‘তানাজী : দ্য আন্সাং ওয়ারিয়ার’ – গেরুয়া রাঙা দেশাত্মবোধ
পরিচালনা: ওম রাউত
অভিনয়ে – অজয় দেবগন, কাজল, সইফ আলি খান, শরদ কেলকার, লুক কেনি
রিলিজ – ১০ জানুয়ারি, ২০২০
রেটিং – 4/5
ঐতিহাসিক ঘটনা অনেকসময় বিস্মৃত হতে হতে স্থান পায় লোককাহিনী হিসেবে। সেই অর্থে বলতে গেলে লোককাহিনী ইতিহাসের দলিল না হলেও গুরুত্বপূর্ণ দস্তাবেজ। ইতিহাস তো আসলে শাসকের জয়গাথা গায়, সময়ে সময়ে পরিবর্তিত হয় তার ভাষ্য। কিন্তু কিছু কাহিনী এমনও থাকে যাকে অস্বীকার করার চেষ্টা করলেও ভোলা অসম্ভব। আমাদের দেশ বীরের দেশ, আমাদের দেশ কাহিনীর দেশ। ভারতবর্ষের মাটিতে সময়ে সময়ে এমন অবিস্মরনীয় বীরের জন্ম হয়েছে যাদের বীরগাথা হাজার বছরের বিদেশী শাসনে আবছা হলেও হারিয়ে যায়নি। এমনই এক মারাঠা বীর সুবেদার তানাজী মালুসারের বীরত্বের কাহিনী শৈশবের অমর চিত্রকথার পাতা থেকে সেলুলয়েডের পর্দায় তুলে ধরেছেন পরিচালক ওম রাউত।
গল্পটা মোটামুটি সকলের জানা, ভারতবর্ষের বুকে তখন মুঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেবের শাসন। একদিকে রাজ্যবিস্তার অপরদিকে বলপূর্বক ধর্মান্তকরণ দুটোই সাফল্যের সাথে সামলাচ্ছেন আলমগীর বাদশা। এসময় মহারাষ্ট্রের মাটিতে জন্ম নেয় এক মুক্তিসূর্য, ছত্রপতি শিবাজী মহারাজ। স্বরাজের স্বপ্ন চোখে নিয়ে একের পর এক দখল করতে থাকেন মুঘলদের কেল্লা। শিবাজীকে দমন করতে লক্ষাধিক সেনার সাথে মীর্জারাজা জয় সিং-কে পাঠান মুঘল বাদশা। বাধ্য হয়ে পুরন্দরের সন্ধি স্বাক্ষর করেন শিবাজী। স্বরাজের অন্তর্গত তেইশটি কেল্লা মুঘলদের ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হন। এই তেইশটি কেল্লার মধ্যে অন্যতম ছিল কোন্ধানা কেল্লা। শিবাজীর শৈশবের একটা বড় অংশ কেটেছিল ওখানে, তাই এই কেল্লার প্রত তাঁর আত্মিক টান ছিল। এরপর মারাঠারা শিবাজীর নেতৃত্বে আবার হৃত কেল্লা পুনরুদ্ধারের শপথ নেয়। শিবাজীর বাল্যবন্ধু এনং ডানহাত বলে পরিচিত সুবেদার তানাজী মালুসারে কোন্ধানা উদ্দারের দায়ীত্ব নেন। নিজের একমাত্র ছেলের বিবাহের আগের দিন তিনি কোন্ধানা পুনরুদ্ধারে যান। লোককথা অনুসারে তিনি বৈজয়ন্তী নামের এক পোষা গোসাপের সাহায্যে কেল্লার খাড়া দেওয়াল চড়েন। রাতের অন্ধকারে তানাজীর নেতৃত্বে মারাঠা সেনার সাথে কেল্লার মুঘল শাসক উদয়ভান রাঠৌরের সেনার সাথে ভীষণ যুদ্ধ হয়। মুঘলদের হারিয়ে কোন্ধানা গড়ে মাথা তোলে মরাঠা স্বরাজের গেরুয়া পতাকা। কেল্লা উদ্ধার হলেও যুদ্ধের আঘাতে শহীদ হন তানাজী। প্রিয় বন্ধুর বিয়োগে শিবাজী মহারাজ বলেন- ‘কেল্লা ফিরে এক, কিন্তু সিংহকে হারালাম। ’ এরপর শিবাজী মহারাজ বন্ধুর বীরত্বের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে কোন্ধানা কেল্লার নতুন নামকরণ করেন ‘সিংহ গড়’। বলিউডের পরিচালকদের বিগত বেশ কিছু বছর ধরে ইতিহাস পছন্দের বিষয় হয়ে উঠেছে। সঞ্জয় লীলা বনশালী, আশুতোষ গোয়ারিকরদের সঙ্গে যোগ হল ওম রাউতের নাম। বহু শতাব্দী আগের ইতিহাসের গল্প আজকের দিনের জন্য গ্রহণযোগ্য করে তোলার পথ খুঁজে পেয়েছেন ওম এবং অজয়। অসাধারণ সিনেমেটোগ্রাফি, ব্র্যাকগ্রাউন্ড স্কোর, সেট, কস্টিউম সব কিছু দেখে বোঝা যায় এই ছবি সময় নিয়ে, যত্ন নিয়ে করা।
