জ্বলদর্চি

আমার গুরুজন-বান্ধব প্রদীপ ঘোষ/ রতনতনু ঘাটী

আমার গুরুজন-বান্ধব প্রদীপ ঘোষ       
                   
র ত ন ত নু ঘা টী

কবিতা নিয়ে আমাদের তুমুল উদ্দীপনা ছিল। তা না হলে উনিও চুয়াত্তর সালের পঁচিশে বৈশাখ। মেচেদা স্টেশন থেকে ভোরের ট্রেন ধরে কাঁধের ঝোলায় শীর্ণকায় লিটিল ম্যাগাজিন নিয়ে পৌঁছে যেতাম দল বেঁধে রবীন্দ্রসদন চত্বরে। তখন সকাল থেকে সারাদিন ধরে রবীন্দ্রসদনের পাশের মাঠে মঞ্চ তৈরি করে চলত রবীন্দ্র গান, কবিতা, আবৃত্তি, স্বরচিত কবিতাপাঠ। 
   রবীন্দ্র গান বা তার সব প্রখ্যাত শিল্পীদের সম্পর্কে যত না কৌতূহল ছিল, তার চেয়ে আমার বেশি উন্মাদনা ছিল বিখ্যাত কবিদের নিজের চোখে দেখব, স্বকণ্ঠে তাঁদের কবিতাপাঠ শুনব। ওই বছরই আমি একজন প্রখ্যাত আবৃত্তিশিল্পীর কণ্ঠে রবান্দ্রকবিতার আবৃত্তি শুনেছিলাম। তাঁর নাম প্রদীপ ঘোষ। সেই প্রথম তাঁকে সামনে থেকে দেখা। আরও অনেক আবৃত্তিশিল্পী সেদিন আবৃত্তি করেছিলেন।
   ওই যে একটা কথা আছে না, দেবতার কাছে সমর্পণ করার জন্যে পুষ্প চয়ন করে কী রকম পাত্রে সাজানো হয়েছে, সেটিও কম কথা নয়। তেমনি দীর্ঘদেহী এক পুরুষ, স্কন্ধদেশ ছাপানো সাদা চুল। পরনে সিল্কের আজানুলম্বিত পাঞ্জাবিতে সোনার বোতাম আর পাটভাঙা ধুতির ঝুলন্ত কোঁচা মঞ্চে ওঠার সঙ্গে-সঙ্গে ভূলুণ্ঠিত হয়ে তাঁর সামনে-সামনে এগিয়ে চলেছে। ঘোষকের কণ্ঠে নিনাদিত হয়ে উঠল, ‘এখন আবৃত্তি পরিবেশন করবেন বিখ্যাক আবৃত্তিশিল্পী প্রদীপ ঘোষ।’ আমি নড়েচড়ে বসলাম। প্রাণ ভরে শুনলাম তাঁর উদাত্ত কণ্ঠে ‘কামালপাশা’ কবিতার আবৃত্তি। সেই স্মৃতি চিরভাস্বর। কতবার শুনেছি ‘দেবতার গ্রাস’ কবিতার সেই প্রাণ ভরানো আবৃত্তি। 
   তারপর আনন্দবাজার পত্রিকায় চাকরি করার সময় কতবার কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর চেম্বারে, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের টেবিলের সামনে তাঁকে দেখেছি কাছ থেকে। কবিতা লেখার সুবাদে আমার সঙ্গে তাঁর পরিচয়ও হয়েছে। কতবার নানা অনুষ্ঠানে তাঁর কণ্ঠে কত না কবিতার আবৃত্তি শুনেছি। তিনি আমার কাছে মুখস্থ হয়ে উঠেছিলেন। এমনকী ততদিনে তাঁর উদাত্ত কণ্ঠে আমার লেখা ‘ছেলেবেলা’ বা ‘হস্টেলের চিঠি’ কবিতার আবৃত্তিও শুনে ফেলেছি। 
এরও অনেক পরে, ততদিনে প্রদীপ ঘোষ অনুজের প্রতি তাঁর সস্নেহ মধুর ব্যবহারে আমার কাছে ‘প্রদীপদা’ হয়ে উঠেছেন। সোবার পশ্চিমবঙ্গ সকারের উদ্যোগে শিশুসাহিত্য উৎসবে মুক্তমঞ্চে আমিও কবিতা পড়বার জন্যে আমন্ত্রিত। আমার বসার আসন নির্ধারিত হয়েছিল প্রদীপদার পাশের আসনটিতে। এগিয়ে যেতেই তাঁর আন্তরিক আহ্বান, ‘এসো রতনতনু, আমার আজ কী সৌভাগ্য, আমি আজ তোমার পাশে বসতে পেয়েছি।’ এ কথায় লজ্জায় আমার মাথা হেঁট হয়ে যাওয়ার জোগাড়!
   অনুষ্ঠানের সঞ্চালক সেদিন বেশ দেরি করে আমাকে কবিতা পড়তে ডেকেছিলেন। প্রদীপদার আবৃত্তির আহ্বান এসেছিল তারও পরে। সেই সুযোগে নিচু গলায় প্রদীপদার সঙ্গে অনেক গল্প করার সুযোগ জুটে গেল। এমন সুযোগ এর আগে কখনও পাইনি। কথায়-কথায় আমাকে তাঁর বাড়ি যেতে বললেন একদিন। উত্তরে আমি বলেছিলাম, ‘একদিন আপনার বাড়ি যাব প্রদীপদা!’ 
   আরও কথায়-কথায় সেদিন প্রদীপদা বলেছিলেন, ‘তুমি এত সুন্দর কবিতা লেখো ছোটদের জন্যে। তোমার কবিতা তো আমি আবৃত্তি করি।’
