জ্বলদর্চি

সুবোধ সরকারের 'চারমাস চিলেকোঠা' / সায়ন

সুবোধ সরকারের 'চারমাস চিলেকোঠা'


সেমিকোলনের আত্মজীবনী || পর্ব -১০  


সা য় ন

'চারমাস' নয়, পাঁচমাস 'চিলেকোঠা'

২৫ শে মার্চ ২০২০, হটাৎ একটা সুন্দর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন দিনে নেমে এল একটা ট্রায়াল - লকডাউন। গোটা দেশ এখন শুধু বন্দী হয়ে থাকবে আপন ঘরে, বাইরে থেকে বহিঃশত্রুর আক্রমণ হয়েছে। শত্রু নির্মাণ করা হয়, শত্রুকে দেখা যায় না - সে প্রবেশ করে আমাদের শ্বাস প্রশ্বাসের জীবনে।
বেঁধে বেঁধে থাকার, হাসি আনন্দ আর একতার মাঝে একটি চীনের প্রাচীর। এই ঘর আমার আস্তে আস্তে হয়ে উঠছে একটা চিলেকোঠা , এই দেশ একটা চিলেকোঠা এবং গোটা বিশ্বই এখন একটা চিলেকোঠা!
নিজস্ব একাকিত্ব আর মানব বিচ্ছিন্ন একাকিত্বের দ্বান্দ্বিকতার মধ্যেই লেগে থাকে অন্ধকার আর নির্মাণ । তখন ছবিতে অন্ধকার, রঙে অন্ধকার, ভাষায় অন্ধকার - এই সমস্ত অন্ধকার এক একটা দেহ নিয়ে বার হতে থাকে। আমি সেই অন্ধকারকে দেখি একমনে - 
  " দরজা খোলার পরে বুঝলাম তুমি এসেছিলে 
যে কোনও দৃশ্যের আগে দেখা যায় অন্য দৃশ্যকে 
পায়ে পায়ে পাপ আসে, হাতে হাতে পাপের গোলাপ 
ছিল ভন্ড, আজ সে প্রেমিক একবিংশ শতকে। " ( কবিতা:৩৬)
 ৫৬ টা রূপ ধরে কবিতাদেহ হেঁটে চলে বেড়ায়, সবার চরটে চরণ - যেন দুহাত, দুপাত। ওদের মাথা নেই - আছে ঠোঁট, ওদের ধর নেই - আছে শুধু হৃদয়। এই হৃদয়ের ধ্বনি শুনতে কান পাতি বুকের উপর। ৫৬ টা অন্ধকার আর আলো বৈচিত্র্য, হৃদয় আর ঠোঁট বলে 'চারমাস চিলেকোঠা' । সে কি! সে তো অনেক বছর আগে ২০১১ সালে সুবোধ সরকারের কবিতার বই। হ্যাঁ, আমরাই আজ আবার জীবন্ত, তোমাকে চারমাস ধরে দেখাবো কিভাবে " এত কাছে গাঙচিল, মানুষ এখনও কতদূর। "
 বাস্তব স্বপ্নের মাঝে টেবিল পেতে বসে আছি । একটা কাঁটাহীন ঘড়ি, জানালা আর একটা বইয়ের উড়ন্ত কিছু পাতা। বাইরে তখন শুয়ে আছে, মনে হচ্ছে অবাস্তব শহর পৃথিবীর পেটে লুকিয়ে আছে - " Cities get less real as they get closer : or as me gets closer to them"
বধ্যভূমি থেকে মহাকবি এলিয়ট পাঠ করছেন - 
Jerusalem Athens Alexandria
Vienna London 
Unreal 
আমি জানালা দিয়ে মুখ বার করে বলি,
 - মহাকবি আপনি ভারতবর্ষের নামটাও যোগ করুন। আপনাকে একটা কবিতা পড়ে শোনাবো এখনই - " কতটুকু বাঁচে লোকে? কতটুকু বেঁচে থাকি আমি? / জলের তলানি বাঁচি। পিপীলিকা মাস্টারমশাই/ এমন একটা দেশ কেউ কারও কথাই শোনে না। / টিপে মারব আমি তোকে, ভাইকে বলছে তার ভাই। " (কবিতা: ১২)

