জ্বলদর্চি

অ্যাঁতেলেকত্যুয়েল বনাম আঁতেল-২৪/ সন্দীপ কাঞ্জিলাল

 অ্যাঁতেলেকত্যুয়েল বনাম আঁতেল-২৪

প্রকৃত বুদ্ধিজীবী, বুদ্ধিবৃত্তি ও হৃদয়বৃত্তি দুটোতেই সমৃদ্ধ হয়। একজন অশিক্ষিত চোর মালগাড়ি থেকে মাল চুরি করে,আর একজন শিক্ষিত চোর গোটা মালগাড়িটাই চুরি করে নেয়।

সন্দীপ কাঞ্জিলাল

বুদ্ধিজীবী ও সমাজ-২
       

আগের পর্বে আলোচনা করেছিলাম, সমাজ জনগণকে জানিয়ে দিয়েছে লেখক, কবি শিল্পী এরা বুদ্ধিজীবী। এদের মুলধন ভাষা, ভাব এবং প্রকাশ করার ভঙ্গিমা। লেখক কবিরা সমাজে মানুষের কাছে পৌঁছানোর অন্যতম উপাদান ভাষা, এই ভাষা যেমন শ্রেণি-নিরপেক্ষ না, যেমনি নিরপেক্ষ নয় বুদ্ধিজীবীর দায় দায়িত্ব। এই ভাষা নির্মাণ এবং এর ব্যবহারের যে রাজনীতি সেখান থেকেই আমরা পাই সমাজ পরিবর্তনে সক্রিয়, জনস্বার্থ বিরোধী এবং নিষ্ক্রিয় বুদ্ধিজীবীর ভূমিকা। অনেক সত্য ও শুধু ভাষার কারণে, অর্ধসত্যে পরিণত হয়। আবার অনেক সময় ভাষার জন্য সত্য ও মিথ্যায় পর্যবসিত হয়। আবার সমাজের বেশির ভাগ বুদ্ধিজীবী যারা প্রকাশ্যে সত্য বলতে চান বা বলতে বাধ্য হন, তাদের ভাষা জটিলতার কারণে সমাজে বিভ্রান্তি আরও বাড়ে। আর সকলে জানে, ভাষার কারণে যে সত্য অর্ধসত্যে পরিণত হল, তা বড় ভয়ঙ্কর। 

যিনি বা যাঁরা লেখেন, তাঁরা তাদের ভেতরের তাগিদ থেকে লেখেন। শুধু লিখেই তাঁরা ক্ষান্ত হয় না। সবার মধ্যে তাগিদ থাকে সেই লেখা অন্যের গোচরে আনা, প্রকাশ করার। অনেকে বলেই থাকেন, আমার লেখা এখন কেউ না বুঝলেও, তিনি কল্পনা করে নেন, একদিন সময় এর মূল্যায়ন করবে। তার মানে তাঁরা বলতে চাইছেন পরবর্তীকালে এমন সমঝদার শ্রোতা আসবে, যারা এর মর্ম উদ্ধার করতে পারবে। অতএব বোঝাই যায়, তাঁরা সাধারণ মানুষের জন্য লেখেন না। কিন্তু তাঁরা একটি বিষয়ে বিস্মৃত হন যে, ভাষা একটা মাধ্যম মাত্র। তাঁর নিজস্ব কোনো মূল্য নেই। তার দ্বারা লেখক বা কবি নিজের অভিজ্ঞতা সাধারণের বোধগম্য করে রূপ দিতে পারলেই, তবে তা মূল্যবান। না হলে তাঁর রচিত কবিতা বা উপন্যাস বা অন্য কিছু যাই লেখুন তা সর্বসাধারণের সাহিত্য হয়ে উঠতে পারে না। এর ফলে যে কারণে সাহিত্যের প্রয়োজন, তা আর কাজে আসে না। এর ফলে সাধারণ মানুষের সঙ্গে সেই সাহিত্যিকের ব্যবধান বেড়ে যায়। সেই লেখার ভেতর যতই মণিমাণিক্য লুকানো থাক, তা তাঁদের কাছে ছাইয়ের গাদাতে পর্যবসিত হয়। আর সেই লেখক বা কবি সাধারণ মানুষের কথা ভুলে আত্মকেন্দ্রিক হয়ে প্রকরণ প্রধান হয়ে ওঠে। তাঁদের কল্পনা ক্রমশ ভঙ্গি সর্বস্ব হয়ে ওঠে। কিন্তু সেই ভঙ্গির ভেতর কি ঈঙ্গিত আছে তা-ও সাধারণ মানুষের বোঝার বাইরে থেকে গেল। সেই লেখক যখন দেখছেন, তাঁর লেখা স্বীকৃতি পাচ্ছে না, তিনি তখন মানুষ সম্পর্কে মনে মনে অশ্রদ্ধা পোষণ করেন। সাধারণ মানুষকে ভালোবাসার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন। এঁদের লেখা পড়লে মনে হয় না, এঁদের জীবনে সাধারণ মানুষের জন্য ভালোবাসা, কিংবা তাদের জন্য সৃষ্টিশীলতার কোনো স্থান আছে। সাধারণ মানুষও যখন ঐ লেখকের সাহিত্যের মধ্যে লুকানো সম্পদের হদিশ না পায়, তখন তাঁরা নিজেদের নিতান্ত হতভাগ্য বলে মনে করে, যেমন সাধারণ মানুষকে এঁরা সাধারণ বলে মনে করেন। তাঁদের মনে রাখা উচিৎ এঁরাই সংখ্যায় বেশী। এরাই আপনাকে স্রষ্টার আসনে বসিয়েছেন। তাই এঁদের মান উন্নতির দায়, আপনি অস্বীকার করতে পারেন না। 

