জ্বলদর্চি

শারদ উৎসব /কালীপদ চক্রবর্ত্তী


শারদ উৎসব

পর্ব – ১

কালীপদ চক্রবর্ত্তী, নিউ দিল্লী

আমাদের জাতীয় উৎসব

এবছর আমাদের সকলের মনই খুব খারাপ কারণ আমরা আমাদের সবচেয়ে প্রাণের উৎসব উপভোগ করতে পারবো না। করোনা-র প্রকোপে সবাই খুব আতঙ্কিত, সন্ত্রস্ত। নয়তো শরৎকাল এলেই আমাদের বাঙালিদের মনটা আনন্দে ভরপুর হয়ে ওঠে। পশ্চিমবঙ্গে সকালবেলা শিউলি ফোটার গন্ধ, নীল আকাশে পেঁজা তুলোর মত সাদা আর নীল মেঘের আনাগোনা এবং কাশ ফুলের দোলা সব কিছু আমাদের মনে করিয়ে দেয় পূজা এসে গেছে। মা-দুর্গা নিজের বাড়ীতে ফিরছেন তাই চারিদিকে তাঁকে বরণ করার ধূম শুরু হয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে পুলকিত হয় বাঙালির মন। এই উৎসব শুরু হয়, ঋতু চক্রের তৃতীয় প্রহর শরতে। শরতে জলে, স্থলে, আকাশে, বাতাসে শোনা যায় তারই আগমনী বার্তা। মা আসছেন, আসছে “মহালয়া”। মহালয়াতে অর্থাৎ দেবীপক্ষ শুরুর আগে, ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের প্রতিপদ তিথি থেকে এক-পক্ষকাল প্রতিদিন তিলতর্পন করতে হয় পরলোকগত পূর্বপুরুষদের আত্মার পরিতৃপ্তির জন্য। আর, মহালয়া তিথিতে পার্বণ শ্রাদ্ধের মাধ্যমে তার পরিসমাপ্তি। ‘বর্ষ ক্রিয়া কৌমুদী’ ও ‘তিথি-তত্ত্ব’ – তে এই বিধি দেওয়া আছে।

দুর্গার অপর নাম, “অম্বিকা”। তৈত্তিরীয় ব্রাক্ষ্মণে কিন্তু অম্বিকা ও শারদা অভিন্ন বলা হয়েছে। ‘শারদা এম্যাম্বিকা স্বযা।“ শারদ বা শারদীয় থেকে স্ত্রীলিঙ্গ শব্দ করে হয় শারদা বা শারদীয়। রাজ শেখর বসুর চলন্তিকায় এর অর্থ করা হয়েছে ‘শরৎকালীন’। আর ‘সারদা’ ‘শারদা’ শব্দ দুটির সমার্থকে বলা হয়েছে ‘সরস্বতী’ ‘ দুর্গা’। সেই অর্থে শরত ঋতুর প্রশস্ত সময় এই মহালয়া থেকেই দেবী পক্ষের সুবর্ণা এবং জগম্নাতা দেবী দুর্গার আহ্বান ও পূজার পক্ষেও যথোপযুক্ত কাল। 