চিলেকোঠায় প্রথম মাস :

আস্তে আস্তে সমস্ত কিছু ঢুকে পড়ছে এই নির্জন চিলেকোঠায়। এক একটা মোবাইল হয়ে উঠছে গোটা দেশ। সভ্যতার সমস্ত জঞ্জাল  উগ্রে    দিচ্ছে আপন প্রচারের ভাষা। এই ফেসবুকই এখন সবচেয়ে বড় চিলেকোঠা যেখানে জমে আছে বাঙালির নিজস্ব পাপের আপেল। সমস্ত সৃষ্টির পিছন থেকে বেরিয়ে আসছে নিজস্ব নগ্নতা। মিথ্যা স্বরের বারুদ আস্তে আস্তে একটা গ্রেনেডের রূপ নেয় - যে কোনো মুহূর্তে আপনাকে আমাকে ছিন্ন ভিন্ন করে দেবে - 'এস . এম . এস' থেকে সেই গ্রেনেড আজ বর্ডার পেরিয়ে 'পোস্ট' এর রূপ নিয়ে নিয়েছে। ঠিক যেভাবে বিশ্বায়নের হাত ধরে এ বর্ডার থেকে ও বর্ডারে ঢুকে পরেছে মানবিক ও জৈবিক ভাইরাস - " বাংলা কবিতা থেকে উড়ে গেছে সব গাঙচিল /   শুধু এস . এম . এস বসেছে জাঁকিয়ে / ভুলে গেছি চিঠি দিতে, পোস্টম্যান আসে না দুয়ারে / পরমাণু শীত এল ডিজিটাল ভালোবাসা নিয়ে। " (কবিতা:৮)

একটা পোস্টম্যান জানালার সামনে এসে একটা খোলা চিঠি দিয়ে গেল। 
- এই শূন্য শহর থেকে কীভাবে এলে তুমি....
বলতে বলতে একটা মাস কেটে গেল.. 

চিলেকোঠায় দ্বিতীয় মাস :

একজন কবির জীবনে ঢুকে পড়ে অনেক কবি। এই 'অনেক' আসলে একজনই। এটা তো চিঠি নয়, একটা পাতার অংশ ডায়েরি থেকে আলাদা হয়ে গেছে - " কবি কোনো কালে গন্ডায় গন্ডায় জন্মায় না । সুতরাং কবিতা লেখক , আপনি নিজেকে দূর্ভাগা মনে করবেন না, উদ্বিগ্ন হবেন না, রেডিও টেলিভিশন সংবাদপত্রে প্রচারিত হবার জন্য ছোটাছুটি করবেন না। বরং বাসনাহীন হয়ে বইটি নিজের খরচায় ছাপুন এবং তারপরে শক্ত মলাটে বাঁধিয়ে ভালো করে কীটনাশক মাখিয়ে কালের গর্ভে নিক্ষেপ করুন। মৃত্যুর পর, অনেকদিন পরে আপনি জানতে পারবেন আপনি কবি ছিলেন কিনা। " এই লাইনগুলো পড়েছি মনীন্দ্র গুপ্তের "চাঁদের ওপিঠে " - ও এই কারণেই কবি এত ভালোবাসেন মনীন্দ্র গুপ্তকে। ৯ বছরের এই গর্ভবাস করার পর আবার কবিতাগুলো শূন্য শহরের ছবি নিয়ে আসতে বেরিয়ে পড়ল যেভাবে " তোমার শরীর যেন অবশিষ্ট লুকোনো অফিস/ বেহুঁশ না হলে কেউ এত ভালোবাসতে পারে না / অফিস যতটা পারে মানুষ পারে না ততবেশি / ভালোবাসা মরে কিন্তু ভালোবাসা মরেও মরে না। " ( কবিতা:১০) 
চারপাশে অন্ধকার নাকি শূন্যতা, তবুও তো সকাল হয়। মস্তিষ্কের বাইরে গাছের পাতার দিকে তাকিয়ে দেখি সবুজ। সে সবুজ বড় ফ্যাকাশে হয়ে যায় যখন শুনি বন্ধুর বাড়িতে নেই খাবার! চিলেকোঠা তুমি কেন বোঝো না " আমি তার চৈত্রমাস, আমি তার নুন / আমি তার ঘুমহীন বিছানায় আমায় আমায় " (কবিতা:১৩) আবার একটা সুস্থ পৃথিবীর জন্য জানলা দিয়ে দুহাত বাড়িয়ে আছি। 
' সুদীর্ঘ কালো চুলে' এর মতো আবার ....

