সুযোগ পেলেই বিস্ফোরণ ঘটে । সাধারণের কথা বুদ্ধিজীবীদের মতো পরিশীলিত নয়, সুচিন্তিত নয়। তবু সাধারণ লোকের সে ভাবনার আলোচনা হওয়া উচিত জন পরিসরে। তাদের মতো করে উত্তর দেওয়া উচিত। তা না করে যদি প্রশ্নগুলি এড়িয়ে যাওয়া হয় তাহলে সমস্যা ক্রমাগত বেড়েই চলবে।
কি তাদের জিজ্ঞাসা? কি তাদের ভাবনা? সব আমি জানিও না, সব আলোচনা করার পরিসরও নেই। দু একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। অবশ্যই সব মুসলিম জঙ্গি নয় কিন্তু সব (প্রায়) জঙ্গি মুসলমান কেন? অন্য কোন সন্ত্রাস কখনও হয়নি তা নয় । আমরা গোধরা ও তার পরবর্তী কান্ড , খ্রিস্টান সন্ন্যাসী গ্রাহামকে পুত্রসহ জ্যান্ত পুড়িয়ে দেওয়া, শিখ নিধন কোন ঘটনাই ভুলে যাইনি। কিন্তু সংখ্যার দিক দিয়ে দেখলে ইসলামীয় সন্ত্রাস এত বেশি কেন? সাম্য যে ধর্ম প্রতিষ্ঠার ভিত্তিভূমি সেই ধর্মের বাণী দিয়ে কিভাবে হত্যায় প্ররোচিত করা হচ্ছে ?শিক্ষায় গলদ নেই তো? কোথাও সংস্কারের কোন মারাত্মক ভ্রান্তি নেই তো? গোয়েন্দা ব্যর্থতাকে প্রশ্ন করার পাশাপাশি আরো একটি প্রশ্ন কি করা যায়? যে দেশেরই একটি অংশে এত নিরাপত্তা রক্ষী বেষ্টিত হয়ে হাঁটতে হবে কেন? আমাদের দেশে কেন রাস্তা বন্ধ করে পূজোর প্যান্ডেল করা হয়? কেনই বা রাস্তা বন্ধ করে নামাজ পড়া হয়? কেন ভোরের আজান আর সৎসঙ্গের প্রার্থনা সংগীত মাইকে বহুদূর পর্যন্ত ছড়িয়ে দিতে হয়? সেই চত্তরটুকুতে শোনালেই কি যথেষ্ট নয়? ইচ্ছে না থাকলেও সকলকে শুনতেই হবে এবং সুরটিকে মধুর বলতে হবে? স্বাধীন দেশের নাগরিকের কি নিজের খাদ্য নির্বাচনের অধিকার থাকবে না? কেন গোমাংস খাওয়ার জন্য নির্যাতিত হতে হবে কাউকে? ছাত্র অবস্থায় পড়েছিলাম কলকাতা বিমানবন্দরের সম্প্রসারণ একটি মসজিদ থাকার কারণে করা যায়নি। সেই মসজিদে সামান্যই কয়েকজন নামাজ পড়তেন। মসজিদ স্থানান্তরের প্রস্তাব তারা মেনে নেননি। কেন মুসলিম সমাজ থেকেই এর প্রতিকারে কেউ এগিয়ে আসেনি? প্রতিটি ধর্মেই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সংস্কার দরকার। সে সংস্কার কেন হয় না? কেন ইরানে হিজাব বিরোধী আন্দোলন হলেও আমাদের দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হিজাব পরার জন্য আন্দোলন হয় ? একবিংশ শতকেও আমরা কেন শুধু ধর্ম নিয়ে বাঁচি, ধর্ম নিয়ে মরি ?ধর্ম যতক্ষণ ব্যক্তিগত পর্যায়ে থাকে সে শান্তি দেয়। কিন্তু যখনই প্রাতিষ্ঠানিক হয়ে ওঠে তখনই সেটি বিভিন্ন বিধি নিষেধ আরোপ করে, অন্যকে ঘৃণা করতে শেখায়। কারণ নিজে বড় হওয়ার সবচেয়ে সহজ পন্থা অন্যকে ছোট করা। এটা আমরা আর কবে বুঝব? কেন ধর্মনিরপেক্ষতা বোঝাতে বিশেষ পোশাক পরে ইফতার পার্টি যোগদান করতে হবে? ধর্মনিরপেক্ষতার মানে কি? প্রকাশ্যে হিন্দু নিধনের হুমকি দেওয়া নেতাকে কেন গ্রেফতার করবে না প্রশাসন? ক্রমাগত উস্কানিমূলক বক্তব্য রাখা ধর্মীয় গুরুদের কেন শাস্তি দেবে না প্রশাসন।আরো গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন কেন আওয়াজ উঠবে না সেই সভা থেকেই? শ্রোতারাই কেন বলবে না মনুষ্যত্ব আমার ধর্ম সত্তার আগে। কেন একশ্রেণীর বুদ্ধিজীবী সুদূর গাজা সম্পর্কে সোচ্চার হলেও মুর্শিদাবাদে নীরব থাকবেন ? কোথায় সরব হবেন কোথায় নীরব থাকবেন এটা অবশ্যই আপনার অধিকার। কিন্তু যদি আপনি ক্রমাগত ‘মুর্শিদাবাদ’ গুলিকে এড়িয়ে যান তাহলে আপনাকে পক্ষপাতদুষ্ট বলাটাও জনসাধারণের অধিকার নয় কি? ক্ষোভের আগুন সেজন্য বাড়বে না কি?
