জ্বলদর্চি

অহিংসার পূজারী--মহাত্মা গান্ধী / স্বরূপকুমার মণ্ডল

Priest of non-violence - Mahatma Gandhi

অহিংসার পূজারী--মহাত্মা গান্ধী

স্ব রূ প কু মা র  ম ণ্ড ল  

নিরঙ্কুশ রাজ কর্তৃত্বের অধিকারী নন, দুর্দান্ত সমরনায়ক নন, সুগভীর পাণ্ডিত্যের পরিচয়বাহিও নন, শাণিত ক্ষুরধার বাগ্মীও নন, অথচ অনন্য সাধারণ এমন এক গগনচুম্বী চাপরাস তাঁর চোখে মুখে বিচ্ছুরিত হচ্ছে যাঁর আকর্ষণে চরম শত্রুও আকৃষ্ট হয়ে তাঁর বাহুবন্ধনে ধরা দিয়েছেন। এমনই এক অমিততেজ কটিমাত্র বস্ত্রাবৃত তাগব্রতী সন্ন্যাসী, আমৃত্যু অহিংসার পূজারী, -- জাতির জনক হলেন --  মহাত্মা মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী।

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, মহাত্মার প্রচণ্ড মানবিক শক্তি গোটা দেশের বুকজোড়া জড়ত্বের জগদ্দল পাথরকে নাড়িয়ে দিয়েছে, কয়েক বৎসরের মধ্যে ভারতবর্ষের যেন রূপান্তর জন্মান্তর ঘটে গেল। ইনি আসার আগে দেশ ভয়ে আচ্ছন্ন, সংকোচে অভিভূত ছিল। সব দুঃখকে ছাড়িয়ে গেছে আজ এক আনন্দ। যে মাটিতে আমরা বেঁচে আছি, সঞ্চরণ করছি, সেই মাটিতেই একজন মহাপুরুষ, যাঁর তুলনা নেই, তিনি ভারতবর্ষে জন্মগ্রহণ  করেছিলেন।

একদিকে অহিংসার-ব্রত ও সত্যাগ্রহ এবং অন্যদিকে উদ্দীপিত তেজ ও অপার মানবিক সাহস শুধু তাঁর ব্যক্তিজীবনকে প্রভাবিত করেনি, তিনি তা সমগ্র ভারতীয় উপ-মহাদেশে সঞ্চারিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। কোনও জাগতিক বাধার সামনে তিনি নতজানু হননি, সাময়িক উত্তেজনা কিংবা তাৎক্ষণিক লাভের জন্য ব্যক্তি স্বার্থলিপ্ত কোনও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেননি, সমস্ত রকম বিকৃতি ও আপসের ঊর্ধ্বে ছিলেন। তাঁর জাতীয়তাবাদ চেতনা ও কর্মকাণ্ড প্রায় দুশো বছরের শোষিত ভারতবাসীকে মুক্তির স্বাদ এনে দেয়। তাঁর অহিংসা ও সত্যাগ্রহের আদর্শের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল সুগভীর মানব প্রেম। অহিংসার পূজারী গান্ধীজির জীবন ছিল তাঁর বাণী। 

সারা জীবন তিনি সাম্প্রদায়িকসম্প্রীতি রক্ষার চেষ্টা করেছেন। তিনি বলেছেন, " ভালোবাসার আগুনে কঠিন জিনিসও গোলে যায়। যদি না গোলে তাহলে বুঝবে আগুনের জোর কম।" তিনি আরও বলেছেন, "অহিংসা দুর্বলের অস্ত্র নয়, সবলের শক্তি।"

 বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে তিনি 'মহাত্মা', নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর কাছে তিনি 'জাতির জনক', পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুর কাছে তিনি 'আলোর ঝলক'। জওহরলাল নেহরু তাঁর 'Discovery of India' গ্রন্থে লিখেছেন 'He was like a powerful current of fresh air.' তিনি ছিলেন আলোকের ঝলকের মতো, যা অন্ধকার ভেদ করে আমাদের চোখের সামনের পর্দাগুলো সরিয়ে দিলেন। ঝড়ের মতো এলেন তিনি তাতে কত কি উড়ে গেল। সব থেকে উড়ে গেল মানুষের চিন্তা করার পুরোনো পদ্ধতি। তাঁর হাত ধরেই পরাধীন ভারতের জাতীয় সংগ্রাম সর্ব ভারতীয় গণআন্দোলনের রূপ ধারণ করেছিল।

   এমনই এক মহামানবের আবির্ভাব ঘটে ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দের ২ রা অক্টোবর গুজরাটের পোর বন্দরে এক নিষ্ঠাবান বৈষ্ণব পরিবারে, মা পুতলী বাঈ ছিলেন একজন ধর্মপ্রাণা মহিলা। বাবা করমচাদঁ উত্তমচাঁদ গান্ধীর (কাবা গান্ধী) বেশ কিছু পার্সি ও মুসলিম বন্ধু ছিলেন। এর ফলে তিনি শৈশব থেকেই বিভিন্ন ধরনের মানুষের সঙ্গে মেশার সুযোগ পান এবং  ধর্মীয় ব্যাপারে উদার হন। বাবার সাহসিকতা ও সাধুতার মন্ত্রে দীক্ষিত হন। অন্য দিকে ধার্মিক মায়ের সাথে থেকে জীবের প্রতি অহিংসা, নিরামিষ ভোজন ও আত্মশুদ্ধির জন্য উপবাসে থাকা ইত্যাদি শেখেন। তিনি কোনো প্রাণীকে হত্যা করা তো দূর কথা - প্রাণিজাত ঔষধ, দুধ, ডিম, মাছ, মাংস ভক্ষণ করতেন না। বিদ্যালয়ের শিক্ষক বিনা দোষে জরিমানা ও শাস্তি দিলেও তিনি কখনো অশ্রদ্ধা বা হিংসা প্রদর্শন করেননি। এককথায় গান্ধীজির 'মহাত্মা' হয়ে ওঠার বীজমন্ত্র তিনি পরিবার থেকেই লাভ করেছিলেন। ১৮৭৬ সালে রাজকোর্টের পাঠশালায় ও ১৮৮১ সালে পোর বন্দরের ইংরেজি বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ছাত্র জীবনে গান্ধীজি মাঝারি মানের ছাত্র ছিলেন। মাত্র ১৩ বছর বয়সে কস্তুরবাঈ - এর সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।

        ১৮ বছর বয়সে তিনি দেশের পড়াশুনা শেষ করে ১৮৮৮ সালে ব্যারিস্টারি পড়ার জন্য বিলেত(লন্ডন) যাত্রা করেন। ১৮৯১ সালে ১৩ জুন তিনি ব্যারিস্টারি পাশ করে ভারতে ফিরে আইন ব্যাবসা শুরু করেন। কিন্তু ভারতে ব্যাবসায় প্রসার ঘটাতে না পারায় ১৮৯৩ সালে তিনি একটি ভারতীয় প্রতিষ্ঠানের আইন উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করার উদ্দেশ্যে দক্ষিণ আফ্রিকার নাটালে যান। সেখানেই তাঁর রাজনৈতিক জীবনের সূচনা হয়। যদিও তখন তাঁর কোনো রাজনৈতিক স্বপ্ন ও আদর্শ ছিল না। জীবিকার অন্বেষণে প্রায় দশ হাজার ভারতীয় দক্ষিণ আফ্রিকায় বসবাস করত। বর্ণ বৈষম্যের কারণে সেখানে বসবাস কারী ভারতীয়দের কোনো নাগরিক অধিকার ছিল না এবং সেখানকার শ্বেতাঙ্গ সরকার তাদের ওপর নানাভাবে অত্যাচার করত। গান্ধীজিও বহুবার এর শিকার হন। তিনি এই অত্যাচারের প্রতিবাদে দক্ষিণ আফ্রিকায় বসবাসকারী  ভারতীয়দের নিয়ে 'নাটাল ইন্ডিয়ান কংগ্রেস' প্রতিষ্ঠা করে বিভিন্ন দাবিতে সম্পূর্ণ অহিংসা ও সত্যাগ্রহের পথে আন্দোলন শুরু করেন। শেষে ১৯১৪ সালে আন্দোলনের চাপে শ্বেতাঙ্গ সরকার "ইন্ডিয়ান রিলিফ আইন'' পাশ করলে গান্ধীজি আন্দোলন প্রত্যাহার করেন। শুরু হলো গান্ধীজির রাজনৈতিক জীবন।

