জ্বলদর্চি

ভারততত্ত্বের প্রবক্তা দার্শনিক ও শিক্ষাবিদ রাধাকৃষ্ণন



ভারততত্ত্বের প্রবক্তা
দার্শনিক ও শিক্ষাবিদ রাধাকৃষ্ণন


ম ঙ্গ ল প্র সা দ  মা ই তি

মানুষটি ভারতবর্ষের মতো একটি বৃহত্‍ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে (১৯৫২-১৯৬২)দু’দুবার উপরাষ্ট্রপতির পদ অলঙ্কৃত করেছেন। ১৯৬২-১৯৬৭ এই পাঁচবছর হয়েছেন এই ভারতবর্ষেরই প্রথম নাগরিক অর্থাত্‍ সর্বোচ্চপদের অধিকারী রাষ্ট্রপতি। অত্যন্ত দক্ষতার সাথে এবং তুখোড় রাজনীতিবিদ হিসাবে এই গৌরবজনক পদের দায়িত্ব তিনি সামলেছেন। তিনি যদি স্বেচ্ছায় সরে আসতে না চাইতেন তবে আরো পাঁচবছর তিনি অনায়াসে রাষ্ট্রপতি পদে বহাল থাকতে পারতেন। এ এক অসাধারণ ঘটনা, বিরল কৃতিত্ব। এই সবকে ছাড়িয়েও তিনিই আবার আপামর ভারতবাসীর কাছে তো বটেই সারা বিশ্বের দরবারে অন্যতম সেরা দার্শনিক, চিন্তাবিদ হিসাবে চিহ্নিত হয়েছেন। আমাদের ভারতবর্ষের মানুষেরা তাঁকে পেয়েছি অন্যতম সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষক হিসাবে। হ্যাঁ, এই মানুষটি হলেন ড. সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন।
   ১৮৮৮ সালের ৫ সেপ্টেম্বর, মাদ্রাজের তিরূতানি গ্রামে এক তেলেগু গোঁড়া ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। অতলান্ত জ্ঞান ও প্রজ্ঞার অধিকারী এই মানুষটির ছোটবেলা থেকেই ছিল প্রচণ্ড বই পড়ার নেশা। হাতের সামনে যে কোনো বই পেলেই তিনি সেটা না শেষ করে ছাড়তেন না। বই পড়তে পড়তে তিনি তার মধ্যে এতটাই বুঁদ ও একাত্ম হয়ে যেতেন মনে হতো তিনি যেন বাহ্যজ্ঞান লোপ পেয়েছেন। যে বয়সে শিশুরা হেসে-খেলে ছুটে বেড়ায়, খেলাও অন্যান্য বিনোদনের মধে ডুবে থাকতে পছন্দ করে সেখানে রাধাকৃষ্ণাণ ছিলেন সম্পূর্ণ অন্য ধরণের। বই ছাড়া অন্যকিছুতে তিনি যেন শান্তি পেতেন না। বই ছিল যেন তার কাছে মুক্তির জগত, আনন্দের জগত। তাঁর এই তীব্র বই পড়ার নেশা দেখে তাঁর মা পর্যন্ত একসময় ভীত হয়েছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন তাঁর এই সন্তানকে হয়তো তিনি সংসারে বেঁধে রাখতে পারবেন না। তাঁর মধ্যে এই আশঙ্কা পর্যন্ত তৈরি হয়ে তাঁর এই সন্তান বাড়ি-ঘর ত্যাগ করে বিবাগী বা সন্ন্যাসী হয়ে না যায়। এক জ্ঞাতিতুতো ভাইয়ের কাছে দর্শনের একটি বই পড়ে দর্শন শাস্ত্রের প্রতি তীব্র অনুরাগ জন্মে রাধাকৃষ্ণণের। 
   দর্শনের মধ্যে তিনি এমন এক রসদ খুঁজে পান যে পরবর্তীকালে ইতিহাসের ছাত্র হয়েও দর্শনকে তিনি ধ্যান-জ্ঞান করে নেন। বই পড়ার প্রতি দুরন্ত টান ও আকর্ষণ তাঁকে এতটাই অকর্ষিত করেছিল  একের পর এক ক্লাসের পরীক্ষায় অসামান্য কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হন। আমরা লক্ষ্য করি বিদ্যালয়, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো পরীক্ষাতেই প্রথম ছাড়া দ্বিতীয় হননি। যে অসামান্য কৃতিত্ব পৃথিবীতে খুব কম মানুষেরই আছে। 
