জ্বলদর্চি

কবিতার তৃতীয় ভুবনে- ৫ / আরণ্যক বসু




কবিতার তৃতীয় ভুবনে, কণ্ঠে – উচ্চারণে


পর্ব - ৫



আ র ণ্য ক  ব সু


কণ্ঠচর্চা – শান্তরস থেকে রৌদ্ররসে




জন্মসূত্রে যা পেয়েছি সেটাই তলোয়ার,

মাইক্রোফোন না-ও যদি পাই, পরোয়া নেই কোনো;

আমি থেকে আমরা হবোই কণ্ঠসাধনাতে,

কবিতা আমার বজ্রমাণিক, দাঁড়িয়ে যাও – শোনো।




প্রিয় বাচিক শিল্পী বন্ধুরা ও পাঠক বন্ধুরা, যদি বলি, বসন্ত চোধুরী, কাজী সব্যসাচী, অমরীশ পুরী, অমিতাভ বচ্চন, অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, হেমন্ত মুখার্জী ও কিশোর কুমার – এঁদের মধ্যে সম্পর্ক কী? জানি, আপনারা নিশ্চয়ই উত্তর দেবেন - এঁরা প্রত্যেকেই ব্যারিটোন ভয়েসের অধিকারী, কণ্ঠ এঁদের সম্পদ। জন্মসূত্রে যা পেয়েছেন, তাঁরা সেই সম্পদকে সযত্নে রক্ষা করেছেন এবং ঠিকঠাক ব্যবহার করেছেন। আমরা রেকর্ডে, সিডিতে বা সিনেমায় এঁদের কণ্ঠস্বর শুনে আজও শিহরিত হই।


এবারে একটা অন্য কথা বলি। হেমন্ত মুখার্জী - নীল আকাশের নীচে এই পৃথিবী... এই গান দিয়ে অনুষ্ঠান শেষ করে স্টেজ থেকে নেমেছেন। তারপরেই উঠলেন ধুতি পাঞ্জাবী পরা আর একজন স্বনামধন্য গায়ক সতীনাথ মুখোপাধ্যায়। পাঠককে নিশ্চয়ই বলে দিতে হবেনা, হেমন্ত মুখার্জীর রাজকীয় ব্যারিটোন ভয়েসের পাশে সতীনাথবাবুর কণ্ঠস্বর দারুন সুরেলা, কিন্তু একটু চাপা। এবার সেই চাপা কণ্ঠেই চাঁপা ফুলের সৌরভ ছড়িয়ে তিনি যখন গেয়ে উঠলেন আর একটি অবিস্মরণীয় বাংলা গান - এলো বরষা যে সহসা মনে তাই, রিমঝিমঝিম রিমঝিমঝিম গান গেয়ে যাই – বুকে হাত দিয়ে বলুনতো, ঠিক একই রকম ভালো লাগলো না?


আরএকটা উদাহরণ দিই – ধরা যাক রবীন্দ্রসদনে কাজী সব্যসাচী বিদ্রোহী কবিতাটি আবৃত্তি করে তাঁর অনুষ্ঠান শেষ করলেন। তারপরে উঠলেন মহালয়ার চন্ডীপাঠখ্যাত কণ্ঠশিল্পী শ্রী বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। তিনি ধরলেন, রবীন্দ্রনাথের দেবতার গ্রাস – গ্রামে গ্রামে সেই বার্তা রটি গেল ক্রমে, মৈত্র মহাশয় যাবে সাগরসঙ্গমে, তীর্থস্নান লাগি.....

পাঠক, যদি স্মৃতিতে থাকে এমন কোনো অনুষ্ঠানের কথা তহলে কি দুটি আবৃত্তি নিবেদনের মধ্যে কোনো তুলনা আনতে পারবেন?


কণ্ঠস্বর যদি একেবারেই ফ্যাঁসফেসে বা ভাঙা-ভাঙা হয় তাহলে উপযুক্ত চিকিৎসা করে সারিয়ে নেওয়া প্রয়োজন। আমার কণ্ঠস্বর কেন ভরাট গম্ভীর হলোনা, এই ভেবে হতাশার সাগরে ডুবে যাবার কোনো মানে হয়না। গানের ক্ষেত্রে দেখবেন, একটু বসা বা চাপা গলাকেও কি সুন্দর ব্যবহার করছেন শিল্পী। মাইক্রোফোন যন্ত্রটিকে উপযুক্তভাবে ব্যবহার করতে শিখলে আপনাকে আটকাবার সাধ্য কারও নেই। বাড়ির হারমোনিয়ামে সা-পা তে আঙুল রেখে অনেকটা দম নিয়ে সা-ধ্বনি অথবা আ-ধ্বনি নিয়মিত অনুশীলন করুন। রবীন্দ্রনাথের এই লাইনগুলো ওই হারমোনিয়াম ধ্বনির সঙ্গে ধীরে ধীরে, দম নিয়ে উচ্চারণ করুন – ম্লান হয়ে এলো কণ্ঠে মন্দারমালিকা, হে মহেন্দ্র, নির্বাপিত জ্যোর্তিময় টিকা মলিন ললাটে।পুণ্যবল হলো ক্ষীণ, আজি মোর স্বর্গ হতে বিদায়ের দিন.....

অথবা, প্রেমেন্দ্র মিত্রের ‘জং’ কবিতাটি – হাওয়া বয় শনশন তারারা কাঁপে, হৃদয়ে কি জং ধরে পুরনো খাপে, কার চুল এলোমেলো কিবা তাতে এলো গেলো, কার চোখে কত জল কেবা তা মাপে....


আর, বাড়ির বাথরুমে, যেখানে আপনি একমাত্র ভারত সম্রাট, সেখানে এইসব ব্যকরণ ভুলে শাওয়ারের জলধারার নীচে দাঁড়িয়ে, পাগলা মনটাকে না বেঁধে, আপনার কণ্ঠকে ময়ুরপঙ্খী নাওয়ের বৈশাখী ঝড়ের ফুলে ফেঁপে ওঠা পাল করে দিন। গলা ছেড়ে ধরুন – উদয়ের পথে শুনি তার বাণী, ভয় নাই ওরে ভয় নাই, নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান, ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই।


দেখবেন, সঠিক অনুশীলন করলে, পাড়ার জনবহুল মোড়ের জনসভায় হঠাৎ বিকল হয়ে যাওয়া মাইক্রোফোনটি পাশে সরিয়ে দিয়ে আপনি অনায়াসেই শ-খানেক মানুষকে শুনিয়ে দিচ্ছেন – আমাদের সংগ্রাম চলবেই, জনতার সংগ্রাম চলবেই।


পরের সপ্তাহেও কণ্ঠস্বর সাধনার সংগ্রাম চলবেই। আবার দেখা হবে।





Post a Comment

3 Comments

  1. খুব ভালো লাগলো
    অনেক কিছু জানতে পারলাম
    আর আমার গুরুর গুরুর কথা শুনে আরো ভালো লাগলো

    ReplyDelete
  2. কি অপূর্ব লিখেছেন আপনি,অসাধারণ

    ReplyDelete
  3. স্মার্ট, খুব সুন্দর ছিলাটান বক্তব্যটি পড়ে ভালো লাগলো।

    ReplyDelete