জ্বলদর্চি

সিগমুণ্ড ফ্রয়েড ও ইংরেজি সাহিত্য(Sigmand Freud and English literature)

(Sigmand Freud and English literature)


সিগমুণ্ড ফ্রয়েড ও ইংরেজি সাহিত্য

ত প ন জ্যো তি  ব ন্দ্যো পা ধ্যা য়

 গত শতাব্দীতে বৌদ্ধিক পরিমণ্ডল যে চারটি বিশেষ চিন্তাসূত্রের দ্বারা আলােড়িত হয়েছিল তার একটি হ’ল মনোবিশ্লেষণের কৌশল প্রয়ােগ ক'রে যে মানুষের অন্তর্জগত ও প্রকাশ ব্যবহারের বৈচিত্র্য বিষয়ে জ্ঞান অর্জন সম্ভব তা হৃদয়ঙ্গম করা। এই কাজটির জন্যে বিংশ শতাব্দীর মনন বিশেষভাবে ফ্রয়েডের কাছে ঋণী। অন্য তিনটি চিন্তা কাঠামাে হ'ল কার্ল মার্কসের দর্শন, গণিত, পদার্থ বিজ্ঞানের কল্যাণে পাওয়া বিশ্ববীক্ষা এবং নৃতাত্ত্বিকদের গবেষণাপ্রসূত বিভিন্ন ধরনের সামাজিক গঠন, রীতিনীতি বিষয়ে নবলব্ধ জ্ঞান।

সাহিত্য সমালোচনার সময় একটা অবশ্য-সত্য (এবং হয়তাে সেই জন্যেই চিৎকার করে বলার মতো সত্য নয়) আমরা বলে থাকি যে যেকোনও যুগের সাহিত্যই সেই সময়কার বৌদ্ধিক আবহের সঙ্গে সংযুক্ত, এমনকি তার দ্বারা অনেকাংশে নিয়ন্ত্রিত। এই আবহ হয়তােবা ধর্মীয় কিংবা দার্শনিক, নয়তাে রাজনৈতিক অথবা অর্থনৈতিক। ইংরাজী সাহিত্যের কথা মাথায় রাখলে এটা বলতেই হবে যে অষ্টাদশ শতকের উল্লেখযােগ্য লেখকদের রচনায় কার্টেজীয় (Cartesian) দর্শনের প্রতিধ্বনি শ্রুত হয়। রােম্যান্টিক কবি সাহিত্যিকরা রুশাের তত্ত্ব এবং জার্মান আদর্শবাদের দ্বারা প্রভাবিত। ভিক্টোরীয় যুগের প্রথম দিককার প্রধান লেখকগণ ইউটিলিট্যারিয়ান ধ্যানধারণায় সম্পৃক্ত এবং পরবর্তী পর্যায়ের ভিক্টোরীয় ঔপন্যাসিক প্রমুখ বিবর্তনবাদ ও তার সঙ্গে যুক্ত চিন্তাসমূহে বিশ্বাস ন্যস্ত করেছেন।

ফ্রয়েডের তত্ত্ব নিয়ে দীর্ঘ আলােচনার অবকাশ আমাদের নেই। শুধু তাঁর কয়েকটি মূল প্রাক্ সিদ্ধান্তের (hypotheses) উল্লেখ করা যেতে পারে: (ক) মানুষের বিকাশ সবচেয়ে ভালােভাবে বােঝবার উপায় হল তার যৌন-ইচ্ছার পরিবর্তনশীল বস্তুগুলির বিশ্লেষণ; (খ) আমাদের মনস্তাত্ত্বিক যন্ত্রটি অভ্যাসবশত যৌন এবং আক্রমণাত্মক ইচ্ছাগুলােকে দমন করে থাকে এবং তার ফলে সেই ইচ্ছাগুলাে ধ্যান ধারণার অবচেতন অবস্থার মধ্যে সংরক্ষিত হয়; (গ) অবদমিত ইচ্ছাগুলির সঙ্গে অবচেতনে যে সংঘাত চলে তা অনেক সময়ই স্বপ্ন বা অন্য ধরনের পলায়নী পদ্ধতির মাধ্যমে প্রকাশের পথ খুঁজে নেয়।

