জ্বলদর্চি

পূর্ব মেদিনীপুর জেলার মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের কথ্য ভাষা / বিমল মণ্ডল

 language of the fishing community of East-Medinipur district / Bimal Mondal

পূর্ব মেদিনীপুর জেলার মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের কথ্য ভাষা 

বি ম ল  ম ণ্ড ল     
     
পর্ব-৩   

সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকা চিহ্নিত করণ

পূর্বমেদিনীপুর জেলার পূর্ব দিকে বঙ্গোপসাগর রয়েছে। এই জেলার সমুদ্র উপকূলবর্তী ব্লকগুলি হল-রামনগর-১,রামনগর-২,কাঁথি-১, কাঁথি-২,খেজুরী-২, নন্দীগ্রাম-১, হলদিয়া, সুতাহাটা, মহিষাদল।

পূর্বমেদিনীপুর জেলার   অধিবাসীদের স্বাধীন জীবিকা হলো মৎস্য চাষ, মাছ ধরা, কৃষিকাজ প্রভৃতি। এই জেলার  সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকায় মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের মানুষ বসবাস করেন। এই জেলায় বসবাসকারী মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের মধ্যে হিন্দু ও মুসলমান উভয় ধর্মের মানুষের অবস্থান দেখা যায়। ফলে পাশাপাশি থাকার ফলে মৎস্যজীবীদের  কথ্যভাষার সাথে অন্যান্য কথ্যভাষার  নানান পরিবর্তন হয়েছে। 

পূর্ব মেদিনীপুর জেলার  মৎস্যজীবীর সংখ্যা প্রায়-৫১, ৭২৩ জন অন্তর্দেশীয়, ১,০২,৪৮৪ জন সামুদ্রিক।  এর মধ্যে সক্রিয় মৎস্যজীবীর সংখ্যা- ১৭,২৪১জন অন্তর্দেশীয়,  ৫৫,১৫৬জন সামুদ্রিক।     প্রাথমিক মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির সংখ্যা-
১.মিঠা জলের ক্ষেত্রে-৪৪টি
২.নোনা জলের ক্ষেত্রে-২৪টি
৩.সামুদ্রিক ক্ষেত্রে- ৭৫টি
 এছাড়াও এই জেলায় মৎস্য জীবীদের সুবিধার জন্য যা যা রয়েছে তা হলো-

১.কেন্দ্রীয় মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির সংখ্যা-২টি( -কাঁথি ও তমলুক-ঘাটাল)
২.মৎস্য উৎপাদক গোষ্ঠীর সংখ্যা-৪০টি
৩.বরফ কারখানায় সংখ্যা-৩৮টি
ফিসমিল প্রক্রিয়াকরণ কেন্দ্রের সংখ্যা-২৫টি
৪.শুকনো মাছের বাৎসরিক উৎপাদন হয় -৪৮৭৮ মেট্রিকটন।
৫.মোট উৎপাদিত মৎস্য বীজের সংখ্যা-৯৫৫ কোটি।    
৬.সরকারি মৎস্য খামার ১টি(জুনপুটে অবস্থিত)
৭.যন্ত্রচালিত মাছ ধরার নৌকার সংখ্যা-৩৯৩৫টি
৮.দেশি মাছ ধরার নৌকার সংখ্যা- ৪০০০টি 

এছাড়া মৎস্য জীবীদের জন্য এই জেলায় রয়েছে -যোগাযোগের জন্য রাস্তা, গৃহ নির্মাণ প্রকল্প,বেনিফিস কমিটি, ডিজেল পাম্প, জালও হাঁড়ি দেওয়ার ব্যাবস্থা আছে।       