যুগ থেকে যুগে রূপ বদলেছেন মা দুর্গা। দুর্গার প্রথম মূর্তি পাওয়া গেছে রাজস্থানের নাগোর অঞ্চলে। সেখানে তিনি মহিষমর্দিনী। তাঁর হাতে কোন অস্ত্র নেই। চতুর্থ শতকে মধ্যভারতে পাওয়া যায়  দুর্গার চার হাত। আমরা দেখি অষ্টম শতাব্দীর দুর্গার আট হাত। বাংলায় বা পূর্ব-ভারতে তিনি সিংহবাহিনী হয়ে আসেন। উত্তর ভারতে আমরা তার বাহন রূপে বাঘ কে দেখতে পাই। বাঙালিদের কাছে দেবী দুর্গা দশভুজা হলেও কোথাও তিনি দ্বিভূজা, কোথাও চতুর্ভুজা, কোথাও অষ্টভুজা, আবার কোথাও দ্বাদশভুজা  বা অষ্টাদশ ভুজা। পাতাল ভৈরবী নামে যে দুর্গার পরিচয় পাওয়া যায়, তাঁর আঠারোটি হাত।  এভাবেই, ষোল হাতের, ছত্রিশ হাতের দুর্গা, এমনকি হাজার হাতের দুর্গার কথাও শোনা যায়। অনেকেই বলে থাকেন, দুর্গার আসলে দু-টিই হাত, বাকিগুলি রূপক। ভারতের বাইরেও সিংহবাহিনী রূপটি পাওয়া গেছে। ননা, তান্নিট ও সিবিলি রূপে দেবীকে পাওয়া গেছে পৃথিবীর প্রাচীন দুই সভ্যতার দেশ মিশর ও গ্রীসে। ভারতে প্রথম শতাব্দীতে কণিষ্ক ও হুবিস্কের সমসাময়িক মুদ্রায় সিংহবাহিনীর ছবি আছে। মধ্যপ্রদেশের ভিল-অধ্যুষিত এলাকা উদয়গিরিতে বারো হাত বিশিষ্ট দুর্গামূর্তি দেবী গোধা (শূল) দ্বারা মহিষাকৃতি দানবকে বধ করছেন। নালন্দা মিউজিয়ামে আদি-মধ্যযুগের একটি গোধাবাহনা চতুর্ভুজা ব্রোঞ্জ মূর্তি আছে। গৌড়ের রাজা শশাঙ্কর মুদ্রায় আছে অষ্টভুজা দেবী মূর্তি। 
চিত্র - সুদেষ্ণা রায়চৌধুরী   

শারদীয় দুর্গোৎসব বর্তমানে বাঙালিদের কাছে এক জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়েছে। পূজা এবং উৎসব এদুটিই বাঙালিকে নাড়া দেয়। ঢাকে কাঠি পড়লেই মনটা আর ঘরে আবদ্ধ থাকতে চায়না। শৈশব থেকেই গ্রাম এবং শহরের দুর্গাপূজা দেখে আসছি। গ্রামের দুর্গাপূজাতে প্রকৃতির আন্তরিকতার ছোঁয়া পাওয়া যায়। শিশির ভেজা ঘাস, নীল মেঘের আনাগোনা, শিউলি প্রস্ফুটিত ফুলের পশরা মনকে নিয়ে যায় অন্য এক জগতে। আজও যারা গ্রামে থাকেন তাঁরা হয়তো এমনি আনন্দ পেয়ে থাকেন।

শহরের পূজা একটু আলাদা। পূজা মণ্ডপ এবং মূর্তিগুলির মধ্যে ফুটে ওঠে শিল্পীর নিপুণ হাতের বৈচিত্র্য। পরিস্ফুট হয় শিল্পকলা। থিমের ও আলোক-সজ্জার বৈচিত্র্য এনে দেয় এক নতুন রূপ।

প্রবাসে এসে পূজাটাকে যেন আরও নিবিড় ভাবে অনুভব করলাম। সারা বছর অক্লান্ত পরিশ্রমের পর দুর্গাপূজার দিনগুলোতে প্রবাসীরা যেন প্রাণের স্পন্দন খুঁজে পাই। সারা বছর যাঁদের সাথে দেখা সাক্ষাৎ হয়না তাদের ও খুব কাছে পাই। উচ্চ-নীচ ভেদাভেদ ভুলে যাই। এককথায় ঐ কদিন দুর্গাপূজামন্ডপ মহামিলন ক্ষেত্রে পরিণত হয়। পুজোর দিনগুলোতে অনেকেই হয়তো ইনভার্টারের ব্যাটারীর রিচার্জ হওয়ার মতো রিচার্জ হয়ে যান। এছাড়াও পুষ্পাঞ্জলি, প্রসাদ, ভোগ খাওয়া এবং বিভিন্ন নামী-দামী শিল্পীদের অনুষ্ঠান দেখার সুযোগ আমাদের আরও উজ্জীবিত করে তোলে।

