শিক্ষক দিবস ও সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন
স ন্দী প কা ঞ্জি লা ল
আমাদের শিক্ষানবিশী চলতেই থাকে। জীবনভর। আমরা প্রতিদিন শিখি। যাপন ও জীবনের রোজনামচা আমাদের প্রায় প্রতিদিনের অভিজ্ঞতায় কত কিছু যে শিখতে বা শিখে নিতে বাধ্য করে। আমরা ঠেকে শিখি। ঠকে শিখি। ভুল করি বিস্তর। আবারও ঠিক করে ফেলি। পরবর্তী অভিজ্ঞতালব্দ্ধ জীবনে ছাত্রাবস্থায় শেখা অনেক ভালো জিনিস কাজে লাগে। অনেক কিছু কিন্তু আবার লাগেও না। আমাদের ছাত্রাবস্থায় সেই শেখাটা কিন্তু ঠিক ছিল-- কিন্তু নানা প্রতিকূলতা ও চাপের কাছে, হয়তো বা আদর্শের কাছে নতিস্বীকার করতে হয়েছে। দেওয়ালে কখনও পিঠ ঠেকে গেলে এও মনে হয়েছে, ধ্যুস জীবনে কিছুই শেখা হল না আজও।
সেভাবে বলতে গেলে নার্সারি বা স্কুলে ভর্তি জীবনের আগে পর্যন্ত তো আমরা অ আ ক খ বা ইংরেজি বর্ণমালা, ১ থেকে ১০০, ছড়া, রং চেনা, পশুপাখিদের ছবি দেখে চিনতে শেখা, রামায়ণের গল্প আরও কত কি বাড়িতেই শিখে যাই বাবা মায়ের কাছ থেকেই। হামাগুড়ি বয়স থেকেই হাঁটতে শেখা, কথা বলতে শেখা সবই তাদের কাছেই। এক্কেবারে কচি বয়স থেকে আমাদের শিক্ষার হাতে খড়ি তাদের হাত ধরেই। আমাদের বাবা ও মা-ই আমাদের প্রথম ও পরম গুরু। জীবনযাপনের অন্যতম শিক্ষক।
পরবর্তীতেও প্রিয় শিক্ষক তাঁরাই। তাদের স্নেহে প্রশ্রয়ে, শিক্ষায়, সহমর্মিতায়, মরমী সমালোচনায়, চরিত্র গঠনের দৃঢ় শিক্ষায় আমরা ঋদ্ধ হতে থাকি ক্রমশ। আমাদের প্রতিটি আচরণের বহিঃপ্রকাশ ঠিক কী হবে, শিশু বয়স থেকেই উচিত অনুচিতের বোধ আমরা শিখতে থাকি তাদের কাছেই। আমাদের নিজস্ব পছন্দ অপছন্দ, আমাদের দায়বদ্ধতা বিশ্বাস, অন্যকে মান্যতা দেওয়া, গুরুজনকে সম্মান জানানো, নিজেদের পারিবারিক রীতিকে মর্যাদা দেওয়া, পরস্পরাকে টিকিয়ে রাখা এই সমস্ত কিছুই শিখি বাড়ির গুরুজন অভিভাবকদের থেকেই। আমাদের আদর্শ আমাদের চরিত্রগঠন সব কিছুর প্রাপ্তি তাদের থেকেই। শিক্ষকদিবসের আলোচনায় বাবা মা-কেই অন্যতম প্রারম্ভিক শিক্ষক তথা গুরু হিসেবে স্মরণ করে প্রণতি জানাতে পারি-
"গুরু সাক্ষাৎ পরম ব্রহ্ম / তস্মৈ শ্রী গুরবে নমঃ।"
সমাজের অগ্রগমণের ক্ষেত্রে মানব সমাজের অবদান সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। আর এই মানব সমাজকে যথোপযুক্ত তৈরী করার দায়িত্ব যাদের উপর তাঁরা হচ্ছেন শিক্ষক। ৫ই সেপ্টেম্বর আমাদের জাতীয় শিক্ষক দিবস। যিশু খ্রীষ্টের জন্মের ৫৫১ বছর পূর্বে চিন দেশে জন্মগ্রহণ করেছিলেন প্রখ্যাত দার্শনিক ও শিক্ষক কনফুসিয়াস। তাঁর জন্মের ২৮ শে সেপ্টেম্বর ধরে প্রথম চিন দেশে শিক্ষক দিবস পালনের রীতি শুরু হয়। পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশে এই দিন শিক্ষক দিবস হিসাবে পালিত হয়। ভারতবর্ষে শিক্ষক দিবস পালন করা শুরু হয় ১৯৬২ সালের ৫ই সেপ্টেম্বর থেকে। এই দিনই আমাদের দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি মহান দার্শনিক শিক্ষকের শিক্ষক সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণনের জন্মদিন। যখন উনি রাষ্ট্রপতি ছিলেন তখন একজন শুভানুধ্যায়ী উনার জন্মদিন পালনে সচেষ্ট হন। উনি তখন বলেছিলেন এই দিন আমার জন্মদিন পালন না করে যদি শিক্ষক দিবস হিসাবে পালিত হয়, তবে আমি খুশী হব। তাই এই ৫ই সেপ্টেম্বর জাতীয় শিক্ষক দিবস। ১৯৯৩ সালে ৫ই অক্টোবর আন্তর্জাতিক শিক্ষক দিবস হিসাবে পালিত হয়।