চিলেকোঠায় তৃতীয় মাস:
 
 " বিদ্যুৎ রেখার মতো ধরে আছি লেখার খাতায় / ইউরোপ ধরে আছে যেরকম অ্যালবের কামু - কে " (কবিতা: ৩০) 
তাই নাকি? সত্যিই কি কেউ কাউকে ধরে আছে! ধরে থাকার কাল-নিয়ম-ক্ষণ যে আমাদের চলে গেছে। আমি গোটা ভিক্টোরিয়া বাগানকে অস্বীকার করতে পারি আমার প্রেমিকার হাতের সুগন্ধের জন্য। সেই হাত  কি স্যনিটাইজড  করা যায়! " কতটা স্টুপিড আমি নিষ্ঠুর নগরে ঘুরে মরি / শহরে গরীব নেই আছে আধা সামরিক সেনা।" (কবিতা: ৩১)
 দিল্লি থেকে দেওঘর পুলিশ ছুটে চলে মানুষের ভিতর ভাইরাস মারার নেশায়। গোটা সংবিধান থেকে সংসদ কেউ কিচ্ছুটি করতে পারল না, মুখের একটুকরো কাপড় দিয়ে তুমি মানুষ বাঁচাবে ......... কাঁটাহীন ঘড়ি হাসতে হাসতে বলে - গোটা দেশটা ঢেকে দেব মুখের টুকরো কাপড় দিয়ে! তবুও সাদা পাতার অন্ধকার ছবিতে প্রেমের কথা থাকে - " আমার শরীর থেকে রোদ্দুর মুছিয়ে দিতে এলে / তোমার আঙুল দেখে ভয় করে যদি ভালোবাসি। / ভালো না বাসলে তুমি বেঁচে গেলে, একেবারে ছুটি / মৃত্যুর মুখ থেকে হাসিমুখ বের হয়ে আসি। " (কবিতা : ৪১)  
এক একটি রাজ্যের মধ্যে হাজার লক্ষ মানুষের পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছি , শ্মশানের দরজা খুলে যাচ্ছে একটা একটা করে ... লোকসভা জানে না " কোভিড-১৯ জনিত লকডাউনের অতিমারীর পরিস্থিতিতে দেশে কত পরিযায়ী শ্রমিক কাজ হারিয়েছেন এবং কতজন পরিযায়ী শ্রমিক প্রাণ হারিয়েছেন, দেশের সরকারের কাছে কোনো তথ্য নেই।" (দেশহিতৈষী, ১৮ সেপ্ট, ২০২০) 
কবি এবার সরাসরি আঙুল তোলেন - ".....মহাভারতের মিস্টার বিদুর / বন্ধু বলতে ল্যাপটপ, চিঠি বলতে ব্যাঙ্কের কাগজ /আমাকে চাওনি তুমি , দুরে ছিলে, আজ অতিদূর। " (কবিতা : ৪৩ )
থালা বাটি বাজাতে বাজাতে বাজাতে বাজাতে....  চিলেকোঠার বাইরে নেমে এল আরও একটা লকডাউন 

চিলেকোঠায় চতুর্থ মাস : 