ছবির কাস্টিং দুর্দান্ত। চেনা ছকের লার্জার-দ্যান-লাইফ পিরিয়ড পিসে একাধারে পরাক্রমী পৌরুষ, শৌর্য-বীর্যের মূর্ত প্রতীক, প্রবল দেশপ্রেমিক এবং দায়িত্ববান পত্নীনিষ্ঠ স্বামীর ভূমিকায় অজয় দেবগনকে যেমনটা লাগার কথা ছিল, ঠিক তেমনই লেগেছে। এক দিকে তিনি বীরপুরুষ-সুলভ চোখা চোখা নাটকীয় সংলাপে, মরাঠা জাত্যাভিমানে, শিবাজী রাজের প্রতি অটুট আনুগত্যে, তুখোড় যুদ্ধকৌশলও অস্ত্রচালনায়, দড়ি বেয়ে অতল খাদ পেরোনো বা দুর্গম পাহাড় চড়ার অনায়াস বীরত্বে নজর কাড়েন। অন্য দিকে সেই তিনিই একমাত্র ছেলে রাইবার বিয়ে নিয়ে আবেগে চোখের জল ফেলা স্নেহশীল পিতা কিংবা স্ত্রী-র সাধপূরণে দুজনকে এক ফ্রেমে দেখতে পাওয়ার আয়না কেনা প্রেমিক স্বামী। তানাজি হিসেবে অজয় দেবগণ বিশ্বাসযোগ্য। পাতাল কাঁপানো সংলাপ, যা এমনিতে অসম্ভব মনে হলেও তাঁর গলায় মানিয়ে যায়। দেশাত্মবোধক ভাব জাগিয়ে তুলতে সফল অজয়। তবে এই ছবির সারপ্রাইজ প্যাকেজ সইফ আলি খান। মুঘল সাম্রাজ্যের রাজপুত সেনাপতি উদয় ভান রাঠৌরের ভূমিকায় সইফ আলি খান। সইফ একটা অদ্ভুত স্মার্টনেস নিয়ে এসেছেন উদয় ভানের চরিত্রে। নৃশংসতার পাশাপাশি এক অদ্ভুত সেন্স অফ হিউমার রয়েছে উদয় ভানের। কস্টিউম থেকে শরীরী ভাষা, সইফ এই চরিত্রে যেটা এনেছেন, সেটা অনবদ্য। তানাজির স্ত্রী সাবিত্রীর চরিত্রে কাজল। ‘তানাজি’-তে তাঁর স্ক্রিন প্রেজেন্স খুব স্বল্প। অজয়ের সঙ্গে তাঁর দৃশ্যগুলো পর্দায় ম্যাজিক সৃষ্টি করেছে। শরদ কালেকারকে ছত্রপতি শিবাজি হিসেবে এমন মানিয়েছে, যে অন্য কাউকে এই চরিত্রে আর ভাবাই যায় না। লুক কেনি ঔরঙ্গজেব হিসেবে দারুণ।
লড়াই এবং যুদ্ধের প্রস্তুতির দৃশ্যগুলোয় প্রযুক্তির অনবদ্য ব্যবহা্র, রাজকীয় সেট, কেল্কো নকাহারার দুর্দান্ত সিনেম্যাটোগ্রাফি কিংবা অজয়-অতুলের জমজমাট ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর এবং চোখ ধাঁধানো কোরিওগ্রাফিতে এ ছবিতে বিনোদনের উপাদানের খামতি নেই। বেশ কিছু দৃশ্য সত্যিই তাক লাগিয়ে দেওয়ার মতোও। ওয়ার সিক্যুয়েন্স গুলো অনবদ্য বাধ সাধল শুধু ছবির গতি এবং ইতিহাসের মূল গল্পকে অযথা টেনে লম্বা করে তুমুল অতিনাটকীয় রূপায়ণ! ইতিহাসের খুঁটিনাটি জানবেন ভেবে ছবি দেখলে হতাশ হবেন বরং অ্যাকশন, পিরিয়ড-ওয়ার ছবি দেখতে যাচ্ছেন ভেবে যদি দেখেন, ভাল লাগবে। ‘তানাজী : দ্য আন্সাং ওয়ারিয়ার’ অভিনেতা হিসেবে অজয় দেবগনের শততম ছবি তাই এই ছবি দেখে আপনিও আলাদা এক আত্মতৃপ্তি অনুভব করবেন। ‘ফুল অউর কাঁটে’ থেকে ‘তানাজী : দ্য আন্সাং ওয়ারিয়ার’ এই দীর্ঘ সফরে আমরা অজয় দেবগনের অভিনয় দেখে মুগ্ধ হয়ে আসছি এটাও তো কোনও ইতিহাসের চেয়ে কম নয়!
রেটিং
5 অসাধারণ
4 বেশ ভালো
3 ভাল
2 দেখতে পারেন
1 না দেখলেও চলবে
0 Comments