রাধাকৃষ্ণনের জন্ম চেন্নাই থেকে উত্তর-পশ্চিমে তিরুত্তানি শহরে এক তেলেগু দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারে ১৮৮৮ সালের ৫ই সেপ্টেম্বর। বাবার নাম সর্বপল্লী বিরাসস্বামী, মা সীতাস্মা। বাবা চাইতেন ছেলে যজমানি করে দুটো পয়সা ঘরে আনুক৷ কিন্তু তিনি যে স্বাভাবিক বনস্পতি। যতই অনাদর অবহেলা থাকুক, সে ঠিক মাথা তুলবেই সূর্যের নিমন্ত্রণে। তাই তো তিনি প্রশ্ন করেন, " Education is merely to grow rich or is it for the purpose of fulfilling yourself and making yourself an offering to suprime? আবার তিনি তার উত্তর দিলেন "Education is their to help us to find out what we are for in this world."
মাত্র দশ বছর বয়সে গ্রামেরই মেয়ে শিবকাম্মার সঙ্গে বিয়ে হবে ঠিক হয়। ১৬ বছর বয়সে তিনি তাকেই বিয়ে করেন। তার পাঁচ কন্যা ও এক পুত্র। মাত্র ১৮ বছর বয়সে তিনি এম.এ. পাশ করেন। সে সময় এম.এ. পাশ করতে হলে গবেষণা পত্র দাখিল করতে হত। তার গবেষণার বিষয় ছিল, শুনলে চমকে উঠতে হয়- বেদ। "The Ethics of the Vedanta an it’s metaphysical pre-suppositions।" আবার তিনি বলেছেন, "No education can be regarded as complete, if it neglects the heart and the spirit."
সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েতের প্রথম শিক্ষামন্ত্রী লুনাচারস্কি শিক্ষক সম্পর্কে বলেছিলেন, "শিক্ষক হলেন এমন এক ব্যক্তি যিনি নতুন প্রজন্মের কাছে যুগ যুগান্তরের সঞ্চিত যাবতীয় মূল্যবান সাফল্য হস্তান্তরিত করবেন কিন্তু কুসংস্কার, দোষ, অশুভ ছাত্রদের হাতে তুলে দেবেন না। শুধু শিক্ষকদের দিয়েই সুস্থ কুঁড়িগুলোকে লালন করতে পারেন।"
রাধাকৃষ্ণন বললেন "একজন শিক্ষক শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ জীবন গঠন করেন। শিক্ষার্থীদের মধ্যে সাংস্কৃতিক ও নৈতিক মূল্যবোধ জাগিয়ে তোলেন। এবং এইভাবে দেশ ও জাতিকে উন্নতর ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে নিয়ে যান।"
সংস্কৃতে একটা শ্লোক আছে - " সা বিদ্যা যা বিমুক্তয়ে।" অন্তরে সমস্ত আবিলতা দূর করার জন্য চাই শিক্ষা। আবার বিবেকানন্দ বললেন- "Education is the manifestation of the perfection already in man"- প্রথম থেকে যে পূর্ণতা মানুষের মধ্যে আছে শিক্ষার মাধ্যমেই তা প্রকাশ পায়। মানুষের মধ্যে যদি জ্ঞান ও শক্তি আগে না থাকে, বাইরে থেকে কোন জ্ঞান বা শক্তি ঢোকানো যায় না। যে সকল বিষয় জ্ঞান প্রকাশে বাধা তাই দূর করার কাজ শিক্ষকের।। সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন ১৯৩০ সালে বেনারস শিক্ষক সম্মেলনে বললেন, "If you are not able to do it you may get a degree, you may have it but your education is not true education."