আমরা এটা জানি যে ফ্রয়েডের দুই উজ্জ্বল শিষ্য ও ছাত্র, অ্যাডলার এবং য়ূঙ্গ, তাঁর প্রদর্শিত পথে কিছুদূর অগ্রসর হবার পরে তাঁদের নিজেদের তত্ত্ব আবিষ্কার করেন এবং মানুষের মনস্তত্ত্বে ফ্রয়েডীয় লিবিডোর বাইরেও যে আরও কিছু চালিকাশক্তি আছে তা প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু আমরা যখন ইউরােপীয় সাহিত্যে, বিশেষ করে ইংরেজী সাহিত্যে, এই যুগান্তকারী মনোবিশ্লেষণ তত্ত্বের প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষ প্রভাব খুঁজে বার করার চেষ্টা করি, তখন অনিবার্যভাবেই, প্রধানত ফ্রয়েড আমাদের সামনে এসে দাঁড়ান।

এই প্রভাব কাব্য, নাটক, উপন্যাসে নিশ্চয়ই বিশেষভাবে দৃষ্ট হয়। কিন্তু সাহিত্য আলােচনার ক্ষেত্রেও বিশেষ করে কিছু কিছু লেখকের লেখায় মূল ভাবনা ও ধারার বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে মনােবিশ্লেষণ নামক আগ্রাসী এই বিশ শতকীয় দর্শনের ছায়াপাত ঘটেছে উল্লেখযােগ্য রকমের। সাহিত্য- তত্ত্ব নির্মাণেও এই প্রভাব দৃশ্যমান।

একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে ইংরেজ কবি সাহিত্যিকেরা মনােবিশ্লেষণাত্মক রচনার জন্যে ফ্রয়েডের অপেক্ষায় ছিলেন না। অর্থাৎ ফ্রয়েডের আবির্ভাবের আগে তাঁরা চরিত্রগুলির অন্তর্জগত সম্পর্কে সম্পূর্ণ উদাসীন ছিলেন, একথা ঠিক নয়। ভিক্টোরীয় যুগে কবি ব্রাউনিং ঘােষণাই করে দিয়েছিলেন যে তাঁর  উদ্দেশ্য হল মানব-আত্মার বিকাশের বিশ্লেষণ, অন্য কোনও কিছুই তাঁর মনােযােগের যােগ্য বলে তিনি বিবেচনা করেননি। উনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে যেমন ডিকেন্স, থ্যাকারে, কার্লস বীড এবং টমাস হার্ডির মত ঔপনাসিকেরা নরনারীর বহিরঙ্গের গল্প লিখেছেন, জর্জ এলিয়ট, মেরেডিথ, জর্জ মুর এবং হেনরি জেমস এর মত লেখকগণ তাদের সৃষ্ট চরিত্রগুলির অন্তরঙ্গ চিত্রনে বেশী আগ্রহ দেখিয়েছেন। সামগ্রিকভাবে ইউরোপীয় পটভূমি কথা মাথায় রাখলে টলস্টয়, তুর্গেনিভ এবং দয়স্তয়ভস্কি এরা সকলেই দুই ধরনের ভঙ্গীতেই প্রায় সমান পারদর্শিতা দেখিয়েছেন। বিংশ শতাব্দীর প্রধানত ফ্রয়েডীয় মনােবিশ্লেষণাত্মক কৌশলের সর্বাধিক ব্যবহার দেখেছে, কী সৃষ্টিধর্মী রচনায়, কী সমালােচনা সাহিত্যের অঙ্গনে। গল্পে-উপন্যাসে মানুষের মনের ভিতরে ডুব দেওয়ার প্রবণতার একটা বড় কারণ নিশ্চয়ই উনিশশতকী লাসসা ফেয়ার (Laissez faire) পুঁজিবাদী অর্থনীতির প্রভুত্ব। স্পর্শকাতর দরদী ও মরমী স্রষ্টার কাছে মনােজগতের হাতছানি দেখানাে পরিত্রাণের পথ। কিন্তু একই সঙ্গে এটাও সত্যি যে বিশ শতকের প্রথম দু'তিন দশকেই মানব জ্ঞানের ভুবনে যে বৈপ্লবিক বিস্ফোরণ ঘটল, পদার্থ বিজ্ঞান, রসায়ন, জীববিজ্ঞান এবং গণিতের ক্ষেত্রে এবং চিকিৎসা বিজ্ঞান ও এমনকি সমাজ বিজ্ঞানের পরিসরেও যে সব দিগন্ত বিস্তৃতকারী পরিমার্জন ও সংযােজন ঘটতে থাকল, তা বিগত শতাব্দীর জমাট-বাঁধা জ্ঞান ভাণ্ডারের সামনে ছুঁড়ে দিল দর্পিত প্রতিস্পর্ধা: খুঁটিয়ে দেখা, জ্ঞান রাশির বিশালতাকে স্বীকার করেও তার উৎসমুখের অনুসন্ধান এবং চরমসীমায় সূচীমুখগুলিকে স্পর্শ করার ব্যাকুলতা-- এই সবই বিংশ শতাব্দীর মনকে যখন ঝাঁকুনি দিয়ে উত্তেজিত করেছে ঠিক তখনই ফ্রয়েডীয় মনোবিজ্ঞান তত্ত্বগুলি সাহিত্যের সামনে হয়ে দাঁড়াল স্পষ্ট এবং অভিপ্রেত এক দিক নির্দেশিকা।

