জ্বলদর্চি

দিল্লি দর্পণ - ১২ / কালীপদ চক্রবর্ত্তী

দিল্লি দর্পণ -১২

কা লী প দ  চ ক্র ব র্ত্তী  


বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য

যখন ছোট ছিলাম, তখন কলকাতায় একটি খেলাধুলার অনুষ্ঠানের সভায় খেলার ধারাভাষ্যকার স্বর্গীয় কমল ভট্টাচার্যের মুখে শুনেছিলাম, তিনি একবার কাঠফাটা গরমে দিল্লি বেড়াতে এসে দেখেছিলেন এখানকার ছেলেরা ওই রোদে ক্রিকেট অনুশীলন করছে। তিনি বলেছিলেন, এই অসম্ভব অধ্যবসায়ের কারণেই হয়তো সেখান থেকে ভাল ভাল ক্রিকেটার তৈরি হচ্ছে। ওই বয়সে তখন কথাগুলোর তাৎপর্য অত গভীর ভাবে না বুঝলেও, এখানে এসে দেখলাম ওনার কথা এবং অভিজ্ঞতা সত্যিই প্রণিধান যোগ্য। মে-জুন মাসের ৪৪/৪৫  ডিগ্রীর ও বেশী তাপমাত্রার গরমে বা ৩ ডিগ্রীর মত ঠাণ্ডাতেও এখানকার ছেলে-মেয়েদের খেলাধুলা অভ্যাস করতে দেখেছি। এখানকার লোকেরা খুব পরিশ্রমী। 
এখানেও বারো মাসে তেরো পার্বণ দেখা যায়। দিল্লিতে বিভিন্ন রাজ্যের অধিবাসী থাকাতে এখানে বিভিন্ন ধরণের পূজাপার্বণ অনুষ্ঠিত হয় এবং সেখানে বিভিন্ন জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে যোগদান সত্যিই উল্লেখযোগ্য। ‘বিবিধের মাঝে দেখ মিলন মহান’ – এই বাক্যটির যথার্থ-রূপ আপনি এখানে সর্বত্র দেখতে পাবেন। এখানে বিবাহের অনুষ্ঠানগুলো দেখলেই বুঝতে পারবেন, ভারতবর্ষের সব জাতি-ধর্ম মিলে মিশে সব একাকার হয়ে গেছে। কয়েক বছর আগে এমনই একটি বিবাহের অনুষ্ঠানে গিয়ে দেখলাম পাত্র হল কেরেলিয়ান এবং পাত্রী হল বাঙালি। বিয়েটা হল দিল্লি ক্যান্টনমেন্টের এক জায়গায়। বর এলো ঢাক ঢোল বাজিয়ে দক্ষিণ ভারতীয় ঢঙে। বিয়ে হল বাঙালি মতে। তবে পুরোহিত ছিলেন সেনাবাহিনীর পুরোহিত, ফলে বিয়ে সম্পন্ন হতে এক ঘণ্টার চেয়েও কম সময় লাগলো। খাওয়া-দাওয়া হল বর পক্ষের ইচ্ছে অনুযায়ী নিরামিষ। বিয়ে এবং বৌভাত একই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সারা হল, খরচ, সময় এবং পরিশ্রম ইত্যাদি বাঁচানোর জন্য। এখানে বহু বাঙালি ছেলেই যেমন অবাঙালি মেয়েদের বিয়ে করে সুখে আছেন, তেমনি বহু বাঙালি মেয়েরাও অবাঙালি ছেলেদের বিয়ে করে বহাল তবিয়তে আছেন। ‘বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য’ কথাটির তাৎপর্য যথার্থ ভাবেই এখানে আপনি দেখতে পাবেন। দিল্লিতে বাঙালিদের একটি পৃথক পরিচয় আছে। সব বাঙালিই ‘দাদা’ নামে  অন্যদের কাছে পরিচিত। সে ছোট হোক বা বড় হোক। উত্তর ভারতের লোকেদের মেয়ের বিয়েতে বেশিরভাগ নিমন্ত্রিতরাই উপহারের বদলে মেয়ের পরিবারকে ক্যাশ-টাকা দিয়ে সাহায্য করে থাকেন, যাতে মেয়ের বাবা অন্তত: খরচা থেকে কিছুটা মুক্তি পান। এই নিয়ম আজকাল বাঙালি পরিবারের বিয়েতেও দেখা যাচ্ছে। এই প্রসঙ্গে জানাই, হরিয়ানার লোকেরা কিন্তু বিয়েতে কোনও উপহার স্বীকার করেন না, অবশ্য আমি তাদের তিলক অনুষ্ঠানে কিন্তু উপহার নিতে দেখেছি। বিবাহে বা অনুষ্ঠানে নিরামিষাশী খাবারেরই আয়োজন করেন।  
এখানকার বিয়েবাড়িগুলোতে আগের দিন গিয়ে যদি দেখেন প্যান্ডেল তৈরি হয়নি তবে অবাক হবেন না। দেখবেন সারারাতের মধ্যে লোহার পাইপ ও কাপড় লাগিয়ে সকালে বিয়েবাড়ির প্যান্ডেল তৈরি। জায়গার অভাবে অনেক সময়ই রাস্তাগুলো ঘিরে রাস্তায় কার্পেট পেতে এক অপূর্ব রূপ দেওয়া হয়। দেখে বোঝার উপায় নেই যে এটি রাস্তা। অবশ্য আজকাল সরকার রাস্তাতে এরকম অনুষ্ঠান করতে অনুমতি  দিচ্ছেন না বলে অন্যকোথাও ভাড়া নিয়ে অনুষ্ঠান করতে হচ্ছে। 
দিল্লি-গেটের খুনি দরওয়াজার অনতি দূরে দরিয়াগঞ্জে প্রতি রবিবার রাস্তার দু’ধারের ফুটপাতে বসতো পুরানো বই-এর বাজার। যদিও সেটি এখন অন্যত্র স্থানান্তরিত করা হয়েছে একথা আগের পর্বেই জানিয়েছি। এটি পড়ুয়াদের জন্য এক খুব প্রিয় জায়গা। রেডফোর্টের পেছনে পুরানো জিনিষের বাজার বসতো, যেটি চোর বাজার নামেই অধিক প্রসিদ্ধ ছিল, সেটিও আজকাল স্থানান্তরিত হয়েছে শুনেছি।  
দিল্লি বিভিন্ন কারণেই অন্যান্য প্রদেশের থেকে একটু পৃথক। এখানকার হিন্দিতে পাবেন পাঞ্জাবী ভাষার মিশ্রণ। কলকাতায় বিহারের হিন্দি শুনতে আমরা অভ্যস্ত কিন্তু দিল্লিতে চলে পাঞ্জাবী হিন্দি। এই দুই-এর মধ্যে একটু পার্থক্য আছে। রোদ বা বৃষ্টিতে লোকেরা ছাতা ব্যবহার করে না বললেই চলে (আজকাল অবশ্য অনেকে করছেন)। এর কারণ হিসেবে বলা যেতে পারে, এখানে একনাগাড়ে বৃষ্টি কম হয় বলেই হয়তো এই অভ্যাস। এখানে দেখবেন অত্যাধুনিক শিল্পকলার যত্রতত্র ব্যবহার। পাবেন লাল রঙের এয়ার কন্ডিশন বাসে ভ্রমণের আনন্দ। এখানকার মেট্রো-কে পাতাল রেল বলা যাবে না কারণ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মাটির ওপর দিয়ে গেছে এর রেল লাইন। এখানে সব পাড়াতে তরিতরকারির বাজার বা মাছের বাজার পাবেন না। পরিবর্তে পাবেন ঠেলা (যাকে স্থানীয় ভাষায় রেড়ী বলা হয়)-য় করে তরিতরকারি বেচার ফেরিওয়ালা। তবে শত চেষ্টা করেও বাংলা পত্র-পত্রিকা সর্বত্র পাবেন না। বাঙালি অধ্যুষিত অঞ্চলে দু’ একটি দোকান দেখা গেলেও যেতে পারে।