এই বন্দি জীবনের তাৎপর্য কি? নিজেকে দেশের সমাজের মানুষের থেকে বাইরে করে সবটা দেখা। এই ভিড়ে ঠাসা আধুনিক জীবনের নিঃসঙ্গতাকে মানসিক গঠন আর মানস সরোবরের একটি দ্বান্দ্বিক হাইওয়ে দেখা ।শতাব্দীর কথা ,ভাষা ,রঙে তোলপাড় করা গাছগুলো চলে গেল কোথায়, চুল্লিতে ছাই হয়ে গেল কত না জানা ইতিহাস। আমরা তো একবার দেখতে পেলাম না তাদের কচ্ছের রান থেকে কলকাতা, কিংবা " দিল্লিতে আমার কোনও গাছ নেই, কালো পিচ রোড/ তুমি ভাই তুমি বোন তুমি রাস্তা সবার সুজন। " ( কবিতা : ৪২) 
মানুষের কোলাহলে কিংবা নৈঃশব্দে - কোনো জীবনকে কাছে টানার প্রবল অভিকর্ষ আমরা অনেকদিন হারিয়ে ফেলেছি। লেখার টেবিলের পাশে ঝুল ঝেড়ে অপেক্ষা করে একটা চেয়ার। প্রতিদিন একটা করে কবিতা আসে  কথা বলে আর ডুবে যায় দিন শেষে ঘড়ির তলায়।
"আমাকে, আপনি, তুই - কী বলে ডাকলে ভালো লাগে? 
তুমি ছায়া, ছায়া তুই কোথায় থাকিস সারাদিন? 
আপনাকে চোখে না দেখে থাকতে পারি না, ভালোবাসা 
যে জীবনে রং নেই - সে জীবন করেছ রঙিন।" (কবিতা:৫৪) 
আমি কবিতাকে জিজ্ঞাসা করি - আর কতদিন দেখাবে শূন্য কোলাজ? 
কবিতা বলে - লকডাউন কেন , যতদিন মন চায় তোমার।
 জানলার বাইরে বিকট শব্দ, বাজ পাখির ডানায় ছড়িয়ে পড়ছে আগুন মেঘ।  ঘড়ি খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসে আর বলে - লেবাননের রাজধানী বেইরুটে ৪ আগষ্ট ভয়াবহ বিষ্ফোরণে চমকে ওঠে গোটা বিশ্ব। মারা যায় ২০০০ উপর সাধারণ মানুষ । হিরোসিমা নাগাসাকির পর আবার এমন বিস্ফোরণ বলেছে ইউ.এন.ও  ...….. বিকেলে ফেসবুক লাইভে কবিরা জটলা করে - দেখতে, শুনতে পড়তে দেখাতে দেখাতে শুরু হয় -

চিলেকোঠায় পঞ্চম মাস : 

কবির কন্ঠস্বর আবার আসছে " কোনও কবিকে যখন আক্রমণ করা হয়, কোনও লেখককে যখন আক্রমণ করা হয় আমি দেখেছি, সময়টা এখন এমন একটা জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে যে, সেই কবির হয়ে সেই লেখকের হয়ে অন্য কবিরা এসে দাঁড়ায় না, অন্য লেখকরা এসে দাঁড়ায় না। কবিরা দূরে দাঁড়িয়ে মজা দেখে। .... কেউ হয়তো ফুচকা খেতে খেতে উপভোগ করে, কেউ হয়তো সিগারেট টানতে টানতে উপভোগ করে। " 
( 'কিন্নর দল', শারদ সংখ্যা,১৪২৭)
ঘরে থাকি আর বাইরে থাকি অবস্থাটা তাহলে আলাদা কিছু নেই। বেইরুটে বোমা পড়ুক কিংবা সিরিয়া থেকে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাক ৮০০র বেশি হাসপাতাল - কবিদের কিছু যায় আসে না । না খেতে পেয়ে এই লকডাউনে কত কলম মুখ থুবড়ে পড়ে গেল জানতেও পারলাম না। একটা কবিতা আর জীবনের মধ্যে কোনও ফারাক আছে কি, কবিতার স্পন্দনটাতো বুকের মধ্যে ডাব লাব করে । স্পন্দনটুকু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেই কতগুলো শব্দের রেখা শুধু , একবার তো আপনাকে নাড়ি চেপে বুঝে নিতে হয় - সাচ্চা কবিতা ছিল কিনা? 
 
" কবি কারও দাস নয়, পূর্ণিমা যেমন ছিল, আছে
কবিকে কিনতে চাও? আদার ব্যাবসা নয় কবি।
দিনে সাতখানা লোভ, আছে শত্রু শীততাপ ঘরে
নিয়তির মোবাইলে কথা হল,কাকে ভয়, কবি?"
( কবিতা : ৫৬)

Post a Comment

0 Comments