বর্ণনাত্মক মনােবিজ্ঞানের যে ঐতিহ্য (ইংরাজী) সাহিত্য এতদিন বয়ে বেড়াচ্ছিল যেখানে চিন্তা ও অনুভূতিগুলি সুশৃংখল এক মিছিলের মত এগিয়ে যেত শুরু থেকে শেষের দিকে সেই উত্তরাধিকার অগ্রাহ্য করে সাহিত্যিকরা বিশ্লেষণমূলক মনোবিজ্ঞাননের আশ্রয় নিলেন: যুক্তিনিষ্ঠা এবং অবিবেচনা, সুস্থ মানসিকতা ও উড়ক্কু ক্ষ্যাপামি, স্বাভাবিক ও বিকৃতমনা এই সব একসঙ্গে পাশাপাশি অথবা সামনে পিছনে জায়গা করে নিল। বিশ শতকের প্রথম দিককার 'আত্মানুসন্ধানী উপন্যাস' (Introspective Novel) নিঃসন্দেহে ফ্রয়েডের তত্ত্বজ্ঞানের জমির উপর গড়ে-ওঠা। Mrs. Dalloway,Those Barren Leaves, Point  উপন্যাসগুলি  এই শ্রেণিভুক্ত।  এগুলি যদি 'অন্তর্গত আত্মকথন' (internal monologue) হয়,তাহলে Orlando, Forster-এর A passage to India-র অংশ বিশেষ (মাড়াবার গুহার ঘটনা) ইমপ্রেসনিস্ট (impressionistic)! পরাবাস্তববাদ (surrealism) ফ্রয়েডের প্রভাবের ফসল অবশ্যই। তবে গল্প-উপ্যনাসের তুলনায় ছবি এবং কবিতার আঙ্গিকেই তার প্রকাশ ঘটেছে বেশী মাত্রায়। Henry Moore, John sutherland আঁকার জগতে এবং Vernon Watkis ও  F. Prokosh কাব্য জগতে এই শৈলী ব্যবহারের উদাহরণ রেখেছেন। T.S. Eliot-এর কবিতায় কখনাে কখনাে impressionism এর দৃষ্টান্ত দেখা যায়। বিভিন্ন স্তরের ব্যঞ্জনাযুক্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে অনেক সময় তিনি রেখে দিচ্ছেন পাশাপাশি। কখনাে বা সবগুলাে জুড়ে দিচ্ছেন একটা সংক্ষিপ্ত চেহারায়, যাতে একটা অর্থহীনতা ও দুর্বোধ্যতার আপাত-মিশেল তৈরী হয়। এবং একই সঙ্গে গভীরতর এক সংযুক্তির ব্যঞ্জনা।

