Spoken language of the fishing community of East-Medinipur district / Bimal Mondal
পূর্বমেদিনীপুর জেলার মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের কথ্যভাষা -৬
বিমল মণ্ডল
ধ্বনিতত্ত্ব(Phonology)
৩.ধ্বনি পরিবর্তনের বিভিন্ন ধারা
ভাষা পরিবর্তনের অন্যতম প্রধান দিক হলো ধ্বনি পরিবর্তন। পূর্ব- মেদিনীপুর জেলার সমুদ্র উপকূলবর্তী মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের কথ্যভাষায় যে শিষ্ট বাংলা ভাষার মতো তাঁদের উপভাষাতেও এই ধ্বনি পরিবর্তনের বিভিন্ন রীতি অনুসৃত হয়। আর এই ধ্বনি পরিবর্তন চলিত বাংলা ভাষায় ন্যায় এই জেলার মৎস্যজীবীদের কথ্যভাষায় ধ্বনি পরিবর্তনের চারটি ধারা লক্ষ্য করা যায়। যেমন-
৩.১. ধ্বনির আগম
এই ধ্বনির আগম এই জেলার কথ্যভাষায় উচ্চারণের সাথে সাথে স্বরধ্বনি ও ব্যঞ্জনধ্বনির আগম দেখা যায়। তাই সাধারণত এই ধ্বনির আগমকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়। যেমন—
৩.১.১.স্বরাগম
এই জেলার মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের মানুষ সহজ ভাবে উচ্চারণ করতে করতে শিষ্ট চলিত বাংলার ন্যায় এদেরও কথ্যভাষায় তিন ধরনের ধ্বনির আগমের প্রয়োগ দেখা যায়। তা হলো-
ক. আদি স্বরাগম
স্ত্রী>ইস্ত্রি, স্কেল>ইসকেল, স্কুল>ইসকুল, স্টেজ>ইসটেজ, স্তুপ>উসতুপ, স্মাইল>ইসমাইল,শেওড়া>শাবড়া,
খ.মধ্য স্বরাগম
গ্লাস>গিলাস, ব্রাশ>বেরাস, চাকরি>চাকিরি/চাকুরি, ব্লগ>বলোক, প্রামাণিক>পরামানিক, মিষ্টি>মিসটি, ব্লাউজ> ব্যালাউচ, গোবর>গবোর ,
এই মধ্য স্বরাগম এখানে উচ্চারণের রীতি অনুযায়ী শব্দের আদিতে, মধ্যে ও অন্ত্যে কথ্যভাষায় এই ধ্বনির প্রয়োগ দেখা যায়। যেমন-
শব্দের আদিতে-
প্রথম>পরথম, প্রকার>পরকার, ভ্রম>ভরম
শব্দের মধ্যে-
গর্ব>গরব,জন্ম>জনম, মন্দ>মনদ, কর্ন>করন, যত্ন>যত্ন, শক্তি>শকতি
শব্দের শেষে-
নর্ম>নরম,ভ্রু>ভুরু, গার্ড>গরাদ
গ. অন্ত্য স্বরাগম
লিস্ট>লিসটি /লিস্টি, পুষ্ট>পুষটি, এখন>এখুনি, বেঞ্চ>বেঞ্চি, মাঝে>মাজু, ভর্তি>বুজ্জি , পিসে>পেশা, মেশো>মাউশা, মায়া>মেয়ে, আঁটকুড়ো>আঁটকুড়া, ওলাওঠা>অলাউঠো, উঠোন>উঠান, নারকেল>লাড়িয়া,
৩.১.২. ব্যঞ্জনাগম
এই জেলার কথ্যভাষায় ব্যঞ্জনধ্বনির আগম শিষ্ট চলিত বাংলা ভাষার মতো ব্যবহার করতে দেখা যায়। স্বরাগমের মতো ব্যঞ্জনাগমের মধ্যে তিন ধরনের পরিবর্তন দেখা যায়। যেমন-
ক.আদি ব্যঞ্জনাগম-
অক্কা>মক্কা, আমার>মোর,ঋজু>রুজু
খ.মধ্য ব্যঞ্জনাগম-
শৃগাল>শিয়াল/শেয়াল, ইঁন্দুর>ইন্দুর, পুকুর>পুখুর, অম্ল>অম্বল, ডুমুর>ডম্বুর,
এই মধ্য ব্যঞ্জনাগমে অতিরিক্ত কিছু ধ্বনি উচ্চারিত হয় তা শ্রুতিধ্বনি নামে পরিচিত।
সেই শ্রুতিধ্বনি গুলি হলো-
'য়'-শ্রুতি-শুকুর>শুয়োর, শৃগাল>শিয়াল,