সমস্ত সম্প্রদায়ের ধর্ম থেকে খানিক দুরে অবস্থান করা ব্যক্তিদের দায়িত্ব এই সমস্ত প্রশ্নকে আলোচনার পরিসরে নিয়ে আসা। সেকুলার ভাবমূর্তিতে আঘাত লাগবে বলে প্রায়শই সেই আলোচন আমরা এড়িয়ে যাই। পরিবর্তে কতগুলি বাধা বুলি দিয়ে নৈবেদ্য সাজাই। সেকুলার ভাবমূর্তিটুকু যদি আমাদের কাছে সমস্যার থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়, সেকুলারিজমের অভিমান যদি আমাদের কাছে বড় হয় তাহলে থাক আলোচনার প্রয়োজন নেই। ঝন্টু আলি শেখ, রুকসানা – ঈশিকাদের গল্প দিয়ে বিষ ফোড়াটা ঢেকে রাখুন। একদিন না একদিন সেটার বিস্ফোরণ ঘটবে। সেটা ফাটবেই এবং তার পুঁজ রক্ত একদিন আমাদেরও গায়ে লাগবে। আশার কথা একটাই যে আওয়াজ ওঠা শুরু হয়েছে। হিন্দু ধর্মে কোন কালেই সমালোচকের অভাব ছিল না, এখনও নেই। জনৈক আশিক ইকবাল সম্প্রতি নিজের ধর্মের ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে বলেছেন। এক শিক্ষক সমাজ মাধ্যমে ঘোষণা করেছেন তিনি ধর্মত্যাগ করছেন। তিনি নি-ধর্ম থাকবেন। প্রতিবাদে মুখর হয়েছে কাশ্মীর উপত্যকার ভাই বোনেরা। জানা পরিধির বাইরে আরো অনেকেই নিশ্চয়ই বলছেন। আসুন আমরা প্রতিবাদ করি, প্রশ্ন করি, উত্তর দেবার চেষ্টা করি। সমাজে সাম্প্রদায়িক সমস্যা আছে সেটা স্বীকার করে তার সমাধানের পথ খুঁজি, পরস্পরের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করি।
4 Comments
কে শুনবে একথা?
ReplyDeleteনা রাজনৈতিক নেতা, না ধর্মীয় নেতা।
বাকি রইল সাধারণ জনগণ।
তারা তো পরান্নভোজী ও পরমুখাপেক্ষী।
সত্যি কথা বলার মতো সাহস তাদের নেই।
রাজার বিরুদ্ধে কথা বললে যদি রাজকোপে পড়তে হয়!!!
ঠিকই
Deleteসৌমেন রায় অনেক প্রশ্নের সামনে নিজেকে এবং আমাদের দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন। সাম্প্রতিক ঘটনাবলী যে কোনো সংবেদনশীল মানুষকেই উদ্বিগ্ন করবে। যে দেশের কবির কন্ঠে একদা উচ্চারিত হয়েছিল সেই শাশ্বত মর্মবাণী - সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই, সেখানেই আজ নতুন করে মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে ধর্মান্ধতা। লজ্জা কোথায় রাখি!
ReplyDeleteআমাদের বোধহয় তথ্যগুলো জেনে রাখাই হবে । আমরা সমাধানের জোনে কোনও দিন প্রবেশ করতে পারবো না ।
ReplyDelete