   ১৮৯৬-১৯০০ এই চারবছর রাধাকৃষ্ণন তিরুপতি শহরের এক খ্রিস্টান মিশনারী বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। এখানে পড়তে পড়তেই তিনি পাশ্চাত্য সভ্যতার সংস্পর্শে আসেন। ধর্মকেন্দ্রিক এই বিদ্যালয়টি তাঁকে চরিত্র গড়তে প্রভূত সাহায্য করেছিল। এখানকার নিয়ম-শৃংখলা, অনুশাসনে মুগ্ধ হয়ে তিনি আরও যেন বইপ্রেমী হয়ে উঠলেন। বালক রাধাকৃষ্ণণ শুধু পাঠ্যপুস্তকের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকলেন না। তার বাইরেও বই পড়াতে বিশেষ আগ্রহী হয়ে উঠলেন। ধীরে ধীরে তাঁর মনের আকাশ যেন খুলে গেল। ১৯০০ সালে তিনি এসে ভর্তি হলেন ভেলোর কলেজে। এখনে এসে তিনি তামিল সংস্কৃতির সঙ্গে গভীরভাবে পরিচিত হলেন। একই সঙ্গে কৈশোরের এই দিনগুলিতেই তিনি পরিচিত যুগপুরুষ স্বামী বিবেকানন্দের রচনাবলির সঙ্গে। বিবেকানন্দের বাণী, তাঁর উপদেশ, এবং রচনা পড়ে তিনি যেন এক নতুন আলোর সন্ধান পেলেন। জীবনের এক মহাপথের দিক তাঁর সামনে উন্মোচিত হয়ে গেল। এরপর ১৯০৪-১৯০৮ সাল এই চারবছর তিনি মাদ্রাজের খ্রিস্টান কলেজে পড়াশোনা করলেন। আমরা অবাক হয়ে যাই যে সময়ে ছাত্রছাত্রীরা বিনোদনের জগতে ডুবে থাকে, আমোদ-প্রমোদে ব্যস্ত থাকতে ভালোবাসে সে সময়ে রাধাকৃষ্ণণ পারমাত্মিক বিষয়ের অনুসন্ধান করে চলেছেন। আগামী দিনে ভারতবর্ষ যে এক বিরাট মনীষীকে পেতে চলেছে সেটা বুঝতে পারা গিয়েছিল রাধাকৃষ্ণনের বালকবেলার অস্বাভাবিক ঘটনাগুলি দেখলেই। 
   ১৯০৯ সালে রাধাকৃষ্ণনের মাদ্রাজের প্রেসিডেন্সি কলেজে এপ্রিল মাসে অধ্যাপক নিযুক্ত হন। এই কলেজের ছাত্রছাত্রীরা এই তরুণ–নতুন অধ্যাপককে পেয়ে ভীষণ খুশি। বাগ্মী রাধাকৃষ্ণর দর্শনশাস্ত্রের উপর অগাধ জ্ঞান ও পাণ্ডিত্য এখানকার ছাত্রত্রীদের এতটাই মুগ্ধ ও প্রীত করেছিল যে তিনি যখন ক্লাসে পড়াতেন তারা সকলে নিশ্চুপ হয়ে যেত। একটা পিন পড়লেও বুঝি তার শব্দ শোনা যেত। শুধু সেই ক্লাসের ছাত্র-ছাত্রীরাই নয় অন্য ক্লাসের ছাত্রছাত্রীরাও করিডোরে এসে ভিড় করত রাধাকৃষ্ণনের সাবলীল, প্রাঞ্জল বক্তব্য শোনার জন্য। এমনকি বিজ্ঞান বিষয়ের উপর পড়াশোনা করা ছাত্রছাত্রীরাও ছুটে আসত যুক্তি দিয়ে বোঝানো তাঁর ক্লাস দেখতে। যে ঘটনাগুলো আমরা দেখলে বিস্ময়ে অবাক হয়ে যাই। ১৯২২ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের আমন্ত্রণ পেয়ে চলে আসেন কলকাতা। এখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি পঞ্চম জর্জের নামাঙ্কিত প্রফেসর অফ ফিলোজফি নামে দর্শন বিভাগের একজন অধ্যাপক হিসাবে যোগদান করেন।তখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যায়ের নাম-ডাক দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়েছে। সংস্কৃতির পীঠস্থান কলকাতার সঙ্গে রাধাকৃষ্ণনের আত্মিক মেলবন্ধন গড়ে উঠল। 