এই ভাষা জটিলতাকে লুকানোর জন্য বুদ্ধিজীবীগণ ব্যবহার করেন 'উত্তরাধুনিক' ভাষার ছদ্মবেশ। আমাদের দেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশে উত্তর আধুনিকতার ধারণা যেখানে শিক্ষিত সমাজে প্রায় 'ফ্যাশন' হিসেবে ব্যবহৃত হয়, সেখানে বুদ্ধিজীবীরাও সত্যের ধারণার 'এক বিমূর্ত সংজ্ঞা' তৈরি করেন এবং সেটাও ফ্যাশন হিসেবে। যা জনগণের পক্ষে যে কোন সচেতন লড়াইয়ের প্রয়াসকে ব্যপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ করে। 

বুদ্ধিজীবীর কাজ কালের রাজনীতি ও সমাজতত্ত্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করে ভাষা বিচার করার যে পদ্ধতি পশ্চিমে (সেই সূত্রে আমাদের এখানেও) শক্তিশালী তা প্রত্যাখ্যান করা এবং সাংস্কৃতিক বিন্যাস ও বাস্তবতার ঐতিহাসিক পরম্পরার ভিত্তিতে বিচার বিশ্লেষণ করা। 
বুদ্ধিজীবীকে শ্রেণিবিভক্ত সমাজে আপন শ্রেণির বাইরেও তাঁর নৈতিক অবস্থান গ্রহণ করতে হবে। এ জন্য এটা জরুরী না যে বুদ্ধিজীবী মানেই শ্রেণিচুত্য হবেন। বরং এর চেয়ে বেশি জরুরি সমাজ পরিবর্তনের জন্য কার্যকর সংকেত গুলোকে গণ মানুষের ভাষায় সমাজে ব্যাখ্যা প্রদান। 
এক্ষেত্রে অনেক বুদ্ধিজীবী এসব সামাজিক প্রবণতা বুঝেও, এমনকি এসব প্রকাশের ভাষা জানা সত্ত্বেও ক্ষমতার পক্ষ অবলম্বন করেন। উনিশ ও বিশ শতকের কালোনিয়াল দুনিয়ার এর অগণন উদাহরণ রয়েছে। এর জন্য দূর প্রাচ্য বা আফ্রিকা বা ল্যাতিন আমেরিকায় যাবার দরকার নেই, তথাকথিত 'বাংলার রেনেসাঁর ইতিহাসে' এমন অনেক উজ্জ্বল উদাহরণ বিদ্যমান। 