আর্থ -সামাজিক পরিচয় -

এই জেলার মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের  আর্থ-সামাজিক এক পরিচয় পাওয়া যায়। আসলে এই জেলার জনগণের বেশিরভাগ অংশটাই দারিদ্র্য সীমার নীচে বসবাস করে। তবে এরা অত্যন্ত সাহসী, কর্মক্ষম ও কষ্টসহিষ্ণু। এরা ভীষণভাবে হাড়ভাঙা খাটুনি খাটে। এমনকি শুধু  মাছ ধরতে যাওয়া নয় এরা আর্থিক উন্নতির জন্য কৃষিকাজ, জন মজুরি প্রভৃতি কাজে এরা যুক্ত থাকে। 
হিন্দু - মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ  এই জীবিকা নির্ভর। তাতে ছেলে, মেয়ে,বৌ এরা সবাই মিলে এই কাজে ব্রতী হয়। 
বর্তমানে এই মৎস্য জীবী সম্প্রদায়ের পরিবারে ছেলে মেয়েরা আগের তুলনায় এখন ভালো লেখাপড়া করে তারা বিভিন্ন জীবিকার সাথে যুক্ত  হয়েছে। পূর্ব মেদিনীপুর জেলার খেজুরী, রামনগর, নন্দীগ্রাম, সুতাহাটা,মহিষাদল, হলদিয়া ব্লকগুলোর মধ্যে প্রচুর গরীব মানুষের অবস্থান দেখা যায়। এই জীবিকার উপর নির্ভর করে তারা কিছু কৃষি জমি কিনেছে, তারা সেই কৃষিজমিতে মাছ চাষ, ঋতু অনুযায়ী কৃষিজ ফসল ফলিয়ে তারা আর্থিকভাবে লাভবান হয়েছে। 
তবে কেউ কেউ আর্থিক অস্বচ্ছলার জন্য অপরাধমূলক কাজে লিপ্ত হয়। ফলে সম্প্রদায়ের মধ্যে কিছুটা ভীতির উদ্রেক হয়। তবে বেশিরভাগ মানুষ জেলা জুড়ে কৃষিকাজ, শিক্ষা,সংগঠন প্রভৃতি জীবনের প্রতিটি পরীক্ষায় তাঁরা উল্লেখযোগ্য কৃতিত্বের অধিকারী। 

পূর্বমেদিনীপুর জেলার অর্থনৈতিক অবস্থা বাংলার অধিবাসীদের মতোই। এদের চাহিদা সামান্য শারিরীক প্রয়োজনটুকু মেটাবার মতো সঙ্গতি হলেই নিজেদের বিত্তবান বলে মনে করেন। কাদামাটির দেওয়াল  দেওয়া কুঁড়ে ঘর,গোটা কয়েক হাঁড়ি- কুড়ি ও বাসন। শরীর ঢাকার মতো একখানা কাপড়। মাঝেমধ্যে একটু মাছ ও শাক দিয়ে দু'মুঠো ভাত। সবার উপরে একটা হুঁকো আর বিড়ি ইত্যাদি চাহিদাটুকু মেটাতে পারলেই এদের পরিতুষ্ট। মানুষের শরীরের সভ্যতার টানে  আঞ্চলিক জীবনযাত্রার পরিবর্তন এসেছে। যুব সমাজ চাকরির খোঁজে দিশেহারা। কেউকেউ চিরাচরিত চাষবাস ছেড়ে অধিক লাভজনক নতুন চাষে নেমেছে।

জেলার কৃষিকাজ প্রধানত বৃষ্টি নির্ভর। জেলার প্রধান ফসল ধান। আমন ধানের চাষই এই জেলায় বেশি হয়। সেচের অভাবে বোরোধানের চাষ ব্যবহৃত হয়। এই জেলায় ধান ছাড়া আর চাষ হয় সরিষা, রাই, তিল,কয়েক রকমের ডাল। আলু, বেগুন, টমেটো প্রভৃতি বিভিন্ন ধরনের শাকসবজি। তুঁত চাষ ও হয়ে থাকে এই জেলার  বিভিন্ন থানার বিভিন্ন গ্রামগুলোতে। তবে সাধারণত এই চাষ  হয়ে থাকে তমলুকে। মাদুর তৈরির জন্য জেলার সবং, পাঁশকুড়া  প্রভৃতি অঞ্চলে মাদুর  কাঠির চাষ করা হয়। তাঁত শিল্প এই জেলায় প্রধান শিল্প। কৃষির পরেই বেশিরভাগ মানুষ এই শিল্পে নিযুক্ত থাকে। এই জেলার আর একটি অর্থকারী ফসল হলো পান।            