  অধ্যাপক থাকাকালীন তো বটেই ছাত্রাবস্থা থেকেই তিনি দর্শন, ধর্ম, অধ্যাত্মবাদ বিষয়ের উপর নিরন্তর গবেষণা করে গেছেন। আগেই বলেছি রাধাকৃষ্ণণ ১৯০৯ সালে মাদ্রাজের প্রেসিডেন্সি কলেজ অধ্যাপকের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। এখানে তিনি সাত বছর অধ্যাপনা করেন। এই সময়েই তিনি গীতা, উপনিষদ, ব্রহ্মশাস্ত্র ইত্যাদি প্রাচীন হিন্দুশাস্ত্রগুলি পড়ে ফেলেন। এই সব শাস্ত্রের উপর লেখা শংকর, রামানুজ, মধ্ব, লিম্বাত্‍ প্রমুখ আচার্যদের ভাষ্যগুলিও তিনি পাঠ করেন। অধ্যয়ন করেন বৌদ্ধধর্মের বিষয়গুলি। ১৯১১ সালে তিনি ‘লরিয়েট ইন টিচিং’ উপাধি লাভ করেন। যখন রাধাকৃষ্ণনের বয়স মাত্র তেইশ। অধ্যাপনার কাজে মুগ্ধ হয়ে কলেজ কর্তৃপক্ষ তাঁকে এই উপাধি দেন। রাধাকৃষ্ণণের আগে বা পরে কেউ এত কম বয়সে এই উপাধি লাভ করতে পারেননি। এটাও একটা তাঁর জীবনে বিরল ঘটনা।
   দর্শনশাস্ত্রের অধ্যাপনার সুত্রে রাধাকৃষ্ণন পাশ্চাত্যের বহু মনীষীর অমূল্য সব লেখনীর সঙ্গে পরিচিত হলেন। প্লেটো, প্লাতিমাস, কাণ্ট বাডলি, বার্গসঁ প্রমুখদের সম্বন্ধে জানলেন। স্পষ্টতই তিনি বুঝতে পারলেন প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যের দর্শন ভাবনার মধ্যে একটা মৌলিক প্রভেদ ও পার্থক্য বিদ্যমান। তিনি তুলনামূলকভাবে বিচার করে দেখলেন পাশ্চাত্যের দর্শনের মধ্যে ব্যবহারিক দিকটা বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, বাস্তবের সঙ্গে স্বভাবতই যেটা মিশে আছে। আর প্রাচ্যের দার্শনিকরা অতিন্দ্রীয়বাদকে বেশী প্রধান্য দিয়েছেন। যেখানে ত্যাগ ও নৈতিকতাকে জীবনের মস্তবড়ো আদর্শ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। গভীরভাবে উপলব্ধি করে রাধাকৃষ্ণন দেখলেন সকলে বিভিন্ন পথের পথের পথিক হলেও উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য কিন্তু সকলের এক। রাধাকৃষ্ণন প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের দার্শনিকদের মধ্যে একটা মেলবন্ধন স্থাপন করার প্রয়াস চালিয়ে গেছেন। 
   এমন একজন মনীষী, বিদগ্ধ পণ্ডিত, অতলান্ত প্রজ্ঞার অধিকারী তাঁর দর্শনভাবনা ও চিন্তার মণিমুক্তোগুলিকে যে তিনি গ্রন্থের মধ্যে লিপিবদ্ধ করবেন এটাই স্বাভাবিক। লিখেছেনও বহু অমূল্য গ্রন্থ। সেই গ্রন্থগুলি হল –“Religion in Contemporary Phylosophy”-সমকালীন দর্শনে ধর্মের স্থান, এটি একটি সংকলন গ্রন্থ। যেটি প্রকাশ করেন ১৯২০ সালে ম্যাকমিলন কোম্পানি। ১৯২৩ সালে  প্রকাশিত হয় “Indian Philosophy” (প্রথম খণ্ড ও দ্বিতীয় খণ্ড)। বিদগ্ধ সমালোচকগণ মনে করেন রাধাকৃষ্ণন যদি আর কোনো গ্রন্থও না লিখতেন শুধু এই গ্রন্থটির জন্যই চির অমর হয়ে থাকতেন। ”The Hindu  view of Life”-এটিও রাধাকৃষ্ণনের একটি সংকলন গ্রন্থ। ১৯২৭ সালে সে ভাষণগুলি তিনি দিয়েছিলেন সেই ভাষণগুলিকে সংকলন করে এই পুস্তকটি প্রকাশিত হয়।  “Philosophy of Rabindranath Tagore”-বা রবীন্দ্রদর্শন। রাধাকৃষ্ণণের এইই বইটি প্রকাশিত হয় ১৯১৮ সালে।  “Essential of Phychology”- বা মনস্তত্ত্বের প্রধান বিষয়বস্তু, “My search for Truth” বা আমার সত্য সন্ধান ইত্যাদি।