এবং সেজন্যই আপাতত বুদ্ধিজীবীদের উল্লেখ্য আমার মনে সন্দেহ বলুন আর বিতৃষ্ণা, তাই জাগে। এখন কেউ দু চার কলম লিখতে পারলে, বা ছবি দু একটা এঁকে, বা একটা দুটো সিরিয়ালে অভিনয় করে বুদ্ধিজীবীতে পরিণত হয়েছে। তাই বুদ্ধিজীবীরা আবার বোদ্ধার বেশে অবতীর্ণ হচ্ছে। তাঁদের ধারণা ইতিহাস যাই বলুক, তাঁরা চায় দ্রুত পদক্ষেপে এগোতে। নিজের নিজের চিন্তা ধ্যান-ধারণা দিয়ে উদ্ভট পথের নির্দেশ দিচ্ছেন। জনতা এগোক বা না এগোক তাঁরা এগিয়ে যাবেই। তা যদি অন্য সবাইকে বাদ দিয়ে, একা-ও হয়, তাই সই। আবার একদল আছেন, যাঁদের কথার সঙ্গে কাজের মিল নেই। কারণ কোন কথার মানে করলে কি দাঁড়ায়, সেটা তারা বোঝে না। এক পা এগিয়ে দরকার পড়লে, তিন পা নয়, নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য দশ পা পিছিয়ে আসবে। এমনকি আগে বলা কথার জন্য অনুতাপ করবে। অথচ কেউ তাদের তখন মাথার দিব্যি দেয়নি সেই কথা বলার জন্য, বা এগিয়ে যাওয়ার জন্য। তখন তাঁরা ভেবেছিল এভাবে না বললে বা এগোলে বুদ্ধিজীবী তকমা থাকবে না। কিন্তু প্রকৃত বুদ্ধিজীবী কেবল এগোতে জানে, পিছিয়ে আসতে তাঁরা শেখেনি। অথচ এরা এগোয়, আবার জুজুর ভয় বা লজেন্স দেখলে, আবার পেছোয়। কিন্তু এরা যদি এগিয়ে আর পিছিয়ে না আসতো, তবে এরা ইতিহাসকে সাহায্য করতো। আর ইতিহাস কারোর সাহায্য সহজে ভোলে না। সে প্রতিদান দিতে জানে, তাঁর পৃষ্ঠায় তার নাম তুলে নেয়। এদের মানসিকতার এই হীনমন্যতায়, ইতিহাসকে এরা ছেলেখেলায় পরিণত করে। তাই ইতিহাস ও এদের আস্তাকুঁড়ে ফেলে দেয়।
দার্শনিক সার্ত্র-বোভোয়ার বুদ্ধিজীবীর ক্ষেত্রে তাঁরা সব চাইতে বেশি জোর দিয়েছেন সততার উপরে। নিজের কাছে নিজে সৎ হতে হবে-অনুভবে, চিন্তায়, বিশ্বাসে,বাক্যে, আচরণে। ঐক্যের সাধনাই তাঁদের কাছে ব্যক্তিজীবনের  নৈতিক আদর্শ। বুদ্ধিজীবী ব্যক্তিস্বাধীনতা, ন্যায় ও সাম্যের পক্ষে। যে সব প্রতিষ্ঠান, সর্ম্পক, নীতিনিয়ম,আচার, আচরণ স্বাধীনতাকে সঙ্কুচিত করে,যা অত্যাচার ও শোষণের সহায়ক, যা বেশিরভাগ মানুষকে বঞ্চিত করে অল্প কিছু মানুষকে স্বাচ্ছন্দ্য দেয়, তাঁরা তার বিরুদ্ধে থাকবেন। বুদ্ধিজীবী আগাগোড়াই প্রতিষ্ঠান বিরোধী।আর এরজন্য চাই প্রকৃত শিক্ষা। প্রকৃত শিক্ষায় বুদ্ধিবৃত্তি ও হৃদয়বৃত্তি  দুইই সমৃদ্ধ হয়। একজন অশিক্ষিত চোর মালগাড়ির মাল চুরি করে, আর একজন শিক্ষিত চোর গোটা মালগাড়িটাই চুরি করে নিতে পারে। আমরা  অনেকেই মনে করি স্কুল কলেজের ডিগ্রি থাকলেই আমরা শিক্ষিত। এর মাধ্যমে শিক্ষালাভ করলেও, অনেকেই  প্রকৃত শিক্ষা পায়নি। বুদ্ধিগত শিক্ষা আমাদের মস্তিষ্ককে উর্বর করে,এবং মূল্যবোধের শিক্ষা আমাদের হৃদয়বৃত্তিকে সমৃদ্ধ করে। বস্তুতপক্ষে যে শিক্ষা আমাদের হৃদয়বৃত্তিকে সুশিক্ষিত করে না,সে শিক্ষার কোনো মূল্য নেই। আমাদের পরিবার, সমাজ উপযোগী চরিত্র গঠনের জন্য  নীতিবোধ ও নীতিশিক্ষার প্রয়োজন। যে শিক্ষা চরিত্রের সততা, সহমর্মিতা, সাহস, একাগ্রতা ও দায়িত্ববোধের মতো মৌলিক গুণাবলী গঠন করে, সেই শিক্ষাই একান্ত প্রয়োজন। আর আমাদের চারপাশে যারা শিক্ষিত রূপে ঘুরে বেড়ায়,তাঁরা ডিগ্রির মানদণ্ডে মাপা শিক্ষিত। তারা খুব উচ্চ ডিগ্রিধারী অথচ নীতিবোধ বর্জিত। গ্রেড পাওয়ার জন্য নয়, আমাদের প্রতিযোগিতা হওয়া উচিত জ্ঞান ও বৈদগ্ধ লাভের জন্য। মানবিক গুণশূন্য হয়েও একজন ভালো ডিগ্রি বা গ্রেড পেতে পারেন। অনেক বিষয় মনে রাখার ক্ষমতা বা অনেক বিষয় মঞ্চে দাঁড়িয়ে আওড়ানোকে শিক্ষা বলে না।নীতিবোধহীন শিক্ষা সমাজের কাছে ক্ষতিকারক হয়ে ওঠে।

