সেমিকোলনের আত্মজীবনী -১২
মনীষার চিতায় চোদ্দো ফোঁটা "মরণোত্তর জল"
সা য় ন
“বাংলা কবিতা এলিটিস্ট এতদিন ছিল না। হয়ে গেল।
গত পঞ্চাশ বছরে কোন চামার কবি হতে পারেননি, কোন দলিত কবি হতে পারেননি, কোনও মুচি, মেথর, ডোম কবি হতে পারেননি। আমাদের হাবভাবটা এরকম যে, আমরা ওদেরকে নিয়ে কবিতা লিখব, ওরা কেন নিজেরা কবিতা লিখবে। আমরা ওদের নিয়ে কবিতা লিখে আরও উঁচু এলিটিস্ট হব, ঠিক যেরকম ‘সাবলটার্ন’ নিয়ে লেখালেখি করে সবচেয়ে দামী অভিজাত হোটেলে গিয়ে আমরা ডিনার করে আসি।”
কবির এই কথাগুলো দিয়ে একটা মশাল বাঁধছি। সুবোধ সরকার এমন একটা ভাষা, অনেকগুলো ছন্দোবদ্ধ উত্তরের পথরেখা- আমি তাকে নিয়ে মানবাধিকারের কাছে দাঁড়াব, আমি সাহিত্যের ভাগাড় ও প্যারাডাইসের সামনে দাঁড়িয়ে জলকামান চালাবো। আমার হাতে শৃঙ্খল নেই, আলো আছে- এই আলোর নাম ভাষা, বাংলা ভাষা- এই আলোই আবার বাংলা কবিতা। কোনও নির্দিষ্ট ঘর নেই, কোনও আদালত নেই - গোটা দেশই এখন আমার কাছে আদালত।
সাহিত্যের ইতিহাসের সমস্ত তোরণের ভিত্তি আলগা করে দিলে দেখা যাবে, মৃত মনীষা বাল্মিকীর পেট্রোলের গন্ধমাখা ছাই, গৌরি লঙ্কেশের কণ্ঠস্বর কিংবা কাশ্মীরে গুলিতে ছিন্নভিন্ন পণ্ডিতদের হৃৎপিণ্ড। আমরা খিলান দেখি, তোরণ দেখি, অট্টালিকার ভিতর ঝারবাতি দেখি কিন্তু ‘শব্দহীন কান্নার’ কোনও আওয়াজ পাই না, ক্ষমতার বিরাট হাত চোখ- মুখ কীভাবে চেপে দেয় সামাজিক সাবজেক্ট, তার ছায়া এসে পড়ে না- ক্লাসরুমে, ওয়েবিনারে, খাতায়, বইয়ের পাতার উপর। কিন্তু আমার চোখ উপড়ে নিলেও আমি যে অন্ধ হতে পারি না- আমি সমস্ত চিতার কর্কর্ শিখার ভাষা কেড়ে নিয়ে ছড়িয়ে দেবো রাজপথ থেকে রাজভবন-
“দৌড়তে দৌড়তে ঘোড়া একদিন অন্ধ হয়ে যায়
তুমি কি ফিরবে আর? তুমি কি ফিরবে কোনদিন?
যদি ফেরো, ক্ষণকাল দাঁড়িয়ো যতীন দাস রোডে অন্ধ ঘোড়ার পিঠে অন্ধ যুবক আমি তোমার আশায়।”
(অন্ধ ঘোড়ার পিঠে)
কবিতাগুলো আমি আমার বুলেটপ্রুফ কারগোর ভিতর সেট করে নিয়েছি। এখন একটা যুদ্ধের ভূমিতে দেখা হবে উচ্চবর্ণের সঙ্গে উচ্চমানের ভাষা, ক্ষমতাজীবীর সঙ্গে কবিতাজীবীর।
তরুণ নাট্যকর্মী রুদ্ররূপ মুখোপাধ্যাযে়র এর একটি নাট্যসংলাপ সামনে চলে এলো - "যারা খবর রাখে আগ্রাসনের, হত্যার, যুদ্ধের তারা কান পাতলে টের পায় এর মধ্যে একটা কান্না লুকিয়ে আছে"। এখন সময় ডাক দিচ্ছে-
“তুমি কে? তুমি কে?
মানুষ ও মূষিকের পরামর্শদাতা, আমি তোমাকে চিনি না।” (ধর্ম)
এখন কবিতার কোনও কাজ নেই কর্নারে বসে থাকার, চা’য়ের দোকানে গুমটি অন্ধকার থেকে বার হয়ে চৌরঙ্গি মোড়ে দাঁড়িয়ে সে বলবে- সুশান্ত সিং রাজপুত, রিয়া চক্রবর্তী ও মনোজ শুক্লার বানানো খবরের নিচে চেপে দেওয়া হয় হাথরাস সহ মেদিনীপুর জেলার দুই নাবালিকাকে গণধর্ষণ করে হত্যা। হাথরাসের মনীষার এই ভয়ানক হত্যার প্রতিবাদে মুখ্যমন্ত্রী থেকে সাধারণ মানুষ যখন রাস্তায় নেমে আসছে, তখন ফ্রি স্কুল থেকে গড়িয়াহাট, লেকমল থেকে সিটি সেন্টার উপচানো ভদ্রমহোদয়গণদের কাছে বাড়াবাড়ি ঠেকছে এসব। ভারতের জনজাতির এই ঐক্য থেকে বিচ্ছিন্নতার পথ, ঘাট, নদী , নালার মাঝে একটা ভোগবাদের বিরাট টাইটানিক প্রবেশ করে গেছে। কিন্তু টাইটানিকেরও পতন ঘটে, তার চেয়ে “যে নৌকো ফেরে না ঘরে, আমি সেই নৌকো যাত্রা চাই। /সেই নৌকো নিয়তির উলটোনো চোখের মতো ডাকছে আমাকে।” (উলটোনো চোখের মতো)
‘মরণোত্তর জল’-এর ১৪টি কবিতার একটা একটা ফোঁটা জল আমি তোমার মুখে দিলাম মনীষা। যে দেশে বাঁচতে গেলে জিভ কেটে রেখে বাঁচতে হয়, আমি সেই দেশকে ঘৃণা করি। ভারতবর্ষের পেটের ভিতর থেকে আরও একটা ভারতবর্ষ বেরিয়ে আসছে, যে ভারত ধর্ম দিয়ে জাতিকে চিহ্নিত করে, যে ভারত দলিতকে মনে করে একটি ভোগ্যপণ্য, যে দেশে একজন নাবালিকার ধর্ষণের পর জেলা শাসক, এস.পি এবং ডি.এস.পি. মৃতা নির্যাতিতার পরিবারের সদস্যদের বাড়িতে বন্দি করে রাখা হয় - সেই অন্ধকার ভারতবর্ষের মানচিত্রও গুঁড়িয়ে যাবে যদি প্রতিটি মানুষ এক সঙ্গে বলতে পারে -
" আমার কী হবে আমি জানতে চাইনা
হস্তরেখা, আমি তোকে ধরি পায়ুদ্বারে
জ্ঞানী না হয়েও জানি কে রাখে কে মারে
আমাকে মূর্খ করে রেখো না আয়না। " ( সেখানে আর না)
দেশ দেশের মতো চলবে, আমরা আমাদের মতো- আমার উপর তো এর কোনো প্রভাব পরছে না, আমার বাড়ির মেয়েটা তো ঠিক আছে, আমার বাড়ির ছেলেটা তো পার্টির দাদা দিদিদের ধরে, ঘুষ দিয়ে সরকারি চাকরি জুটিয়ে নিয়েছে - এইসব রাজনৈতিক ঝুট ঝামেলা নিয়ে আমাদের কি বলুন তো! আমরা রবিবার মাংস খাই, সারা সপ্তাহ অফিস করি, ব্যবসা করি - কে দলিত আর কে ব্রাহ্মণ তাই দিয়ে কি আমাদের সংসার চলবে? একটা দেশের সমাজের চিন্তার ভিতর এমন সব গর্তের মধ্যে দিয়েই প্রবেশ করে ফ্যাসিবাদ। ফ্যাসিবাদ এমন এক আকর্ষণ যাকে ফেলে আপনি এগিয়ে যেতেই পারবেন না। সে আপনার সামনে আরব দেশের জাদু নৃত্য শুরু করে রাতের পর রাত - আর ঠিক তার পিছনেই শাং শাং শাং ...... ধার হচ্ছে বিরাট একটা ছুরির। আমি জানালার কাছে গিয়ে, ক্যাফেটেরিয়ার পাশে বসে, ক্যান্ডেল লাইট ডিনারের আগুনের শিখার পাশে বসে বলব -
" শুয়ে থাকা মনুষ্যমাথাকে বলি, মোটরবাইক থেকে নেমে আসা হেলমেটটিকে বলি, ছেড়ে রাখা জামা, ছেড়ে রাখা জুতো, মোজা
ছেড়ে রাখা দুঃখী গেঞ্জি তোমাদের ও বলি, বলো আমার কী দোষ! " ( পারদনগরবাসী)
জীবনের পথ চলায় কোনও মহৎ শক্তির কাছে হেরে গেলেও লেখা থাকে ওই জীবনটারই কথা। মানুষের হয়ে কথা বলার চেয়ে মহৎ আর কিছুই হয় না। যে পথে শকুনের ঠোক্কর উপেক্ষা করে কুয়াশাগন্ধে পাপীর সঙ্গে হেঁটেও পাপের গলা টিপে ধরা যায় । মনীষার শিরদাঁডা় ভেঙে দিয়েছি আমরাই, তার জিভ কেটে দিয়েছি প্রাচীন যুগেই। যেদিন টিকটিকি এসে খেয়ে গেল খনা আর মনীষার জিভ সেদিনের পর থেকে আর আমরা নয়, পার্লামেন্টের ছাদের মাথায় ঝুলে সে বলেছিল -
"চরিত্র ভালো না,তবু আমাকে যতীন দাস রোডে নিয়ে এলে?
কী ভুল করেছ তুমি,পা বেযে় চলেছে বিষ,উর্ধ্বগামী লোভ।
আমার জন্মের পথে সন্ধ্যা হলে ফিরে আসে একটি মহিষ
তার অন্ধকার পিঠে আমার মায়ের নাম,গোত্র লেখা আছে।" ( চরিত্রের দোষ)
টিক্ টিক্ টিক্ টিক্..........
0 Comments