এটা উল্লেখ করা জরুরি যে সৃষ্টিধর্মী (ইংরেজী) সাহিত্য শুধু মনােবিশ্লেষণের কৌশলগুলির ব্যবহারেই থেমে থাকেনি, বিষয়বস্তুগুলির ব্যবহারও এই সাহিত্যে চোখে পড়ার মত। চারটে প্রধান বিষয়বস্তু বারবার ব্যবহৃত হচ্ছে: স্মৃতি, যৌনতা, মন্দ জীবনের আলেখ্য এবং শিশুসুলভ অস্তিত্বের টানাপােড়েন (কখনাে বা বয়ঃসন্ধির আবেগ ও পীড়ন)। ভার্জিনিয়া উলফ, জেমস জয়েস, ডি, এইচ.লরেন্স তাঁদের রচনায় স্মৃতির অসামান্য ব্যবহার করেছেন, তাঁদের ব্যবহৃত স্মৃতি উদ্দেশ্য সাধনের হাতিয়ার নয়, তা হ’ল মনের মধ্যে ফিরে আসা অতীত ঘটনা ও আবেগগুলির মধ্যেকার মুক্ত এবং প্রায় স্বয়ংক্রিয় যােগাযােগের সূত্র নির্মাণ। Mrs. Dalloway এবং The Waves-এই গল্পগুলির মূল বিষয় মানবিক চৈতন্যের স্রোত। ভার্জিনিয়া উলফ এবং জেমস জয়েস উভয়েই মার্শেল প্রুস্ত - এর রচনা দ্বারা প্রভাবিত। বিশেষ
করে প্রুস্তের A La Recherche du Temps Perdu তে এই মগ্ন চৈতন্যধারার যে প্রক্ষেপণ রয়েছে তা তাদের উদ্বুদ্ধ করেছে ভীষণভাবে। প্রুস্ত এর রচনাশৈলী এবং বিষয় নির্মাণ অবশ্যই মনোবিশ্লেষণ-এর ফসল। ফ্রয়েড এবং তাঁর অনুগামীরা অসংখ্য মনোবিকলন-সংক্রান্ত গবেষণা পত্র লিখেছিলেন এবং তাঁদের বিশ্লেষণ থেকে উঠে এসেছিল বহুধরনের তথাকথিত বিপথগামী এবং গভীর তাৎপর্যপূর্ণ যৌন রহস্যের খুঁটিনাটি। বিশ শতকের প্রথম কয়েক দশক ধরে বিশেষ করে ইংরেজ ঔপন্যাসিক এইসব বিশ্লেষণী রচনা থেকে অনুপ্রেরণা আহরণ করে প্রেম-জীবনের নতুন বর্ণনা ও ব্যাখ্যায় প্রবৃত্ত হলেন। ডি. এইচ লরেন্স এক চমৎকার উদাহরণ। তিনি ফ্রয়েডের প্রভাবে বিশেষ প্রভাবিত হয়েছিলেন। The Fantasia of the Unconscious নামে একটি পুস্তিকাও তিনি লিখেছিলেন। এবং ফ্রয়েডীয় ধরনে তিনি  তাঁর দুই বিখ্যাত উপন্যাস Sons and Lovers এবং Lady Chatterley's Lover এ যৌন-সম্পর্কগুলির বিন্যাস ও অনুসন্ধান করেছেন। Sons and Lovers এ নায়কের সঙ্গে দুই নারীর (মিরিয়ম ও ক্লারা) প্রেমের ও যৌনতার সম্পর্কের উপর তার (নায়কের) মা'র (একটা সময় পর্যন্ত) প্রায় সর্বগ্রাসী স্নেহচ্ছায়া যে আলাে