জহরলাল নেহেরু রাধাকৃষ্ণন সম্বন্ধে বলেছিলেন, "He has served his nation in many capacities. But above all he is a great teacher."
উপনিষদ বলছে "ন নরেনাবরেন প্রোক্ত এষ সুবিজ্ঞেয় বহুবা চিন্তমানঃ"। যে আচার্য নিজে আত্মজ্ঞান লাভ করেননি তিনি শিক্ষা দানের যোগ্য নন। তাই তো রাধাকৃষ্ণন বললেন,"A teacher can not satisfied by wealth. His literacy is not education, his knowledge is not education, but the growth of wishdom, the capacity to look upon other objects with compassion, that is what is necessary."
রবীন্দ্রনাথ তাঁর শিক্ষাবিধি প্রবন্ধে বললেন "একদল বলিতেছে ছেলেদের শিক্ষা যথাসম্ভব সুখকর হওয়া উচিৎ, আর একদল বলিতেছে ছেলেদের শিক্ষার মাধ্যমে দুঃখের ভাগ যথেষ্ট পরিমাণে না থাকিলে, তাহাদিগকে সংসারের জন্য পাকা করিয়া মানুষ করা যায় না। বস্তুত এ দ্বন্দ্ব কোনদিনও মিটবে না- কেন না, মানুষের প্রকৃতির মধ্যে এ দ্বন্দ্ব সত্য। সুখও তাহাকে শিক্ষা দেয়, দুঃখ ও তাহাকে শিক্ষা দেয়। শাসন না হলে তার চলে না, স্বাধীনতা না হলেও তার রক্ষে নেই।"
১৯১৮ সালে রাধাকৃষ্ণন একটি বই লেখেন "Philosophy of Rabindranath Tagor" তাতে তিনি একজায়গায় বললেন, "Tagore combined modern methods of education with this ancient Indian ideal of soul- culture." তিনি ঐ বইতে আরও এক জায়গায় বললেন "The best teacher like one can have is the like in the company of great books and great man." তিনি আরও লিখলেন "A teacher has no age bound. He can not take retired, if he is a real teacher."
একবার আমাদের প্রয়াত মহান রাষ্ট্রপতি ডঃ কালাম সাহেব বলেছিলেন,"শিক্ষক হিসাবে আমাকে মনে রাখলে খুশী হবো।" তাই রাষ্ট্রপতি পদ থেকে অব্যাহতির পরের দিন চেন্নাই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতে ছুটে গিয়েছিলেন। তিনি মরণ বরণ করে ছিলেন ছাত্রদের সামনে বক্তব্য রাখতে রাখতে।
১৯৬২ সালে রাধাকৃষ্ণন ভারতের রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচিত হন। রাষ্ট্রপ্রধানের যে সুযোগ সুবিধা বৈভব তা তার মোটেই পছন্দ ছিল না। জাগতিক জীবনের ভোগবিলাস তাকে আকর্ষণ করতো না। তিনি সে সময় একান্ত আলাপচারিতায় বলেছিলেন "আমার সবসময় ভয় হয়, রাষ্ট্রপতি প্রাসাদের মাধ্যমে জীবন কাটাতে গিয়ে আমি যেন আমার আসল লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত না হই।"
১৯৬৪ সালে ডিসেম্বর মাসে রোমান ক্যাথলিক ধর্মগুরু পোপ ষষ্ঠপল ভারতে আসেন। তিনি রাধাকৃষ্ণনকে "ভ্যাটিকান স্পার" উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন।
সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন তাই বললেন "Religious in a changing world" বইতে "যত দিন বিভিন্ন জাতির পৃথক অস্তিত্ব থাকবে, ততদিন সম্পূর্ণরুপে বিরোধের নিষ্পত্তি হবে না। যতদিন না 'Universal Religion' বা সার্বজনীন ধর্ম প্রতিষ্ঠিত না হয়, ততদিন আমাদের দিন কাটাতে হবে আতঙ্কের মধ্যে।"