পূর্ব- মেদিনীপুর জেলার কাঁথি, খেজুরী, রামনগর, নন্দীগ্রাম, প্রভৃতি এলাকায় কাঁচা ইঁটের বাড়ি তৈরির প্রবনতা আছে। আজকাল  গ্রামে প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা এবং মৎস্যজীবীদের জন্য পাকা বাড়ির ব্যবস্থা হয়েছে।  এই জেলায় রসুলপুর ও দীঘার মধ্যবর্তী উপকূল ভাগে প্রায় ৩০কি.মি পর্যন্ত  বিস্তীর্ণ এলাকায় মৎস্য চাষ  মৎস্য ধরার উপযোগী করে তোলা হয়েছে। তাই মাছ সংগ্রহ ও মাছ উৎপাদনে পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে  চিরস্থায়ী স্থান দখল করেছে পূর্ব-মেদিনীপুর জেলা। 
জনপদ ও জনগোষ্ঠীঃ-

পূর্ব-মেদিনীপুর জেলার জনগোষ্ঠীর পরিচয় একান্ত প্রাসঙ্গিক। প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য যেমন এই জেলাকে ভৌগোলিক একটা রূপরেখা দিয়েছেন তেমনি এই জেলার পশ্চিমে ছোটনাগপুরের মালভূমির ঢালুভূমি সানুদেশ ও উড়িষ্যার জঙ্গলাকীর্ণ অঞ্চলের প্রান্তসীমা। এর ভূ-ভাগ উঁচু-নিচু বন্ধুর। এই জেলার দক্ষিণ - পশ্চিম এলাকা এই ভূ-ভাগের অধীন। ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক আদান-প্রদানে এই এলাকা উড়িষ্যার সঙ্গে বেশিরভাগ  সময় লিপ্ত থাকায় উড়িষ্যার বহু অধিবাসী যেমন এসব এলাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস করছে, তেমন ভাবে আত্মীয়তার সূত্র তৈরি হয়েছে উড়িষ্যা এই  জেলার মেল বন্ধন। ফলে উড়িষ্যা এবং পূর্ব-মেদিনীপুর  জেলার  অধিবাসীদের মধ্যে সুনিবিড় সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। 

এই জেলার জনগোষ্ঠীর  পরিচয় লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে, এখানে ব্রাহ্মণ, বৈষ্ণব, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ও ইসলামীয় ধর্মের  প্রভাব বেশ লক্ষ্য করা যায়। তাছাড়া এখানে সাধারণত মাহিষ্য, সদগোপ, ব্রাহ্মণ, বৈষ্ণব, নাপিত, তপশিলী উপজাতি  যেমন যথেষ্ট সংখ্যায় আছে, তেমনি হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মানুষ এই জেলায় সংখ্যায় বেশ উল্লেখযোগ্য। মাহিষ্য সম্প্রদায় এই জেলায় এক বিরাট জনসম্পদ।রাষ্ট্র সমাজ ও সমর বিভাগ পরিচালনায় এককালে এই সম্প্রদায়ের যে বিশাল ক্ষমতা ছিলো তার প্রমাণ এখনো নামের সঙ্গে যুক্ত পদবিগুলোর পেছনের ইতিহাস খুঁজলেই পাওয়া যাবে। যেমন- রানা, সামন্ত, বেরা, দে,দাস,গিরি, মণ্ডল, কলা, বল, নায়েক, মাঝি, কাণ্ডার, শীট, মাইতি, ভৌমিক প্রভৃতি। এই জেলায় ব্রাহ্মণদের প্রাধান্য বেশ জোরদার ছিল। যেমন- পণ্ডা, ত্রিপাঠী, মিশ্র, দাশ, চক্রবর্তী, পাহাড়ি প্রভৃতি পদবিগুলো লক্ষনীয়। এছাড়া উপজাতি ও তপশিলী সম্প্রদায়ের যে ভাবে চিহ্নিত করা হয় পদবি দেখে তা হলো - সিংহ, সিং,দাস, করণ, ভূঞ্যা, বর্মন, মির্দ্যা, মণ্ডল, মাইতি, জানা, ঘোড়ই প্রভৃতি। এই জেলায় বিশেষ করে বর্ণ হিন্দু ও মুসলমান সংখ্যায় বেশি। 