      প্লেটো, অ্যারিস্টটল, হেগেল, মার্কস লেনিন প্রমুখের মতো গান্ধীজি রাষ্ট্রদার্শনিক না হলেও রাষ্ট্রনৈতিক চিন্তার ইতিহাসে তাঁর অবদান অপরিসীম। সত্য, অহিংসা, সত্যাগ্রহ, সর্বোদয় প্রভৃতি ছিল গান্ধীজির  নিজস্ব মতাদর্শ। গান্ধীজি ছিলেন সত্যের পূজারী। তাঁর মতাদর্শের মূল নীতি হলো অহিংসা। তাঁর মতে, ''অহিংসা" হলো পারস্পরিক ভালোবাসা ও সম্প্রীতির এক অটুট বন্ধন।আবার ''সত্যাগ্রহ'' হলো ব্যক্তির আত্মপীড়ণের মাধ্যমে স্বাধিকার অর্জনের এক প্রচেষ্টা। "সর্বোদয়'' কথার অর্থ হলো সমাজের সকল শ্রেণীর মানুষের কল্যাণ।

     মহাত্মা গান্ধীর ঘনিষ্ট সহযোগী নৃ বিজ্ঞানী নির্মল কুমার বসু তাঁর সত্যাগ্রহের মুলসূত্র ও সত্যাগ্রহের প্রয়োগ প্রবন্ধে বলেছেন,গান্ধীজি যা কিছু করতেন তাঁর পিছনে এক স্বাধীন গণতান্ত্রিক জনমত ও প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলাই তাঁর সর্বোত্তম লক্ষ ছিল। আত্মনির্ভরশীল হওয়ার চেষ্টা করলে তবেই মানুষ আত্মনির্ভরশীল হয়। মুক্তির অন্য কোনো পথ নাই। গান্ধীজির দৃঢ় ধারণা হয়েছিল যে ভারতবর্ষের মতো দেশে যদি হিংসার দ্বারা স্বাধীনতা লাভ ঘটে তাহলে সমস্ত রাষ্ট্রনৈতিক ক্ষমতা হিংসার প্রয়োগকারী শ্রেণী বিশেষের আয়ত্তে পুঞ্জীভূত হবে। সেজন্যই ১৯৩৮ সালে গান্ধীজি হরিজন পত্রিকায় বলেছিলেন, ''I am essentially a nonviolent man and I believe in war bereft of every trace of violence.'' সত্যের সন্ধান করতে গিয়েই গান্ধীজি খুঁজে পেয়েছিলেন অহিংসাকে। গান্ধীজির ভাষায়:-''অহিংসাকে আমি পুনরুদ্ধার করেছি মাত্র, নতুন করে আবিষ্কার করিনি।'' তিনি তাঁর সংগ্রামের নাম দিয়েছিলেন-''সত্যাগ্রহ''। গান্ধীজির মতে সত্যাগ্রহীরা হবেন অহিংসার পূজারী। অহিংসাই হবে সত্যাগ্রহীদের জীবন ও কর্মের ব্রত। গান্ধীজি বলেছেন, ''আমার জীবনই আমার বাণী'' ------ একথা বড় সত্যি হয়ে দেখা দিয়েছে তাঁর সুদীর্ঘ জীবনে। তাঁর সঞ্জীবনী এবং অমৃতময় বাণীর মধ্যে রয়েছে তাঁর চিন্তা-ভাবনা। তিনি অবশ্যই ছিলেন দার্শনিক, কিন্তু কেতাবি অর্থে নয়। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে গান্ধীজির অনেক বিষয়ে মতান্তর ছিল, কিন্তু কখনোই মনান্তর ঘটেনি। এককথায় বলা চলে জাতিভেদ ও অস্পৃশ্যতা-বিরোধী, স্বাধীনতা প্রয়াসী, দেশপ্রেমিক, মানবতাবাদী গান্ধীজি ছিলেন ভারতবর্ষের অন্যতম প্রাণপুরুষ।

       ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দের ২৩ জুন পলাশীর আম্রকাননে ভারতের স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়। তারপর থেকে প্রথমে ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি ও পরে ব্রিটিশ সরকারের শাসনকালে জাতি-ধর্ম-বর্ণ-স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে অসহায় ভারতবাসী শাসিত, শোষিত নির্যাতিত ও নিপীড়িত হচ্ছিল। সমস্ত রকম অত্যাচারের বিরুদ্ধে আপামর ভারতবাসীকে ঐক্যবদ্ধ করে ব্রিটিশবিরোধী সর্বভারতীয় গণ আন্দোলন গড়ে তোলার মতো যোগ্য নেতার অভাব বোধ করছিল। ঠিক এমনই এক সন্ধিক্ষণে পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরুর কথায়: ''আলোর ঝলকের ন্যায় ১৯১৫ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ভারতে ফিরে ভারতবর্ষের জাতীয় মুক্তি আন্দোলন তথা স্বাধীনতা আন্দোলনের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন গান্ধীজি।

১৯১৭-১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে বিহারের চম্পারণে নীল চাষীদের ওপর নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে তিনি সত্যাগ্রহ আন্দোলন শুরু করেন।''চম্পারণ সত্যাগ্রহ'' ছিল পরাধীন ভারতবর্ষে গান্ধীজির প্রথম সত্যাগ্রহ আন্দোলন।গান্ধীজির নেতৃত্বে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন তিনটি বড় আন্দোলন সংগঠিত হয়। 
যথা:-(১) ১৯২০ সালে অহিংস অসহযোগ আন্দোলন;
    (২)  ১৯৩০  সালে  আইন  অমান্য  আন্দোলন ও  
    (৩) ১৯৪২ সালে ভারত ছাড়ো আন্দোলন।

       গান্ধীজির নেতৃত্বে তৃতীয় বড় গণআন্দোলন হলো ''ভারত ছাড়ো'' আন্দোলন। বোম্বাই বর্তমানে মুম্বাই শহরে ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে আগস্ট মাসে মহাত্মাজি ইংরেজ সরকারকে শেষ সাবধান বাণী শুনিয়ে দিলেন, ''Quit India''-  ভারত ছাড়ো। ভারতকে শাসন করবার কোনো নৈতিক অধিকারই ব্রিটিশদের নেই। আর দেশবাসীকে দিলেন অগ্নিময় এক মন্ত্র-- ''Do or Die''--''करेंगे या मरेंगे''--- ''করব নয় মরব।''

সশস্ত্র অহিংস পাশব শক্তির অধিকারী ব্রিটিশের বিরুদ্ধে নিরস্ত্র অহিংস ভারত - বাসীর বুক পেতে দেওয়ার অভূতপূর্ব বিপ্লবের ধাক্কা ব্রিটিশ শক্তি সামলাতে পারলেন না,--যার অনিবার্য ফলশ্রুতি ভারতবর্ষের স্বাধীনতা লাভ।উল্লেখ্য যে, ভারত ছাড়ো আন্দোলন চলাকালীন ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দের ৪ জুন নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু রেঙ্গুনে আজাদ হিন্দ রেডিও থেকে বৃহত্তর সংগ্রামে নামার আগে গান্ধীজির কাছে আশীর্বাদ চেয়ে তাঁকে প্রথম ''জাতির জনক'' আখ্যায় ভূষিত করে বলেন--- ''Father of our Nation in this holy war for India's liberation, we ask for your blessings and good wishes.''