   ১৯০৮ সালে রাধাকৃষ্ণনের একটি মৌলিক প্রবন্ধ “The Ethics of the Vedanta and its metaphysical presupposition” পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয়। এর পিছনে একটা ইতিহাস আছে। তখন রাধাকৃষ্ণনের বয়স মাত্র কুড়ি। মাদ্রাজ কলেজের ছাত্র তখন তিনি। সেই সময় মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়ে এম. এ. ক্লাসে পাঠরত ছাত্রছাত্রীদের একটা প্রবন্ধ লিখতে দেওয়া দেওয়া। এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে রাধাকৃষ্ণন লিখলেন “Ethics of the Vedanta”। এই প্রবন্ধটি পড়ে বিচারকমণ্ডলী চমৎকৃত হয়ে গেলেন। একজন তরুণ ছাত্রের লেখার মধ্যে এমন জ্ঞান ও বিচার বিশ্লেষণ ক্ষমতা দেখে তাঁর রীতিমতো হলেন মুগ্ধ ও আনন্দিত। এই সময়ে মাদ্রাজ খ্রিস্টান কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন হগ সাহেব। তিনি ছিলেন প্রকৃত অর্থেই একজন শিক্ষাবিদ। ভারতীয় দর্শন এবং ভারতীয় সংস্কৃতির উপর যথেষ্ট জ্ঞান ছিল। তিনি তো রাধাকৃষ্ণনের এই মৌলিক প্রবন্ধটি পড়ে একেবারে আনন্দে মতোয়ারা হয়ে গেলেন। একজন ছাত্রের লেখার ভাষা এত সুন্দর ও প্রাঞ্জল হতে পারে তিনি ভাবতেই পারেননি। তিনি ভেবেই ফেললেন এই ছাত্রটি একদিন সারা বিশ্বে নাম করবে।
এই মৌলিক প্রবন্ধটি কলেজের প্রকাশনা বিভাগ থেকে প্রকাশিত হল। সমগ্র বিশ্বের ইতিহাসে এরকম ঘটনা খুব কমই ঘটেছে। তাঁর লেখা আরো যে গ্রন্থগুলি আছে  তা হল- “The Religion We Need” (১৯২৪), “East and West in Religion” (১৯৩৩), “India and China”-১৯৪৪, “Religion of Society”-১৯৪৭, “Principal of Upanisad”-১৯৫৩, “Recovery of Faith”-১৯৫৫, “Sourse Book of Philosophy”-১৯৫৭, “Religionin a Changing World”-পরিবর্তিত বসুন্ধরায় ধর্মের স্থান, ১৯৬৭ ইত্যাদি।    
   এছাড়াও রাধাকৃষ্ণণের বহু প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। যেগুলি তিনি বিভিন্ন আলোচনা সভা আর সেমিনারে বক্তব্য হিসাবে রেখেছিলেন। পরবর্তীকালে সেগুলি সংকলন গ্রন্থ হিসাবে প্রকাশিত হয়। “An idealist View of Life” সেরকমই একটি গ্রন্থ। লণ্ডন ও ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি অনেকগুলি ভাষণ দিয়েছিলেন সে ভাষণগুলিরই একটি সংকলন গ্রন্থ এটি। 