অন্ধকারের মায়া তৈরী করে তা অবশ্যই ফ্রয়েডীয় দর্শন অনুপ্রাণিত। ভার্জিনিয়া উল্ফ To the Lighthouse উপন্যাস লেখার সময় তার ডায়েরীতে একদিন লিখেছিল : "এ মুহূর্তে এক নারীর খানিকটা গুপ্ত, আধ্যাত্মিক এবং খুব গভীর একটি জীবন আমাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। এই গল্প একটা সময়ে আমি বলব এবং তখন বর্তমান পুরােপুরি মুছে যাবে। ভবিষ্যৎ ফুটে উঠবে অতীতের গর্ভ থেকে: হয়ত সামান্য একটা ফুলের পতনের মতন (তুচ্ছ) ঘটনা ব্যাপারটা ধরে রাখবে।” এখানে ফ্রয়েডের প্রভাব হয়ত প্রত্যক্ষ নয়, কিন্তু ফ্রয়েড চেতন-অবচেতনের যে তত্ত্ব প্রস্তুত করেছিলেন তা উলফের মত লেখিকার রচনারীতি ও প্রকরণে আনছে অভিনবত্ব। ফ্রয়েড-পরবর্তী ইংরেজ লেখক স্মরণযােগ্য চরিত্র নির্মাণের চেয়ে চরিত্রগুলির মনের আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়ানাে অনেক বেশী জরুরী মনে করলেন। Melin Friedman যথার্থই লিখেছিলেন: "আধুনিক উপন্যাসের উত্থানের কারণ খোঁজার জন্য বেশী দূরে যাবার দরকার নেই—য়ূঙ্গ -এর রচনাতেই তা পাওয়া যাবে।" এই য়ূঙ্গ (Jung), আমরা জানি, ফ্রয়েডের অন্যতম প্রধান শিষ্য ও ছাত্র। দৈহিক কামনার উদ্দামতা যে মানুষের আচরণের পিছনে মুখ্য চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে তার সাহিত্যিক উদাহরণ আমরা পেলাম লরেন্স, পাউইস (Pawys) অথবা উল্ফের অনেক পরে হেনরি মিলার এবং নবােকভের রচনায়। গ্রাহাম গ্রিন Brighton Rock এর মিস ক্রম্পটন বার্ণেটের More Woman Than Man, এফ. এল. গ্রীন এর Odd Man Out এর মত উপন্যাসে মানুষের ভিতরকার অশুভ শক্তির (evil) তীব্র প্রকাশ দেখা গেল। এই রচনাগুলিতে মূল চরিত্রগুলি আসলে মানবিক অশুভ শক্তির মনস্তাত্ত্বিক প্রতিরূপ প্রস্তুতি। এই উপন্যাসগুলির কোনও কোনওটিতে এবং আরও অনেকগুলি সমসাময়িক ইংরাজী উপন্যাসে শৈশব এসেছে বিষয়বস্তু হিসেবে। এর পেছনেও আছে ফ্রয়েড এবং তার অনুগামীদের অবদান। মনোবিশ্লেষণ যে বিজ্ঞান তাঁরা সামনে নিয়ে এসেছিলেন তাতে মানুষের শিশুকাল এক বিশেষ স্থান ও গুরুত্বের অধিকারী।