      গান্ধীজি হিংসাশ্রয়ী আন্দোলনের পক্ষপাতী ছিলেন না, তিনি ছিলেন অহিংসার পূজারী, ফলে মাস্টারদা সূর্যসেন, বিনয়-বাদল-দীনেশ, ভগৎ সিং এমনকি নেতাজি সুভাষ চন্দ্রের নেতৃত্বে আজাদ - হিন্দ বাহিনীর অভিযান, এমনকি ১৯৪৬এর রয়েল ইন্ডিয়ান নেভির-নৌবিদ্রোহকেও সমর্থন করেননি। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি তাঁর রাজনীতির প্রধান উদ্দেশ্য ছিল, সেজন্য ব্রিটিশ সরকারের ভারত বিভাগের প্রস্তাবকে তিনি তীব্র ভাবে বাধা দেন। তিনি দেশ ভাগের স্বাধীনতা চাননি। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বিরুদ্ধে প্রতিরোধের প্রাচীর হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন নিঃসঙ্গ গান্ধীজি। তিনি কখনও নোয়াখালীতে, কখনও বিহারে কখনও কলকাতাতে ছুটেছেন। সেইজন্য মাউন্টব্যাটেন তাঁকে আখ্যা দিয়েছিলেন, ''One man boundary force." গান্ধীজি মনে করতেন, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা- হাঙ্গামার মূলে ধর্ম, রাজনীতি, অর্থনীতির সমস্যাই একমাত্র সমাধানের পথ নয় -- এর জন্য সবথেকে বেশি প্রয়োজন মানুষের প্রতি মানুষের বিশ্বাস ও ভালোবাসা, ঐক্য স্থাপন অর্থাৎ মানব প্রেমের উন্মেষ ঘটানো। যার নাম অহিংসা। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় যিনি অহিংসার পূজারী, তাকেই ১৯৪৮  সালের ৩০ জানুয়ারি বিকেল বেলায় এক প্রার্থনা সভায় অগণিত জনতার মাঝখানে এক আততায়ী নাথুরাম গডসের বন্ধুকের গুলিতে অন্তিম নিদ্রায় নিদ্রিত হতে হল।

       মহাত্মা গান্ধী ছিলেন বহুমুখী সম্পাদক। তাঁর সম্পাদিত পত্রিকাগুলো হল- 'হরিজন', 'ইন্ডিয়ান অপিনিয়ন', 'ইয়াং ইন্ডিয়া', হিন্দিতে- 'नबोजिबन'। 
উল্লেখযোগ্য বই গুলো হল --' My experiments with truth' (১৯২৭), 'হিন্দ স্বরাজ' প্রভৃতি। 