'ওয়া'- শ্রুতি- যা+আ>যাওয়া, পা+আ>পাওয়া, খা+আ>খাওয়া, শো+আ>শোওয়া>শুয়া,
ধো+আ>ধোওয়া>ধুয়া
'এর' শ্রুতি- চা+এর>চায়ের, মা+এর>মায়ের,
'ব' -শ্রুতি -এই 'ব' শ্রুতি এই জেলার কথ্যভাষায় 'ওঅ' ধ্বনির শ্রুতি ঘটে যেমন-
দে+য়া>দেয়া, নে+য়া>নেয়া, চেয়ে, খেয়ে,
'দ' - শ্রুতি- বানর>বান্দোর, সংস্কৃত সুনর থেকে সুন্দর , বাঁধ>বাঁন্দ, রাঁধ>রান্দ,
'হ'- শ্রুতি- বেআলা>বেহালা, দোয়াত>দোহাত
অন্ত্য ব্যঞ্জনাগম-
জমি>জমিন, খোকা>খোকন, মাখা>মাখন, সীমা>সীমানা, নানা>নানান, পোড়ামুখো>পোড়ারমুখো,
৩.২. ধ্বনি লোপ-
পূর্ব-মেদিনীপুর জেলার মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের কথ্যভাষায় সাধারণত বয়স ভেদে নিজেরা নিজেদের মতো উচ্চারণ করতে গিয়ে অনেক সময় ধ্বনির লোপ পায়। উচ্চারণগত ভাবে এই ধ্বনি লোপ পেয়ে মূল শব্দটির সংক্ষিপ্ত করে উচ্চারণ করেন এবং সেটি দুই ভাবে ঘটে। যেমন-
৩.২.১.স্বরলোপ
স্বরলোপ তিন ধরনের। যেমন-
ক.আদি স্বরলোপ-
অভ্যন্তর>ভিতর /ভেতর, ইউরোপ>য়ুরোপ,উদ্ধার>ধার,
আওয়াজ>রোয়াজ, পিসে>প্যাসা
খ.মধ্য স্বরলোপ -
গামোছা> গামছা, জানালা>জানলা, সরিষা>সরষা/সর্ষা, করো+না>করনা, বসতি>বস্তি, ভগিনী>ভগ্নী,
গ. অন্ত্য স্বরলোপ -
মনুষ্য>মানুষ, দন্ত>দাঁত, বন্যা>বান, লজ্জা>লাজ, সজ্জা>সাজ, আজি>আজ, রাতি>রাত, রাশি>রাশ, চৈত্র>চৈত, আশা>আশ,জোনাকি>জোনাক,
৩.২.২. ব্যঞ্জনধ্বনির লোপ
ব্যঞ্জনধ্বনি তিন ভাবে ব্যবহৃত হয়। যেমন-
১.আদি ব্যঞ্জনলোপ —স্টেজ>টেজ, স্টোভ>টোভ, স্থান>থান, ট্রেন>টেন, শ্রাবন>শাওন/শাবোন, প্রাচীন>পাচিন,প্রভাত>পোভাত, স্থির>থির
২.মধ্য ব্যঞ্জনলোপ -তহবিল>তবিল, জঙ্গলা>জংলা, ভূমি>ভুঁই,
অগ্রহায়ণ>অঘ্রান, গোষ্ঠ>গোঠ, কার্পাস>কাপাস
৩.অন্ত্য ব্যঞ্জনলোপ- পঙ্ক>পাঁক, কুটুম্ব>কুটুম,আল্লাহ>আল্লা, জল>জ, কল>ক, কুল>কু, চল>চ, মুখ>মু,শাশুড়ি>শাউড়ি, মধু>মউ,সখী>সই
৪.এই জেলার কথ্যভাষায় কখনো কখনো 'হ' ধ্বনির লোপ ঘটে। যেমন -
সহি>সই, দহি>দই, মহিষ>মোষ, দহি>দই, বহিন>বোন, শিয়ালদহ>শিয়ালদা, সাহু>সাউ, গ্রাহক>গাহক, বহিন>বোন, গাহিছে>গাইছে, রাহী>রাই,
৫.সমাক্ষর লোপ- এখানকার মানুষের কথ্যভাষায় দেখা যায় দুটি সমধ্বনি উচ্চারণ করতে গিয়ে শ্বাসাঘাতের জন্য একটা ধ্বনি লোপ পায়। এই জেলার কথ্যভাষায় প্রায়শই এমনই উচ্চারিত হয়। যেমন- বড়ো দাদা >বড়দা>বড়্ দা, বউদিদি>বউদি, জেঠ্যাই মা>জ্যেঠ মা, মেজো দিদি >মেজ্ দি, বউড়ি>বউ, বড়ো ছেলে>বড়ো পো, ছোটো কাকা>ছোটকা
৬.যুক্ত ব্যঞ্জন কখনো উচ্চারণের সময় একক ব্যঞ্জনের মতো উচ্চারিত হয়। যেমন- হ্রদ>হত, বৃত্তি>বিত্তি, কৃতিত্ব>কিতিত্ত, পুষ্করিণী>পুখুর, স্লেট>সিলেট, আবৃত্তি>আবৃতি/আবিত্তি
(চলবে)
0 Comments