বেদের ঋষিরা প্রকৃতির মধ্যে পেয়েছিলেন ঈশ্বরের নানা শক্তির পরিচয়। এসব শক্তিই হলেন বেদের দেবতা। মুনি-ঋষিরা দেবতাদের নামকরণও করলেন তারা যজ্ঞ, স্তব, স্তুতি এবং আরাধনার মাধ্যমে দেবতাদের আহ্বান করতেন। দেবতারা অলক্ষ্যে উপস্থিত হয়ে তাদের মঙ্গল সাধন ও বর প্রদান করতেন। দেবতা অনেক, এক ঈশ্বরের বহু প্রকাশ। ঋষিরা দ্রষ্টা। তাঁরা সেই সত্যস্বরূপ, মঙ্গলময়, সব সৌন্দর্যের আধার, জ্ঞানময় পরম ঈশ্বরকে নিরাকার ভাবে চিন্তা করতেন। যা সাধারণ মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। ভক্তরা নিরাকার ঈশ্বরের পূজা করে তৃপ্তি পেলেন না। ভক্তের ইচ্ছে হল উপাস্যকে চোখে চোখে রাখতে, অতিকাছ থেকে তাঁর পদতলে বসে মনোবাসনা পূর্ণ করতে। এভাবেই নিরাকার ঈশ্বর সাকার রূপ গ্রহণ করে ভক্তের ইচ্ছা পূর্ণ করলেন। আর্যদের আগমনের বহু আগে থেকেই এই উপমহাদেশে দ্রাবিড়রা “পূজা” শব্দটি ব্যবহার করে আসছে। প্রাগৈতিহাসিক যুগের মহেঞ্জোদারো – হরপ্পাতে আবিষ্কৃত প্রত্নতত্ত্বের মধ্যেও মাতৃপূজা-র নিদর্শন পাওয়া যায়। আর্যরা দ্রাবিড়ি “পূজা” শব্দটি নিজেরা গ্রহণ করেছিলেন। “পূজা” অর্থ পুষ্পকর্ম। ইতিহাস পাঠে জানা যায় যে দক্ষিণ এশিয়ায় প্রায় সাড়ে ছয় হাজার বছর আগেও পূজার প্রচলন ছিল। এই মূর্তিপূজা হল মহাবিশ্বের নিরাকার ঈশ্বরের সাকার আরাধনা। বেদের নিরাকার উপাসনা বিভিন্ন পুরাণের মাধ্যমে সাকার বন্দনায় রূপায়িত হয়েছে। আর দুর্গা হলেন সব দেবতাদের শক্তি সমূহের সম্মিলিত প্রতীক।

দুর্গাপূজাকে প্রাচীন শিষ্ঠ সমাজে কলির অশ্বমেধ যজ্ঞ বলা হয়। ভারতের বিভিন্ন স্থানে আশ্বিনের শুক্লা প্রতিপদ থেকে আরম্ভ করে নবমী পর্যন্ত নবরাত্রি উৎসব উদযাপন করা হয়। 

চণ্ডীতে উল্লেখ আছে “দুর্গম” নামে এক অসুরকে বধ করার কারণে দেবীর নাম হয় “দুর্গা”। আবার কেউ কেউ বলেন দুর্গতি হতে রক্ষা করেন বলে দেবীর নাম করণ হয়েছে “দুর্গা”/ মহাভারতের যুধিষ্ঠির বিপদ থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য ও শ্রীকৃষ্ণের আদেশে যুদ্ধ যাত্রার আগে অর্জুন দুর্গাদেবীর স্তব করেছিলেন। মেধস মুনির উপদেশে রাজ্যহারা রাজা সুরথ ও পরিবার – পরিজন কর্তৃক বিতাড়িত ধনবান ব্যক্তিরা নিজেদের রক্তদিয়ে দেবী দুর্গার পূজা করেছিলেন।

ঐতিহাসিকদের বই-পত্র থেকে প্রমাণিত হয় যে, সপ্তম বা অষ্টম শতক থেকে বাংলায় মৃন্ময়ী প্রতিমার দুর্গাপূজার প্রচলন ঘটে। ইষ্টইন্ডিয়া কোম্পানির আমল থেকেই প্রথম শাস্ত্রবিধিকে উপেক্ষা করে বিরাট জাঁকজমক ও আড়ম্বরের মধ্যে দিয়ে দুর্গাপূজা উদযাপিত হওয়া শুরু হয়। ছোট-বড় ইংরেজ সাহেবদের খুশী করার জন্য একশ্রেণীর লোক দুর্গাপূজায় লাগামহীন হৈ, হুল্লোড়, বাইজী নাচ, কবিগান ও নানাপ্রকার সঙের আয়োজন করে এক পরিবর্তনের সূচনা করে। সুখের বিষয় হল যে বাঙালিদের দুর্গাপূজায় আড়ম্বরের পাশাপাশি সাত্ত্বিক আচার-আচরণ ও শাস্ত্রাচার সম্মত পূজা পদ্ধতির গুরুত্ব আজও কমেনি বরং বাড়ছে।