      গান্ধীজির রাজনীতির সঙ্গে ধর্মের একটু গূঢ় সম্পর্ক ছিল। এখানেই তাঁর জনপ্রিয়তা আবার এখানেই তাঁর সীমাবদ্ধতা। সমাজ ব্যবস্থার কি কি অন্তর্নিহিত কারণে নিচু তোলার মানুষ দুঃসহ দারিদ্র‍্য যন্ত্রণা ভোগ করে, তাঁর মূলে গান্ধীজি পৌঁছাতে চাননি, সমাজে যে শ্রেণী-বৈষম্য,বর্ণ-বৈষম্য , - এতকাল কায়েমি স্বার্থকে রক্ষা করে এসেছে, তাঁর শাস্ত্রীয় আবরণ ছিন্ন-ভিন্ন করেছেন গান্ধীজি। সেগুলিকে অচল-অনড় রেখেই হরিজন আন্দোলন, অস্পৃশ্যতা বর্জন ও নরনারায়ণ সেবাকে প্রাধান্য দিয়েছেন। সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজদের দমন - পীড়ন ও জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যা কাণ্ডের প্রতিবাদে তিনি ইংরেজ সরকার প্রদত্ত 'কাইজার-ই-হিন্দ' পদক প্রত্যাখ্যান করেন। মত ও পথের দিক থেকে জাতীয় নেতাদের মধ্যে গান্ধীজি ছিলেন সবচেয়ে নরমপন্থী কিন্তু ব্যক্তি হিসাবে নির্ভীক ও দৃঢ়চেতা। তাই বার-বার ইংরেজ সরকার জনগণের ওপর তাঁর প্রভাব খর্ব করতে তাঁকে বন্দি করে। ১৯২২ সালে অহিংস অসহযোগ আন্দোলন ৬ বছর কারাদণ্ড - স্বাস্থ্যের কারণে ১৯২৪ সালে মুক্তি। ১৯৪২ সালে ভারত ছাড়ো আন্দোলনে কারাবাস - ১৯৪৫ সালের জুন মাসে মুক্তি। এইভাবে তিনি পরাধীন ভারতের স্বাধীনতার জন্য একাধিক বার কারাবরণ করেছেন। ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দ থেকে মৃত্যু পর্যন্ত তিন দশক ধরে তিনি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের মধ্যমণি ছিলেন। গান্ধীজির স্বরাজ ভাবনা ও রাষ্ট্রদর্শন ছিল সকল সমালোচনার ঊর্ধে। তাঁর আন্দোলন ছিল 'পূর্ণ স্বরাজের' জন্য। বুনিয়াদি শিক্ষা,জাতপাত - অস্পৃশ্যতা বিরোধী আইন,সংখ্যা লঘুদের অধিকার স্বীকৃতি, বিকেন্দ্রিক শাসন ব্যবস্থা, স্থানীয় স্বায়ত্ত শাসন ব্যবস্থা তথা পঞ্চায়েতী রাজ ব্যাবস্থা-সর্বত্রই গান্ধীজির প্রভাব পরিলক্ষিত হয়।

       পরিশেষে গান্ধীজির কথায় বলা যায়, বসুন্ধরা তার বুকে বসবাসকারী প্রাণীদের অভাব দূর করার জন্য যথেষ্টই দিয়েছে, মানুষের অভাব-পূরণের ব্যবস্থা কর, কিন্তু তাদের লোভ বাড়িয়ে তুলো না। অর্থাৎ কিছু দিয়ে নয়, কর্মসংস্থানের মাধ্যমে মানুষের অভাব দূর করতে হবে। আর ঘৃণা ও অবিশ্বাস এর পরিবর্তে ভালোবাসার মধ্য দিয়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অটুট করতে হবে - তবেই দেশও দশের সামগ্রিক উন্নয়ণ ঘটবে, গান্ধীজি ও গান্ধীজির দর্শনকে সম্মান জানানো হবে। নোবেলজয়ী অমর্ত্য সেনের কথায়: গান্ধীজির মূল লক্ষ ছিলো সেই সমাজ গড়ে তোলা- যেখানে হিংসার চর্চা হয় না। অর্থাৎ সন্ত্রাসমুক্ত  সমাজ। আমাদিকেও সকল রাজনীতির ঊর্ধ্বে থেকে সেই লক্ষ্যে এগোতে হবে। তবেই ২রা অক্টোবর দিনটি উৎযাপন সার্থক হয়ে উঠবে। 
          

Post a Comment

4 Comments

  1. গন আন্দোলন এর সূচনা তাঁর হাতে হয়। সর্বভারতীয় ও তাতে সাধারণ মানুষের যোগদান সম্ভবপর করেন তিনি ই।

    ReplyDelete
  2. খুব সুন্দর লেখা ।

    ReplyDelete