কেউ ভীষণ পড়াশোনা করে, জ্ঞানের প্রতি তাঁর মোহ, তবু তাকে শিক্ষিত বলা যাবে না। কারণ সে যদি বাহবা  পাওয়ার জন্য, এ-সব  করে  থাকে, তার পুরোটাই যদি লোকদেখানো হয়,তবে সে এক অজ্ঞ। কোনো বিষয়ে অজ্ঞ হওয়ার মধ্যে কোনও লজ্জা নেই, কিন্তু সেই অজ্ঞতাকে মূলধন করে কেউ যদি 'হাম সে বড়কর কৌন' ভাব দেখায়,তবে তা ভয়ঙ্কর। সে একজন ঘৃণ্য অপরাধী। তারা শুধু সমাজের ক্ষতি করে না, নিজের ও ক্ষতি করে। তারা লোভী ও বটে। আর সেই লোভ তার নিজের মৃত্যুর কারণও অনেক সময় হয়ে দাঁড়ায়।

বানর ধরা হয় কেমন করে জানা আছে? বানর শিকারী একটা গোল ছিদ্রযুক্ত বাক্স ব্যবহার করে। ঐ গোল জায়গা দিয়ে বানরের হাত অনায়াসে ঢুকে যায়।ঐ বাক্সের ভেতর বাটিতে বাদাম দেওয়া থাকে। বানর তখনঐ বাদামের লোভে হাত ঢুকিয়ে বাদাম মুঠো করে ধরে। তারপর সে যখন হাত বের করতে চায়,ঐ মুঠো করে বাদাম ধরে রাখার জন্য সে হাত বের করতে পারে না।কিন্তু ঐ মুঠো ছেড়ে দিলে হাত বের করে নিতে পারতো, তা তার বুদ্ধিতে আসে না।ফলে বানর ধরা পড়ে। এইভাবে যারা সমাজে বুদ্ধিজীবীর ভান করে, তারা শাসকের উপঢৌকনের লোভে ধরা পড়ে যায়। আবার অনেকে নিজেকে বুদ্ধিজীবী সাজার জন্য বিভিন্ন অপকৌশল ও অপকর্মে জড়িত হয়।এরা এমন বিজ্ঞতার অভিনয় করে, কেউ সঠিক কথা বললেও গ্রহণ করে না।এরা জানেনা অপরের ভুল থেকেও শিক্ষা নিতে হয়।কারণ জীবন এত দীর্ঘ নয়,নিজের ভুল থেকে শুধু শিক্ষা গ্রহণ করলে চলে। (ক্রমশ)

-------------
আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments