জ্বলদর্চি

হাজার বছরের বাংলা গান -২১ / তুলসীদাস মাইতি

হাজার বছরের বাংলা গান ।। পর্ব-২১

তু ল সী দা স   মা ই তি

কাজী নজরুলের গান:
বৈচিত্র্যে  ও সৌন্দর্যে অনন্য

"প্রাচুর্য গুণের সঙ্গে তুলনীয় নয় জানি, 'কোয়ান্টিটি' 'কোয়ালিটি'র সমানুপাতিক কখনোই হতে পারে না। কিন্তু নজরুলের গানের বেলায়, গুণের হিসাব ছেড়েই দিচ্ছি, তার পরিমাণটাই একটা মহাবিস্ময়ের বস্তু। কথায় কথায় যার কলমে গান বেরোয়, কণ্ঠ থেকে অবিরল ধারায় সুর ঝরে পড়তে থাকে, তাঁর এই খাতের সৃষ্টির অজস্রতা আপনিই একটা তাক লাগিয়ে দেবার মতো বিষয়। সৃষ্টির এমনতর হাঁপ ধরানো সংখ্যাবাহুল্য অসামান্য প্রাণশক্তিরই এক প্রকাশ।" কাজী নজরুলের গানের আলোচনা প্রসঙ্গে গবেষক নারায়ণ চৌধুরী এই কথাগুলি বলেছেন। নজরুলের সংগীত সৃষ্টির বিপুল আয়োজন এই কথাগুলোকেই পূর্ণভাবে মান্যতা দেয়। 

প্রায় সাড়ে তিন হাজারের কাছাকাছি গান রচনা করেন তিনি। সমকালের পঞ্চকবি অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রলাল, রজনীকান্ত, অতুলপ্রসাদ ও নজরুল-এর মধ্যে নজরুলই সর্বাধিক গান রচনা করেন। কবি ও সংগীত স্রষ্টা নজরুলের জীবন পর্যালোচনা করলেই দেখি, এই যে বিপুল সংখ্যক গান তা তিনি মাত্র বাইশ বছরে রচনা করেন। ১৯২০-তে তিনি সংগীত রচনা শুরু করেন। ওই সালেই সামরিক জীবন ছেড়ে সাহিত্য সংস্কৃতির জগতে পা রাখেন। তাঁর সংগীত রচনা এই সময়কাল থেকেই। ১৯৪২ এর পর তিনি গুরুতর অসুস্থ  হয়ে পড়েন। কবিতা-গান সহ তাঁর সব সৃষ্টিই বন্ধ হয়ে যায়। অর্থাৎ এই কথা সত্য যে, অল্প সময়কালের মধ্যেই  নজরুল ইসলাম কাব্যের সঙ্গে সংগীত জগতেও  বিস্ময়কর কর্ম সম্পাদন করতে পেরেছিলেন। গীতিকার সুরকার হিসেবে নজরুলের এই কাজটি 'বাংলা গানের ক্ষেত্রে সংখ্যার হিসেবে সর্বোচ্চ রেকর্ড'। 

নজরুলের ক্ষেত্রে বলা হয় তিনি সঙ্গীত আবিস্কারকও। বাংলা গান ও সংস্কৃতির ইতিহাসে নজরুলগীতি  একটি উল্লেখযোগ্য অধ্যায়। কবি নজরুলকে ছাপিয়ে সংগীত- স্রষ্টা নজরুলের অস্তিত্ব। প্রাচুর্য-বৈচিত্র্য-ঐশ্বর্য- এর অপূর্ব মেলবন্ধন। বাংলা গানের মহাভান্ডারে প্রবেশ করে তিনি যেমন দীর্ঘকাল ধরে চলে আসা ভারতীয় তথা বাংলা গানের নানা ধারা অনুসরণ করে  গান রচনা করেছেন তেমনই নানাপ্রকার মৌলিক সংগীতেরও তিনি সৃষ্টি করেছেন। ছোটোবেলায় লেটো গানের দলে তিনি গান গেয়েছেন। বড় হয়ে রবীন্দ্রনাথের গান গেয়েছেন। বিভিন্ন সভা- সমিতিতে তাঁর গান ছিল আকর্ষণের জায়গা। নিজের গান রচনার সূত্রপাত গজল দিয়ে! খুব বেশি সংখ্যক এই পর্যায়ের গান তিনি সৃষ্টি না করলেও বাংলা গানের ক্ষেত্রে তাঁর গজল সবার আগে স্থান করে নিয়েছে। তিনি পারস্য দেশীয় প্রেমসংগীতের সাথে বাঙালি প্রেম-মানসিকতার সমন্বয় ঘটিয়েছেন। সংগীত মনস্ক বাঙালির কাছে এর গুরুত্ব অনেকখানি। প্রসঙ্গে বলা প্রয়োজন নজরুল বিভিন্ন ভাষায় পারদর্শী ছিলেন বাংলা ছাড়াও হিন্দি, আরবি, ফারসি, উর্দু ইত্যাদি ভাষা তার জানা ছিল। তাঁর বেশ কিছু বাংলা গানে এই সব ভাষার প্রভাব পড়েছে। তাঁর গজল সংগীতে এমনই ভাষা ব্যবহৃত হয়েছে। পরে পরে কাব্যসংগীত, স্বদেশগীতি, নাটকের গান, প্রেমগীতি, লোকায়ত সংগীত, ভক্তিগীতি, হাসির গান প্রভৃতি নানাবিধ সংগীত সৃষ্টি করতে থাকেন।

নজরুলের গান শুনলেই বোঝা যায় শাস্ত্রীয় সংগীতে তিনি কতটা দক্ষ ছিলেন। ১৯২৮ এ তিনি যোগ দিলেন এইচ.এম. ভি তে। তারপরেই গানেই দিগন্ত তৈরি হলো। সংগীত রচয়িতা ও ট্রেনার হিসেবে তিনি যথেষ্ট দক্ষতার পরিচয় দেন। ১৯২৯ সালের ডিসেম্বরে তিনি গ্রামোফোন কোম্পানিতে সংগীতের প্রশিক্ষক পদে উন্নীত হন। এদিকে চার বছরের সন্তান বুলবুলের মৃত্যুর শোক তাঁকে গানের মধ্যে টেনে এনেছিল। তিনি ডুবে গেলেন সংগীতের জগতে। আমির খসরুর সংগীত বিষয়ক বিশাল গ্রন্থ এবং নবাব আলীর লেখা 'মারিখুন্নাগমাত' গ্রন্থ পড়ে তিনি সংগীতে বিশেষ জ্ঞান অর্জন করেন। মেধা এবং অনুশীলনের মাধ্যমে সমকালীন সংগীত ভাবনায় তিনি অন্যতম ব্যক্তিত্ব হিসেবে গড়ে ওঠেন। আকাশবাণীতে কাজে যোগদান তাঁর সংগীতচিন্তার অন্যতম পথ। বলা বাহুল্য, সংগীত জগতে নানা অনুসন্ধান ও গবেষণাকে তিনি আকাশবাণীর নানা অনুষ্ঠানে প্রকাশ করতেন। তাঁর রচিত 'যামযোজনায় কড়িমাধ্যম' সংগীত আলেখ্যটি আকাশবাণীর একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান হয়ে ওঠে। এই অনুষ্ঠানের শুরুতে নজরুল বলেছিলেন, "সংগীতের সুর - সপ্তকের মধ্যে কড়ি মা বা তীব্র মধ্যম স্বর এই যাম বা প্রহর যোজনার সেতুস্বরূপ। প্রতি প্রহরকে এই তীব্রমধ্যম যেন আহ্বান করে আনে এবং আগত প্রহরের সাথে বিদায় প্রহরে পরিচয় করে দেয়।" আটটি প্রহরকে নানা রাগ ও গতি দিয়ে গানে ব্যবহার করা তাঁর স্বকীয়তার পরিচয়। ললিত রাগ দিয়ে অনুষ্ঠানটি শুরু হত, অন্যান্য প্রহরগুলিতে টোড়ি, গৌড় সারঙ, মুলতানি, পূরবী, ছায়ানট, বেহাগ ও পরজ রাগে পরিবেশিত হতো। 'হারামনি', 'মেলমিলন ও নবরাগমালিকা' প্রভৃতি অনুষ্ঠানগুলি আকাশবাণীতে জনপ্রিয়তা লাভ করে। নজরুলের গানে মৌলিকত্ব ও স্বাতন্ত্র্য এগুলিতে প্রকাশ পায়। বিশেষ করে 'হারামনি'তে বিস্মৃতপ্রায় অপ্রচলিত রাগরাগিনীর উজ্জ্বল উদ্ধার শ্রোতাদের কাছে ছিল অত্যন্ত আকর্ষণীয়। 

১৯২৭ থেকে ১৯৪২ সাল পর্যন্ত প্রায় শতাধিক অনুষ্ঠানে নজরুল শতশত গান লিখেছেন ও পরিবেশন করেছেন। অনেক পাণ্ডুলিপি সংরক্ষিতই হয়নি। আকাশবাণীতে তাঁর উপস্থাপনায় আরও কয়েকটি অনুষ্ঠানের নাম 'ছন্দিতা', 'সারঙ্গ' প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।

নানাপ্রকার নজরুলগীতির মধ্যে ভক্তিগীতি একটি উল্লেখযোগ্য বিষয়। প্রায় দুশোর বেশি শ্যামাসংগীত সহ নজরুল নানাপ্রকার ভক্তিগীতি রচনা করেন। অনেক ইসলামী ভক্তিগীতিও তিনি রচনা করেন। মানবিক অনুভূতি থেকে জাত এই পর্যায়ের গানগুলি তাঁর উদার ধর্মবোধকেই তুলে ধরে। এ বিষয়ে তাঁকে হাসনরাজা, আলী রাজা, মীর্জা হুসেনআলী, মুন্সি বেলায়েত হোসেন প্রমুখের উত্তরসূরী বলা হয়ে থাকে।

রাগাশ্রয়ী বাংলা গানের সৃষ্টিতে নজরুলের অবদান অনেকখানি। শাস্ত্রীয় সংগীতের বহু রাগরাগিনী নিয়ে তিনি গান রচনা করতেন। নিজে কয়েকটি মৌলিক রাগ রাগ-রাগিনী সৃষ্টি করেন। তার মধ্যে মীনাক্ষী, দোলনচাঁপা, রূপমঞ্জরী, অরুণমঞ্জরী, নির্ঝরিণী প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। খেয়ালগানের নানা গায়ন রীতিকে তিনি এই কাঠামোয় যুক্ত করেছেন নিপুণভাবে। নজরুলের এ পর্যায়ের গান অবশ্য ভাঙা খেয়াল বর্গের গান নয়, "এর বাঁধুনিতে ক্লাসিক ও রোমান্টিক এই দুই প্রকার উপাদানেরই পোষকতা রয়েছে। সুরের দিক থেকে ক্লাসিক, বাণীর দিক থেকে রোমান্টিক। ইংরেজিতে  'ক্লাসিক ও মডার্ন সংস' একেই বলে।"

দেশপ্রেমের গানে নজরুলের মাটির প্রতি অগাধ টান ফুটে উঠেছে। এ পর্যায়ের গানে কোর্স ও একক - এ দু বর্গের গানই আছে। দেশের গান, কৃষকের গান (ওঠরে চাষী), ছাত্র সংহতির গান (আমরা শক্তি আমরা বল), শ্রমিকের গান (তোল কাঁধে শাবল) ও নারী জাগরণের গান প্রতিটি ক্ষেত্রই তিনি উজ্জ্বল করেছিলেন। বিশ্ববন্দিত ইন্টারন্যাশনাল গানের ও প্রথম ভারটিও তর্জমার কৃতিত্ব তার। এ প্রসঙ্গে জাগো অনশনবন্দি গানটির উল্লেখ করা যায়। 

বিদেশি সুরের অনুসরনে নজরুল বহু গান রচনা করেছেন। বাঙালি সুরসংযোজনার সাথে বিদেশি গানের সূত্র মিশিয়ে অপূর্ব সংগীত সৃষ্টি করেছেন তিনি।
নজরুল বহু হাসির গান রচনা করেছেন। বহু অপেরাধর্মী গীতিনাট্য রচনা করেছেন।

কাজী নজরুলের লোকায়ত সংগীত ভাবনাটিও বিপুল। এ পর্যায়ের গানে নজরুল বাউল, ভাটিয়ালি, ঝুমুর কাজরী, জংলা প্রভৃতি বিষয় অবলম্বন করেছিলেন। সাঁওতাল ও মুণ্ডাদেরদের তাঁর এ পর্যায়ের সমস্ত গানই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। আজও চলছে। 

তিনি শুধু সংগীত স্রষ্টা নন, সংগীত পরিচালকও।
বহু রকম সিনেমায় সংগীত পরিচালনা করেছিলেন। ১৯৩১ থেকে ১৯৪২ সাল পর্যন্ত তিনি বহু চলচ্চিত্রে সংগীত রচনা, সুরারোপ ও পরিচালনা করেছেন। তার মধ্যে 'ধ্রুব', 'পাতালপুরী', 'গ্রহের ফের', 'গোরা', 'বিদ্যাপতি', 'শহর থেকে দূরে', 'সাপুড়ে', 'নন্দিনী', 'নন্দিতা', প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।

নজরুলের এত বৃহৎ সংঙ্গীত সম্ভার সম্পর্কে ছোট পরিসরে আলোচনা করা যায় না। সামান্যতম ধারণা দিতেই এই আলোচনার অবতারণা। সংগীতের নানা শাখায় তাঁর স্বচ্ছন্দ যাতায়াত তাঁর উচ্চতর সংগীত মেধাকেই প্রতিষ্ঠিত করে। শুধু সংখ্যার বিচারে নয়, তাঁর সঙ্গীতের প্রসাদগুণই বাঙালির কাছে প্রিয় হয়ে থাকবে। বৈচিত্র্যে ও সৌন্দর্যে তাঁর গান অনন্য।
(চলবে)

Post a Comment

1 Comments

  1. নজরুল সম্বন্ধে আমাদের যতটা জানা উচিৎ আমার মনে হয় আমরা ততটা জানিনা, তাঁর যতটা ব্যাপকতার পরিচয় এই লেখার মাধ্যমে পেলাম তেমন টা তিনি পাননি বলেই মনে হয়।
    তথ্যসমৃদ্ধ এই প্রবন্ধটি সংগীতের জগতে এক দলীল হয়ে থেকে যাবে । অসাধারণ পর্যবেক্ষণ, অসম্ভব সুন্দর লেখনী সব মিলিয়ে এক মন ভরানো গানের সুন্দর ইতিহাস ।
    সঙ্গে আছি , থাকবো ।
    ভালো থাকবেন ।🙏🙏

    ReplyDelete