স্কেচ- রূপম চক্রবর্ত্তী

Post a Comment

8 Comments

  1. সমৃদ্ধ হলাম দাদা

    ReplyDelete
  2. বাঃ বিয়ের অনুষ্ঠানের কথায় মনে পড়ল -- এক-দুবার আমার অভিজ্ঞতায় এমন হয়েছে পাত্রপক্ষ তখনো পৌঁছায় নি বলে খাবার পরিবেশন শুরু হয় নি। অথচঃ রাত ১১টা বেজে গেছে। অগত্যা না খেয়েই বাড়ি ফেরা। সঙ্গে ফেরত আসল উপহার সামগ্রী 😄😆

    ReplyDelete
  3. দিল্লিতে নিজের অভিজ্ঞ্তার সঙ্গে মিলিয়ে নিতে বেশ ভাল লাগছে বিষয় গুলো জানতে পেরে ।
    চিত্তরঞ্জন শর্মা

    ReplyDelete
  4. ভালো লাগলো আপনার লেখা পড়ে ।

    ReplyDelete
  5. আমরা যারা দিল্লির ঐ সমস্ত অনুষ্ঠানে যাওয়ার সৌভাগ্য পাইনি, সেখানে এই অনবদ্য লেখা আমাদেরকে আগ্রহী ও আনন্দিত করে তোলে। ধন্যবাদ আপনাকে।

    ReplyDelete