জ্বলদর্চি

কেশরী’ : ইতিহাসের নাড়িতে জাতীয়তাবাদের সিংহনিনাদ/ রাকেশ সিংহ দেব

'কেশরী’ : ইতিহাসের নাড়িতে জাতীয়তাবাদের সিংহনিনাদ

পরিচালক – অনুরাগ সিং 
অভিনয় – অক্ষয় কুমার, পরিনীতি চোপড়া 
মুক্তি – ২১ মার্চ, ২০১৯ 
রেটিং – 3/5 

শিখ মানেই জাত্যাভিমান। শিখ মানেই দেশপ্রেম। শিখ মানেই স্থান কাল পাত্র সব কিছুর ঊর্ধ্বে নিজের পাগড়ি শোভিত শির আত্মসম্মানের সাথে তুলে ধরার পণ। এই আদর্শের প্রতীক হল কেশরী রঙ। আমরা বাঙালীরা যাকে বলি ত্যাগের প্রতীক গেরুয়া। শিখদের জীবনে ত্যাগ, আত্মবলিদানের কেশরিয়া দীক্ষা দিয়েছিলেন গুরু নানক সাহেব। এই কেশরীর আব্রু রক্ষায় মোঘলদের কচুকাটা করেছিলেন গুরু গোবিন্দ সিং জী। ‘সওয়া লাখ সে এক লড়ায়ু’ গুরু গোবিন্দ সিংজীর এই আত্মপ্রত্যয়ী বজ্রনিনাদ আজও অকুতোভয় শিখ জাতির বীজমন্ত্র। এই বীজমন্ত্র অবগাহনে আফগানিস্তানের রুক্ষ মরুপ্রান্তরের এক যুদ্ধ লড়েছিল অকুতভোয় একুশ শিখ সিংহ। যেখানে ঘোড়া ছুটিয়ে ধেয়ে এসেছিল হাজার হাজার আফগান পাঠান যোদ্ধা। আর তাঁদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে যাবতীয় অস্ত্র ব্যর্থ হওয়ার পর , শেষ অস্ত্র হিসাবে দাঁড়িয়ে ছিল সেই কতিপয় শিখ সেনানীর অদম্য 'সাহস'। এই অমানবিক সাহসিকতার কাহিনি ইতিহাসে 'সারাগারহির যুদ্ধ' নামে খ্যাত। বর্তমান পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত খাইবার পাখতুনখোয়াতে ১৮৯৭ সালের এই লড়াইয়ের কাহিনিই তুলে ধরেছে মুভি 'কেশরী'। 

চিত্রনাট্য গল্প শুরু হচ্ছে ব্রিটিশ ভারতের প্রেক্ষাপটে। যেখানে ব্রিটিশ পুলিশের অধীনস্ত হয়ে কাজ করেন হাবিলদার ইশার সিং (অক্ষয় কুমার)। তৎকালীন অবিভক্ত ভারতের পাখতুনখোয়াতে ৩৬ শিখ রেজিমেন্টের সদস্য তিনি। আফগান উপজাতির হাজার দশেক যোদ্ধা হঠাৎই এক সকালে ব্রিটিশ সেনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষমা করে এলাকার সারাগারহির দূর্গ আক্রমণ করে। আর সেই আক্রামণ ঘিরেই ছবির চিত্রনাট্য তৈরি হয়েছে। রুখা-সুখা প্রেক্ষাপটের সঙ্গে মানানসই ৩৬ জন সর্দারের কার্যকলাপ। সম্মুখ সমরে নিঃস্বার্থ আত্মবলিদানের চূড়ান্ত নমুনা রাখে এই শিখ রেজিমেন্ট। ছবিতে রক্ত গরম করা বেশ কিছু সংলাপ রয়েছে যা বাড়তি পাওনা এ ছবির। ছবির জাতীয়তাবাদও খুব বিশ্বাসযোগ্য। তবে ইসগর সিংয়ের সঙ্গে সঙ্গে তার রেজিমেন্টের শিখদেরও পরিচালক একেবারে অভিনেতার সম্মান দেননি তা নয়। কিছু কিছু চরিত্র খুবই সুন্দর। নিচু জাত বলে একজনের কপালে টিকা দিয়ে সাম্যর জয়ডঙ্কা তোলাও সুন্দর। ছবিতে মেলোড্রামা থাকলেও সেটা ছবির প্রয়োজনেই সীমাবদ্ধ। তার কোনওরকম অতি বাড়াবাড়ি নেই, অতিরঞ্জনও নেই।
একজন কড়া অথচ হৃদয়বান শিখের ভূমিকায় দেখা যায় অক্ষয়কে। এ ধরনের ছবিতে অক্ষয় বরাবরই ভালো। এখানেও পুরোটাই অক্ষয় একাই টেনে নিয়ে গিয়েছেন। তার সাজপোশাক, মেক-আপ, কথা বলার উচ্চারণ (খাঁটি শিখ উচ্চারণ) একবারের জন্যও মনে হয়নি তিনি চরিত্রাভিনয় করছেন। ‘কেশরী’ ছবিতে অক্ষয়কুমারকে দেখতে দেখতে এই প্রশ্নই মনে আসে, তাঁর মাথার পাগড়ির জন্য তিনি প্রাণ দিতেও পারেন। তিনি দায়বদ্ধ তার স্বজাতির প্রতি। দায়বদ্ধ, শত্রু আফগানদের সাথে কোনও আপোষ না করার রাস্তায়। দায়বদ্ধ, ইংরেজরা প্রভু হলেও, মাটির অপমান মেনে না নেওয়াতে। 