   রাধাকৃষ্ণন বিশ্বের প্রায় সমস্ত সেরা সেরা দার্শনিকদের দর্শন ভাবনা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা করেছেন। ভালো দিকগুলি নিয়ে যেমন বলেছেন আর যে বিষয়টা ভালো লাগেনি সেটাও অনায়াসে বলেছেন। তবে একটা জিনিস ভাবার বিষয় স্বামী বিবেকানন্দের দর্শনভাবনা নিয়ে কোথাও এতটুকু আলোচনা করেননি বা মতামত দেননি। ফলে এই নিয়ে তাঁকে কিছু সমালোচনার মধ্যেও পড়তে হয়। তবে আমরা যদি একটু বিচার-বিশ্লেষণ করি তবে দেখতে পাব যে রাধাকৃষ্ণন বিবেকানন্দের ভাবধারায় বিশ্বাসী ছিলেন। তাঁকে তিনি হয়তো গুরু হিসাবেই মেনে নিয়েছিলেন। তাঁর চিন্তা-চেতনা, ধর্ম-দর্শনের সঙ্গে বিবেকানন্দের প্রভূত মিল লক্ষ্য করা যায়। জাতির জনক বাপুজি অর্থাত্‍ মহাত্মা গান্ধী এবং রাধাকৃষ্ণন ছিলেন সমসাময়িক। মহাত্মা গান্ধীকে তিনি সততা, ত্যাগ ও ন্যায়ের প্রতীক বলে বর্ণনা করেছেন। ভারতীয় দর্শন, ধর্ম নিয়ে দুজনের মধ্যে প্রচুর আলোচনা হয়েছে। চিঠিপত্র লেখালেখি হয়েছে। যা সব অমূল্য সম্পদ। আর একজনের কথা না বললেই নয় তিনি হলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। চিন্তনে-মননে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে রাধাকৃষ্ণণের প্রচুর মিল লক্ষ্য করা যায়। দুজনের মধ্যে বন্ধুতা, আত্মিক সম্পর্ক লক্ষ্য করার মতো। যখনই প্রয়োজন দেখা দিয়েছে দুজনে একসঙ্গে মিলিত হয়েছেন। রবীন্দ্রনাথকে তিনি এতটাই ভালোবাসতেন এবং শ্রদ্ধা-সম্মান করতেন তিনি লিখে ফেললেন রবীন্দ্রনাথের দর্শন নিয়ে “Philoisophy ও Rabindranath Tagore”। এর থেকে বোঝা যায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে তিনি মনের মধ্যে কতটা স্থান দিয়েছিলেন।
   রাধাকৃষ্ণন সারাজীবন ধর্ম ও দর্শনকে বৈজ্ঞানিক সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন। যেটা চেয়েছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ। তিনি ভাবতেন ধর্ম এবং দর্শন কোনো মৃত জড়বত্‍ পদার্থ নয়। মূল গভীরে গিয়ে বিষয়টিকে ভাবতে হবে। আত্মার উন্মীলন ঘটাতে হবে। সাধারণ মানুষের থেকে দূরে সরিয়ে রাখলে চলবে না। বিজ্ঞানীরা যেমন কোনো জিনিসকে ভেঙেচুরে, বিশ্লেষণ করেন সেটাকে আবার জোড়া লাগানোর চেষ্টা করেন রাধাকৃষ্ণণ তেমনি চেয়েছিলেন হিন্দু ধর্মের বিভিন্ন অংশগুলিকে ভেঙে আবার নতুন করে গড়ে তুলতে। সবকিছুর মধ্যে একটা সমন্বয় সাধন করে দর্শনকে সকলের বোধগম্য করে তুলতে। এখানেই রাধাকৃষ্ণণের শ্রেষ্টত্ব। 
   এবারে আসি শিক্ষবিদ রাধাকৃষ্ণনের শিক্ষাচিন্তা ও শিক্ষাভাবনার কথায়। রাধাকৃষ্ণন সুদীর্ঘকাল ধরে শিক্ষকতা করেছেন অত্যন্ত দায়িত্বের সঙ্গে, শিক্ষাকে অত্যন্ত ভালোবেসে। শিক্ষাবিদ এই মানুষটি শিক্ষকদের সুগভীর শ্রদ্ধা ও মর্যাদার সঙ্গে দেখে এসেছেন। তিনি মনে করতেন নতুন দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি, আগামীদিনের সুনাগরিক তৈরিতে বিদ্যালয়শিক্ষার একটা গুরুত্ব আছে। আর সেই বিদ্যালয় শিক্ষাকে এগিয়ে নিয়ে নিয়ে যাবেন শিক্ষকতাকে জীবনের মহাব্রত হিসাবে গ্রহণ করেছেন যাঁরা সেই মহান শিক্ষককুল। শিক্ষকদের তিনি এতটাই সম্মানের চোখে দেখেছেন যে নিজের জন্মদিনটিকে তিনি শিক্ষকদিবস হিসাবে পালিত হোক নিজের থেকে তিনি তা ব্যক্ত করেছেন। ১৯৬২ সাল। রাধাকৃষ্ণণ তখন রাষ্ট্রপতির পদে