জ্বলদর্চি

শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ সঙ্গীতামৃত - ১৫ সুদর্শন নন্দী

পর্ব-১৫   

শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ সঙ্গীতামৃত  

সু দ র্শ ন  ন ন্দী


পরের গানের কথা দুদিন পর ২০শে ডিসেম্বর ১৮৮৩। পঞ্চবটির ঘরে মণি রাতে ছিলেন। সকালে আপন মনে তিনি গান গাইছেনঃ 
গৌর হে আমি সাধন-ভজনহীন
পরশে পবিত্র করো আমি দীনহীন......

হঠাৎ জানালার দিকে তাকিয়ে দেখেন শ্রীরামকৃষ্ণ দাঁড়িয়ে রয়েছেন। “পরশে পবিত্র করো আমি দীনহীন!” -- এই কথা শুনে ঠাকুরের চোখে আনন্দাশ্রু।
আবার একটি গান গাইলেন মণি:
আমি গেরুয়া বসন অঙ্গেতে পরিব
      শঙ্খের কুণ্ডল পরি।
আমি যোগিনীর বেশে যাব সেই দেশে,
      যেখানে নিঠুর হরি ৷৷
গানটির রচয়িতা জ্ঞানদাস। উল্লেখ্য সে সময় শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে রাখাল বেড়াচ্ছিলেন।

১৮৮৩, ২২শে ডিসেম্বর বিকেলে ঠাকুর দক্ষিণেশ্বরে ভক্তদের সাথে গোপীদের ভালবাসা নিয়ে কথা বলছেন।এই প্রসঙ্গে আলোচনা করতে করতে তিনি চারটি গান গেয়েছিলেন। আগেও গেয়েছেন, তাই প্রথম দুটি গানের উল্লেখ পূর্বে রয়েছে। বাকি দুটি গান হল
শ্যামা তুমি পরাণের পরাণ...
এবং
সেদিন আমি দুয়ারে দাঁড়ায়ে...
গানটি এই এক লাইন উল্লেখ রয়েছে কথামৃতে। সম্ভবত নরোত্তম দাসের রচনা থেকে এটি গাওয়া। 
১৮৮৩, ২৩শে ডিসেম্বর। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর ঘরের দক্ষিণ-পূর্বের বারান্দায় রাখাল, লাটু, মণি, হরিশ প্রভৃতি ভক্তসঙ্গে বসে আছেন। বেলা নটা হবে। মনোমোহন কোন্নগর থেকে সকাল বেলা এসেছেন। হাজরাও ঠাকুরের কাছে বসে আছেন। নীলকণ্ঠের দেশের একজন বৈষ্ণব ঠাকুরকে গান শোনাচ্ছেন। বৈষ্ণব প্রথমে নীলকণ্ঠের গান গাইলেন:
শ্রীগৌরাঙ্গসুন্দর নব-নটবর তপতকাঞ্চন কায়।
করে স্বরূপ বিভিন্ন, লুকাইয়ে চিহ্ন, অবতীর্ণ নদীয়ায়......
 
গানটির রচয়িতা নীলকণ্ঠ মুখোপাধ্যায়। গানটির পাঁচবার উল্লেখ পাই কথামৃতে। জনৈক বৈষ্ণব ছাড়াও বৈষ্ণবচরণ তিনবার এবং রচয়িতা নীলকণ্ঠ একবার গেয়েছিলেন এই গানটি। 
পরের গানটিঃ
ভাব শ্রীকান্ত নরকান্তকারীরে। 
নিতান্ত কৃতান্ত ভয়ান্ত হরি...
  
