জ্বলদর্চি

প্রাচীন ভারত, ইতিহাস ও বিজ্ঞান-৫ / অনিন্দ্যসুন্দর পাল

ধারাবাহিক-প্রাচীন ভারত, ইতিহাস ও বিজ্ঞান
(Ancient India, History & Science)   
পঞ্চম পর্ব

অনিন্দ্যসুন্দর পাল
অলংকরণ- শ্রেয়সী ভট্টাচার্য্য          


ঐতিহাসিক উৎস, প্রকারভেদ ও ধারণা -২

পরিসংখ্যান অনুযায়ী এখনও অবধি প্রায় ৭০,০০০ লেখমালা আবিষ্কৃত হয়েছে। এই লেখমালা যেমন একদিকে অতীত সম্পর্কিত ধ্যান-ধারণার একটি পুঞ্জীভূত অধ্যায় ঠিক তেমন অন্যদিকে প্রাচীন ভারতের ইতিহাস আলোচনার ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের অন্যতম দাবিদার। অধ্যাপক দীনেশচন্দ্র সরকারের মতে, এখন অবধি প্রায় ৭০,০০০ লেখমালা আবিষ্কৃত হয়েছে এবং সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশ, নেপাল, এবং বহির্ভারতেও এদের বিস্তৃতি লক্ষ্য করা যায়। তবে বিশেষ উল্লেখযোগ্য লেখমালায় দেশীয় ভাষার (যেমন তামিল, তেলেগু, কানাড়া) পাশাপাশি বৈদেশিক ভাষা (যেমন গ্রীক, আরামীয়) ব্যবহৃত হত।

      তাই, লেখমালাকে একই শ্রেণীতে না রেখে এর চরিত্র অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণীতে রাখতে সচেষ্ট হন ঐতিহাসিকরা। আমরা জানি, লেখমালা প্রধানত দুই প্রকার। এক, দেশীয় ও দুই বিদেশীয়। এছাড়াও লেখমালাকে আরো অন্যভাবে বিভাজন করা সম্ভব হয় যেমন, বাণিজ্যিক, ধর্মীয়, শিক্ষামূলক, প্রশাসনিক, প্রশস্তিমূলক, নিবেদনমূলক, দানমূলক, স্মরণমূলক এবং সাহিত্যগুণমূলক। তবে স্মরণে রাখা ভালো, দেশীয় লেখমালা ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসকে সূচিত করে ঠিকই কিন্তু বিদেশীয় লেখমালা কোনোভাবেই বৈদেশিক ইতিহাসকে সূচিত করে না, বরং বিদেশ থেকে প্রাপ্ত ভারতবর্ষের ইতিহাসকেই নির্দেশ করে।
   যাইহোক, এইবার একটু লেখমালার বিষয়গুলোর উপর গভীরভাবে দৃষ্টিপাত করা যাক। সিন্ধুসভ্যতার সিলমোহরগুলির মধ্যে বাণিজ্যিক বৈশিষ্টগুলো লক্ষ্যণীয়। বিশেষত ছোট সিলমোহরগুলোর মধ্য ব্যক্তির নাম ও বড় গুলোর মধ্যে বাণিজ্যিক পণ্যের নাম ও প্রেরক ঠিকানা এইসব নির্দেশ পাওয়া যায় আবার হরপ্পার সিলমোহরের মধ্যে পাওয়া যায় ধর্মভাবনার চিত্র। তবে প্রাচীনভারতে বাণিজ্য নিগমগুলোর নিজস্ব কিছু মুদ্রা ও বাণিজ্য পরিচালনের জন্য নিজস্ব সিলমোহরের প্রচলন থাকলেও তার অধিকাংশই কালের নিয়মে অবলুপ্ত। 
      উহারণস্বরূপ বলা যেতে পারে যে, আধুনিক ইরাক বা প্রাচীন ব্যাবিলনিয়ায় ১৬০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের যে সকল লেখমালা থেকে আর্যদের আদি ইতিহাস ও বাসস্থান সম্পর্কিত তথ্য জানা যায় তা থেকেই প্রমাণ পাওয়া মেলে প্রাচীন ক্যাশাইটরা ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষারও ব্যবহার জানতেন। তাই প্রাচীন ভারত রচনার সময় এইসব লেখমালাকেও স্মরণে রাখতে হবে। বিশেষ দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে লেখমালা শুধুমাত্র প্রাচীন ভারতের ইতিহাস নয় সমকালীন ভারতীয় ভাষা অনুধাবনের ক্ষেত্রেও অন্যতম সহায়ক। 

