জ্বলদর্চি

গুচ্ছ কবিতা /হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়



হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়

তালগাছ

এক

তালগাছটা ছিল আমাদের বাড়ির গায়েই। খোলার চালের ঠিক ওপরেই পাতাগুলো এমনভাবে সাজানো থাকতো যেন মনে হতো দাদুর ছাতা। আমাদের বাবার দিকে তার সবসময়ের নজর। 


দুই

ভোরের হাওয়ায় তালগাছের পাতা বেজে উঠলে কাঠের দরজায় টোকা উঠতো। রাস্তার মানুষজনদের ঘড়িতে সময় পড়া আমাদের কানে এসে ঢুকতো তালপাতার অ্যালার্ম। পাতার হাতের আওয়াজে কিছুতেই বয়স পড়া যেত না।


তিন

পাতার ফাঁক দিয়ে রোদ্দুর যখন দুয়ারের পৈঠেয় এসে পড়ত তখন আমরা কোমরে গামছা জড়িয়ে দলবেঁধে পুকুরে ঝাঁপ দিতাম। একটু পরেই গরম ভাতে তালপাতার বাতাস। স্কুলে তালগাছ মুখস্থ বলার সময় মনে হতো আমাদের দাদুর কবিতা।


চার

খোলার চাল মাথায় নিয়ে আমাদের বাড়ি সকলের পিছনে হারিয়ে গেলে দাদু সবার ওপরে মাথা তুলে দাঁড়াত। সবাই যখন মন্দির মসজিদ গির্জা চারতলায় পাঁচতলায় আঙুল তুলে ধরত, আমি তখন তালগাছ দেখাতাম।


পাঁচ

কালবৈশাখীর দুপুরে বাবার হারিয়ে যাওয়ার দিন থেকে আজ পর্যন্ত বাড়িতে একটুও হাওয়া নেই। যেন মরুভূমির মাঝখানে চারটে দেওয়ালের ওপর কেউ একজন তীব্র অনিচ্ছা সত্ত্বেও কিছু খোলা সাজিয়ে দিয়েছে। আজও দেখি স্বজন হারানোর শোকে তালগাছের কিছু অসাড় হাত। 


ছয়

তালগাছটার জন্যেই বাড়িটাকে মন্দির মনে হয়। মাঝে মাঝেই দেখতে পাই বাড়িজুড়ে একটা সবুজ ছায়া। আমাদের গলাগুলো তখন সব ভিজে যায়, সবাই নিচু স্বরে কথা বলে।


সাত

তালগাছটার ঠিক পিছনেই আমাদের বাড়ি। অথচ সবাইকে বলতাম তালগাছটার সামনে। যেকোনো কথাতেই সে উঠে এসে একেবারে সামনে দাঁড়াত, ঠিক যেভাবে ছেলের একহাতের দূরত্বে বাবা দাঁড়িয়ে থাকে।


আট

মা রোজ সন্ধেবেলা তালগাছের গোড়ায় প্রদীপ দিত। গলায় কাপড় দিয়ে অনেকক্ষণ মাথা নিচু করে থাকতো। আমি দূর থেকে দেখতাম। গঙ্গা আমাদের বাড়ি থেকে কতদূরে কেউ জানে না। মা তালডোবার জলকেই আমাদের সকলের মাথায় ছড়িয়ে দিত। 


নয়

দেরি করে বাড়ি ফিরলে, পরীক্ষায় নম্বর কম পেলে, বন্ধুদের সঙ্গে মারপিট করলে বাবা তালগাছের পাশে ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড় করিয়ে রেখে দিত। অভাব যখন বাবার রাতের ঘুম কেড়ে নিতো তখন বাবাকেও দেখতাম তালগাছের পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে। বুঝতে পারতাম প্রত্যেকের জীবনেই একটা করে তালগাছ থাকা উচিৎ।


দশ

এক বৃষ্টিদিনের সন্ধেয় মনে হলো কে যেন আমাদের দুয়ারে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। বৃষ্টি থামার পর দেখলাম দুয়ার অক্ষত আছে। পরদিন সকালে দেখলাম বাড়িটাও ঠিক আগের মতো। শুধু একটা সরলরেখায় কোথাও কোনো দাঁড়াবার জায়গা নেই। আমরা অভিভাবকহীন। কিন্তু আজও আমাদের বাড়ি তালগাছের সামনে।


Post a Comment

0 Comments