ধর্মীয় ভিত্তিতে জনবিন্যাস আসলে নৃতাত্ত্বিক পরিচয়েরই অঙ্গ। বর্ণ হিন্দুর পাশাপাশি নিম্ন বর্ণের হিন্দু তথা তপশিলী ভুক্ত জাতি -উপজাতিরা এই জেলায় জনজীবনকে নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করছে। এই জেলায় সব ধর্মের মানুষ কাঁথি, খেজুরী, তমলুক, মহিষাদল, রামনগর, সুতাহাটা, হলদিয়া ইত্যাদি অঞ্চলে মৎস্যজীবী। এই সব সাধারণ মানুষেরা মাছ ধরে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করেন। এই জেলার মৎস্যজীবী  পরিবারের সংখ্যা প্রায় ৩০ হাজার এবং মৎস্যজীবীর জনসংখ্যা প্রায় এই জেলায় প্রায় ২ লক্ষ জন। 

সামগ্রিক ভাবে এই জেলার অধিবাসীদের অর্থনৈতিক অবস্থা খুব একটা উন্নত নয়। চাকুরি জীবির সংখ্যা এদের ভেতর কম দেখা যায়। কৃষিকাজে নিযুক্ত শ্রমিক এবং অন্যান্য কাজে নিযুক্ত জন মজুরের সংখ্যা বেশি। এই জেলায় ক্ষুদ্র চাষির সংখ্যা বেশি দেখা যায়। অধিকাংশ নিম্নবিত্তের মানুষের সংখ্যা বেশি চোখে পড়ে। এইসব মানুষদের চাহিদা সামান্য। কাদামাটির দেওয়ালের কুঁড়ে ঘর, গোটাকয়েক হাঁড়ি-কুঁড়ি, সামান্য বাসন,শরীর ঢাকার মতো একখানা কাপড় প্রভৃতি ছোটোছোটো চাহিদাগুলি মিটেগেলে এরা সন্তুষ্ট থাকে। এই জেলাতে মাটির কাজ, লোহার কাজ, মাদুর কাঠির কাজ, মোরাম কাটার কাজ, ইঁট ভাঁটার কাজ, কাঠের কাজ, রাজ মিস্ত্রির কাজে অনেকে যুক্ত। তবে বর্তমানে সরকারি নানান প্রকল্পের জন্য নানান ভাবে এই সাধারণ মানুষেরা উপকৃত হচ্ছেন।প্রধানমন্ত্রী আবাসিক,ইন্দ্রা আবাস যোজনা, মৎস্যজীবী  দের গৃহ নির্মাণ প্রভৃতির মধ্য দিয়ে নানান ভাবে এরা উপকৃত হচ্ছেন।                                               
   পূর্ব মেদিনীপুর জেলার  এই সম্প্রদায়ের সাধারণ মানুষ    সে হিন্দু কিংবা মুসলমান পাশাপাশি নারী পুরুষের সে বয়স ভেদে নানান ভাষার পার্থক্য   লক্ষ্য করা যায়।  তা উচ্চারণগত ভাবে   শুধু নয় মৌখিক কথ্যভাষার মধ্যে যে ধ্বনি, শব্দ, বাক্য, প্রত্যয়- বিভক্তি, ক্রিয়া ইত্যাদির ব্যবহারে এই জেলার লোক সংস্কৃতির অনুষঙ্গে সর্বপরি শব্দভাণ্ডার এই জেলার মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের মৌখিক কথ্যভাষা স্বাতন্ত্র্য ভাবে পরিলক্ষিত হয়। তা পরবর্তী পর্বগুলোতে বিস্তারিত আলোচনা হবে।
---------------------------------
অভিমত জানাতে পারেন।  
jaladarchi@yahoo.in  

Post a Comment

0 Comments