গানটির রচয়িতা দশরথি রায়ের। এই গানটি স্টার থিয়েটারে প্রহ্লাদ চরিত্র দেখতে গিয়ে গিরিশ ঘোষের সাথে আধ্যাত্মিক কথোপকথনের সময় ঠাকুর আরেকবার (১৪ই ডিসেম্বর ১৮৮৪) গেয়েছিলেন। 
২৪শে ডিসেম্বর ১৮৮৩তে দক্ষিণেশ্বরে ভক্তদের সাথে আদ্যশক্তি নিয়ে আলোচনায় ঠাকুর “ জাগো মা কুণ্ডলিনী! তুমি নিত্যানন্দ স্বরূপিনী” গানটি গেয়েছিলেন বোলে উল্লেখ পাই। গানটির রচয়িতা অজ্ঞাত। একবারই উল্লেখ পাই কথামৃতে। 
পরের গান ৩০শে ডিসেম্বরে ঠাকুর ভক্তদের উদ্ধৃতি হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন। পরে(৭ই সেপ্টেম্বর ১৮৮৪) তার গলায় গাইতে শুনি গানটিঃ 
মনের কথা কইবো কি সই কইতে মানা। 
দরদী নইলে প্রাণ বাঁচে না...
 
রচয়িতা অজ্ঞাত। গানটি সিমুলিয়ায় রামচন্দ্র দত্তের বাড়িতে কেদারও একবার(২৮শে সেপ্টেম্বর ১৮৮৪) গেয়েছেন ঠাকুরের অনুরোধে। 
৫ই জানুয়ারি ১৮৮৪। দক্ষিণেশ্বরে পঞ্চবটীঘরে বেলা চারটা নাগাদ মণির কীর্তন শুনছেন। রাখাল ভাবাবিষ্ট। ঠাকুর এবার বেরিয়ে এলেন পঞ্চবটীতে। মণিকে একটি গান গাইতে বললেন।  গানটি এক লাইন উল্লেখ রয়েছে কথামৃতেঃ সব সখি মিলি বৈঠল, (এই তো রাই ভাল ছিল...)  রচয়িতা রাধামোহন দাস। গানটি আরেকদিন (২রা ফেব্রুয়ারি ১৮৮৪) ঠাকুরের গলায় শুনতে পাই। ঐদিন সন্ধ্যায় আরতির পর রামলালকে “গৌর প্রেমের ঢেউ লেগেছে গায়...” গানটি গাইতে বলেন। গানটির রচয়িতা গোঁসাই কবি। কথামৃতে এই গানটি ঠাকুরকে আরও দুবার এবং কেদারকে একবার গাওয়ার উল্লেখ পাই।  
পরের গান শুনতে পাই ১৮৮৪, ২রা মার্চে ত্রৈলোক্যের গাওয়া। তিনিই গানের রচয়িতা। কথামৃতে যেভাবে রয়েছে তুলে দিচ্ছি।
“ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ কালীমন্দিরে সেই পূর্বপরিচিত ঘরে ছোট খাটটিতে বসিয়া গান শুনিতেছেন। ব্রাহ্মসমাজের শ্রীযুক্ত ত্রৈলোক্য সান্যাল গান করিতেছেন। নরেন্দ্র, সুরেন্দ্র (মিত্র), মাস্টার, ত্রৈলোক্য প্রভৃতি অনেকে বসিয়া আছেন।
ঠাকুরের শরীর, হাত ভাঙা অবধি, এখনও ভাল হয় নাই। হাতে অনেক দিন বাড়্‌ (Bar) দিয়া রাখা হইয়াছিল।
ত্রৈলোক্য মার গান গাইতেছেন। গানে বলিতেছেন, মা তোমার কোলে নিয়ে অঞ্চল ডেকে আমায় বুকে করে রাখ:
তোর কোলে লুকায়ে থাকি (মা)।
চেয়ে চেয়ে মুখপানে মা মা মা বলে ডাকি......
  
কথামৃতে একবারই উল্লেখ রয়েছে গানটির। 
ঠাকুর শুনিতে শুনিতে প্রেমাশ্রু বিসর্জন করিতেছেন। আর বলিতেছেন, আহা! কি ভাব!
ত্রৈলোক্য আবার গাইছেন:
                       
লজ্জা নিবারণ হরি আমার।
(দেখো দেখো হে -- যেন -- মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হয়)...
 