ফ্রয়েড পরবর্তী ইংরাজী উপন্যাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ, তাই উনিশ শতকের উপন্যাসের ধারাকে বিশ্বস্তভাবে অনুসরণ না করে একটা নতুন ধরন ও চরিত্র নিয়েছিল। অবচেতন মনের ক্রিয়াকলাপ, অবদমিত যৌনতার প্রকাশের নানান ভঙ্গি স্বপ্ন অথবা স্বপ্নের মত মগ্ন চৈতন্যের অন্য কোনও প্রক্রিয়া এইসব বিষয় ও প্রকরণ বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ  জুড়ে ইংরাজী উপন্যাসে ছড়িয়ে ও ছেয়ে আছে।

অন্য আরেকটি প্রসঙ্গ অল্প একটুখানি আলোচনা করেই এই নিবন্ধ শেষ করবাে। আগেই উল্লেখ করেছি, সাহিত্য-সমালােচনার ক্ষেত্রেও ফ্রয়েড-পরবর্তী যুগে চিন্তাশীল পাঠক ও পণ্ডিতেরা একটি নতুন মাত্রা যােগ করেছেন। Psycho-analytical criticism যে ধারা বিশ শতকে বেশ একটি প্রভাবশালী ধারা হিসেবে চিহ্নিত, তা বহুলাংশে ফ্রয়েডীয় চিন্তার প্রয়ােগের একটি পরিসর। আর্নেষ্ট জোনস্ (যিনি স্বয়ং একজন মনােবিদ ও ফ্রয়েড-অনুগামী) হ্যামলেটের আচরণের যে ইদিপাস কমপ্লেক্স নিয়ন্ত্রিত ব্যাখ্যা দিয়েছেন তা তাে সর্বজনবিদিত। ডি, এইচ, লরেন্সের Sons and Lovers এর নায়ক পল মরেলের মাতৃ-নির্ভরতা ও প্রেমিকাদের সঙ্গে রহস্যময় আচরণ—এরও ব্যাখ্যা ঐ একই কমপ্লেক্সের সূত্রে দেওয়া হয়েছে এবং অনেক সমালােচকই এই কাজ করেছেন। উপন্যাসে স্বপ্ন-নির্ভর যুক্তি (dream-logic), চৈতন্য প্রবাহ(stream of consciousness), রূপকধর্মী প্রক্ষেপণ (metaphorical representation), ফ্যান্টাসির ব্যবহার—গুলি উল্লেখ ও সবিস্তার আলােচনা আধুনিক সমালােচনার অঙ্গ। এই প্রসঙ্গে প্রখ্যাত সমালোচক লিওনেল ট্রিলিং (তার Freud :Within and Beyond Culture শীর্ষক রচনায়) বলেছেন: আমাদের সাহিত্য-আস্বাদনের ব্যাপারে ফ্রয়েডের ভূমিকা এই নয় যে তিনি সাহিত্য বিষয়ে অনেক কিছু বলেছেন, সেটা এই যে তিনি মানুষের মনের প্রকৃতি বিষয়ে বিশেষ কিছু বলেছেন.." অর্থাৎ ফ্রয়েডীয় মনােবিশ্লেষণ আমাদের সাহিত্য বােঝার, সাহিত্যরস উপলব্ধি ও আস্বাদন করার রসদ জুগিয়েছে।

ফ্রয়েড নিজে শেক্সপীয়রের Merchant of Venice এবং King Lear নাটকের অংশ বিশেষের বিশ্লেষণ করেছিলেন। প্রথমােক্ত নাটকের বিখ্যাত Casket Scene এর নিজস্ব মৌলিক ব্যাখ্যা দিয়ে ফ্রয়েড বলেছেন এই দৃশ্যটিকে স্বপ্নের প্রকৃতির সূত্রে বুঝে নেওয়া যায়: স্বপ্নে casket, box, basket, case এই বস্তুগুলি আসলে নারীর প্রতীকী রূপ। তাই ব্যাসানিও’র তিনটি casket থেকে বেছে নেওয়া আসলে তিনটি নারীর মধ্যে একজনকে পছন্দ করার কাজ King Lear-এর তিন নারীর (রাজার তিন কন্যা) মধ্যে লীয়রের Cordelia কে ত্যাজ্য করে Goneril ও Regan কে বেছে নেওয়ার মধ্যে ফ্রয়েড একই ধরনের কৌশল আবিষ্কার করেছেন। তফাৎ হল, Bassanio'র পছন্দ ছিল নির্ভুল আর Lear এর পছন্দ ভুল ও বিপথে চালনাকারী। শেষ করি এই কথা বলে যে টমাস্ মান একদা ফ্রয়েডকে সাহিত্যে নােবেল পুরস্কারের জন্য মনােনীত করেছিলেন।

Post a Comment

3 Comments

  1. খুব ভালো প্রবন্ধ । বিদেশিসাহিত্যে ফ্রয়েডচিন্তার প্রভাব স্বচ্ছভাবে জানতে পারলাম । আমাদের বাংলা সাহিত্যেও একসময় এই প্রভাব ছিল , এখনো আছে মনে হয় ।

    ReplyDelete
  2. অনবদ‍্য দৃষ্টিপাত!
    প্রতিবেদক মহোদয়কে অপার শ্রদ্ধা জানাই।

    ReplyDelete
  3. ভাবনা ঋদ্ধ লেখা।

    ReplyDelete