     আবার প্রশস্তিমূলক লিপিগুলি প্রাচীন ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসের ক্ষেত্রে অন্যতম দাবী রাখে। দৃষ্টান্ত হিসাবে কলিঙ্গ রাজা খারবেলের "হাতিগুম্ফা লেখমালা", রুদ্রদমনের "জুনাগড় প্রস্তর লেখমালা", গোড়খপুর জেলার "সহগৌরা কপার প্লেট লেখমালা", সমুদ্রগুপ্তের "এলাহাবাদ প্রশস্তি" ইত্যাদিকে উল্লেখ করা যেতে পারে। তবে "এলাহাবাদ প্রশস্তি"তে লেখক এতটাই রাজা "সমুদ্রগুপ্তের" ব্যক্তিগত বর্ণনা ও তার সামরিক কৃতিত্বের বর্ণনায় ব্রতী ছিলেন যে অন্যান্য গুরুত্বপূর্ন জ্ঞাতব্য বিষয় গুলোকে উল্লেখ করতে তিনি ভুলেই গেছেন বলা যায়। এছাড়াও রাজ ভোজের "গোয়ালিয়র প্রশস্তি একটি অন্যতম দৃষ্টান্ত। তবে উল্লেখযোগ্য প্রশস্তি রচয়িতারা রাজ-অনুগৃহিত বলে রাজা মহারাজাদের বিশেষ দিকগুলোর প্রতি আলোকপাত করে গেছেন, সৎ ঐতিহাসিকদের মতো ব্যাখ্যা বর্ণনা দিয়ে তার আলাপ আলোচনার পাশাপাশি সমালোচনা করতে পারেননি। এইটা এইদিক থেকে প্রশস্তি রচয়িতাদের একটা প্রবল দুর্বলতা বলা যায়।

     এরপরও অপর এক ধরনের প্রশস্তিমূলক লিপি পাওয়া যায়, যেখানে আবার রাজস্তুতির পাশাপাশি অন্যান্য আলোচনারও নিদর্শন পাওয়া গেছে। যেমন, শক রাজা উষ্যদন্ডের "নাসিক গুহালিপি", গৌতম বনশ্রীর "নাসিক প্রশস্তি", বুদ্ধগুপ্তের "পাহাড়পুর কপার প্লেট লেখমালা", প্রভাবতী গুপ্তের "পুনা প্লেট" ইত্যাদি। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য- ভানুগুপ্তের "এরান প্রশস্তি" থেকে যেমন সতী'র ইতিহাস জানা যায়, ঠিক তেমন  নাসিক প্রশস্তির মাধ্যমেই সাতবাহন বংশের শ্রেষ্ঠ শাসক গৌতমীপুত্র সাতকর্ণির বিশদ ও নির্ভরযোগ্য তথ্যাদি সম্পর্কে অবলোকিত হই।

    আবার, নিবেধনমূলক লিপি বলতে আমরা সেই সব লিপিকে বলে থাকি যা থেকে বুঝতে পারি দাতা উদ্দেশ্য নিয়ে কিছু করেছেন বা করছেন এবং ভবিষ্যৎ-প্রজন্মের স্মরণের জন্য লেখমালার মাধ্যমে নথিভুক্ত করতে চান বা চেয়েছেন। যেমন "পিপরাওয়া লেখমালা"তে ভগবান বুদ্ধের ব্যবহৃত দ্রব্যের দান করে দেওয়ার ঘটনা, আবার গ্রীক নাগরিক "হেলিওডোরাসের" বেসনগর গরুড় স্তম্ভলিপিতেও এইধরনের দান ও দাতার ব্যাপার উল্লেখ আছে।