দেবী দুর্গার উৎপত্তি সম্পর্কে “শব্দ কল্পদ্রুম” শাস্ত্রে কলা হয়েছে যে “দ” শব্দ দৈত্য নাশক, “উ” কার বিঘ্ন নাশক, “রেফ” রোগ নাশক, “গ” পাপ নাশক, “আ” কার ভয় ও শত্রু নাশক। দৈত্য, বিঘ্ন, রোগ, পাপ, ভয় ও শত্রু হতে যিনি রক্ষা করেন তিনিই দুর্গা।

স্কন্দ পুরাণে উল্লেখ আছে যে মা দুর্গা দৈত্যের পুত্র দুর্গাসুরকে বধ করে বিশ্বলোকে দুর্গা নামে পরিচিত হয়েছেন। ব্যাকরণগত সূত্রে দুর্গা শব্দের অর্থ দুর্জ্ঞেয়, তাই তিনি দুর্গা। সৃষ্টি তত্ত্বের মূলে এক মহাশক্তির ক্রিয়া বিদ্যমান। এ মহাশক্তিই মায়াশক্তি। ভগবতীর মায়া মূর্তির দুটি রূপ। একটি জগত পালিকা ও জগদাতৃকা মায়ারূপ, অপরটি তার জগতের অতীত অপরিচ্ছন্ন অদিকারীরূপ অর্থাৎ মায়া ও মহামায়া। মায়া – অবিদ্যা ও মহামায়া – বিদ্যা। মায়া জীবকে ভগবৎ বিমুখ করে আর মহামায়া জীবকে ভগবৎ অভিমুখী করে। এ মহামায়াই দুর্গা, কালী, তাঁরা প্রভৃতি জগন্মাতার নানা মূর্তিতে বিভাসিতা।

পিতামহ ব্রক্ষ্মা, মা দুর্গার নয়টি নামকরণ করেছেন, যা নব-দুর্গা নামে পরিচিত, শৈল-পুত্রী, ব্রক্ষ্মচারণী, চণ্ডঘ্নটা, কুষ্মান্ডা, স্কন্দমাতা, কাত্যায়নী, কালরাত্রি, মহা-গৌরী ও সিদ্ধিদাতা। চোদ্দ ভূবনময় এই জগতকে দেবী-ধাম বলে। দুর্গা দেবী হচ্ছেন দেবী-ধামের “অধিষ্ঠাত্রী”, যিনি দশভুজা, সিংহ বাহিনী, পাপ দমনী ও দুর্গতি নাশিনী। পুরাকালে অসুরদের অধিপতি স্বর্গজয়ী  মহিষাসুরকে বধ করার জন্য দেবতাদের সম্মিলিত তেজ থেকে উদ্ভূত হন ভগবতী।  (চলবে) 


কৃতজ্ঞতা স্বীকার:-

১। দুর্গোৎসব ও আমাদের প্রাসঙ্গিক ভাবনা – সুকেশ চন্দ্র দেব
২।     দেবী দুর্গা, রাম-সীতা, কৃষি ও পাখি কথা – সাজাহান সরদার
৩।     দুর্গাপূজা ও শক্তিধর্ম – প্রেমরঞ্জন দেব
৪।     বিভিন্ন দেশে ও বিদেশে পত্র, পত্রিকা।
৫।     দুর্গাপূজায় মহালয়া – স্বপন কুমার মিস্ত্রী

Post a Comment

5 Comments

  1. Beautiful, what's a knowledgeable writing ! I enjoy Durga puja in Delhi two years, again I am influenced.

    ReplyDelete
  2. একরাশ মুগ্ধতা।
    গবেষণার ফসল এই লেখা।সংগ্রহে রাখার মতো।
    পরবর্তী লেখার অপেক্ষায় রইলাম।

    ReplyDelete
  3. তথ্য সমৃদ্ধ ও সুখপাঠ্য লেখা। খুব ভালো লাগলো।

    ReplyDelete
  4. খুব ভালো লাগলো, মা দুর্গার বিবরণী ।

    ReplyDelete
  5. খুব ভালো লাগলো, মা দুর্গার বিবরণী ।

    ReplyDelete