জ্বলদর্চি

কবিতার তৃতীয় ভুবনে, কণ্ঠে – উচ্চারণে- ৭

পর্ব – ৭

কবিতার তৃতীয় ভুবনে, কণ্ঠে – উচ্চারণে

আ র ণ্য ক  ব সু

যখন নিজের কণ্ঠ চিনতে শিখি

আমার আছে  নিজের কথা, আমার আছে গলা,
কবিতা আমার সেই সম্পদ সবার কথা বলার।
তোমরা যখন সময় নষ্টে আমি বাঁচি সাধনায়;
নিজেকে আমার চেনাজানা, দাঁড়াবো নিজের পায়ে।

প্রিয় বাচিক শিল্পী বন্ধুরা, গতকাল আমার লাইভ অনুষ্ঠান পরিচালনার সময় অনভিপ্রেত একটা ঘটনা ঘটে গেল। শিল্পী বন্ধু তখন খুব সুন্দর, রোমান্টিক একটি কবিতা আবৃত্তি করছিলেন, সঙ্গে আবহসঙ্গীতের অনুসঙ্গ রেখেছিলেন। কিন্তু, আবৃত্তি শুরু হওয়ার মুহূর্ত থেকেই কণ্ঠকে ছাপিয়ে গেল আবহ। দর্শক শ্রোতাদের পক্ষ থেকে স্বাভাবিকভাবেই মন্তব্য আসতে লাগল আবহের প্রাবল্য কমাবার জন্য। আমার পক্ষ থেকে তখন তাঁকে সাবধান করবার কোনো উপায় ছিল না। বেশ একটা অস্বস্তির মধ্যেদিয়ে তিনি অনুষ্ঠান শেষ করলেন এবং ক্ষমা চেয়ে নিলেন। আসলে যে কথাটা বলতে চাই, সেটা পরিস্কার ভাবেই বলি, কেমন? ইদানিংকালে সামান্য কয়েকটি কবিতার লাইন বলতে গিয়েও মাননীয় বাচিক শিল্পী বন্ধুরা আবহসঙ্গীত নির্ভর হয়ে পড়ছেন। ব্যাপারটা মোটেই শুভ নয়, অন্তত আমার কাছে। মাঝখান থেকে কবিতা ও আবহ দুটোই জড়িয়ে পেঁচিয়ে তাঁর নিবেদনকে মাটি করে দিলো। বাচিক শিল্পী বন্ধুরা, আবহসঙ্গীত সবসময় ব্যবহার করবেন কি না খুব ভালোভাবে ভেবে দেখবেন দয়া করে। যেখানে নিজেকেই আবৃত্তির সঙ্গে আবহসঙ্গীত নিয়ন্ত্রণ করতে হয় একটি স্মার্ট ফোনের মাধ্যমে, সেখানে প্রফেশনাল স্মার্টনেসকে নিজস্ব ক্ষমতার শীর্ষ বিন্দুতে নিয়ে যেতে হবে। আমাদের সবসময় মনে রাখতে হবে–কবির সৃষ্টিকে মানুষের কাছেই পৌঁছে দেওয়াটাই আমাদের কাজ।
নিজের কণ্ঠস্বরের উপর বিশ্বাস রাখতে শিখুন। নিজস্ব আত্মবিশ্বাস পরিপূর্ণভাবে থাকলে কখনোই আমাদের যন্ত্র নির্ভর হতে হবে না। কেননা, আপনি একই সঙ্গে কবিতা আবৃত্তি করবেন এবং নিজেই যন্ত্রকে নিয়ন্ত্রণ করবেন, এই সাধনায় সিদ্ধালাভ করলেই তবে সফল হবেন।
আমার নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলে আজকের প্রতিবেদন শেষ করব। বয়ঃসন্ধির যন্ত্রণায় এবং ফুটবল-ক্রিকেট খেলার মাঠে অতি উৎসাহে গলার উপর চাপ পড়ে, আমার নিজস্ব কণ্ঠস্বর কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। জন্মসূত্রে আমি ব্যারিটোন ভয়েসের অধিকারী নই; তার উপরে গলা কিছুটা চেপে যাওয়ায় আমাকে আবৃত্তি পরিবশনের সময় নানা রকমের মন্তব্য সহ্য করতে হয়েছে, যা আমাক কাছে অত্যন্ত অপমানজনক বলে মনে হতো। পাগলের মতো কণ্ঠ-সাধনায় নিজেকে ডুবিয়ে দিয়েছিলাম। আবৃত্তির পাশাপাশি নাটকের জগতে এসে সহশিল্পীদের প্রেরণা আমাকে সেই হতাশার গুহা থেকে উদ্ধার করল। আমি চিনতে শিখলাম আমার নিজের কণ্ঠসম্পদকে। গত কুড়ি-পঁচিশ বছর ধরে বিভিন্ন একক আবৃত্তির অনুষ্ঠানে আমি যন্ত্রানুসঙ্গ ও ভোকাল রাগ-রাগিনী ব্যবহার করি, যেখানে হাতে অন্তত ঘন্টাখানেক সময় থাকে। আমি ঠিক তেমনিই, মাঠে ময়দানে খোলা আকাশের নীচে, হাজার হাজার মানুষের সমাগমে (রাজনৈতিক বা সাংস্কৃতিক), অনায়াসেই কোনোরকম আবহ ছাড়া একটানা আবৃত্তি করে যেতে পারি। ইয়েস, এটাই সেল্ফ-কনফিডেন্স। নিজস্ব আত্মবিশ্বাস। এখন আর একজন মানুষকেও বলতে শুনি না – আপনার কন্ঠস্বর ভালো নয়। অতীতের তিতো মন্তব্যগুলো কোন মন্ত্রে যে  ফুলের তোড়া হয়ে গেল, ভাবতে অবাক লাগে।
প্রিয় বাচিক শিল্পী বন্ধুরা,  আত্মবিশ্বাস ছাড়া কোনো কাজেই সফল  হওয়া যায় না। কণ্ঠচর্চার ফাঁকে ফাঁকে, আয়নার সামনে নিজেকে দাঁড় করান। সম্পূর্ণ স্মৃতি থেকে একটার পর একটা কবিতা বলে যান। নাটকের সংলাপ বলুন। নিজের আত্মবিশ্বাসের পরীক্ষা নিজেই নিন। আপনি পারবেন – কোনো আবহ ছাড়া ঘন্টাখানেক একটানা কবিতা বলে যেতে আপনি পারবেন। আপনাদের উপর আমার বিশ্বাস স্থির থকলো। নিজেকে ব্যর্থ বলে কখনোই ভাববেন না। কণ্ঠস্বর চর্চা করুন, কণ্ঠস্বরকে তলোয়ারের মতো ঝকঝকে করে তুলুন। দেখিতো কে আপনাকে হারাতে  পারে?
সারা শরতের আকাশভরা শুভেচ্ছা জানালাম।
পরের সপ্তাহে আবার কথা হবে। ভালো থাকবেন।

    

Post a Comment

2 Comments