মানুষের মধ্যে পুরনো অভ্যাসগুলি ঘুমিয়ে আছে। মৌলবাদীরা সেই অভ্যাসগুলি জাগিয়ে তুলতে সচেষ্ট। এদের মন নিরপেক্ষ করাই শিক্ষকের কাজ। কিছু শিক্ষক নিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী। আবার কিছু শিক্ষক ধর্মান্ধতায়। শিক্ষকরা নিজেরাই বিভ্রান্ত। যারা নিরপেক্ষতা বুঝতে পারেননি, সেই সমস্ত শিক্ষকদের সাম্প্রদায়িকতার সমস্যা বুঝতে হবে। নিজেরা বুঝলে ছাত্র-ছাত্রীদের বোঝানো যাবে। শিক্ষার কিংবা শিক্ষকের কর্তব্য ফুরিয়ে যায়নি। প্রাচীনকালে একলা মানুষ থেকে দল, দল থেকে গোষ্ঠী, গোষ্ঠী থেকে সম্প্রদায়, সম্প্রদায় থেকে ধর্ম, ধর্ম থেকে বিভিন্ন জাতি। এখন হতে হবে সব জাতি মিলে একটাই জাতি মানবজাতি। আমাদের পৌঁছাতে হবে সেখানে- "যেথা তুচ্ছ আচারের মরু বালিরাশি/ বিচারের স্রোত পথ ফেলে নাই গ্রাসি।"
"যেদিন আমি হারিয়ে যাবো, বুঝবে সেদিন বুঝবে/ অস্তপারের সন্ধ্যা তারা আমার খবর পুছবে / বুঝবে সেদিন বুঝবে" বিদ্রোহী কবির কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে বলি- আজকের দিনে দেশ, জাতি, মানুষের উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন শিক্ষকদের শিক্ষক রাধাকৃষ্ণনকে স্মরণ করতে হবে। আজ দেশ ও জাতির অধঃপতনের দায় শিক্ষকরা অস্বীকার করতে পারেন না।
"সেই তো বসন্ত ফিরে এলো, হৃদয়ের বসন্ত কোথায় হায়রে। সব মরুময়, মলয় অনিল এসে কেঁদে শেষে ফিরে চলে যায় রে।" বিশ্বকবির কণ্ঠে যে হতাশার সুর ধ্বনিত হয়েছিল ৫ই সেপ্টেম্বর শিক্ষক দিবস এলে তখন ভারতের সকল শিক্ষাপ্রিয় শিক্ষাহিতৈষী মানুষের মনে কিছু মর্মবেদনা কিছু প্রশ্ন জেগে ওঠে।
"A great teacher is like a candle, it consumps itself to light the way for others."
একজন মহান শিক্ষক মোমবাতির মতো, যে নিজেকে পুড়িয়ে অপরকে আলো দেয়।
কিন্তু এখন দেখছি কি? শিক্ষকদের নিয়ে শুরু হয়েছে রাজনীতি। "মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে।" বিজ্ঞাপন দেওয়া হচ্ছে। শাসকের তরফ থেকে। শিক্ষারত্ন হতে হলে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে সরকারি চাকরী পাওয়ার মতো আবেদন করুন। সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন ভারতরত্ন উপাধি পেয়েছিলেন কোন আবেদন করেননি। কোন আত্মমর্যাদাসম্পন্ন এবং নিজের গরীমা সম্পর্কে সচেতন শিক্ষক কোনকালে সম্মান পাওয়ার জন্য ভিখারি হননি। দুর্ভাগ্যবশত কিছু শিক্ষক এই রত্ন পাওয়ার দৌড়ে সামিল হয়েছে। এই আজ্ঞাবহ হতে হতে শিক্ষকদের মধ্য থেকে হারিয়ে যাচ্ছে সাদা-কালোর ভেদ। শিক্ষকদের আইনত দাবী পাওয়ার কথা বললে বলা হচ্ছে বিশেষ জন্তুর মতো ঘেউ ঘেউ করছে। এসব দেখে বলতে ইচ্ছা করে "প্রভু কেন নষ্ট হয়ে যাই....।"