   এ কথায় লাজুক মুখে আমার বিমোহিত হওয়া ছাড়া আর কী-ই বা করার ছিল? তার পরেই প্রদীপদা যে কথা বলেছিলেন, সে কথাটি আমার পাওয়া যে-কোনও বড় পুরস্কারের সমতুল! প্রদীপদা বলেছিলেন, ‘তুমি ছোটদের জন্যে এত সুন্দর কবিতা লেখো! এই কবিতাগুলো যদি আরও কিছুদিন আগে আমার মেয়ের ছোটবেলায় পেতাম, তা হলে আমার মেয়েকে আমি অন্যভাবে মানুষ করতে পারতাম!’
   আমি বাক্যহারা! আসন থেকে উঠে প্রদীপদার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে বলেছিলাম, ‘এ আমার কাছে কবিতা লেখার শ্রেষ্ঠ পুরস্কার!’
   তারপর অনেকবার প্রদীপদার বাড়ি গিয়েছি। অনেকবার। সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়েছে। আমার কবিতা দিয়ে যে মেয়েকে বড় করে তুলতে চেয়েছিলেন, তাঁর সঙ্গে প্রদীপদার বাড়িতে পরিচয়ও হয়েছে। আর বউদি? বেঁটেখাটো, কপালে লাল টিপ-পরা সদাহাস্যময়ী। কিছু না খাইয়ে ছাড়তেন না কখনও। 
   বয়স বাড়ার সঙ্গে-সঙ্গে প্রদীপদা কথা বলার মতো মানুষ খুঁজতেন। তার সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ কথা বলতেন, কিছুতেই সহজে ছাড়তেন না। কত ফোটো তোলা হত প্রদীপদার সঙ্গে। বউদিকে জোর করে ধরে এনে একসঙ্গে ফোটো তোলা হত।
   বছর চারেক আগে একদিন সকালে প্রদীপদাকে ফোন করলাম, ‘প্রদীপদা, আজ আমি আমার স্ত্রীকে নিয়ে আপনার বাড়িতে যাব। আপনি ফাঁকা আছেন তো?’
   শুনে হা-হা করে হেসে বললেন, ‘তুমি আসবে, সস্ত্রীক? এর চেয়ে আর আনন্দের কী আছে? আমি তো সবসময় ফাঁকাই। কতদিন আমার কাছে আসোনি। অনেকক্ষণ থাকতে হবে কিন্তু!’
   মনে আছে, আমরা প্রদীপদার বাড়িতে গিয়েছিলাম সকাল সাড়ে ন’টা নাগাদ। ফিরেছিলাম দুটোয়। আমার মেয়ের বিয়ের আমন্ত্রণপত্র দিতে গিয়েছিলাম। আমন্ত্রণপত্রটি কয়েকবার উলটেপালটে দেখলেন। জানতে চাইলেন, ‘কে করেছে এমন সুন্দর আমন্ত্রপত্রটি?’
   আমি বললাম ‘শিল্পীর নাম লেখা আছে: সুব্রত মাজী।’
   প্রদীপদা অভিভূত হয়ে বউদিকে ডাকলেন, ‘দেখে যাও, কী সুন্দর হয়েছে রতনতনুর মেয়ের বিয়ের কার্ড!’
   প্রদীপদা ও বউদিকে বললাম, ‘আমার মেয়ের বিয়ের দিন যেতে হবে কিন্তু!’
   তখন প্রদীপদার শরীর খুব যে ভাল ছিল, তা নয়। কন্যাসম্প্রদান করার সময় ছাদনাতলায় বসে আমি দেখলাম, প্রদীপদা বউদিকে সঙ্গে নিয়ে সত্যিই এসেছেন! আমি সেদিন আবারও মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম।
   আজ ষোলো অক্টোবর ২০২০ সালের প্রদীপদার এই বিষণ্ণ প্রয়াণদিনে বেশি করে মনে পড়ছে আবৃত্তিশিল্পের প্রতি কী কেন্দ্র আর কী রাজ্যসরকারের মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার মুখশ্রী! প্রদীপদার হাতে সমগ্র আবৃত্তি জীবনের অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ‘বঙ্গভূষণ’, ‘বঙ্গবিভূষণ’...‘পদ্মশ্রী’, ‘পদ্মভূষণ’...এরকম কোনও সম্মানই কি তুলে দেওয়া যেত না? সরকার যদি এসব অবদানের মূল্যায়ণ না করে, তা হলে কে করবে? এই খেদ আমার সারা জীবন থাকবে প্রদীপদার জন্যে।
   আর আমি যদি কখনও ছোটদের জন্যে এক-আধটি কবিতা ভাল লিখে ফেলতে পারি, তখন কে ফোন করে বা দেখা হলে চারপাশে না তাকিয়ে গলা তুলে বলবেন, ‘রতনতনু, তুমি অমুক কাগজে কবিতাটা বড্ড ভালো লিখেছ!’
   প্রদীপদার প্রয়াণের সঙ্গে-সঙ্গে আমার সেরকম গুরুজন-বান্ধবের সংখ্যা প্রায় শূন্যে নেমে গেল। এই ক্ষতি আমার মতো এক তুচ্ছ শিশুসাহিত্যিকের জীবনে পূরণ হওয়ার নয়।
______________
আরও পড়ুন 

আবৃত্তিকার প্রদীপ ঘোষ স্মরণে

সা হা না রা খা তু ন


Post a Comment

0 Comments