    এরইসাথে, দানমূলক লিপির দৃষ্টান্তও অজস্র ও অনস্বীকার্য। জমিদানের পাশাপাশি দানের বিষয়টিকে স্মরণীয় ও আইনগ্রাহ্য করার ব্যাপারেও এই লিপির ব্যবহার বিশেষ উল্লেখ্য। বাস্তবিক পক্ষে লেখামালাকে সরকারি ও বেসরকারি লেখমালা হিসাবেও বিভক্ত করা যায়। কিন্তু উল্লেখযোগ্য বেসরকারি লেখমালার প্রধান উৎস হলো এই দানমূলক লিপি।
 প্রসঙ্গত, জন্ম মৃত্যু এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাকে স্মরণে রাখার জন্যই স্মরণমূলক উপস্থিতি ভীষণ জরুরি। উল্লেখ্য, বুদ্ধের জন্মস্থান দর্শন করার স্মারক হিসাবে সম্রাট অশোক  প্রথম এই লেখমালার উৎকীর্ণ করান। অনুরূপভাবে কিছু কিছু লেখমালাকে আমার সাহিত্যকীর্তির জন্যও চিহ্নিত করতে পারি। যেমন , আধুনিক উত্তরপ্রদেশের "মহানির্বাণস্তূপ" উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যেতে পারে, যার থেকে উদ্ধৃত তাম্রলিপি থেকে ভগবান বুদ্ধের উদানসূত্র সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা যায়।

   লেখমালার বিবরণ যতই স্বতঃস্ফূর্ত ও সমসাময়িক হোক না কেন, বিশেষ প্রয়োজনে স্থায়ী বস্তুর উপর  লেখাগুলোর উপর পরবর্তীকালে লেখকরা হস্তক্ষেপ না করতে পারলেও তা যুক্তি ও ব্যাখ্যা দিয়ে তার সত্যতার মাপ-পরিমাপ বিচার করতে পারেন বা পেরেছেন স্বাধীনভাবেই। যদিও অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, সন তারিখ এসবের উল্লেখ না থাকা সত্ত্বেও  প্যালিওগ্রাফির সাহায্য নিয়ে বহু ব্রাম্হী ও অন্যান্য ব্যবহৃত লিপির সময় নির্ধারণ করতে পেরেছেন। তাই এদিক থেকে বলা যায়, ইতিহাসের সাক্ষ্য হিসাবে লেখামালার গুরুত্ব লিখিত পুঁথি ও গ্রন্থের চেয়ে অধিক, কারণ এই আলোচনার পূর্বেই বলেছিলাম লিখিত সাহিত্যের রচয়িতারা বহু ক্ষেত্রেই সময় সমন্ধে মনোযোগী নন এবং অনেক ক্ষেত্রেই মৌলিক লেখাকে একাধিকবার সংস্কার করা হয়েছে। এইখানেই সাহিত্য ও লেখমালা হয়ে উঠেছে একে পরের কিংবা পরস্পর পরস্পরের পরিপূরক ও সাহায্যকারী, যা একার্থে সাহিত্যসন্ধানের রূপকও বটে।
(ক্রমশ)
-----------------
আরও পড়ুন 

ঐতিহাসিক হোক বা সাহিত্যিক উভয়কেই ইতিহাস অথবা সমাজবিজ্ঞান চর্চার জন্য প্রচলিত শিলালিপি, মুদ্রা বা তাম্রলেখ অথবা মহাফেজখানা বা অভিলেখগারের প্রত্ন-সামগ্রীকের উপরই নির্ভরশীল হতে হয়, তা লিখিত-ই হোক বা অলিখিত।

Post a Comment

0 Comments