আসীন। রাধাকৃষ্ণনের ভক্ত-অনুগামীরা চাইলেন তাঁর জন্মদিনটি ঘটা করে পালিত হোক। রাধাকৃষ্ণন চাইলেন না নিছক জন্মদিন হিসাবেই দিনটি পালিত হোক। তিনি ইচ্ছা প্রকাশ করলেন জন্মদিন যদি পালন করতেই হয় তবে তা শিক্ষকদিবস হসাবে পালন করা হোক। তখন থেকে অর্থাত্‍ ১৯৬২ সালের তাঁর জন্মদিন ৫ সেপ্টেম্বর থেকেই দিনটি ‘শিক্ষকদিবস’ হিসাবে পালিত হয়ে আসছে। স্বাভাবিকভাবেই শিক্ষক দিবস আমদের শিক্ষকদের কাছে আত্মসমীক্ষার দিন। শিক্ষার অঙ্গনে কতটুকু কি করতে পেরেছি তার পর্যালোচনার দিন।
   রাধাকৃষ্ণণ সারাজীবন ধরে তাঁর বিভিন্ন বক্তব্যে এবং লেখার মধ্য দিয়ে যে কথাটা শিক্ষকদের সম্বন্ধে বলে এসেছেন তা হল শিক্ষকরা হলেন এক সামাজিক দায়বদ্ধ মানুষ। তিনি সমাজের কাছে দায়বদ্ধ, মানুষের কাছে দায়বদ্ধ সর্বোপরি তিনি মানবতার কাছে দায়বদ্ধ। শিক্ষক হবেন সেই বিশ্বনাগরিক যাঁর কাছ থেকে শিক্ষাগ্রহণ করে আমাদের ছাত্র-ছাত্রীরা, যুবকেরা একটা বলিষ্ঠ সমাজ গঠন করবে। শিক্ষকরা হবেন জ্ঞানান্বেষী এবং নিরন্তর সেই জ্ঞানের সঞ্চারক। একটা 
মানুষের মধ্যে ভালো এবং মন্দ এই দুইসত্তাই কাজ করে। শিক্ষার কাজ হবে এই দুই সত্তাকে অতিক্রম করে নিজের জীবনকে চিনতে সাহায্য করা, জানতে সাহায্য করা। শুধুমাত্র পাঠ্যপুস্তকে মুখ রেখেই প্রকৃত শিক্ষা অর্জন করা যাবে না, অন্তরসত্তাকেও জানতে হবে। আর এ ব্যাপারে শিক্ষকদের বিরাট ভূমিকা আছে। ১৯৭৫ সালের ১৬ এপ্রিল রাত ১২ টা ৪৫ মিনিটে এক নার্সিংহোম এই মহামনীষীর জীবনাবসান ঘটে।   
   ভারতের দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি, জ্ঞানতপস্বী, ভারতরত্ন ড. সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণনের মূল মর্মবাণী হল –‘জীবন সাধনারই জন্য।” তিনি বলছেন-“কোনো অশুচি বা অপবিত্র বস্তু আমরা দেবতার চরণে যেমন নিবেদন করতে পারিনা, তেমনি ভগবানের চরণে যদি আমাদের আত্মনিবেদনই করতে হয় তাহলে প্রথমেই আমাদের জীবনকে পবিত্র করে তুলতে হবে।” বাইবেলের কথার উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেছেন –“The temple of God is holy which temple ye are” অর্থাত্‍ “দেব মন্দির হল নিত্য পবিত্র মন্দির-আর সে পবিত্র মন্দির তুমি নিজেই।” ৫ সেপ্টেম্বর রাধাকৃষ্ণণের জন্মদিন। বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ দার্শনিক, চিন্তাবিদ, শিক্ষানায়ক, ভারততত্ত্বের অন্যতম সেরা প্রবক্তা এবং তুলনামূলক ধর্মালোচনার পথিকৃত্‍ এই মহামানবের চরণে জানাই অন্তরের শ্রদ্ধা ও প্রণাম। 


Post a Comment

2 Comments

  1. আমি বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করি।

    ReplyDelete
  2. https://roundtableindia.co.in/index.php?option=com_content&view=article&id=8753:dr-sarvepalli-radhakrishnan-the-teacher-who-plagiarised-his-student-s-thesis&catid=119&Itemid=132

    ReplyDelete