আজ আমরা শিক্ষকরা আর মোমবাতি নই। আমরা এখন সলতে পুড়ে যাওয়া অন্ধকার ঘরের প্রদীপ। যা থেকে শুধু কালো ধোঁয়া উঠছে। আর সেই ধোঁওয়ায় সমাজ কালো হয়ে যাচ্ছে। আগেকার দিনে শিক্ষক মহাশয়রা ছিলেন গ্রামের সম্মানীয় ব্যক্তি। এত টাকা বেতন পেত না৷ কিন্তু সম্মান পেতেন। বাড়িতে বা বাগানে ভালো কিছু হলে বাড়িতে বলত যা শিক্ষক মহাশয়কে পৌঁছে দিয়ে আয়। প্রসাদ পৌঁছে দিয়ে আয়। মাছ দিয়ে আয়। আজকাল এসব আমরা দেখছি না। কেন? তার উত্তর আমরা খুঁজব না? টাকা পয়সা দিয়ে সব হয় না। এই সম্মানটা আমাদের ফিরিয়ে আনতেই হবে। শিক্ষক দিবসের আলোচনায় আমাদের বলতেই হবে "জগতে আনন্দ যজ্ঞে আমার নিমন্ত্রণ / ধন্য হল, ধন্য হল মানব জীবন।"
ইস্কুলে ইস্কুলে দেখছি মাষ্টারদের ছাত্রদের প্রতি অশ্লীল আচরণ। দেখে শুনে মাথা হেঁট হয়ে যায়। ইস্কুল বাদ দিয়ে টিউশানিতে ব্যস্ত। ক্লাস ফেলে টিউশান করছে। কেউ আবার ব্যবসার দালালি করছে। দিনরাত পরিশ্রম করছে কীভাবে আরও টাকা পাওয়া যায়। তারা ভুলেও ভাবেন না আমরা মরণশীল। আমরা এখানে অল্প সময়ের অতিথি। আইনস্টাইন বলেছিলেন "প্রতিদিন আমি নিজেকে স্মরণ করাই, আমার এই বেতন, দৈহিক জীবন যে সমস্ত মানুষের শ্রমের উপর নির্ভরশীল, যাদের কাছ থেকে আমি আমার অন্ন গ্রহণ করছি, তাদেরও কিছু দিয়ে যাওয়া প্রয়োজন।" সকাল থেকে টিউশান করছে, ব্যবসার দালালি করছে, বহুদূর পথ পাড়ি দিয়ে বিদ্যালয়ে পৌঁছাতেই ক্লান্ত। আর ছোটবেলায় পড়ায় অমনোযোগী ছাত্ররা পড়ার ভারে তাঁরাও ক্লান্ত। নিজেদের নিয়ে ক্লান্ত হওয়া দু'জন শিক্ষক ও ছাত্র শ্রেণীকক্ষে উপস্থিত হয়ে পরস্পরকে ক্লান্ত করে তুলছে। শিক্ষক-ছাত্রের মধ্যে সবচেয়ে বড় ভয়ের ব্যাপার শ্রদ্ধা হারানোর ভয়। ভয় যেখানে থাকে, শ্রদ্ধা সেখানে থাকে না। ছাত্রদের বোঝানো দরকার কেন বিদ্যালয়ে আসে৷ শিক্ষকদের বোঝা দরকার কেন তারা শিক্ষক হয়েছেন। এই দু'জন দু'জনকে বুঝতে পারলে দু'জনের মধ্যে ভয় দূর হয়ে যায়। আর ভয় দূর হলে শ্রদ্ধা সেখানে চিরস্থায়ী হয়। যেসব শিক্ষকরা বাবা-মাকে ভালোবাসেন না তারাই ঘরের নাম রাখেন মা-বাবার আশীর্বাদ। এদিকে ধর্মগ্রন্থের কথা বলে, সুযোগ পেলেই বাবা-মায়ের সমালোচনা করে। যারা স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীকে অবহেলা করে নিজের সন্তানকেও প্রকৃত ভালোবাসে না।
এই বরেণ্য শিক্ষক ১৯৭৫ সালে ইউরেমিয়া রোগে আক্রান্ত হয়ে নার্সিং হোমে ভর্তি হন। নার্সিংহোমে থাকাকালীন 'Templeton' পুরস্কার পান। তার পুরো অর্থটাই একটি নার্সিংহোমে দান করেন। "এবার ভাসিয়ে দিতে হবে আমার/ এই তরী/ তীরে বসে যায় যে বেলা।" ১৯৭৫ সালের ১৬ই এপ্রিল রাত ১২-৪৫ মিনিটে বিশ্বের একজন শ্রেষ্ঠ মনীষী সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন অমৃতলোকে যাত্রা করেন।
"তব কাছে এই মোর শেষ নিবেদন / সকল ক্ষীণতা মম করহ ছেদন / বীর্য দেহো তোমার চরণে পাতি শির/ অহর্নিশি আপনারে রাখিবারে স্থির।"
0 Comments