ঠাকুর আবার প্রেমাশ্রু বির্সজন করিতে করিতে মেঝেতে আসিয়া বসিলেন। আর রামপ্রসাদের ভাবে গাহিতেছেন --
‘যশ অপযশ কুরস সুরস সকল রস তোমারি।
(ওমা) রসে থেকে রসভঙ্গ কেন রসেশ্বরী ৷৷

ঠাকুর ত্রৈলোক্যকে বলিতেছেন, আহা! তোমার কি গান! তোমার গান ঠিক ঠিক। যে সমুদ্রে গিয়েছিল সেই সমুদ্রের জল এনে দেখায়।
ত্রৈলোক্য আবার গান গাহিতেছেন:
(হরি) আপনি নাচ, আপনি গাও, আপনি বাজাও তালে তালে,
মানুষ তো সাক্ষীগোপাল মিছে আমার আমার বলে......

 গানটি কথামৃতে নরেন্দ্রকে একাধিকবার গাইতে দেখি।
১৮৮৪, ২৩শে মার্চ।  বয়সে যুবক হলেও এক ব্রাহ্মণকে সবাই ঠাকুরদাদা বোলে দাকে। তা ঠাকুরদাদা  দু-একটি বন্ধুসঙ্গে এসেছেন দক্ষিণেশ্বরে। ঘরে ঢুকে ঠাকুরকে প্রণাম করলেন। বয়স ২৭/২৮ হইবে। বরাহনগরে বাস। ব্রাহ্মণ পণ্ডিতের ছেলে, -- কথকতা অভ্যাস কছেন।  ঠাকুর কথা বললেন তার সাথে।জানলেন ইনি গান গাইতে পারেন। ঠাকুর তাকে গান গাইতে বললেন
ঠাকুরদাদা গাইছেন -
প্রেম গিরি-কন্দরে, যোগী হয়ে রহিব।
আনন্দনির্ঝর পাশে যোগধ্যানে থাকিব ৷৷
তত্ত্বফল আহরিয়ে জ্ঞান-ক্ষুধা নিবারিয়ে......
 
গানটি অশ্বিনী কুমার দত্তের। গান শুনে শ্রীরামকৃষ্ণ বললেন, আহা, বেশ গান! আনন্দনির্ঝর! তত্ত্বফল! হাসিব কাঁদিব নাচিব গাইব। 
 ১৮৮৪, ২৫শে মে.। ভক্তরা এসেছেন ঠাকুরের জন্মোৎসব পালন করতে। বিজয়, কেদার, সুরেন্দ্র,ভবনাথ, রাখাল সবাই আছেন। কীর্তনের আয়োজন হয়েছে।  কীর্তনিয়া গৌরসন্ন্যাস গাইছেন। 
তার দুটি গান হলঃ নারী হেরবে না!... এবং “আঁধল প্রেম” গান দুটি। 
কথামৃতে সংক্ষিপ্ত উল্লেখ রয়েছে। সম্ভবত গোবিন্দদাসের রচনা।
ঐদিন আরেকটি গানের উল্লেখ পাই কথামৃতে। ঠাকুর দক্ষিণেশ্বরে গঙ্গার ধারে বসে রয়েছেন। বিজয়, ভবনাথ, কেদার প্রমুখ ভক্তেরা উপস্থিত।খানিক আগে কীর্তন হয়েছে। ঠাকুর মাঝে মাঝে বলছেন, হা কৃষ্ণচৈতন্য।       
এরপর  গান ধরলেন তিনি:

    প্রেমধন বিলায় গোরারায়।
প্রেমকলসে কলসে ঢালে তবু না ফুরায়!
চাঁদ নিতাই ডাকে আয়! আয়! চাঁদ, গৌর ডাকে আয়!
(ওই) শান্তিপুর ডুবু ডুবু নদে ভেসে যায়।
গানটির রচয়িতা অজ্ঞাত। একবারই উল্লেখ পাই গানটির ।
আরেকটি গানের উল্লেখ পাই এর দুদিন পর ২৭শে মে ১৮৮৪তে। গানটি হল- শিতল তছু অঙ্গ হেরি সঙ্গসুখ লালসে (হে)। দক্ষিণেশ্বরে গেয়েছেন মনোহরসাঁই গোঁসাই। গানটির রচয়িতা শশিশেখর। এই গানটি সুরেন্দ্রনাথ মিত্রের বাড়িতে আরেকদিন (১৫ই জুন ১৮৮৪) কীর্তনিয়ারা গেয়েছিলেন।   
এবার আমরা একাধিক গানের উল্লেখ পাই ১৫ই জুন ১৮৮৪ তারিখে। ঠাকুর এসেছেন সুরেন্দ্রের বাগান বাড়িতে মহোৎসব উপলক্ষে।আছেন ভবনাথ, নিরঞ্জন, মাস্টার, মহিমাচরন, মণি মল্লিক রাম প্রমুখ ভক্তেরা। আছেন ব্রাহ্ম ভক্তেরা। সকাল থেকে সংকীর্তন হচ্ছে। হচ্ছে একের পর এক গান । 
এখন মাথুর গান হচ্ছে। কীর্তনিয়া প্রথমে গৌরচন্দ্রিকা গাইছেন। - গৌর একবার চল নদীয়ায়।
ঠাকুর ভাবাবিষ্ট। হঠাৎ দাঁড়িয়ে করুণ স্বরে আখর দিতেছেন -- “সখি!   
কীর্তনিয়া গাইছেনঃ
     মরিব মরিব সখি, নিশ্চয় মরিব,
(আমার) কানু হেন গুণনিধি কারে দিয়ে যাব।
না পোড়াইও রাধা অঙ্গ, না ভাসাইও জলে,
(দেখো যেন অঙ্গ পোড়াইও না গো)......
(গানটির রচয়িতা বিদ্যাপতি। একবারই উল্লেখ পাই কথামৃতে।)
পরের গান- ধনি ভেল মূরছিত, 
হরল গেয়ান, (নাম করিতে করিতে) 
(হাট কি ভাঙলি রাই) 
তখনই তো প্রাণসখি মুদলি নয়ান...

গায়ক শ্রীমতীর বিরহ অবস্থার কথা বলছেন। কৃষ্ণ বিরহে শ্রীমতী বাহ্যজ্ঞান হারা। ঠাকুরও ভাবে বিভোর। (গানটির রচয়িতা মুকুন্দ দাস গোস্বামী। একবারই উল্লেখ পাই কথামৃতে।)
পরের গান – 
শ্যামনামে প্রাণ পেয়ে, ধনি ইতি উতি চায়,
 না দেখি সে চাঁদমুখ কাঁদে উভরায়...। 
 
(গানটির রচয়িতা নীলকণ্ঠ মুখোপাধ্যায়। গানটির একবারই উল্লেখ পাই কথামৃতে।)
গায়ক বলছেন-“কোথায় হরি হে, গোপীজনজীবন! প্রাণপল্লভ! রাধাবল্লভ! লজ্জানিবারণ হরি! একবার দেখা দাও। আমি অনেক গরব করে এদের বলেছি, তুমি আপনি দেখা দিবে।
পরের গান- 
মধুপুর নাগরী, হাঁসী কহত ফিরি, 
গোকুলে গোপ কোঁয়ারি (হায় গো)... 
 
কোথায় গোপীজনজীবন প্রাণবল্লভ! এই কথা শুনে ঠাকুর সমাধিস্থ হলেন। রাধাকৃষ্ণের মিলন হইল। কীর্তনিয়ারা ওই ভাবের গান গাহিতেছেন।
ঠাকুর আখর দিতেছেন --
“ধনি দাঁড়ালো রে
অঙ্গ হেলাইয়ে ধনি দাঁড়ালো রে।
     শ্যামের বামে ধনি দাঁড়ালো রে।
তমাল বেড়ি বেড়ি ধনি দাঁড়ালো রে।”
ঠাকুর এবার নৃত্য করছেন। ভক্তেরাও তাঁকে ঘিরে আনন্দে নাচছেন। মুখে “রাধে গোবিন্দ জয়, রাধে গোবিন্দ জয়।”
------------------------------------------------------------
প্রতি সোমবার ও বৃহস্পতিবার নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে এই ধারাবাহিক। আপনাদের অভিমত পেলে ভালো হয়।    
mail - jaladarchi@yahoo.in              

Post a Comment

0 Comments