যদিও অক্ষয়ের বউ হিসেবে পরিণীতি চোপড়ার খুব একটা কিছু করার ছিল না। তার চরিত্রায়ণ নিয়ে তাই বলার কিছুই নেই। অন্য যে কেউ করতে পারত এই চরিত্র। ছবির সঙ্গীত খুব ভালো। বিশেষ করে বি প্রাকের গলায় ‘তেরি মিট্টি’ গানটির কথা আলাদা করে বলতেই হয়। তবে দেখতে দেখতে কিছু সময় পর ছবি একটু অতিরিক্ত লম্বা বলে মনে হয়। যেহেতু অন্য কোনওরকম মনোরঞ্জনের দিকে পরিচালক যাননি, তাই মাঝে মাঝে একটু বোরিং লাগতে পারে। তবে ভিন্ন স্বাদের জন্য একবার দেখা যেতেই পারে। সব মিলে এই উগ্র জাতীয়তাবাদী সময়ে ইতিহাসের নাড়িতে হাত রেখে আর একবার আত্মসম্মানের গল্প বলে কেশরী। বলে, আত্মসচেতন হতে। 
সিনেমার পর্দার পাশাপাশি আসুন জেনে নিই সেদিনের সেই যুদ্ধ নিয়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য - প্রাণ দিলেও, শহিদের লড়াই বৃথা যায়নি। ২১ শিখ বীর যোদ্ধার বীরগাথা সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। ব্রিটিশ সংসদ পর্যন্ত মাঝপথে অধিবেশন থামিয়ে দিতে বাধ্য হয়। শহিদ ২১ শিখ বীরযোদ্ধাকে সম্মান জানানো হয় দাঁড়িয়ে। শহিদ ২১জন  ভারতীয় শিখ বীর সেনার উদ্দেশে ব্রিটিশ রাজপরিবারের তরফে তাঁদের অকুতোভয় বীরত্বের প্রশংসা করা হয়। বলা হয়, শিখ যোদ্ধারা যে সেনাবাহিনীতে থাকবেন, সেই বাহিনী কোনও দিন হার মানবে না। সেসময় আফগানিস্তান এলাকার দায়ীত্বপ্রাপ্ত ৩৬ শিখ রেজিমেন্টের লেফটেন্যান্ট কর্নেল হাটন তাঁর বক্তব্য বলেছিলেন, "ওই ২১ শিখ যোদ্ধার বীরত্ব কোনও দিন ভুলবে না ইতিহাস। তাঁদের বলিদানের জন্য আমরা মর্মাহত। কিন্তু, শিখ জাতি যতদিন থাকবে, ততদিন এই ইতিহাস স্মরণ করবে।" সারাগড়ির ওই শহিদ বীর সেনাদের মরণোত্তর ‘ইন্ডিয়ান অর্ডার অফ মেরিট’ পুরস্কার দেওয়া হয় ব্রিটিশ সরকারে পক্ষ থেকে। সেই সময় ওই পুরস্কার সর্বোচ্চ সামরিক সম্মান ছিল ব্রিটিশ অধিকৃত ভারতে। কোনও একটা যুদ্ধের জন্য সেবারই প্রথম একসঙ্গে একটা সেনার দলকে সম্মনিত করা হয়। স্বাধীনতার এত বছর পরেও ভারতীয় সেনার শিখ রেজিমেন্ট ১২ সেপ্টেম্বর দিনটিতে ওই একুশ বীর শিখ যোদ্ধাকে স্মরণ করে। উল্লেখ্য, সারাগড়ি পোস্ট কর্নেল হাটনের নেতৃত্বাধীন ব্রিটিশ সেনা এর দু'দিন পরেই পুনরুদ্ধার করে বিদ্রোহী আফগান উপজাতিদের হাত থেকে।

রেটিং 
5 অসাধারণ
4 বেশ ভালো
3 ভালো
2 দেখতে পারেন
1 না দেখলেও চলবে
-------------------------------
 আরও পড়ুন। 

Post a Comment

0 Comments